শাপিতপুরুষ (প্রথম কিস্তি)

  • 21 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 825 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
বৃত্তের বাইরে পা ফেলে ফাঁদে পড়েছে, ফেরার পথ পায় না, অথবা ফিরতে অস্বীকৃতি জানায়, এমন মানুষের জীবনদর্শন, জীবনের রহস্য, জটিল বাস্তবতা অর্থাৎ প্রচলিত সমাজ-ধর্ম ও চিন্তার বাইরের মানুষের আত্মদ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্বের ট্রাজিক বাস্তবতা চন্দন আনোয়ারের ‘শাপিতপুরুষ’ উপন্যাসের বিষয়।

[প্রথম কিস্তি]

এবার আমি মা হবো : রিমা

মানুষের মন জটিল এক গিঁট। একদিকে খুললে আরেক দিকে বাঁধে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বড়শিগাঁথা মাছের মতো পালটি খেয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে বালিশে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে রিমা। বুকের ভেতরে মরণ কামড় দিয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর এক বিষপোকা। এতো দীর্ঘকালের তপস্যা ভাঙবে, ঝড় তো আসবেই। বুকে সহ্যের পাথর বেঁধে ভয়ঙ্কর ঝড় আটকে দাঁত কামড়ে কাটিয়েছে এতগুলো বছর। অবশেষে আজ সুমনকে কথা দিয়েছে। এবার আমি মা হবো। শরীরের গভীর অন্ধকারে ঘরবাঁধা জীবন্ত ভ্রূণটাকে এবার আর হত্যা করব না। কিন্তু ভেতর-বাইরের প্রলঙ্করী ঝড় ঠেকাবে কী করে! প্রবল আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠছে সমগ্র রিমা। জ্যান্ত ভ্রূণটাই যেহেতু এই ঝড় ডেকে এনেছে, তাই পেটের উপরে হাত রাখে। বুকের জমিন পেটের গোঁয়ার  ফেটে চৌচির হয়ে গেল বুঝি আলো-বাতাস-জলের অভাবে! দম বন্ধ হয়ে আসে রিমার। ঈষৎ অন্ধকার নেমে আসে চোখে। বুকের তৃষ্ণা মেটানোর কথা ভাবতেই মা’র কথা মনে পড়ে। মাকে ডাকে রিমা — মা , মাগো, আমাকে স্তন দাও। আমার বুকে ভীষণ তৃষ্ণা...

রিমার মতি ফেরাতে পেরে লঙ্কা বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে সুমন। উত্তাপের আতিশয্যে পাশা খেলার বরের মতো বউকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে কুণ্ডলিপাকিয়ে উঁচিয়ে বিছানায় শোয়ায়। প্রথমে কপাল, তারপর দু’গাল, অতঃপর নাক, মুখ, বুক, চিবুকে ক্ষিপ্র চুম্বনের ঝড় ওঠে। সুমনের উন্মাদনা বাড়াবাড়ির চরমে এখন। লক্ষ্মী সোনা, টুনি সোনা, পিতলা ঘুঘু বউ আমার আদর-সোহাগের ঝড় বইছে সুমনের কাঁপা কণ্ঠে। বিশেষ আবেগের মুহূর্তে কী যে হিজিবিজি ভাষায় সোহাগ করে সেসব ডিক্শনারিতে মুদ্রণযোগ্য নয়।

জন্তুর মতো দুর্বোধ্য আওয়াজ তুলে অশান্ত রিমা অস্ফুষ্ট স্বরে বলে, আমার শ্বাসকষ্ট, ভীষণ শ্বাসকষ্ট। আমাকে তুমি বাঁচাও সুমন, আমাকে তুমি শক্ত করে ধরো সুমন। আর কে ধরবে, আর বাঁচাবে বলো? কোথা কেউ নেই, নিষ্প্রাণ মরুভূমি।

