শাহবানো থেকে শায়ারা বানো—তিন তালাকের বিরুদ্ধে এক অসম্ভব যুদ্ধের কাহিনি

  • 11 July, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1100 view(s)
  • লিখেছেন : রাণা আলম
একটি অসফল বৈবাহিক সম্পর্কে যে কেউ দাঁড়ি টানতে পারেন, সে আইনি অধিকার তাঁর অবশ্যই আছে। কিন্তু একই সাথে মুখে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রী সন্তানদের প্রতি যাবতীয় কর্তব্য দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার অধিকারটা তাঁরা কোথা থেকে পান সেটাও ভেবে দেখার বিষয় অবশ্যই।

বছর আটেক আগের কথা। তখন ঝাড়খণ্ড বর্ডারের কাছে একটি প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়াই। পিছিয়ে থাকা এলাকা। স্বাভাবিকভাবেই ছেলে মেয়েদের নিয়মিত স্কুলে আসার প্রবণতা কম। তাদের স্কুলে উপস্থিতি নিয়মিত করার জন্য মাস্টারমশাইদের বাড়তি উদ্যোগ নিতে হত। আমরা খেয়াল করলাম যে একই বাড়ির তিনভাই বোন আমাদের স্কুলে বিভিন্ন ক্লাসে পড়ে। কিন্তু তিনজন কখনই একসাথে স্কুলে আসেনা।

এই তিনজনের মধ্যে বড় মেয়েটিকে একদিন ডেকে পাঠানো হল। তার নাম ধরা যাক তাহরিমা। বছর চৌদ্দর মেয়েটি চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।প্রশ্নের উত্তর নেই। দেখলাম তাহরিমার চোখ দিয়ে জল ঝরছে। অগত্যা, তাকে ক্লাসে ফেরত পাঠানো হল।

খোঁজ নিয়ে জানলাম, তাহরিমারা তিন ভাইবোন। বাবা তালাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন।তিনি এই পরিবারের ভরণ পোষণের ভার নেন না। তাহরিমার মা বিড়ি বেঁধে সংসার চালান। তিন ছেলে মেয়েই স্কুলে চলে গেলে তার একার পক্ষে বিড়ি বাঁধা এবং সংসারের কাজ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়, তাই পালা করে তিনভাই বোনের একজনকে বাড়িতে মা’কে সাহায্য করতে হয়।

তাহরিমার বাবা তিন তালাক দিয়েছিলেন। বিন্দুমাত্র দায়িত্ব বহন না করেই দ্বিতীয় বিবাহ করতে তাকে ধর্মের স্থানীয় মৌলানারা আটকাননি। তাহরিমার মা কোর্টে খোরপোষের মামলা লড়ছেন, সেই অপরাধে তাঁর প্রাক্তন স্বামী বাড়িতে চড়াও হয়ে যথারীতি পিটিয়ে গেছেন এবং গোষ্ঠী রাজনীতির ফলাফল হিসেবে গ্রামের লোক নাক গলায়নি। তাহরিমার মা আমাদের অভিভাবকসভায় একবার এসেছিলেন। মধ্য চল্লিশের প্রথাগতভাবে শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া এক অসম্ভব সাহসী মহিলা, যিনি নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন এখনও।

তাহরিমার মায়ের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০১১ সেন্সাস অনুযায়ী, পনেরো বছর বয়সের আগে প্রায় চৌদ্দ শতাংশ মুসলিম মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। আঠেরো পেরোবার আগেই বিয়ে হয় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মহিলার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম মহিলাদের একটা বড় অংশই অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হবার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাটুকু পায় না। ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছিল যে প্রায় ৯৫% বিবাহ বিচ্ছিন্না মুসলিম মহিলা তাদের স্বামীর কাছ থেকে কোনোরকম খোরপোষ পান না।

২০১৭ সালে ইন্ডিয়া টুডে তাদের এক রিপোর্টে দেখিয়েছিল বিবাহ বিচ্ছিন্না মুসলিম মহিলাদের প্রায় ছেষট্টি শতাংশকে স্রেফ মৌখিকভাবে তালাক দেওয়া হয়েছে। ৭.৬% মহিলাকে চিঠির মাধ্যমে তালাক দেওয়া হয়েছে। ফোনে তালাক দেওয়া হয়েছে ৩.৪% মহিলাকে। এসএমএস আর ইমেলের মাধ্যমে তালাক দেওয়া হয়েছে ০.৮% মহিলাকে।ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন তাদের আরেকটি রিপোর্টে দেখিয়েছিল যে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম মহিলাদের ৯২% নিঃশর্তভাবে মৌখিক তালাকের বিলোপ চাইছেন।  ৯১.৭% মহিলা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে মত দিচ্ছেন।

এবং স্বাভাবিকভাবেই ‘আমাদের ধর্ম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান’ গোছের আওয়াজ তোলা মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এদের নিয়ে কিস্যু ভাবিত হয়নি

দ্য কুইন্ট এর সাংবাদিক পূজা চাংগ্রিওয়াল তুলে এনেছেন তিন তালাকের শিকার কয়েকজন মহিলার ঘটনা। কুড়ি বছরের জিনাত শাদ শেখ এর বিয়ে দেওয়া হয়েছিল চুয়াল্লিশ বছরের শাদ ইব্রাহিম শেখের সাথে। বিয়ের পর থেকেই মদ্যপ স্বামী জিনাত কে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করতেন। পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের প্রোডাক্ট হিসেবে জিনাত তার স্বামীকে ভগবানতুল্য ভাবতে শিখেছিলেন। যে কারণে ‘ও স্বামীরা একটু আধটু গায়ে হাত তোলেই’ গোছের আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী ছিলেন যথারীতি। দুই মেয়ের বয়স যখন আঠেরো আর একুশ, তখন তার পরম আরাধ্য পতিদেবতা তাকে তিন তালাক দিলেন। প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে, তারপরে চিঠিতে লিখে। স্থানীয় মৌলানা জানালেন যে ইসলামিক আইনে পুরুষ যখন ইচ্ছে তার বৌকে তালাক দিতে পারে। জিনাত শাদ শেখ এইমুহুর্তে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা লড়ছেন খোরপোষের।

বা ধরা যাক বছর সাতাশের নাজিয়া খানমের কথা। তার স্বামী মুদাসসর বেগ তাকে কাগজে তিনবার তালাক লিখে পাঠিয়ে ডিভোর্স দেওয়ার দাবি করেছিলেন। মাদিনা আনওয়ার সাঈদ, বলিউডের জুনিয়র আর্টিস্ট, তাকে তার স্বামী ফোনে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে ডিভোর্স দিয়েছিলেন।

এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, একটি অসফল বৈবাহিক সম্পর্কে যে কেউ দাঁড়ি টানতে পারেন, সে আইনি অধিকার তার অবশ্যই আছে। কিন্তু একই সাথে মুখে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রী সন্তানদের প্রতি যাবতীয় কর্তব্য দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার অধিকারটা তারা কোথা থেকে পান সেটাও ভেবে দেখার বিষয় অবশ্যই।

এইখানে ধর্মের মুরুব্বীদের ভূমিকাও সমানভাবে স্ক্যানারে আসা উচিত। তাঁরা চেঁচিয়ে যান যে তিন তালাক ইসলাম অনুমোদন করেনা। তাহলে এই যে এত তিন তালাকের ঘটনা চোখের সামনে আসে সেগুলো  তাঁরা আটকানোর উদ্যোগ নেন না কিসের জন্য?

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। সময়টা ছিল ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাস। মধ্যপ্রদেশের শাহবানো নামের এক বাষট্টি বছরের তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলা  তাঁর প্রাক্তন স্বামী, প্রতিষ্ঠিত উকিল মুহাম্মদ আহমেদ খানের কাছ থেকে খোরপোষ দাবি করেন। মুহাম্মদ আহমেদ এবং শাহবানোর বিয়ে হয়েছিল ১৯৩২ সালে। তাদের একত্রে তিনটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে সমেত মোট পাঁচটি সন্তান আছে।

শাহবানোর স্বামী মুহাম্মদ আহমেদ কোর্টে জানান যে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের আইন মোতাবেক তিনি ‘ইদ্দত’ এর সময়কাল অব্দি খোরপোষ দিতে বাধ্য, তারপরে নয় এবং বহুবিবাহের অধিকার  তাঁকে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড দিচ্ছে। ইদ্দত হচ্ছে মুসলিম মহিলাদের স্বামীর মৃত্যু অথবা স্বামীর সাথে ডিভোর্স হলে পরবর্তী বিবাহের অথবা সিদ্ধান্তের পূর্বে নির্ধারিত অপেক্ষার সময়কাল। ইদ্দতের সময়কাল পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। সাধারণত তিনমাস থেকে মহিলা গর্ভবতী হয়ে থাকলে সন্তানের জন্মের সময় অব্দি হয়ে থাকে। মুসলিম পার্সোনাল ল' অনুযায়ী এই সময়কালের পরে বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলার কোনো খোরপোষের দায় তার পূর্বতন স্বামীর থাকেনা। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ড এ প্রসঙ্গে শাহবানোর স্বামী মুহাম্মদ আহমেদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তাদের মতে এই বিষয়ে কোর্টের হস্তক্ষেপ দ্য মুসলিম পার্সোনাল ল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট (১৯৭৩) এর অধিকারকে  বিঘ্নিত করছে। এই আইন মোতাবেক বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, খোরপোষ এবং অন্যান্য পারিবারিক বিষয়ে শরিয়ত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দানের ক্ষমতা তাদের আছে।

