মাটি ও আকাশ

  • 23 March, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 602 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
হ্যাঁ, যদি কেউ নিক্তি মেপে বিচার করতে যায় – আমাদের দেশে মেয়েদের নোবেল নেই, তাঁরা লিজা মেইৎনার অথবা মারী কুরি হতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে বিশাল এক বিজ্ঞানরূপী হিমবাহ যখন উৎকর্ষের অভিমুখে অগ্রসর হয় – তখন কোন পাথরটি বড় আর কোনটিই বা ছোট তার বিচার চলে না। সকলের প্রচেষ্টায় আমরা কেবল একটি বিশাল উন্মুক্ত জ্ঞানের আহরণক্ষেত্র তৈরি করতে চেষ্টা করি। বিজ্ঞান, সৃষ্টি অথবা উৎকর্ষের কোনও গণ্ডিবদ্ধ যাপন হয় না। সে জন্ম-উন্মুক্ত, জন্ম-পরিব্রাজক।

এমন ভাবে লিখতে লিখতে যতই এগিয়ে যাচ্ছি, কোথাও গিয়ে যেন দেখছি প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, বিদেশ অথবা স্বদেশের পরিচিত অপরিচিত গণ্ডিগুলি কেমন ভাবে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান, সৃষ্টি অথবা উৎকর্ষের কোনও গণ্ডিবদ্ধ যাপন হয় না। সে জন্ম-উন্মুক্ত, জন্ম-পরিব্রাজক। এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতা, অথবা এক সীমানা থেকে আরেক সীমানাতে তার অনায়াস যাতায়াত চলে। তবু যখনই, হঠাৎ কোনও ক্ষণে মনের অজান্তেই স্বদেশভূমিতে এসে দাঁড়াই – সেই মাটির মানুষদের কথা বলি, মনটা যেন একটু হলেও শান্তি অনুভব করে। নিজস্বতা অনুভব করে। ‘আমার দেশ’ কথাটা তো নীরব এক প্রশান্তির মধ্য দিয়েও আমরা উচ্চারণ করতে পারি, ঢোলক অথবা ত্রিশূলের চোখরাঙানি ছাড়াই।

অসীমা চ্যাটার্জী, জানকী আম্মাল, রাজেশ্বরী চ্যাটার্জী – তিন রত্নের কথাই এখানে বলতে বসেছি। প্রথম দুজনের কাজ বৃক্ষতত্ত্বে ও রসায়নে, শেষোক্তজনের কাজ মাইক্রোয়েভ অথবা বেতারতরঙ্গের গবেষণায়। শেষোক্তজনের প্রতি কিঞ্চিৎ পক্ষপাত দেখাবো হয়তো, কারণ পেশাগত জীবনে আমিও যে কেবল সেই একই পথের পথিক তাই নয়, এমন অন্তত একজন মানুষের সান্নিধ্যে আমি এসেছি যিনি কিনা রাজেশ্বরী চ্যাটার্জীর সঙ্গেও দীর্ঘসময় ধরে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এমন একেকটি পরিচয়ের গল্প আরও বেশি করে উৎসাহ যোগায়। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কেউ তখন বলতে চেষ্টা করে, “চরৈবেতি! চরৈবেতি! লক্ষ্যে না পৌঁছানো অবধি বিশ্রামের চিন্তাও যেন না আসে ...” বৃক্ষতত্ত্ব থেকে তরঙ্গতত্ত্বের আকাশে আমাদের বাধাহীন যাতায়াত এখন।