সুমনের বিশাল প্রশস্ত বুক মাছভাজা কড়াইয়ের মতো তপ্ত হয়ে ওঠে রিমার শরীরের ওম্ নিয়ে। ওম্ যে সুমনের বুকের চামড়া-খাঁচা অতিক্রম করে ফুসফুস উষ্ণ করে তুলছে, নিশ্বাসের ভয়ানক ওঠানামাতেই টের পায় রিমা। হবে না কেন? হতেই যে হবে। মাঘ মাসের শীতেও নারীর শরীরে যে ডিম ফুটানোর মতো ওম্ থাকে।

এ তো নারী জীবন! প্রথমে শরীরের ওম্ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে মধুকর পুরুষ। অতঃপর মধু তেতো হয়ে উঠলে, এই শরীরকেই বীজতলা বানিয়ে ফেঁড়ে-ফুঁড়ে বাচ্চা বের করে আনতে রামযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়। আর ফলন দিতে না পারলে নারীকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেবে, ঠিক মজা ফুরিয়ে যাওয়া বালকের হাতের খালি ঠোঙার মতো। নইলে সুমনের মতো প্রত্যয়ী মানুষ শেষে টিকতে পারল না! সব ভুলে গেল! কী যে টগবগে খুশি খুশি লাগছে সুমনকে! আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে সুমন, এত ভয় কিসের তোমার? গুষ্টিঠাপাই এসবের। আমরা কি অপরাধ করেছি?

জোরে শ্বাস টানে রিমা। নড়ে-চড়ে ইজি হতে চায়। রিমার থক্থকে নরোম পাতলা শরীর সোনালি লতার মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিশ্বাসের আরও কাছাকাছি মুখ নিয়ে সুমন বলে, সাইলেন্ট কেন? কনফিডেন্স বাড়াও। ড্যাম কেয়ার। নষ্ট হয়ে গেছি নাকি? পঁচে গেছি নাকি? আমাদের বিশ্বাস এতো ঠুনকো নাকি যে এতো সহজেই মাটির হাঁড়ির মতো ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। বিশ্বাস জিইয়ে রাখতে হবেই রিমা। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে শুধু শুধু বেঁচে থেকে কী লাভ? বলো? কথা বলো রিমা? তোমার নীরবতা আমাকে অস্থির করে তোলে।

নিমেষেই নীল হয়ে গেল রিমা। এলোমেলো কাঁপছে দু-চোখের পাতা। হাঁটুর ভাঁজ খুলে উঠে দাঁড়াবে বলে শরীর চেতাতেই ডান হাতে হেঁচকা টান দিয়ে ফের পাশে বসায় সুমন, বলো? কথা বলো তুমি? বিশ্বাস হারিয়ে পশু-পাখির মতো বেঁচে থেকে কী লাভ? এ বেঁচে থাকার কোন অর্থ আছে?

হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে হাত টানে রিমা, ছাড়ো। হাত ছাড়ো। নাস্তা বানাতে হবে। হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে বসে সুমন। শক্তভাবে ধরে রিমার হাত, না রিমা, কথা শোনো। এ বড় ভয়ানক কথা! তুমি তোমার নিজের জীবনকে সন্দেহ করতে শুরু করেছো। এ বড় বিপজ্জনক কথা রিমা। তুমি তোমার বিশ্বাসকে সন্দেহ করতে শুরু করেছো! প্রত্যেকের ফেরা একটি পথ থাকে, ঘর থাকে, একটি শেকড় থাকে, ছায়া থাকে। আমরা কিছুই অবশিষ্ট রাখিনি, সব শেকড় উপড়ে ফেলেছি। আমরাই এখন শেকড়। আমাদের মধ্যে থেকেই জন্ম নেমে নতুন গাছ, নতুন ছায়া, নতুন পথ, নতুন ঘর।  

সুমনের হাতের মুঠো ক্রমশ আলগা হয়ে আসে। রিমা শক্তি প্রয়োগ করেনি। স্বাচ্ছন্দ্যে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

হাত-পা টান করে শুয়ে পড়ল সুমন।

[২]

আমি মানুষের পৃথিবী চাই : প্রফেসর চৌধুরী

মধ্য আশির দশক তখন। ভার্সিটির নামি প্রফেসর ছিলেন চৌধুরী মাহমুদ হাসান। ভিন্ন মতাবলম্বী বলে দেশজুড়ে খ্যাতি-কুখ্যাতি দুই-ই ছিল প্রফেসর চৌধুরীর। নিজেকে তিনি হিন্দু কলেজের ডিরোজিওর সমগোত্রীয় ভাবতেন। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর আদলে জনা তিরিশেক বিপ্লবী ধাঁচের রাগী তরুণ-তরুণী নিয়ে ক্যাম্পাসেই গড়েন একটি চক্র। চক্র তো চক্রই। কবে যে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে আর কে যে কী নিয়ে বক্তৃতা করে আসরে বোমা ফাটিয়ে দিচ্ছে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। একজন বক্তৃতা করে শিল্প-সাহিত্যে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলে এবং রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে নোবেল না দেয়ায়  নোবেল কমিটির সদস্যদের বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে। একজন প্রচলিত ধর্ম নিয়ে তো অন্যজন বিদ্যমান সমাজ নিয়ে, একজন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে তো ভিন্নজন দুর্নীতি নিয়ে বক্তৃতা করে। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম, শ্রেণিশত্রু ইত্যাদি বিশ্বচরারের এ হেন  বিষয় নেই যে ওদের বক্তৃতায় উঠে আসে না। মাও সেতুং, লেনিনরা তো কেবল চীন-রাশিয়া নিয়ে পড়েছিল — এরা পৃথিবীর মানচিত্রটাই পাল্টে দেবার ব্রত নিয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারার মতো বিপ্লবীরা ওদের কাছে নস্যি।

প্রফেসর চৌধুরী কঠোর গাম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকেন, ওদের বক্তৃতা শুনেন। কিন্তু ভেতরে তার চাপা উত্তেজনা। ওরা স্বপ্ন দেখছে, ওরা উত্তেজিত হবেই। ওদের বক্তৃতা এলোমেলো হলেও কিছু যায় আসে না। স্বপ্ন দেখাটাই বড় কথা। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই কিনা দেশের মানুষ এভাবে ক্রোধে বিস্ফেরণে ফেটে পড়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল স্বাধীনতার রক্তিম পতাকা উড়িয়ে।

সবার বক্তৃতা শেষে প্রফেসর চৌধুরী দাঁড়িয়ে গুরুগম্ভীর ভাষায় উপসংহার টানেন। এমন একটি মানবসমাজ আমার স্বপ্ন, এমন একটি দেশ আমার স্বপ্ন, এমন একটি বিশ্ব আমি চাই—প্রফেসর চৌধুরী লোমশ হাত উঁচিয়ে বলেন, সেই সমাজে, সেই দেশে, সেই বিশ্বে মানুষ-ই সবার উপরে, আর সবকিছুই মানুষের নিচে, সবকিছুই মানুষের অধীন। মানুষের উপরে আর কিছুই আমি মেনে নিতে আমি অস্বীকৃতি জানাই। আমার এই লড়াই মানুষের পৃথিবীটাকে মানুষের হাতে তুলে দেবার লড়াই।

স্রেফ কৌতূহল মেটাতে চক্রের এক আড্ডায় হাজির হয়েছিল রিমা। গিয়েছিল চক্রের তুখোড় সদস্য মর্তুজা আলীর সাথে। এরপর থেকে রিমার জীবনের মানচিত্রের রেখাগুলো কেমন ওল্টপাল্ট হয়ে গেল। যেদিন প্রফেসর চৌধুরী ভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, আমি  একটি মানবসমাজ চাই, একটি দেশ চাই, একটি বিশ্ব চাই; সেখানে সবার উপরে থাকবে মানুষ। এই বিশ্বটাকে মানুষের হাতে তুলে দিতে চাই আমি। ঠিক সেদিনই রিমার এতকালের সব বিশ্বাস টাল খেয়ে ওঠে। রাতের পর রাত জেগে প্রফেসর চৌধুরীর কথাগুলো তর্জমা করে। নিজের মধ্যে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব আর সিদ্ধান্তহীনতা প্রবল হয়ে ওঠে।

খাতায় নাম লিখিয়ে এখনো পাকা সদস্য হয়নি রিমা। এখনো ফিরে আসতে পারে। প্রফেসর চৌধুরী একদিন শুধু নামটিই জিজ্ঞেস করেছিলেন। যে কয়দিন গিয়েছে, প্রফেসরের কথাগুলোই গুরুত্ব দিয়ে শুনেছে। চক্রের সদস্যদের গলা ফাটানো এলোমেলো বক্তৃতা শুনে হেসেছে ভেতরে ভেতরে।

চা-সিংগাড়া কেনার টাকা নেই পকেটে, দুপুরে খাবার পেটে পড়েছে কিনা সন্দেহ, এদিকে বক্তৃতা শুনলে কানের পর্দা কাঁপে, চোখ কপালে ওঠে, পিলে চমকে ওঠে, যেন আজি সশস্ত্র বিপ্লবে নামবে। এক ছেলে হঠাৎ বলে উঠল, শালা,। জনগণকে জিম্মি করে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতায় এসেছে। এখন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছে। জিন্নার রক্তের ভাই শালা! সবাই অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। রিমাও হাসে। রিমা উৎসুক হয়ে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা একবার লক্ষ করে রিমাকে। বিপ্লবের বক্তৃতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে বোধহয় মুখে গাম্ভীর্য টেনে এনে বলে, রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কিসের রে? রাষ্ট্রের কি স্বর্গ-নরকের ভয় আছে নাকি? রাষ্ট্র কি প্রার্থনা গৃহে গিয়ে প্রার্থনা করবে? ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য। মানুষের কথা না ভেবে কী করে অবৈধ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা যায় খালি এ ধান্ধাবাজি।

রিমার মাথায় চড়ক গাছ। বলে কী ছেলেটা!

কয়জন তরুণের কানে বিপ্লবের মন্ত্র দিলেই বিপ্লব হয় নাকি? বিপ্লব এতই সোজা? সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে রিমা! সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে। ওরা তোর সব কেড়ে নিয়ে ফতুর করে দেবে — তোর বিশ্বাস কেড়ে নেবে — তোর ধর্ম কেড়ে নেবে — তোর বাবা-মা-ভাই বোনকে দূরে সরিয়ে দেবে! জীবন নিয়ে এমন পাকে পড়ে যাবি, কারও সাথে মিলবে না তোর জীবন। এ মোহের ফাঁদ বড় কঠিন ফাঁদ! বিতংস। এই ফাঁদের ভেতরে খাবি খেতে খেতে খাঁচায় বন্দি পাখির মতো জীবনটাই না শেষে...।

আমি নেই, আমি নেই। চক্রের ত্রিসীমানা দিয়ে আমি রিমা আর হাঁটবো না।

গাঁজার নেশার মতো এ যে কঠিন নেশা। গাঁজা খেলে যেমন রাজা বনে যায়। দুনিয়ায় অসম্ভব বলে কিছু নেই। বিপ্লবের মন্ত্র কান দিয়ে মগজে একবার ঢুকলে বিপ্লব না ঘটা পর্যন্ত মুক্তি নেই। বাস্তবে যাই হোক, গলাবাজি আর চাপাবাজিতে ঠিকই বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ফোটে। এসব বিপ্লবীরা গাঁজারুর মতো কল্পনার রাজ্যের অধিবাসী। যত্তোসব পাগলামি! রিমা কেন যে পাগলামিতে মজে গেল! মর্তুজা বদমায়েশটার জন্যেই যত সর্বনাশ! কী কুক্ষণেই যে এ বিতংসে পা দিল! সিনেট ভবনের সামনে দিয়ে জোরে পা চালিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে রিমা। কাজ নেই, হাতে সময় আছে, তবু হাঁটছে জোরে, তুমুল ব্যস্ততার ভান। ভয় শুধু একটাই, চক্রের কোন বিপ্লবী যদি সামনে পড়ে। ভবনের করিডোর ফাঁকা। আড়চোখে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয়। শুধু একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বসে আছে। মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখে ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়েছে কি না কে জানে, নড়াচড়া নেই। সিনেট ভবনের করিডোরে বিপ্লবীদের কেউ নেই মানে এ যাত্রায় বাঁচা। রিমা এবার ধীর-শান্ত। স্বস্তির মন নিয়ে হাঁটছে। এক টাকার বাদাম দে, বলে দাঁড়াল বাদাম বিক্রেতা ছেলেটির সামনে। বাদাম নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরেই চমকে ওঠে রিমা। চক্রের সবচেয়ে উঁচালম্বা সুদর্শন ছেলেটি সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে রিমার দিকে তাকিয়ে আছে বিদ্ধচোখে।

রিমার মতে চক্রের সদস্যদের মধ্যে চোখে ধরার মতো ছেলে এ একটি-ই। ওর নিজস্ব সংজ্ঞায় ছেলেটি ব্যক্তিত্ববান। সুপুরুষ। চক্রের আড্ডায় তীব্র তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো লক্ষ্যভেদী বক্তৃতা করে। নজরুল-সুকান্তের বিপ্লবের কবিতা আবৃত্তি করে ভরাট কণ্ঠ কাঁপিয়ে। ওর বক্তৃতা বা কবিতা শুনলে যে কোন মানুষের শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে উঠবে, রক্তে আগুন জ্বলে উঠবে, এবং বিপ্লবের বিকল্প নেই বলে সিদ্ধান্ত দেবে। ধর্ম-বর্ণ-ধনী-গরিবের সব ব্যবধান লেপেমুছে এক করতে প্রাণত্যাগী যুদ্ধেও প্রস্তুত ছেলেটি। ছেলেটির একদিনের বক্তৃতার কথা মনে হলে রিমার এখনো হাসি পায়।

এক আড্ডায় হঠাৎ এই ছেলেটি লাফিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। সটান দাঁড়িয়ে স্প্রিং-এর মতো হাত পা ছুঁড়ে বক্তৃতা শুরু করলে প্রফেসর চৌধুরীসহ সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় তার দিকে। বেটা বুড়ো রবীন্দ্রনাথ কি পারতো না? কী বলেন আপনারা? সবাই তো হতবাক! কী বলতে চাইছে ছোকড়াটা? দম ফাটা কৌতূহল তৈরি করে ছেলেটা জড় পদার্থের মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল। রিমা ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, পলকহীন চোখ, ফর্সা মুখের কালো রগগুলো তিরতির করে কাঁপছে। প্রফেসর চৌধুরী চোখ লাল করে তাকাতেই ঢেকুর গিলে ছেলেটি বলে, আমি মনে করি স্যার, নজরুল যেমন প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেছে, গুরুদেবেরও উচিৎ ছিল একজন সকিনা-জরিনাকে বিয়ে করে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করা। রিমার বুক ফেটে হাসি বেরিয়ে আসলেও সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর হাসতে পারেনি। কারণ, সবাই বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। প্রফেসর চৌধুরী ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা তৈরি করে হঠাৎ ছেলেটির মনে জেগে ওঠা উদ্ভট আবেগকে মর্যাদা দেন।

বিপ্লবীদের একজনও নেই। ছেলেটি একা এখানে কী করছে? আর দেখো, কিভাবে তাকিয়ে আছে? ছেলেটির পলকহীন বিদ্ধচোখের চাহনির টান রিমাকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। ওর পা আর সামনে চলে না। ছেলেটির মুখোমুখি হয়ে কথা বলার লোভ আছে, তাই বলে এইখানে! এই নির্জনে! আর দেখো, স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে কী ভাবে? হাঁটবে বলে পা বাড়াতেই ছেলেটি বানরের মতো এক লাফে রিমার সামনে হাজির। রিমার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।

এ অসময়ে আপনি? ছেলেটি যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল।

ছেলেটির মুখের দিকে একবার তাকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় রিমা। মানুষের চোখ দুটি কেন যে মুখের মধ্যেই থাকে, হাঁটুতে থাকলে কী হয়? অগত্যা ছেলেটির বুক বরাবর তাকিয়ে কথা বলে রিমা, রুমে ক্লান্ত লাগছিল, তাই একটু বের হওয়া। আপনি ভীষণ ভালো বক্তৃতা করেন। আমি তো রীতিমতো আপনার বক্তৃতার ভক্ত।

এমন প্রশংসা শুনে ছেলেটি লজ্জা পাবে ভেবে মুখের দিকে তাকিয়ে রিমা থ। ছেলেটির চোখ যে রক্তের মতো লাল! গাঁজা-ভাং খেয়েছে কি না? এবার ভয়ই পেয়ে গেল রিমা। এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। তখনি ছেলেটি বলে, আমি এক কঠিন বিপদে পড়ে গেছি। আপনি ছাড়া আশেপাশে আর কাউকে দেখছি না বলেই ছুটে এসেছি। রিমা মুখ তুলে তাকাতেই ছেলেটি বলে, ঐ দেখুন, আমার চোখের ভেতরে কিছু একটা পড়েছে। কচলে চোখ ফুলিয়েছি, কিন্তু বের হচ্ছে না। ভীষণ ব্যথা করছে। হাতের বাদাম ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে রিমা বলে, বসে পড়ুন, এখানেই বসে পড়ুন। এত লম্বা মানুষ, আমি দাঁড়িয়ে দেখি কী করে?

ছেলেটি হাঁটু ভাঁজিয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে পড়ল। এক হাতে ছেলেটার মাথা সামান্য হেলিয়ে অন্য হাতে চোখের পাতা উল্টে দেখে রিমা ছোট্ট কালো একটা পোকা চোখের চামড়ার সাথে সেঁটে আছে। ওড়নার এককোণা প্যাঁচিয়ে চোখের পোকা বের করার সময় রিমা টের পায়, ছেলেটির গাঢ় নিশ্বাস ওর নাভি বরাবর গিয়ে পড়ছে। পোকা বের করে হাতে দিতেই ছেলেটি লাফিয়ে ওঠে, জীবনে এমন কঠিন বিপদে আর কখনো পড়িনি। রিমা হেসে ওঠে, সশস্ত্র বিপ্লব করার জন্য যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত আপনি, আর সামান্য একটা পোকার কাছে এই নাজেহাল!

ছেলেটির মুখে কোমল হাসি। আপনি বাঁচালেন। কিন্তু আপনার নামটাই তো জানা হয়নি। আড্ডায় যদিও আপনাকে দেখেছি, কিন্তু জানেন তো, উপযাচক হয়ে আমি কারো কাছে যাই না।

হুঁ। তাই তো দেখছি। আমার নাম ফারাহ মেহজাবিন রিমা। থার্ড ইয়ার, সোস্যাল সাইন্স। আপনার নাম কিন্তু আমি জানি — সুমন। কোন সাবজেক্ট ওটা জানি না।

বাহ! আপনি ভীষণ ট্যালেন্ট মেয়ে। কথা বলেন দারুণ স্মার্টলি। আপনি দেখতে অপূর্ব সুন্দরী। একথা অবশ্য আমার আগে অনেক ছেলেই বলেছে। যা হোক, আমার ধারণা আপনি আমার পুরো নামটি জানেন না। আমার নাম সুমন কুমার গাঙ্গুলি, ফিজিক্স, মাস্টার্স। 

হঠাৎ একটা রিকশা ওদের পেছনে দাঁড়াল। দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে স্বয়ং প্রফেসর চৌধুরী। রিমা চমকে ওঠে, অ্যা! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত! এবার পালাব কোথায়? কী কুক্ষণে যে রুম থেকে বের হলাম!

তোমরা দুজন এখনি আমার চেম্বারে এসো। আদেশ করেই চালককে হাতে ইশারা করেন প্রফেসর চৌধুরী।

না গেলে স্যার মাইন্ড করবেন,  চলুন যাই, বলেই সুমন হাঁটতে শুরু করে।

রিমার আর কিছু করার নেই। সুমনের পেছনে হাঁটছে।

তোমরা দুজনে বসে গল্প করো। আমি ক্লাসটা নিয়ে আসি। প্রফেসর চৌধুরী বেরিয়ে যাবার সময় রুমের দরজা প্রায় ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন।

রুম একেবারে ছোট নয়। বইয়ের আলমারি, ফ্লোরে ছড়ানো ছিটানো বইয়ের স্তূপের মধ্যে প্রফেসর চৌধুরীর চেয়ার, চৌকোণা একটি কাঠের পুরনো টেবিল ও টেবিলের সামনে হাতলহীন দুটি চেয়ার আছে। একটি চেয়ার আবার পঙ্গু, একটি পা খর্বাকৃতির। যে কোন মুহূর্তে হেলে যেতে পারে। সুমন বসেছে বেশ সতর্কভাবে। রুমে একটিই জানালা। গাঢ় লাল রঙের পর্দা ঝোলানো। মাথার ওপরে একটি পুরনো ফ্যান ঘুরছে। রুমের আবহ বেশ ঠাণ্ডা। লালপর্দার কারণে রুমের আলো লালবরণ।

ফাঁদে ভালোভাবেই পড়েছি। স্বগতোক্তি করে রিমা। স্যারের আক্কেলটা দেখো! এ বয়সের দুটি ছেলে-মেয়েকে এক রুমে গল্প করতে বসিয়ে গেলেন। বুক কাঁপছে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো —গল্প হবে না ছাই! আর এই বেচারার কথা ভাবো! প্রায় বন্ধ ঘর, জলজ্যান্ত এক যুবতী কাঁধে শ্বাস ফেলছে— রক্তের উজানের টান যদি বিপদসীমা অতিক্রম করে? ছেলেটির মাথায় যদি লাল সিগন্যাল জ্বলে ওঠে? তখন কী ঘটবে কে জানে! রিমার গলা শুকিয়ে কাঠ। পানি পাবে কোথায়?

রিমার শরীরে শরীর লাগার ভয়ে পঙ্গু চেয়ারটার উপরে গুটিসুটি মেরে  বসে আছে সুমন। এত বেশি সতর্ক হওয়া কি দরকার? স্বাভাবিক হয়ে বসলেই হয়। বাঘ আর ছেলেরা একই জাতের—শিকার ধরতে প্রথম সাধু সাজে। শিকার বশে পেলেই এক লাফে ঘাড় মটকায়। পাঁচ-দশমিনিটের ব্যাপার তো নয়, চল্লিশ মিনিটের মামলা, এভাবে কতক্ষণ...। রিমা মনে মনে বলে, একটা জ্যান্ত যুবতী পাশে বসে সাত-পাঁচ ভাবছে, আর তার কোন হেলদুল নেই! উনি আবার বিপ্লবী! বক্তৃতায় দিগ্‌জয়ী। এবার সাহস করে রিমা তাকায়। নিচে থেকে একটা বই তুলে নিল সুমন। এলোমেলো পৃষ্ঠা উল্টানো ছাড়া পড়ছে বলে মনে হয় না। টকটকে ফর্সা মুখের উপরে লাল আলো পড়েছে। কপালে ভাঁজে, ফুলে ওঠা পেশী, চিবুকের কাঠামোতে ফিরে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে রিমার।

লোভের আগুন রিমাকে জালের মতো ছেয়ে ফেলেছে। ঝড়ের মতো ধেয়ে আসে প্রমত্ত লোভ...ছি ছি ছি...সর্বনাশ...এসব কী ভাবছি!

আপনি ঘামছেন। অস্বস্তি হচ্ছে বোধ হয়। এখনো তো ২০ মিনিট। ইচ্ছে করলে ঘুরে আসতে পারেন বাইরে থেকে। আমি আছি। সুমন বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোর ফাঁকে কথা বলে।

না, ঠিক আছে। আর তো মাত্র ২০ মিনিট। এছাড়া গরমও নেই তেমন। ওড়নার আঁচল দিয়ে ঘাম মোছে রিমা।

ঘামছেন তো, তাই বললাম।

জ্বলন্ত আগুনে জল ঢেলে দেওয়া কাকে বলে। এ কোন ধাতুর তৈরি মাল রে বাবা! যন্ত্রপাতি ঠিক আছে তো? পাশের যুবতী যা-তা ভেবে, ঘেমে, কেঁপে একশেষ, আর সে কি না... রিমা এবার হিস্ করে ওঠে।

আমি আবার কাঠখোট্টা টাইপের মানুষ। নিঃসঙ্গ নির্বন্ধু একজন মানুষ। টানা এক বছর টিকেছে এমন বন্ধু খুব বেশি হয়নি আমার জীবনে।  

আপনি কাঠখোট্টা টাইপের মানুষ! এ কথা কে বলে আপনাকে?

ছেলেবেলা থেকে তাই শুনে আসছি। ইমোশনলেস, ফিলিংলেস ইত্যাদি কত বিচিত্র শব্দ...

কে বা কারা বলেছে আমি জানি না। বড় প্রেমিক না হলে বড় বিপ্লবী হতে পারে না। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ঐ লাইন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য’। আপনার মধ্যে প্রেম আছে বলেই না এভাবে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারেন। সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর।

বাহ! দারুণ আবিষ্কার। আমি তো এভাবে ভাবিনি। আমি প্রথাধর্ম মানি না, সমাজ মানি না, রাষ্ট্র মানি না, এই যে মানি না মানি না করে চেঁচাই তার পেছনের যুক্তি হাতড়ে বেড়াই। মাঝে মাঝে এ কথাও ভাবি, দশজনের মতো স্বাভাবিক মানুষ হলেই বোধহয় সুখ। বিয়ে করা, বাচ্চা জন্ম দেওয়া, চাকরি-বাড়ি-গাড়ি-সুখ-সংসার এসব আমার কাছে প্রহসন, প্রহেলিকা। এসবে আমার মন সায় দেয় না। 

কিছুই না। আপনি নিজেকেই খুঁজে ফিরছেন। যেদিন আপনি নিজেকে চিনে ফেলবেন সেদিন নজরুলের মতো বলে উঠবেন, ‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’

কী হলো কে জানে! ইউরেকা বলে লাফিয়ে ওঠে সুমন! মাথা বিগড়ে গেল পঙ্গু চেয়ারটার। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। চারদিকে বই, বইয়ের স্তূপের উপরে পড়ে জবাই করা গরুর মতো সুমন সমানে ছুঁড়ছে চার হাত-পা। হাতির মতো শরীর টেনে তোলা কি সম্ভব? নিরুপায় হয়ে চেয়ারে বসেই সুমনের হাত ধরে টান দিতে গেলে রিমার চেয়ারটাও উল্টে যায়। শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে এবার রিমা নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল সুমনের কম্পিত বুকে। এখন কে কাকে বাঁচায়? কে কাকে তোলে? সুমনের বুকে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল রিমা। সুমন যেন ফ্লোরে পা রেখে উঠে বসতে পারে এ জন্যে চারপাশের বইগুলো সরিয়ে দিল। অবশেষে সুমন উঠে বসে এবং রিমার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার ওড়নাটা...। রিমা খেয়াল-ই করেনি। ওর বুকের ওড়না ফ্যানের বাতাসে উড়ে গেছে। প্রফেসর চৌধুরীর চেয়ারের উপরে পড়ে আছে। ঠিক এই সময় দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করেন প্রফেসর চৌধুরী। যা! এবার পালাবে কোথায়? পৃথিবীর সমস্ত আড়াল সমস্ত পোষাক অতি সামান্য এই মুহূর্তে রিমার বুক ঢাকার জন্যে।

প্রফেসর চৌধুরী বসেননি। ওড়নাটা হাতে নিয়ে রিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ভাইস-চ্যান্সেলরের জরুরি তলব, তাই ক্লাস ছেড়ে এসেছি। তোমরা চলে যাও। পরশু বিকেল ঠিক পাঁচটায় আড্ডা। ভুল হয় না যেন।

রিমা আর কোনদিকে তাকাল না। ছুটে বেরিয়ে গেল। সুমন পিছু ছুটেছিল কিছুক্ষণ। পাত্তাই দিল না রিমা। শরীরের সমস্ত শক্তি পায়ের উপরে চালান করে জোরে হাঁটে। রুমে পৌঁছার আগে পর্যন্ত একবারও পেছনে তাকায়নি রিমা। সুমনের ধাবমান পদশব্দ যেন ওকে আততায়ীর মতো তাড়া করে।  [চলবে...]

২০১০-এ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। ২য় সং ২০১৭।

লেখক  : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ )

 

0 Comments

Post Comment