‌বিজ্ঞাপনে লিঙ্গবৈষম্য

  • 16 May, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 3639 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
পিতৃতন্ত্রের হাতে নারী ‘‌ভোগ্যপণ্য’ হয়ে উঠেছে মৌলিক ভাবনার মৃত্যুতে। যুগযুগ ধরে এমন কোনও যাদুকাঠিও হাতে নেই যা মৃত ভাবনাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। যার ফলে বিজ্ঞাপনেও লিঙ্গ বৈষম্যের তীব্রতা এতটাই ক্ষতের সৃষ্টি করেছে যা নারীর স্বাভিমানে লাগবেই।

‘‌‘‌তুমি ভাবছ মেঘ করেছে
বৃষ্টি পড়বে অনেকক্ষণ
 
আসলে তো মেঘ করেনি
মন খারাপের বিজ্ঞাপন’‌
’‌
রুদ্র গোস্বামী
 
প্রাচীন গুহাচিত্র, দেওয়াল লিখন, মৌখিক ঘোষণা, মুদ্রণ মাধ্যম, বেতার, টেলিভিশনের হাত ধরে আজকের বিজ্ঞাপন আধুনিক অন্তর্জাল দুনিয়ায়। 
সুদূরপ্রসারী উত্তরণ কেবলমাত্র প্রযুক্তিতে ঘটেছে‌!‌ আমাদের মানসিকতা কতখানি সমৃদ্ধ হয়েছে? আজকেও আমরা কিন্তু তথাকথিত stereotype বিজ্ঞাপন পৃথিবীতে বাস করছি। ‘‌Stereotype’ শব্দের বাংলা অর্থ বাঁধাধরা ধারণা বা বিশ্বাস। ‘Cambridge Advanced Learner’s Dictionary’-তে ‘Stereotype’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে…‘‌Stereotype means- A fixed idea that people have about what someone or something is like, especially an idea that is wrong: racial or sexual stereotype’। লিঙ্গ ছকের এই খেলায় সাধারণত প্রায় বেশিরভাগ মনুষ্যজগত পিতৃতান্ত্রিক এই কাঠামোকে ধ্রুবসত্য বলে ধরে নিয়েছে। এই সুযোগে পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী মিডিয়া সংগঠন গোপনে হেসে  ফায়দা লুটছে। নারী-পুরুষ সংক্রান্ত গতেবাঁধা ধারণাগুলি একবার দেখে নেওয়া  যাক: পুরুষ মানে ক্ষমতাধর, পরিশ্রমী, স্বাবলম্বী, সফল, শাসক, উদ্যোক্তা। নারী মানে লোভী, নির্বোধ, শোষিত, সেবাদাসী, মনোরঞ্জনকারী, ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জাতিসংঘের এক নতুন প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষদের উপরই বেশি ভরসা করেন৷ নারীদের দুর্বল মনে করেন। বিশ্বের ৭৫টি দেশের তথ্য এই প্রতিবেদনে পেশ করা হয়েছে (তথ্যসূত্র: ডিডাব্লিউ, ৫/৩/২০)।

আধুনিক বিজ্ঞাপনের প্রবর্তক টমাস জে ব্যারাট বলেছিলেন— ‘‘রুচি বদলায়, ফ্যাশন বদলায়, বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই বদলাতে হবে৷’‌’‌ সত্যি রুচি, ফ্যাশনের পরিবর্তন হয় কিন্তু মানসিকতার কোনও পরিবর্তন হয় না! উনিশ শতকে ব্যারাট ‘‌পিয়ার্স’‌ সাবানকে জনপ্রিয় করে তুলতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ‘মিস পিয়ার্স’ প্রতিযোগিতা, সেলিব্রেটি ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডোর দিয়ে পণ্যের প্রচার এবং তার হাত ধরেই ১৮৯১ সালে লিটল ল্যাংট্রি নামক একজন ব্রিটিশ হোটেল গায়িকা প্রথমবার অর্থের বিনিময়ে সাবানের বিজ্ঞাপন করেন। নিজেদের স্বার্থান্বেষণের উদ্দেশ্যে পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞাপন সমাজও মহিলাদের ভোগ্য-পণ্যে পরিণত করেছে।

বিজ্ঞাপনের জগতেও কেন নারী পুরুষের বৈষম্য দেখা যায়? আদতে এর পিছনেও আছে পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রের গল্প। খুব সচেতন ভাবে সমাজে প্রচলিত ‘‌জেন্ডার’‌ ধারণাকে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন কার্যনির্বাহী ডেভিড অগিলভি বলেছিলেন— ‘‌‘‌আমি ব্যাকরণের নিয়ম কানুন জানিনা। তবে আমার মনে হয় আপনি যদি কাউকে কোনও পণ্য ব্যবহার করতে কিংবা কিনতে উৎসাহিত করতে চান তাহলে আপনাকে তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে।’‌’‌ অর্থাৎ বোঝায় যাচ্ছে ধরাবাঁধা ছকে মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসা প্রযুক্তি কেন বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের সমাজের ভাষায় বিজ্ঞাপন কথা বলছে।
‘জেন্ডার এডভারটাইজমেন্ট’‌ বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি তত্ত্ব। বিজ্ঞাপনে নারী-পুরুষের ভাবমূর্তি কীভাবে তুলে ধরা হয় তার বিচার-‌বিশ্লেষণ পদ্ধতি হচ্ছে জেন্ডার এডভারটাইজমেন্ট।

এরভিং গফম্যান ‘জেন্ডার এডভারটাইজমেন্ট’‌ সম্পর্কে প্রথম তাত্ত্বিক ধারণা প্রদান করেন। পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনে জেন্ডারভিত্তিক গবেষণা করে গফম্যান মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে গণমাধ্যমে কীভাবে সমাজের প্রচলিত পুরুষসুলভ স্বভাব প্রদর্শন (Masculinity), নারীসুলভ স্বভাব প্রদর্শন (F‌emininity) এবং কাঠামোগত বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে (Framing analysis) গৎবাঁধা পরিকাঠামো গ্রহণ করেছে তার চিত্র তুলে ধরেছেন। গফম্যানের গবেষণায় আমরা দেখি পুরুষদেরকে বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় সাহসী, পুরুষালী, শক্তিশালী, সিরিয়াস। অপরদিকে নারী নেতিবাচক ভাবে বিজ্ঞাপনে উপস্থিত—মোহনীয়, অপরূপা, লোভী, সেবাদাসী, দুর্বল, যৌনবস্তু, পুরুষ নির্ভর ইত্যাদি।

এতক্ষণ আলোচনার পর বিজ্ঞাপনে নারী পুরুষকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া গেল। আমরা জানি বিজ্ঞাপন প্রচারের অনেকগুলি মাধ্যম আছে। আমার আলোচনা মূলত দুটি জনপ্রিয় মাধ্যমকে কেন্দ্র করে—মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক মাধ্যম। মুদ্রণ মাধ্যমের মধ্যে সংবাদপত্র, সাময়িকী পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ক্ষেত্রে টিভি ও ইন্টারনেট মাধ্যমকে বেছে নিচ্ছি।

মুদ্রণ বিজ্ঞাপনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মূল ধারা (Genre) হল— 
ক) ডিসপ্লে বিজ্ঞাপন
খ) ক্লাসিফাইড বা শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন
প্রথমে আমরা শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন নিয়ে আলোচনা করব। আমরা জানি শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনে পাত্রপাত্রী বিভাগ আছে। বিয়ের বাজারে মহিলাদেরকে পণ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। পাত্রী যতই উচ্চশিক্ষিত হন না কেন, তাঁর গুণাবলী বিশ্লেষণ করার সময় প্রথমেই আসে ত্বকের রঙ! তারপর একে একে উন্মোচিত হয় তার অন্যান্য গুণ—উচ্চতা, অপরূপা, গৃহকর্মে নিপুণা, মার্জিত, রুচিশীল, শিক্ষিত। পাত্ররা অপরূপা, পরমা সুন্দরী, ফর্সা, গৃহকর্মে নিপুণা পাত্রীর খোঁজ করেন। আজ পর্যন্ত কোনও পাত্র চাই  বিজ্ঞাপনে অপরূপ পরম সুন্দর রাজপুত্রের মত সুন্দর পাত্রের সন্ধান করা হয়েছে কি? পাত্রীর অভিভাবকেরা উপযুক্ত পাত্রের আবেদন জানান। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যাক দুটি বিজ্ঞাপন। তাহলেই দুটি বিজ্ঞাপনের মধ্যে তারতম্য চোখে পড়বে।  
 