জানকী আম্মাল, জন্ম ১৮৯৭, মৃত্যু ১৯৮৪। উদ্ভিদশাস্ত্রের গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন উদ্ভিদ প্রজননের বিষয়ে। আখ এবং বেগুনগাছের ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা প্রণিধানযোগ্য। ১৯৭৭ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। কেরালার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জানকীর জন্ম, তাঁর বাবা ছিলেন এক প্রাদেশিক রাজ্যের দেওয়ান পদমর্যাদার সমতুল আধিকারিক। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর ১৯২৪ সালে জানকী আম্মাল মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর বারবুর বৃত্তি লাভ করে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৩১ সালে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন। দেশে ফিরে এসে জানকী আম্মাল ত্রিবান্দাম রাজ-কলেজে বটানির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। দুবছর এই প্রতিষ্ঠানে থাকার পর ১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের জন ইনস ইনস্টিটিউটে তিনি উচ্চতর গবেষণার জন্য নিযুক্ত হন। এখানেই সুবিখ্যাত উদ্ভিদবিদ সি ডি ডার্লিংটনের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে। ১৯৩৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে জানকী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইউরোপে আটকে পড়েছিলেন। এই সময় অধ্যাপক ডার্লিংটনের সঙ্গে যৌথ ভাবে তিনি ‘ক্রোমোজোম এ্যাটলাস অব কাল্টিভেটেড প্লান্টস’ বইটি প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল অবধি তিনি লন্ডনের রয়্যাল হর্টিকালচারাল সোসাইটিতে গবেষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এই সময় তিনি ম্যাগনোলিয়া ফুলের বিশেষ কয়েকটি প্রজাতিকে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। দ্বিতীয়বারের জন্য স্বদেশে ফিরে এসে জানকী আম্মাল এলাহাবাদে সেন্ট্রাল বোটানিক্যাল ল্যাবরেটরির প্রথম অধিকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর জম্মুতে আরও একটি রিজিওনাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে এবং পরবর্তীতে কিছু সময়ের জন্য তিনি ভাবা এ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারেও বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আখের মিষ্টতা নিয়ে তাঁর গবেষণা এই সময়েই সমাদৃত হয়। জোড়কলম বা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ভারতীয় আখের মিষ্টতাকে আরও সুমিষ্ট করে তুলতে তিনি গবেষণা করেছিলেন। বেগুনচাষ ও বেগুনগাছের উপরে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বিষয়েও জানকীর অবদান আছে। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন থাকাকালীন অধ্যাপক আম্মাল সেখানে দরকারি সমস্ত ওষধি গাছগাছড়াগুলিরও একটি চমৎকার ফিল্ড ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন। আমরা, অধ্যাপক আম্মালের মতো একেকজনকে কেবল গুগল ডুডলের মাধ্যমে মনে রাখি। আমরা মনে রাখি না যে, লন্ডনের রয়্যাল হর্টিকালচারাল সোসাইটিতে এখনও বিশেষ এক প্রজাতির ম্যাগনোলিয়া ফুলের নাম ‘ম্যাগনোলিয়া কোবুস – জানকী আম্মাল’। এঁরা বোধহয় সত্যি সত্যিই ফুল হয়ে ফুটে থাকেন।

এদিকে জৈব-রসায়নের ছাত্রী হিসেবে নিজের কেরিয়র শুরু করেছিলেন অসীমা চ্যাটার্জী। জানকীর থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট অসীমার জন্ম সেপ্টেম্বর, ১৯১৭তে। ১৯৩৬ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক হন অসীমা। তাঁর পিতা নারায়ণ মুখোপাধ্যায় উদ্ভিদবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সেই থেকেই রসায়নে স্নাতকের পর ক্রমশ জৈব রসায়নের দিকটিতেই অসীমা আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজাবাজার সায়ান্স কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ও ১৯৪৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ভারতবর্ষের বুকে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি কিনা বিজ্ঞানের কোনও একটি শাখাতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল উদ্ভিদজাত নানা জৈবরাসায়নিক বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও তাদের সংশ্লেষ। অসীমা চ্যাটার্জীর পিএইচডির সময় স্বয়ং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও সত্যেন্দ্রনাথ বোস প্রমুখ তাঁর গবেষণায় নানা ভাবে সহায়তা করেন। পিএইচডি শেষে অসীমা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন, ম্যাডিসন ও ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ পান। প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত নানা ধরনের ওষধি গাছগাছড়া থেকে নিষ্কাশিত রাসায়নিক বস্তুর বিশ্লেষণ ও কৃত্রিম উপায়ে তাদের সংশ্লেষ বা উৎপাদনের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর গবেষণার মাধ্যমেই তিনি একাধিক ম্যালেরিয়া-নাশক, মৃগী-নাশক এমন ক্যানসারের চিকিৎসার পক্ষেও প্রয়োজনীয় উদ্ভিদজাত জৈব-রাসায়নিক ওষুধ আবিষ্কার করেন। সারাজীবনে অসীমা চ্যাটার্জী কর্তৃক লিখিত মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৪০০রও অধিক। সেই যুগে দাঁড়িয়ে এই অসম্ভব কৃতিত্বকেও যে সম্ভব করা চলে অসীমা চ্যাটার্জীরাই সেই কথাকে প্রমাণ করেছেন। প্রথমে বেথুন কলেজ এবং পরবর্তীতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেন। তাঁর পুরষ্কার ও প্রাপ্তির কথাও যদি বা বলতে হয়, কেরিয়রের শুরুতেই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিতে সম্মানিত হন। ১৯৬০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়ান্স একাডেমির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬১ রসায়নশাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরষ্কারে সম্মানিত হন। গৌরবময় এই পুরষ্কারের তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা বিজেতা। ১৯৭৫ সালে তিনি পদ্মভূষণ পদকে সম্মানিত হন, এবং প্রথম মহিলা হিসেবে ইন্ডিয়ান সায়ান্স কংগ্রেস এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল অবধি তিনি রাষ্ট্রপতি-কর্তৃক মনোনীত সদস্য হিসেবে  রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবেও কাজ করেন। মেয়েরা কখন জানি শুধুমাত্র ‘মেয়ে’ হওয়া থেকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে, গড়পড়তা সমাজ তাকে বুঝে উঠতে পারে না। সমাজের বোধহয় আরও বেশি করেই এখন যুগের উপযোগী হয়ে ওঠার সময় এসেছে। আমরা এগিয়ে চলতে চেষ্টা করছি।