১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারক ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় শাহবানোর পক্ষে রায় দেন। তিনি তার সিদ্ধান্তে স্পষ্ট ভাবে জানান,

“Section 125 was enacted in order to provide a quick and summary remedy to a class of persons who are unable to maintain themselves. What difference would it then make as to what is the religion professed by the neglected wife, child or parent? Neglect by a person of sufficient means to maintain these and the inability of these persons to maintain themselves are the objective criteria which determine the applicability of section 125. Such provisions, which are essentially of a prophylactic nature, cut across the barriers of religion. The liability imposed by section 125 to maintain close relatives who are indigent is founded upon the individual’s obligation to the society to prevent vagrancy and destitution. That is the moral edict of the law and morality cannot be clubbed with religion.”

ধর্ম রাজনীতির যে যাঁতাকল এইমুহুর্তে দেশে আমরা দেখছি তার একঝলক সেসময় দেখা গিয়েছিল। রাজীব গান্ধীর সরকার ১৯৮৬ সালে মুসলিম ওমেন প্রোটেকশন অ্যান্ড ডাইভোর্স অ্যাক্ট চালু করেন, যাতে বলা হয় যে তালাকের পর স্বামী ইদ্দতের সময়কাল অব্দিই খোরপোষ দিতে বাধ্য থাকবে। তারপরে প্রয়োজনে ওয়াকফ বোর্ড বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলার দায়িত্ব নেবে।

শাহবানোর আইনজীবী দানিয়াল লতিফ নতুন আইনের বৈধতাকে লিগাল চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। লাভ হয়নি। শাহবানোর অসম্ভব লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মুসলিম নারীর অধিকারের যে নিদর্শন স্থাপিত হতে পারতো তা স্রেফ রাজনৈতিক অন্ধত্বের কারণে পিছিয়ে যায় আরো কয়েক দশক। এবং উল্লেখ্য যে শাহবানো নিজেও পরবর্তীকালে খোরপোষের মামলা তুলে নিয়েছিলেন।

শেষ অব্দি যখন শায়ারা বানো, জাকিয়া সোমান, ইশরাত জেহান, গুলশন পারভিন, আফরিন রেহমানরা সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাকের বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক অসম্ভব অসম লড়াইতে বিজয়ী হলেন, তখনও যে তারা মুসলিম সমাজের মাথাদের কাছে খুব সমাদৃত হয়েছিলেন তা নয়। এই বিজয়িনীদের সোসাল সাইটে চরিত্রহনন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, বিজেপি যোগ সবকিছু নিয়েই নিরন্তর প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

মুশকিল হচ্ছে, তিন তালাকের শিকার মুসলিম মহিলারা সুপ্রিম কোর্টে গেলে এই ধর্মের মাথাদের গাত্রদাহ হয়। তাদের ধর্মে হাত পড়ছে বলে চিৎকার শুরু হয়। টিভি চ্যানেল, ধর্মীয় জলসায় গলা ফাটিয়ে বলা হয় ইসলাম কিভাবে এইসব মেয়েদের আইনি পদক্ষেপের জন্য বিপন্ন হয়ে পড়ছে। প্রো ইসলামিক স্কলার আকাদেমিকরা সংবাদপত্র, ব্লগে ভারি ভারি শব্দ ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যান তিন তালাক কতটা অ-ইসলামিক।

কিন্তু, যখন প্রশ্নটা আসে, এই অ-ইসলামিক বিষয়টি দিনের পর দিন চলছে কীভাবে? এই তিন তালাক অনুমোদনকারী মৌলানাই বা এইরকম অ-ইসলামিক বিষয়কে প্রামাণ্যতা দেন কী করে? এবং আক্ষরিক অর্থেই, এতদিন তারা কোথায় ছিলেন?

তখন নেমে আসে হিরণ্ময় নীরবতা। কবির ভাষায়, শিশিরের শব্দ শোনা যায়।

এবং এইখানেই জিতে যান শায়ারা বানো, জাকিয়া সোমান, ইশরাত জেহান, আফরিন রেহমান, গুলশন পারভিনরা। আর তাদের জয়ে কোথাও না কোথাও মিশে থাকে শাহবানোর মত অসংখ্য তিন তালাকের শিকার হওয়া মুসলিম মহিলার চোখের জল।

সে চোখের জল দুঃখের নয়। আনন্দের। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ লড়াইতে জেতার আনন্দের।

ছবি প্রতীকী

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

0 Comments

Post Comment