পাত্রী চাই
পঃ বঃ তাম্বুলী দুর্গাপুর নিবাসী, ৩৩/৫’৭, স্বগৃহ ব্যাবসায়ী পাত্রের তরুণী, সুমুখশ্রী, অতীব সুন্দরী, ফর্সা, গৃহকর্মে পারদর্শী, সঃ/ উচ্চ অসঃ পাত্রী চাই। 
পাত্র চাই                                                          
পঃ বঃ মাহিষ্য, ফর্সা, সুন্দরী ৩২বঃ, পাত্রীর জন্য সৎ, শিক্ষিত, সরকারী, বেসরকারি চাকুরীজীবী পাত্র চাই।

ডিসপ্লে বিজ্ঞাপন চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করা হয়। ডিসপ্লে বিজ্ঞাপণ মূলত ছবি কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। ফটোশপের দৌরাত্ম্যে ছবিকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপনে নারীদের আই ক্যান্ডি প্লাস্টিক সুন্দরী হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। পুরুষদেরকে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়। বিখ্যাত একটি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে দেখছি—পুরুষ মডেলকে সাধারণ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু নারী মডেলকে মেকআপ, ফটোশপের মোড়কে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।    

বর্তমানে কয়েকটি ব্যাতিক্রমধর্মী বিজ্ঞাপনে পুরুষদের শরীর প্রদর্শন করা হচ্ছে। আমরা জানি বিজ্ঞাপনে নারী-পুরুষ পণ্য হিসাবে উপস্থাপিত হয়। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম পুরুষেরাও পণ্য। কিন্তু পুরুষদের তাতে কি ক্ষতি হচ্ছে? তারা তো ধর্ষণ, নিগ্রহের পৃথিবীতে বাস করে না! জেন কিলবওর্ন প্রায় চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে বিজ্ঞাপনে মহিলাদের ছবি কীভাবে উপস্থাপন করা হয় সে বিষয়ে কাজ করেছেন। তিনি ২০১৪ সালে টেডএক্স টকসে ‘দা ডেঞ্জারাস ওয়েস এডস সি ওম্যান’ শীর্ষক বক্তৃতায় জানাচ্ছেন- “Ads sells more than products Now in many ways, we have obviously come a long way. But from my perspective of over 40 years, the image of woman in Advertising is worse than ever.”   

একটি ডিসপ্লে বিজ্ঞাপনে থাকে— ১) পণ্যের নাম ২) হেডিং ৩) সাব হেডিং ৪) বডি ৫) ছবি ৬) স্লোগান ৭) লোগো। বিজ্ঞাপনের ভাষা নির্ধারণ করা হয় পণ্যের ধরন, ক্রেতার মানসিকতার কথা মাথায় রেখে। ডিসপ্লে বিজ্ঞাপনে মহিলাদের বস্তু হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। গৎবাঁধা ছকে ফেলে উপস্থাপন করা হয়— স্নেহময়ী, মমতাময়ী, মোহময়ী, আবেদনময়ী, অপরূপা হিসাবে। আধুনিক বিজ্ঞাপনের যুগে নারীরা আটকে আছে চার দেওয়ালের মাঝখানে। ঘর সামলানো, রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় পরিষ্কার, বাচ্চার ডায়পার পরিবর্তন, বাচ্চার সুস্বাস্থ্যের ভার সব কিছু দায়িত্ব নারীদের কাঁধে। সমস্ত প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপনে নারীদেরকে উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞাপন আমাদের জানায় কেবলমাত্র নারীদের রেশম চুল, পেলব ত্বক, নরম ঠোঁট, মোহনীয় চেহারার অধিকারী হতে হবে। 

ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুসারে মানুষের মনে তিনটি স্তর আছে। চেতন, প্রাকচেতন, অবচেতন। আমাদের মনের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে অবচেতনের বসবাস। এই স্তরে কামনা, বাসনা রয়েছে। আমাদের অবচেতন মন বিজ্ঞাপনের মোহজালে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বিজ্ঞাপন এজেন্সি আমাদের অবচেতন মনে সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেয়— কমবয়সী থাকতে চাই, সুগৃহিনী হতে চাই, মডেলের মত গড়ন চাই, সাদা ঝকঝকে দাঁত চাই, রেশম চুল চাই, ভাল ব্র্যান্ডের মেকআপ চাই। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই বিজ্ঞাপন। 

ইমেজ প্রধান বিজ্ঞাপনের একটি উদাহরণ দিয়ে দেখে নেব, কীভাবে নারীকে বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ডাবর আমলা হেয়ার অয়েল বিজ্ঞাপনের হেডিং-‌এ বলা হচ্ছে— এখন ডাবর আমলা হেয়ার অয়েলের সাথে ডাবর রেড পেস্ট ফ্রি! এখানে একজন পুরুষ মডেল হতে পারতেন কিন্তু তারা যেহেতু কংস রাজের বংশধর তাই তাদের সুন্দর চুল, সুন্দর দাঁতের প্রয়োজন নেই। যাই হোক, এই বিজ্ঞাপন আমাদের জানাচ্ছে একজন নারীর টু এক্স Stronger চুল এবং প্রবলেম ফ্রি দাঁত থাকতে হবে। সুন্দর চুল, সুন্দর দাঁত! কী সুন্দর ভাবে ধীর লয়ে বিষক্রিয়া করা হচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে।                        

আবার কেয়োকার্পিনের এই বিজ্ঞাপন জানাচ্ছে তোমার চুল অমূল্য। চুলের বিমা করো! পণ্যর প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বিজ্ঞাপনে স্লোগান ব্যবহৃত হয়। এখানে স্লোগান— চুলের ইনস্যুরেন্স করো / রোজ কেয়োকার্পিন করো। এখানে নারীকে বস্তু হিসাবে দেখানো হয়েছে।

আবার স্পার্কল ডিসওয়াশের স্লোগান— চকচকে বাসন, ঝকঝকে জীবন। এখানেও মডেল একজন নারী। তিনি বাসন মেজে জীবনকে ঝকঝকে করে তুলতে চান!

ইলেক্ট্রনিক্স মাধ্যমের বিজ্ঞাপন
নব্বই দশকের কিশোরী হওয়ার কারণে টেলিভিশনের যে বিজ্ঞাপনগুলি দেখে বড় হয়েছি, সেই নেতিবাচক বিজ্ঞাপন ভাবনাগুলি বর্তমানে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ভাবনার কোনও পরিবর্তন হয়নি। ইলেক্ট্রনিক্স মাধ্যমের বিজ্ঞাপনগুলি দু ভাবে উপস্থাপন করা হয়— ক) গল্পকেন্দ্রিক, খ) জিঙ্গেল নির্ভর। আমরা ছোট থেকে জেনে এসেছি হেমা, রেখা, জয়া, সুষমার কাজ কাপড় কাচা।— ঘর ভরকে কাপড়ে পাল মে নিখারা / হেমা, রেখা, জয়া ওর সুষমা সব কা পসন্দ নিরমা / ওয়াশিং পাউডার নিরমা। উজালার বিজ্ঞাপনে পুরুষকে দেখেছি রেগে উঠেছে— পুরনো নীলের দাগযুক্ত কালচে সাদা জামা পরে। নারী মডেল হতাশ হয়ে বলছে— কবে বদলাবে নীল, কবে বদলাবে কপাল। চার ফোঁটা যুক্ত নতুন উজালা আসার পর সেই মহিলার কপাল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বুঝতে শিখেছি রোজ রোজ  নিমা রোজ মাখতে হয়, তাহলে গোলাপের সুগন্ধপূর্ণ রেশমের মত ত্বক হবে। সৌন্দর্য সাবান নিরমা ব্যবহার করলে দুনিয়া ধন্য ধন্য করবে।             

আধুনিক বিজ্ঞাপনগুলোতে কী এমন বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে? পুরনো প্রেস্টিজের বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ছিল— জরুরত হ্যায় এক শ্রীমতী কী, কলাবতী কী, সেবা করে যো পতি কী। নতুন প্রেস্টিজের বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন— যো বিবি সে সাচমুচ করে প্যার ও প্রেস্টিজ সে ক্যায়সে করে ইনকার। নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশন করা হচ্ছে। সেবাদাসী তার সেবা দিয়ে পতির মন জয় করে নেবে!

সারা পৃথিবী জুড়ে পুরুষদের বডি স্প্রে, ডিও বিজ্ঞাপনে নারীদের নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করা হয়। ডিওর গন্ধে মত্ত হয়ে নারীরা নিজেদের সঙ্গী ছেড়ে চলে যায়, ঝাটাক। ওয়িল্ড স্টোন বিজ্ঞাপনে নারীদের যৌনবস্ত রূপে দেখানো হয়। প্যারাসুট বডি লোশন বিজ্ঞাপনে নারীরা নরম কোমল বস্তু। বডি লোশন ব্যবহার করে নারীর ত্বক এত ভালো হয়ে যায় সঙ্গীর কেবল তাকে ছুঁতে ইচ্ছা করে। 

পেটিএম বিজ্ঞাপনে নারীদেরকে লোভী দেখানো হয়েছে। ফ্রি মুভি টিকিটের জন্য ছলনার আশ্রয় নিতে দেখা যায়। প্রায় সমস্ত কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনে নারীদের লাস্যময়ী রূপ দেখা যায়। 

অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে পুরুষদের রমরমা। তার মানে আজও মনে করা হয় মেয়েরা আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল নয়! পলিসি বাজার বিজ্ঞাপনে পুরুষদের আধিপত্য দেখা যায়। 

বাচ্চাদের হেলথ ড্রিঙ্ক বিজ্ঞাপনে নারীদের দেখানো হয়। বাচ্চাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কেবল মায়েরা চিন্তিত। ডমিনজের বিজ্ঞাপনেও সেই ধরাবাঁধা ছকে মাকে হাজির করা হয়েছে, মমতাময়ী রূপে। এই বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন #মানেহিভুলতি! বৃদ্ধা মাকে ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে। কোনও খোঁজখবর নেই না। মা মনে মনে দুঃখও পেলে অন্যদের কাছে ছেলের সুখ্যাতি করেন। অবসর সময়ে মা কামিজ বানান। কামিজ বানিয়ে টাকা উপার্জন করেন। টাকা পেয়ে তিনি ছেলের জন্য পিৎজার অর্ডার দেন। ছেলে মায়ের কাছ থেকে পিৎজা উপহার পেয়ে, অনন্দিত হয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। 

ওয়াঘ বখরি চায়ের বিজ্ঞাপনে দেখি একজন অভিমানী মহিলা ব্যস্ত বরকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে, রেখে গেছে হ্যান্ডিক্যাম বার্তা। মহিলার ভাষ্যে সেই বার্তায় বলা হয়— আমার মনে হয়, আমার কথা শোনার মত আপনার সময় নেই, তাই ভাবলাম আপনার হ্যান্ডিক্যামের সঙ্গে কথা বলে নি। আমার আজকেও সেই দিনের কথা মনে পড়ে, যেদিন আপনি আমাকে দেখতে বারেলি এসেছিলেন। আমি আজও অবাক হয় আমার সমস্ত হাইফাই কাজিনদের মধ্যে থেকে, আপনি আমার মত ভাঙাচোরা ইংরেজি বলতে পারা মেয়েকে কীভাবে পছন্দ করলেন! আপনার মনে আছে আপনি মজা করে একবার বলেছিলেন আপনার সঙ্গে বাইকে বসতে হলে ওজন কমাতে হবে, ওই দিনের পর থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত আমি প্রতিদিন কাংনা ব্রিজ অবধি ছয় চক্কর দৌড়তাম। এরকম অনেক কথা আপনাকে বলতে চাইতাম, কিন্তু বিয়ের পর থেকে আপনার কাছে সময় কোথায় ছিল! হানিমুনের দ্বিতীয় দিন আমি জানতে পেরেছিলাম চা ছাড়া আপনার দিন শুরু হয় না। সেদিন চা বানানো ছাড়া আপনাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য চা খাওয়া শিখে নিয়েছিলাম। হয়তো আপনি জানেন না, সেদিনের আগে আমি কোনদিন এক চুমুক চা খেয়ে দেখিনি, ওই দিনের পর থেকে আপনি ল্যাপটপে যখন টাইপ করতেন, আমি কাপের পর কাপ চা রেখে আসতাম, আপনি বুঝতেই পারতেন না কতবার চা ঠাণ্ডা হয়ে যেত আর আমি পুনরায় চা বানিয়ে নিয়ে আসতাম। যতদিন যেতে থাকে আমি বুঝতে পারি চায়ের মত আমাদের সম্পর্ক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তাই আমি চলে যাচ্ছি। শুধু এটুকু বলার আছে, চায়ের পাতা রান্নাঘরের আলমারিতে রাখা আছে। এবার নিজেই চা বানানো শিখে নাও। চা ঠাণ্ডা হলে মাইক্রোয়েভে গরম করে নিও।                    
এরপর বিজ্ঞাপনের পুরুষ চরিত্র স্ত্রীর মানভঞ্জন করতে বারেলি পৌঁছায়। তাকে দেখে তার স্ত্রী যখন জিজ্ঞাসা করে কেন এসেছ? সে জানায় তোমার হাতের এক কাপ চা খতে এসেছি। এক কাপ চা খাওয়ার পর বর যখন বলে আরেক কাপ হয়ে যাক? বউ সম্মতি জানায়। তখন বর জানায় এবার আমার হাতের বানানো চা খাও। সেই চা বানানোর কথা শুনে মহিলার অভিমান গায়েব হয়ে যায়। এই বিজ্ঞাপন দাবি করছে অয়াঘ বখরি চা পান করলে সম্পর্কে উষ্ণতা আসবে। এই বিজ্ঞাপনের স্লোগান—‘হামেশা রিসতা বানায়ে’।  

যে বিজ্ঞাপনটির কথা বললাম তার আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই বিজ্ঞাপনে লিঙ্গ বৈষম্য, গৎবাঁধা ধারণা এবং লিঙ্গ কাঠামোকরণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। আমরা এই বিজ্ঞাপনে দেখছি— মহিলাটির অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে, সঙ্গী তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে নির্বাচন করেছে বলে আপ্লুত হয়েছে। সঙ্গীর বাইকে স্থান পেতে নিজের শারীরিক গড়নে পরিবর্তন এনেছে। ত্যাগ স্বীকার করেছে, পুরুষ সঙ্গীর মন পেতে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনেছে, সেবাদাসী হিসাবে সেবা করে গেছে, মাইক্রোওয়েভ বস্তুটি তার শূন্যস্থান পূরণ করছে! বর নিজের হাতে চা বানাবে শুনে সে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠছে!

এবার আমরা দুর্গাপুজোর সময় তৈরি দুটি বিজ্ঞাপনের কথা বলব। চিরাচরিতভাবে এখানেও নারী সেই একই ভূমিকা পালন করছে। ‘‌মান্যবর’‌ পাঞ্জাবির বিজ্ঞপনে নারী মডেল সরাসরি উপস্থিত হননি। তবে বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পুরুষ মডেল পাঞ্জাবি পাচ্ছে না। তার ফলে তার সব রাগ গিয়ে পড়ে গিন্নির উপর। এই বিজ্ঞাপনের সংলাপ— কী যে গুছিয়ে রাখার ছিরি বুঝি না। নিজে বসে আছে ইউএসে, নাতনির কাছে। এখানে আমার অষ্টমির অঞ্জলির পাঞ্জাবিটাই হাপিস! এই বিজ্ঞাপনের সংলাপে নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি নাতনির কাছে ঘুরতে গিয়ে যেন অন্যায় করেছেন। তার কাজ পতিসেবা! 

আবার ফেম গেট সেট গ্লো মেকওভার বুঝিয়ে দিচ্ছে নারীকে পরিপাটি ভাবে তৈরি হতে হবে। বিজ্ঞাপনের গল্পে দেখানো হয়েছে একজন মহিলা প্রতিমা শিল্পী খুব মনোযোগ দিয়ে দুর্গা মূর্তি তৈরি করছেন। মূর্তি গড়ার কাজ শেষ হলে দেখানো হয়, প্রতিমা শিল্পীর কাকিমা গদগদ কন্ঠে বলছেন—এবার আমাদের দুর্গাকে তৈরি করি! এই বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন— এই দুর্গা পুজোয় আসল দেবীর বোধন করুন। অর্থাৎ মেকওভার করলেই আসল দেবী বোধন হবে!  

বয়ঃসন্ধিকাল ও বিজ্ঞাপন 
বিজ্ঞাপনের ফাঁদ থেকে কারোর নিস্তার নেই। বয়ঃসন্ধিকালে এমনিতে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়, সেখানে আবার বিষফোঁড়া বিজ্ঞাপনের প্রভাব।  বিজ্ঞাপন দেখে কিশোরীরা ভীষণ ভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে।  
মেকি বিজ্ঞাপন দুনিয়া একটি মিথ্যা বডি ইমেজ তৈরি করেছে। তারা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বোঝাতে থাকে মডেলদের শরীর সুন্দর। তাদের ত্বকে দাগ নেই, দাঁতে হলদেটে ভাব নেই। বিজ্ঞাপন সংস্থা তাদের লাভের জন্য ক্ষতি করে চলেছে আমাদের। কিশোরীরা বিজ্ঞাপনের প্রভাবে পড়ে নিজেদেরকে নিয়ে অখুশি থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক হবার অনেক আগে তারা শরীরের গঠন, মাপ নিয়ে সচেতন  হয়ে পড়ে। নিজেদের শরীর নিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করে। অপ্রাপ্ত বয়স্করা অবচেতন মনে লালন করতে থাকে কাল্পনিক নিখুঁত শরীরের। এর ফলে বেশিরভাগ কিশোরী রোগা থাকতে চাই, খাবার খায় না, বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকে। 

হিমালয়া নিম ফেসওয়াশের বিজ্ঞাপনের স্লোগান— হিমালয়া সবসে পেহলে।  সর্বপ্রথম এই সংস্থা ভারতীয় কিশোরীদের মাথায় ঢোকায় পিম্পল ফ্রি না থাকলে এ জীবন বৃথা! এই পণ্যের টার্গেট— কিশোরীরা। হিমালয়া ফেসওয়াশের প্রায় সব বিজ্ঞাপনে দেখা যায়— প্রথম ব্রণ হওয়ার ফলে আকাশ ভেঙে পড়ে একটি মেয়ের মাথায়। সে ব্রণের হাত থেকে মুক্তি পেতে চাই। সুন্দর ত্বক চাই। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদেরও ব্রণ হয়, তবে তাদেরকে নিয়ে কোনও সংস্থা এখন পর্যন্ত এরকম বিজ্ঞাপন তৈরি করেনি!

ছোটদের বিজ্ঞাপন
অদ্ভুত ভাবে ছোটদের বিজ্ঞাপনগুলি মূলত লিঙ্গ স্টেরিওটাইপিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কয়েকটি বিজ্ঞাপন দেখে রীতিমতো বিস্ময় জাগে! 
পিডিয়াসিওর বিজ্ঞাপনে দেখি, খেলার ছলে ছোট একটি মেয়ে তারই সমবয়সী ছেলে বন্ধুর ‘‌মা’‌ সেজেছে। ছেলেটির ঠাণ্ডা লাগলে মেয়েটি বলে— আবার অসুস্থ, এমন চলতে থাকলে বড় কী করে হবি? টিমে কীভাবে সিলেক্ট হবি? বড় স্পোর্টস স্টার কী করে হয়ে উঠবি? এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে? বড় হয়ে ছেলেটি বড় মাপের খেলোয়াড় হয়ে উঠবে, বাচ্চা মেয়েটি মমতাময়ী মা হবে!

কিন্ডার জয় বিজ্ঞাপন আবার সমাজে প্রচলিত ছেলে/মেয়ে-র রং-‌এর (নীল-গোলাপী)  ধারণাকে তাদের বিজ্ঞাপনে প্রয়োগ করেছে। মেয়েদের জন্য গোলাপী প্যাকেজিং, ছেলেদের জন্য নীল রঙের প্যাকেজিং! অযৌক্তিক ভাবে লিঙ্গ বৈষম্য এই বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হয়েছে। 

ইয়াপি নুডলস বিজ্ঞাপনের মূল চরিত্রে আছে একটা ছেলে। সে ক্রিকেট খেলছে, সংলাপ বলছে, কিন্তু এই বিজ্ঞাপনে মেয়ে চরিত্র গৌণ। সংলাপ নেই, খেলাতে অংশগ্রহণ করে না। চিয়ার্স গার্ল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।  ডাবর চ্যাবনপ্র্যাস বিজ্ঞাপনেও প্রধান চরিত্রে রয়েছে একটি ছেলে। এই বিজ্ঞাপনে মেয়েটিকে অসহায়, দুর্বল রূপে দেখানো হয়েছে। মেয়েটি বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে ঘোরে। মেয়েটি বিপদে পড়লে ছেলেরা পরিত্রাতার ভূমিকা নেয়। 

ফিল্পকার্ট তাদের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনগুলিতে বাচ্চাদেরকে বড়দের ভূমিকায় হাজির করেছে, এই বিজ্ঞাপনগুলিতে ছেলেরা বাইরে কর্পোরেট জগতে কাজ করে, পার্কে ঘোরে, মোবাইল কেনে, সেখানে মেয়েদেরকে বাড়ির কাজ, বিউটি পার্লার, গসিপ, শপিং-এ আটকে রেখেছে। তবে গুটিকয়েক ব্যতিক্রমী ধর্মী বিজ্ঞাপন ইদানিং চোখে পড়ছে।  
      
ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন—‘ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।’‌ সত্যি আমাদের গভীর ভাবনার সময় হয়েছে। এই লিঙ্গ রাজনীতির কবলে পড়ে নইলে আর যাই হোক, বিজ্ঞাপনে সমতা আসবে না। বলা হয়ে থাকে ‘Media is a mind shaper’— তাই বিজ্ঞাপনে সমতা আনতে গণমাধ্যমকে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকেও বড় পদক্ষেপ নিয়ে বিজ্ঞাপনে লিঙ্গ-সমতা নীতিমালা প্রয়োগ করা উচিত। বিজ্ঞাপন-‌দূষণ থেকে মুক্তি পেতে গেলে সামগ্রিক সচেতন প্রয়াস দরকার। এবং আমাদের, এখন যে মগজটুকু অবশিষ্ট আছে সেটিকে কাজে লাগিয়ে বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপনকে বাতিলের তালিকাভুক্ত করতে হবে; অন্যথায় প্রতিটি বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপন আসলে এক একটি মন খারাপের বিজ্ঞাপন হয়েই থেকে যাবে!

পোর্টালের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি পঠিত লেখাগুলো পরপর পাঁচদিন পুনরায় প্রকাশ হচ্ছে। আজ তৃতীয় দিন। 

ছবি  :‌ নেট থেকে সংগৃহীত
লেখক  :‌ প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

0 Comments

Post Comment