রাজেশ্বরী চ্যাটার্জীর সঙ্গে যে সূত্র ধরে আমার পরিচয় বা আলাপ, তাঁরও নাম রাজেশ্বরী চ্যাটার্জী। জন্মসূত্রে দুজনেই দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা। দুজনেই বিবাহসূত্রে চ্যাটার্জী। এমনতরো সম্মিলন বড় একটা দেখা যায় না বোধহয়। প্রথমজন দ্বিতীয়জনের অধ্যাপক ও সুপারভাইজার। প্রথমজন, অর্থাৎ কি না রাজেশ্বরী চ্যাটার্জী সিনিয়র ছিলেন কর্ণাটকের প্রথম মহিলা প্রযুক্তিবিদ, পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়ান্সের অধ্যাপক। রাজেশ্বরী চ্যাটার্জীর মা কমলাম্মা দাসাপ্পাও ছিলেন সে যুগের গ্র্যাজুয়েট। সেই যুগে মহিলাদের গ্র্যাজুয়েট হওয়াটাও বড় একটা সহজ কাজ ছিল না। ১৯২২এ কর্ণাটকে জন্ম রাজেশ্বরীর। তাঁর মায়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষায় হাতেখড়ি। কমলাম্মা কেবল নিজে পড়াশোনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি। কর্ণাটকের বিধবা ও স্বামী-কর্তৃক পরিত্যক্তা মেয়েদের পড়াশোনা ও সুস্থ জীবনের জন্য তিনি নানা কর্মসূচীতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এমন একজন মায়েরই সন্তান রাজেশ্বরী। মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে গণিতশাস্ত্রে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। দুটি পরীক্ষাতেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর, ১৯৪৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়ান্সের ইলেকট্রিকাল টেকনোলজি বিভাগে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। শোনা যায় যে এই সময় তিনি সি ভি রমনের সঙ্গেও কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু, পদার্থবিদ্যায় রাজেশ্বরীর কোনও ডিগ্রি ছিল না বলে রমন তাঁকে ছাত্রী হিসেবে নিতে অস্বীকার করেন। যদিও, নিন্দুকেরা বলে থাকে রমনের সুপ্ত পৌরুষই তাঁকে একজন মহিলা ছাত্রী নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিল। রমনের মানসিক গঠন যে অনেক ক্ষেত্রেই তেমনটা সুদৃঢ় ছিল না তার প্রমাণ আমরা পরবর্তীতেও পেয়েছি। এমনকি কলকাতার কাল্টিভেশন অব সায়ান্সের গবেষণাগারে বসে তাঁর যে দীর্ঘ গবেষণার ফলশ্রুতি হিসেবে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন, শোনা যায় যে পরবর্তীকালে এই শহরের প্রতি কোনওরকম শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি সৌজন্য দেখাননি। সে বরং অন্য প্রসঙ্গে থাকুক।

