- 19 August, 2023
- 0 Comment(s)
- 1241 view(s)
- লিখেছেন : সফি মল্লিক
পর্ব-২
সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ও বাস্তবিকতার বদল
আজকের দিনে বেশিরভাগ বাবা-মায়েরা একটি অথবা দুটি সন্তান নেওয়া নিয়ে কোনও রকম দ্বিধাদ্বন্দে ভোগেন না। সন্তানদের বড় হওয়ার পর তারা যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন সেটি আর আগের মত একটি মেয়েকে বিয়ে করে তার পরিবার ও পরিবেশকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে নতুন একটি পরিবার ও পরিবেশে বন্দি করা বোঝায় না। এখনও হিন্দু সমাজের মধ্যে কন্যাদান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মোহোরানা দিয়ে বিয়েকে অপমান সূচক হিসাবে ন্যায্যভাবেই ধরা হচ্ছে। একদিকে যেমন পণপ্রথাকে সমাজের অভিশাপ ধরা হয়, তেমনি মোহোরানা দিয়ে বিয়ে করাকে অর্থ দিয়ে বউ কিনে আনা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। এখন বিয়ে মানে এক ব্যক্তি একটি পরিবারের পরিবর্তে দুটি পরিবারের অংশ হয়ে ওঠে। ঘরেবাইরে মেয়েদের সমস্ত ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সমাজ নির্মাণে এগিয়ে চলেছে।
১১৫ বছর আগে রোকেয়া “সুলতানা’স ড্রিম” কল্পবিজ্ঞান হিসাবে লিখেছিলেন— যেখানে পেশি শক্তির প্রয়োজনকে পিছনে ঠেলে দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি। ঘরের বাইরে ‘সমস্ত’ কাজই মেয়েরা করেন। পুরুষরা পর্দানশিন হয়ে বাচ্চা মানুষ করা থেকে, আধুনিক বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সৌর শক্তির সাহায্যে রান্না থেকে, নানারকম অটোমেটিক ব্যবস্থায় ঘরের অভ্যন্তরের কাজের মধ্যে আবদ্ধ থাকেন। রোকেয়ার এই গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম কল্পবিজ্ঞান হিসাবে সৌর শক্তির ব্যবহারের উল্লেখ কিনা আমার জানা নেই। রোকেয়া পেশি শক্তির প্রয়োজনীয়তা ফুরাতে বিজ্ঞান প্রযুক্তির যে উন্নতির স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি কতদূর এখনও পর্যন্ত অর্জন হয়েছে সেই আলোচনা না করে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সমাজ এগিয়েছে অনেকটাই। মাত্র ৩০০ বছর আগের রাজাবাদশাহদের বা তাঁদের সৈন্য সামন্তদের ব্যবহৃত অস্ত্রে সজ্জিত কোন মিউজিয়ামে একটু ভ্রমণ করলেই বোঝা যায় আজকের সময়ে গড় পুরুষের থেকে মাত্র ৩০০ বছর আগেই গড় মানুষ অনেক বেশি পরিমাণ পেশি শক্তির ব্যবহার করতেন। কয়েক হাজার বা লক্ষ বছর পার করে গুহাযুগের মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে কোনও সন্দেহই থাকার কথা নয় যে, পেশি শক্তি ব্যবহারে মানুষের মধ্যে ক্রমাগত বিবর্তন চলছে। এই বিবর্তন শুধু পেশি শক্তিতেই নয়, মানুষের সার্বিক আকার, আকৃতি, আচার ব্যবহার, মানসিকতা সর্বত্রই ঘটছে। এই পরিবর্তন মানুষের যৌনতায় ঘটেছে। আদিম যুগে প্রতিকুল পরিবেশে বংশ রক্ষা করার প্রবৃত্তিতে যে পরিমাণ সন্তান উৎপাদন করতে হত ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন নারীকে যেখানে একটি সম্পদ উৎপাদনের যন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছিল, সেই অবস্থা এখন বদলে গেছে। এই বদল আসলে পেশী শক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন নতুন ভারসাম্যের দিক উন্মোচন করছে। রক্ষণশীল ইসলাম এই বিবর্তনকে অস্বীকার করতে চায় অথবা বাধা দিতে চায়, উল্টো দিকে নিয়ে যেতে চায়। নারী পুরুষ “Different but equal” অবস্থানের ঠিক উল্টো নারী ও পুরুষের মধ্যে সর্বত্র হায়ারারকি বিদ্যমান, সেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে আধিপত্য ও পরাধীনতার স্পষ্ট সম্পর্ক আছে, সেখানে পুরুষ প্রভু হিসাবে নীতি নির্ধারণ করেন এবং নারী পুরুষের নির্ধারণ করে দেওয়া রীতিনীতি মেনে চলবেন।
এই শ্রেণিবিন্যাসে, মহিলাদের দুর্বল লিঙ্গ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং আধুনিক সমাজের বিবাহের এথিকস হিসাবে “বিবাহ দুটি মানুষের মধ্যে পার্টনারশিপ ও কোলাবরেশনের একটি সাম্য চুক্তি”কে অস্বীকার করা হয়। নারীকে শালীনতা, পবিত্রতা এবং লজ্জাবতীর প্রতীক হিসাবে নির্মাণ করে তাঁকে সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। ব্যক্তিকে অতিমানবিক করে তোলার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ভারতেও অতীতে ফিরে যাওয়ার একটা প্রবণতা বিগত বেশ কয়েক বছরে দেখা যায়। এইভাবে অতীতের দিকে যাত্রা করার প্রচেষ্টা স্থান ও কালের ভেদে কোথাও কোথাও স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কিছুটা সাফল্য পেলেও দীর্ঘমেয়াদী ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বোঝা যায় সেই প্রচেষ্টা অদূরেই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। সময়ের গতির অভিমুখ পাঠ করলে বোঝা যায় ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সামাজিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে জেন্ডার গ্যাপ কমতে বাধ্য। কোথাও সেটা ৫ বছর লাগতে পারে অন্য কোথাও ৫০ বা ১০০ বছর লাগতে পারে। সম্পত্তির প্রশ্নে, সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রশ্নে, ঘরের বাইরে কাজে মেয়েদের উপস্থিতির প্রশ্নে সবরকম সার্ভের ফলাফলে, মেয়েদের উপস্থিতি ভয়ঙ্করভাবে কম আছে সেটি প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম বা অন্য ধর্মীয় কালচারে সম্পত্তির প্রশ্নে বৈষম্য অস্বীকার করে সামাজিক সংস্কারকে প্রতিহত করার চেষ্টা হোক বা শারীরবৃত্তীয় ও জৈবিক পার্থক্যকে ভিত্তিভূমি ধরে সামাজিক বৈষম্যকে প্রকৃতির নিয়ম বলে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হোক, দুটোই শেষ বিচারে পরাস্ত হবেই। এই মুহূর্তে তাই জেন্ডার গ্যাপ কমাতে ও পৈতৃক সম্পত্তিতে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভাব্য পথগুলি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। এই আলোচনা দুইভাবে হতে পারে— ইসলামিক স্ক্রিপচারের মধ্যে থেকে বা তাঁর আশপাশ থেকেই আইনের সংস্কার অথবা ধর্ম ও ধর্মীয় স্ক্রিপচারকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ করে সামাজিক নিয়মের জন্য ধর্মীয় রীতিরেওয়াজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আধুনিকতার মাপকাঠিতে নতুন নিয়মের প্রবর্তন।
সর্বোপরি শারীরিক শক্তির পার্থক্য ২০২০ সালে আর সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে না। প্রযুক্তির বিকাশ, চেয়ার টেনে বসে কাজ, সুইচ টিপে কাজ, এখন যন্ত্রের সাহায্যে অতি বড় দুর্বল মানুষকে দিয়েও হাতির সমান কাজ নিমেষেই করিয়ে নিতে পারা যায়। তাই যখন দাস ছাড়া সভ্যতার বিকাশ সম্ভব ছিল না তখন একরকম আইন ছিল, দাসদের জন্য অধিকার দিলে সভ্যতার বিকাশ আটকে যেত। আবার আরব দুনিয়ার অগ্রগতির কালে যে নিয়ম বলবৎ ছিল তা আজ আবার প্রযোজ্য নয়। সমাজে এই পরিবর্তনগুলি নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। সেই দ্বন্দ্বের প্রভাব একই বিষয়ে অনেক পরস্পর বিরোধী ভুমিকার মধ্যে দেখা যায়। এক্ষেত্রে কবি নজরুলকে সাবাস জানাতেই হয়। একদিকে তিনি খিলাফত আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদার ছিলেন আবার তিনিই ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই’, লিখে কামাল আতাতুর্ক-এর বৈপ্লবিক কর্মকে প্রশংসা করে গেছেন নিঃসকোচে। যে কামাল শরিয়তকে দেশের আইনের মেরুদন্ড হিসেবে দেখতে অস্বীকার করেছিলেন।
ইসলামিক আইনের অভ্যন্তর থেকে সম্পত্তি আইনের আধুনিকীকরণ
যেহেতু হজরত মহম্মদের মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের জীবনজীবিকা নিয়ে বিধিবদ্ধ নিয়মাবলী সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ওহী হিসাবে আসা বন্ধ হয়ে যায়, প্রথম দিকের মুসলিম আলেমরা ইসলামী আইনের উৎস (ফিকহ) এবং এর কৌশলগুলির যথাযথ বিকাশ, গ্রহণ ও বর্জনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। এর ফলে ইসলামিক সাম্রাজ্যে বিষয়গত ও আঞ্চলিক ভেদে পৃথক পৃথক মতামতের জন্ম দেয় যা ইসলামি আইনশাস্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন ধারার জন্ম দেয়। সময়ের সাথে এই বিভিন্ন ধারাগুলো কমবেশি একত্রিত হয়ে সুন্নি সমাজের চারটি মুখ্য প্রতিষ্ঠানে এসে ঠেকে। এগুলি হল হানাফি, মালিকি, শাফিহই এবং হানবালি।
এই সুন্নী প্রতিষ্ঠানগুলি সর্বসম্মতিক্রমে ফিকহের চারটি সূত্র গ্রহণ করে: কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা (সর্বসম্মতি) এবং কিয়াস (সাদৃশ্য)। ইসলামিক চিন্তাধারা অনুযায়ী উত্তরাধিকার আইনসহ কিছু আইন কোরানে সেট করা আছে তবুও কুরআন কেবল একটি আইনী পাঠ্য নয় বরং সমস্ত সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিচারের বিশ্বস্তভাবে জীবনধারণের মূলনীতিগুলি নির্ধারণ করে। কুরআনের আইনী বিষয়গুলির কোথাও ফাঁক থাকলে হাদিসে বর্ণীত সুন্নাহ দ্বারা পরিপূর্ণ করা হয়— কখনও আইনের শাসনে ইসলামী ফকীহগণের মধ্যে ইজমা ও কিয়াস ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা দেখা যায়। শরিয়ত নির্ধারিত হয়ে ইসলামিক আইনকানুনকে ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত পক্ষপাত প্রতিরোধ করতে কঠোর প্রচেষ্টা নিলেও আইনের ব্যাপারগুলি যথাযথ প্রয়োগের জন্য বিচারক বা ইসলামি আইনবিদদের কিছুটা যুক্তি ও চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়, যা ইজতিহাদ নামে পরিচিত। মালিকি ঘরানায় একজন ব্যক্তি (বিচারক) যে ব্যবস্থার সাহায্যে যুক্তি ও বিবেচনা প্রয়োগ করার সুযোগ পান তাকে বলে ‘উরফ’ এবং ‘ইস্তিসিলাহ’। ‘উরফ’, প্রচলিত রীতিকে সম্মান করার ব্যবস্থা। প্রচলিত রীতিনীতি একটি বাধ্যতামূলক রীতিনীতি হিসাবে স্বীকৃতি পাবে যদি সেই প্রথাগত অনুশীলন ইসলামী নীতিগুলি লঙ্ঘন না করে এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রচলিত হওয়া উচিত যার জন্য এটি বিবেচনা করা হচ্ছে। ‘ইস্তিসিলাহ’ হ'ল যে ব্যবস্থার সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দুটি বিকল্পের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া হয়। এই বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট পরিস্থিতির জন্য আরও উপযুক্ত হিসাবে একটি বিকল্প বেশি গ্রহণযোগ্য এবং নির্বাচিত সমাধানটি প্রত্যাখ্যাত সমাধানের চেয়ে গভীরে বিশ্লেষণ করলে তুলনায় দুর্বল হলেও গৃহীত সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে বেশি গুরুত্ব পায়। মালিকি ঘরানার বিচার প্রক্রিয়ায় যে নীতিটি মানা হয় সেটি হল— যেহেতু আল্লাহর আইন মানব কল্যাণের জন্যই নাজিল হয়েছিল, তাই সার্বিক মানব কল্যাণের প্রয়োজনটাই একাধিক বিকল্পের মধ্যে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়াকে গাইড করতে পারে। সুতরাং ইস্তিসিলাহ আলেম বর্গদের মাধ্যমে মানব কল্যাণের (মাস্লাহা) নির্দিষ্ট পথ তুলে ধরার নির্দেশ করে। দশম শতক পর্যন্ত এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনকানুনের চর্চা হলেও তারপর এই ব্যবস্থার প্রচলন ধীরে ধীরে কমতে থাকে, পরিবর্তে ‘তাক্লিদ’ এর ব্যবহার শুরু হয়। এই ব্যবস্থায় সেই ঘরানায় একই রকম অবস্থায় পূর্ববর্তী কোনও বিচারের উদাহরণকে অনুসরণ করার রীতি শুরু হয় এবং বলা যায় ইসলামে ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ভৌগোলিক ক্ষেত্র যেভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে সেই অনুযায়ী মুসলিম বিশ্ব এক একটি শরিয়তি ধারা গ্রহণ করেছে। শরিয়তি আইনের ঘেরাটোপে থেকেও মুসলিম বিশ্বে এখনও পর্যন্ত নাইজেরিয়া একমাত্র দেশ, জাতিসংঘের সুপারিশ গ্রহণ করে তাঁদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উত্তরাধিকার আইন সংস্কার করেছে। নারী পুরুষের জন্য সমান অধিকারের অন্তত আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা তাই নাইজেরিয়ার অবস্থা আরও একটু গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করবো। পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতই নাইজেরিয়াতে ইসলামের মালিকি ঘরানার প্রভাব বেশি। এই ঘরানায় উৎস হিসাবে ইমাম মালিক ইবনে আনাসকে ধরা হয়, ইনি অষ্টম শতকে মদিনায় দেহ ত্যাগ করেন এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় ইমাম মালিক এর প্রভাব সৃষ্টি হয়। মালিকি ঘরানায় মুসলিম জগতে সর্বত্র ঐতিহাসিক ভাবে স্থানীয় জনজাতির সার্বিক কল্যাণ (মাস্লাহা) এবং স্থানীয় রীতিনীতিকে প্রভূত গুরুত্ব দিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ইসলামের মৌলিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে না গেছে। ইসলামি আইনের বিশেষ কিছু উৎসে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে মালিকি ঘরানা ইসলামের অন্য তিনটি অর্থোডক্স সুন্নি ঘরানার থেকে বস্তু ও চরিত্রগত ভাবে ভিন্ন এবং সেখানে উত্তরাধিকার নিয়ে আইনও তারই অন্তর্গত।
উত্তরাধিকার নিয়ে ইসলামিক আইনের বেশীরভাগের উৎস কোরআন। কুরআন নাজিল হওয়ার আগে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আরবের বেশিরভাগ জনজাতির মধ্যে পুরুষের হাত ধরে হত, সেখানে নারীর কোনও স্থান ছিল না, মেয়ে ও মাতৃরক্ত সম্পর্কিত উত্তরাধিকারের কোনও ব্যবস্থা তো ছিলই না, বরং কিছু ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারী পুরুষের হাতে সম্পত্তির সাথে কিছু নারীও সম্পত্তি হিসাবে হস্তান্তরিত হত। এমনকী কিছু ক্ষেত্রে বাবাকে অতিক্রম করে তাঁর সন্তানের কাছে চলে যাওয়ার অবকাশ ছিল। হজরত মুহাম্মদ অহি নাজিলের মাধ্যমে এইসব দীর্ঘদিন চলে আসা আইনের যুগান্তকারী পরিবর্তন করে দেন।
সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে সুন্নি ঘরানার আইনগুলি আগেই উল্লেখ করেছি। মালিকি ঘরানা সেই আইনের থেকে স্পষ্টভাবে যেখানে আলাদা সেটি হল—দূরবর্তী আত্মীয়রা কোনও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না, যা অন্য ঘরানার নিকট বা দূর সকলের জন্য কিছু না কিছু থাকার থেকে আলাদা। মেয়ের ছেলে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের ছেলে, চাচা বা মামার মেয়ে, চাচা, ফুফু, মামা, খালা এই দূরবর্তী আত্মীয়র পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত। মালিকি ঘরানা বাদ দিয়ে অন্য ঘরানায় এদের সবাই কিছু না কিছু উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়াকে কিয়াসের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়। মালিকি ঘরানায় ‘উরফ’ ব্যবস্থার প্রয়োগ করে যে অঞ্চলের মানুষ ইসলামে কনভার্টেড হয়েছেন সেখানে দূরবর্তী আত্মীয়দের প্রাপ্য সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মালিকি ঘরানায় তাই উত্তর নাইজেরিয়ার হাসুয়া উপজাতির মধ্যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনকেই দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্ব দেওয়া হত। সেই আইনে কৃষিজমি, কৃষি খামার, বিল্ডিং কম্পাউন্ড এর মত মুল্যবান সম্পদ উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মহিলাদের অধিকার উপেক্ষা করে, পরিবর্তে কৃষিজমির ফসল, ফল, নগদ টাকা, গবাদি পশু উত্তরাধিকার হিসাবে পেত। অর্থনৈতিক গাছের ক্ষেত্রে ফলের একমাত্র অধিকারী মেয়েরা হলেও সেই গাছ মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে না। নারী ও পুরুষ দুজনেই এইসব পদার্থের ভাগ নেয় এবং একে অপরের অধিকার স্বীকার করে নেয়। নাইজেরিয়ার এই ব্যবস্থা কোরআনের আইন ও আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের সমান অধিকারের সুপারিশ দুটিই ভঙ্গ করে কিন্তু প্রচলিত রীতি হিসাবে মালিকি ঘরানা স্বীকৃতি দেয়। সুতরাং বর্তমানে একদিকে মালিকি ঘরানার উত্তরাধিকার আইন, হাসুয়া উপজাতির প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠনগুলোর রীতিনীতির পরস্পর বিরোধী অবস্থানে আছে। আধুনিক মুসলিম স্কলারদের একটি অংশ ইসলামি আইনের বজ্র কঠিন আইনের মুষ্টি আলগা করার উদ্দেশ্যে ইসলামি আইনের একটি গতিশীল ধারাকে ধরতে চাইছেন। এই ধারায় ধরে নেওয়া হয় ইসলামের ইতিহাসে অতীতের সকল স্বনামধন্য আলেমরা ইসলামিক আইনের একটি গতিশীল ধারাকে ছুঁয়ে থেকে বিচার দিয়েছেন।
ঊনবিংশ শতকের ইজিপ্টের স্কলার মহাম্মদ আব্দুহর মতে, ইস্তিস্লাহ ও কল্যাণকামী হিসাবে মাস্লাহাকে উর্ধে তুলে ধরার প্রচেষ্টা গতিশীল ইসলামি আইনের অন্যতম একটি হাতিয়ার। ধ্রুপদী ইসলামিক আইনের ধারায় ইস্তিস্লাহ-এর প্রয়োগের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। ইসলামি আইন বিশারদরা মূলত কোরআনে নাজিল হওয়া সূত্র মেনে চলেন। ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব অনুসারে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকাকে ন্যূনতম রাখার প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসাবে মাস্লাহার ভূমিকা গৌণ ধরা হয়। কিছু কিছু স্কলারের মতানুসারে আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে একজন বিচারক এমন কোনও আইন যদি খুঁজে পান যা আইনের ‘পাঁচটি সূত্রে’র কোনও একটিকেও সার্বজনীন নিশ্চিতভাবে ক্ষতি করবে বলে মনে হলে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। নাজিল হওয়া কুরআনের মধ্যে সুরক্ষার এই পাঁচটি সূত্র হল— ১) জীবনের সুরক্ষা ২) বংশ ৩) সম্পত্তি ৪) ধর্ম ও ৫) যৌক্তিকতা। এমনকি কোরআনের কোনও নির্দিষ্ট আইনকেও দূরে সরিয়ে রাখা যেতে পারে যদি কোনও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনও আইন অপ্রতিরোধ্য ও সার্বজনীনভাবে পাঁচটি সূত্রের কোনও একটারও ক্ষতি করে। সাদৃশ্য থেকে প্রাপ্ত আইনের যথাযথতা পরীক্ষা করা উচিত। সাদৃশ্য থেকে প্রাপ্ত আইন যথাযথ নয় যদি সেই নতুন আইনটি সুনির্দিষ্ট যে আইন থেকে নেওয়া হয়েছে সেটার মতই সামাজিক ভালত্ব দিতে না পারে অথবা আইনটি সরাসরি পাঁচটি নীতির কোনও একটির জন্যও ক্ষতিকর হলে। সাদৃশ্য (Analogy) থেকে প্রাপ্ত আইনের ক্ষেত্রে সাদৃশ্যটি খুব ভালো হলেও আইনটি প্রয়োগযোগ্য না হলে দূরে রাখতে হবে। এই গবেষক ও তাঁর উত্তরসুরীরা মাস্লাহার ধ্রুপদী নীতিকে বিস্তারিত করেন। সংস্কারবাদী পদ্ধতি হিসাবে মাস্লাহাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা হয় যাতে বিচারকরা মৌলিক গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত সূত্র ও মানবিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দুটিকেই বিচার্য হিসাবে নেওয়া যায়। ঐশ্বরিক কিতাব ও নবীজীর ঐতিহ্য থেকে মুসলিম আইনকানুন নির্ধারিত হলেও আইনের উৎস সম্পর্কে মানবিক ব্যাখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ইসলামিক আইনে ইসলামিক আইন বিশারদ হিসাবে ফকিহদের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রকৃতপক্ষে, ইসলামী আইন মূলত ফকীহদের আইন, যেটি সুদূর সময়কালে মুসলিম ফকীহগণের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সেই কারণেই আধুনিক সংস্কারবাদী মুসলিমরা মনে করেন মৌলিক টেক্সট ও হাদিসগুলির ব্যাখ্যায় মুসলিম ফকিহদের সব সময় জড়িত থাকা দরকার। তাঁরা মনে করেন ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করা উচিত হয়নি। ইশ্বরের ইচ্ছানুসারে মানুষ কীভাবে আচরণ করতে চায় তা নির্ধারণ করার পদ্ধতি হিসাবে তাঁরা ‘তাকলিদ’-এর বৈধতাকে প্রশ্ন তোলেন। এই বিশেষ সংস্কারবাদী ধর্মতত্ত্বকে সঠিকভাবে নিও-ইজতিহাদ বলা যেতে পারে। সংস্কারবাদী পদ্ধতি হিসাবে নিও-ইজতিহাদ ১৯৭০ সালের পর উত্তর নাইজেরিয়াতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এবং ইসলামিক আইন নিয়ে স্থানীয় মানুষের ধারণার বিপুল পরিবর্তন হয়। এই মতের উপর ভিত্তি করে ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংগঠন ইজালা মৌলবাদী ঝোঁকের বিরুদ্ধে নাইজেরিয়ান মানুষদের চিন্তা ভাবনা প্রকাশ করার সুযোগ দেয়। ইজালা মেয়েদের অগ্রগতির সপক্ষে প্রচার করে যা আধুনিকতার পরিচায়ক ও আন্তর্জাতিক মানবধিকার সংগঠনের ভাবনার সাথে সাযুজ্য রাখে। এইভাবেই মুসলিম আইনকে আধুনিক মানবধিকার রীতিনীতির সাথে মিলিয়ে দিয়ে অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। আইনের সংস্কার করা সম্ভব হলেও, প্রয়োগের উপর ব্যক্তি ও পরিবারের ক্ষমতা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে, মুসলিম সমাজ তাঁদের অভ্যাসের পরিবর্তন বাস্তবিক ক্ষেত্রে কতটা করবে সেটা দেখার জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। তবে রাষ্ট্রের ভূমিকা জবরদস্তিমূলক না হয়ে সহযোগিতা মূলক হওয়াটা কাম্য। অপরদিকে সংস্কারের প্রকৃত সুফল পেতে আইনের পরিবর্তনকে ভিতর থেকেই ন্যায্যতা দিয়ে আনতে হয়। এই পদ্ধতিতেই মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে সংস্কার কার্যকরী করিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। নারী-পুরুষের বিতর্ক ছাড়াও ডক্ট্রিনেটের ব্যবস্থার মধ্যেও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনেকে অনুভব করছেন। ডক্ট্রিনেটের সংস্কারের প্রয়োজনকে কেউ অসিওতনামা করে বা আত্মীয় স্বজনদের ভালো ভাবমূর্তির উপর ভরসা করতে বলে বিরোধিতা করলেও, আইনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। ইসলাম ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নানা দেশ ও সমাজ থেকেই উঠে আসছে। ভারতেও মুসলিম সমাজের অভ্যন্তর থেকেই লিঙ্গ সাম্যের আইনের দাবি প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন।
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ৪ জুলাই ২০২০
প্রতীকী ছবি
লেখক : অধ্যাপক
সৌজন্য: ‘সহজিয়া’ ২০২০ ইদসংখ্যা
0 Comments
Post Comment