এদিকে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়ান্সের ইলেকট্রিকাল টেকনোলজি বিভাগে যোগ দেওয়ার পরে পরেই, স্বাধীনতার প্রাক্কালে রাজেশ্বরী ব্রিটিশ সরকারের একটি বিশেষ বৃত্তিতে সম্মানিত হয়ে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল এঞ্জিনিয়রিং বিভাগে স্নাতকোত্তর ও আরও উচ্চতর শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সময় তিনিও জানকী আম্মালের মতোই বারবুর বৃত্তিতে সম্মানিত হয়েছিলেন। এই সময় আমেরিকান ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ডসের অধীনে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মেজারমেন্ট ডিভিশনে তিনি দীর্ঘ আটমাস হাতেকলমে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৫৩ সালে রাজেশ্বরী তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এরপর, স্বদেশে ফিরে এসে তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়ান্সের পূর্ণ সময়ের একজন অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে, একই বিভাগের অধ্যাপক শিশিরকুমার চ্যাটার্জীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় এবং দুজনে মিলে ভারতবর্ষের বুকে তাঁরা প্রথম তাঁদের মাইক্রোয়েভ গবেষণার গবেষণাগারটিকে গড়ে তোলেন। বিদ্যুৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ, ইলেকট্রন টিউব সার্কিট, ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি কমিউনিকেশন – বিশেষত এ্যান্টেনা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চ্যাটার্জী দম্পতির অবদান সারা পৃথিবীতে স্বীকৃতি লাভ করে। এ্যান্টেনা রিসার্চ এবং এ্যান্টেনা ডিজাইনের ক্ষেত্রে রাজেশ্বরী চ্যাটার্জী ও শিশিরকুমার চ্যাটার্জীর লেখা একাধিক গ্রন্থ বিশ্বজুড়ে সমাদর লাভ করে। কর্মজীবনে অন্তত ২০জন ছাত্রছাত্রীর পিএইচডি সুপারভাইজার হিসেবে রাজেশ্বরী তাঁর দায়িত্ব পালন করেন।

হ্যাঁ, যদি কেউ নিক্তি মেপে বিচার করতে যায় – আমাদের দেশে মেয়েদের নোবেল নেই, তাঁরা লিজা মেইৎনার অথবা মারী কুরি হতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে বিশাল এক বিজ্ঞানরূপী হিমবাহ যখন উৎকর্ষের অভিমুখে অগ্রসর হয় – তখন কোন পাথরটি বড় আর কোনটিই বা ছোট তার বিচার চলে না। সকলের প্রচেষ্টায় আমরা কেবল একটি বিশাল উন্মুক্ত জ্ঞানের আহরণক্ষেত্র তৈরি করতে চেষ্টা করি। সেই ক্ষেত্রে আমাদের সকলের সমান অধিকার, সমান আমন্ত্রণ।

সূত্রঃ

[১] বিনীতা দামোদরন, ‘জেন্ডার, রেস এ্যান্ড সায়ান্স ইন টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়াঃ ই. কে. জানকী আম্মাল এ্যান্ড দ্য হিস্ট্রি অব সায়ান্স’, হিস্ট্রি অব সায়ান্স, খন্ড ৫১, সংখ্যা ৩, ২০১৩

[২] দ্য মিশিগান এ্যালামনাস, খন্ড ৪২, পৃষ্ঠা ৫৩২, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান লাইব্রেরিজ, ১৯৩৫

[৩] ‘দ্য শেপিং অব ইন্ডিয়ান সায়ান্স’, পৃষ্ঠা ১০৩৬, ইন্ডিয়ান সায়ান্স কংগ্রেস এ্যাসোসিয়েশন, সভাপতির অভিভাষণ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়্যান, ২০০৩

[৪] অসীমা চ্যাটার্জী, লয়েড এম. পার্কস, ‘দ্য স্ট্রাকচার অব ভার্বেনালিন’, জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি, খন্ড ৭১, সংখ্যা ৬, মে, ২০০২

[৫] ডি. পি. সেনগুপ্ত, ‘অন হার ওন টার্মস’, দ্য হিন্দু, অক্টোবর, ২০১০

[৬] ‘দ্য নাটস এ্যান্ড বোল্টস অব এ সুপারএ্যাচিভার’, দ্য হিন্দু, এপ্রিল, ২০০২

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২৫ অক্টোবর ২০২১ 

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment