পতি বিনা রমণীর গতি নাহি আর

  • 19 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1470 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
‘‌পতি বিনা রমণীর গতি নাহি আর’‌—এই প্রবাদ শোনেননি তেমন মেয়ে ভূভারতে আছেন কি? আমাদের দেশে কোনও পরিবারে যদি একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মায়, কন্যাসন্তানটি সেই একরত্তি অবস্থাতে টের পেয়ে যায়, তার কেয়ার গিভার অর্থাৎ মা-বাবা, পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের (ভাই-বোন) দুজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করছেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ছোট অবস্থাতে একটি মেয়ের মাথায় গেঁথে দেয় তার জীবনের আসল উদ্দেশ্য বিয়ে। চাকরি, মা-বাবার দায়িত্ব গ্রহণ এসব তার জন্য গৌণ। 

‘‌পতি বিনা রমণীর গতি নাহি আর’‌—এই প্রবাদ শোনেননি তেমন মেয়ে ভূভারতে আছেন কি? নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকেই মেয়েদের বিয়ে প্রসঙ্গে অনেক কথা শুনতে হয়। বলাই বাহুল্য, একটি শিশুকন্যার বিয়ের  প্রস্তুতি জন্মের পর থেকেই শুরু হয়ে যায়। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের সময়, অর্থাৎ ৮ বছর বয়স পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সময় শিশুর অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা তার সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। 

আমাদের দেশে কোনও পরিবারে যদি একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্মায়, কন্যাসন্তানটি সেই একরত্তি অবস্থাতে টের পেয়ে যায়, তার কেয়ার গিভার অর্থাৎ মা-বাবা, পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের (ভাই-বোন) দুজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করছেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ছোট অবস্থাতে একটি মেয়ের মাথায় গেঁথে দেয় তার জীবনের আসল উদ্দেশ্য বিয়ে। চাকরি, মা-বাবার দায়িত্ব গ্রহণ এসব তার জন্য গৌণ। 

আলোচনার সূচনায় বলেছিলাম, জন্মের পর থেকেই একটি শিশুকন্যার বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এবার দেখে নেব কীভাবে জন্মের পর সেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হচ্ছে। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর প্রচলন বিশ্বের  অন্যান্য দেশের মতো, আমাদের দেশেও রয়েছে। শিশুকন্যাকে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ানোর সময় মায়ের গলায় শোনা যায়—
দোল দোল দুলুনি
রাঙা মাথায় চিরুনি
বর আসবে এখনি
নিয়ে যাবে তখনি
অর্থাৎ বর এসে নিয়ে যাবে এটাই ভবিতব্য! এরপর শিশুকন্যাটি ধীরেধীরে যে ছড়াগুলি শেখে সেগুলি একনজরে দেখে নেব— 
চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে,
কদম তলায় কে?
হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে,
সোনামণির বে

পুটু যাবে শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে যাবে কে?
ঘরে আছে কুনো বেড়াল কোমর বেধেছে

আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে
               দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি সংসার কাঁদায়ে

যমুনাবতী সরস্বতী, কাল যমুনার বিয়ে
               যমুনা যাবেন শ্বশুরবাড়ি কাজিতলা দিয়ে

শিশুকন্যার মানসিক বিকাশের সময় কৌশলে তাকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। শিশুর খেলনা নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে লিঙ্গবৈষম্যমূলক খেলনা শিশুদের দেওয়া হয়ে থাকে। পুতুল, বাসনকোসন, গয়না শিশুকন্যার খেলনা। অপরদিকে শিশুপুত্রদের খেলনা ব্যাটবল ,বাইক, জাহাজ! শিশুকন্যারা পুতুলের বিয়ে দেয়। তাদের শেখানো হয় মেয়েদের রান্নাবান্না জানতে হবে, সেলাই শিখতে হবে। ঘরের কাজে নিপুণ হতে হবে। রান্না না জানলে ছিছিক্কার হবে‌—‘‌ছি ছি ছি রানি রাঁধতে শেখেনি, শুক্তনিতে ঝাল দিয়েছে অম্বলেতে ঘি!’ রানিকে রান্না জানতে হবে। রাজার রান্না শেখার প্রয়োজন নেই! 

প্রথমপাঠে শেখানো হচ্ছে খোকারা বীরপুরুষ—মাছ ধরতে যাবে ক্ষীরনদীর কূলে। খুকু লক্ষ্মী তাই—পদ্ম দিঘিতে জল আনতে যাবে। ছোট থেকে ভালো বরের আশায়, পুত্রলাভের আশায় মেয়েদের নানান ধরনের ব্রত করানো হয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জানানো হয়—‘‌স্বামীর পায়ের নিচে বেহেশত।’‌ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সুচারু ভাবে এই বিভেদ সৃষ্টি করেছে। কালের নিয়মে আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে এই বিভাজন। তাই আমরাও নতিস্বীকার করি পিতৃতন্ত্রের কাছে। একটি মেয়ের ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সমস্ত কিছু বিয়েকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। ভালো পাত্র পাওয়ার আশায় অভিভাবকেরা  মেয়েকে নাচ শেখান, গান শেখান, ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পাঠান! ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়ে ডিগ্রি অর্জন করে স্বাবলম্বী হওয়াটা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিয়ের বাজারে কদর বাড়ানোটাই মূল উদ্দেশ্য।  

আমাদের সমাজ বিয়েজাদুর জালে মেয়েদের অতি সহজে জড়িয়ে ফেলে। সবকিছুর মুশকিল আসান বিয়ে। ছোট থেকে একটি মেয়ের কান ভোঁতা হয়ে যায় এইসব পরিপ্রেক্ষিতে  বিয়ের কথা শুনে—  
পড়াশোনায় ভাল ফল হচ্ছে না, সমাধান বিয়ে।
সুন্দরী মেয়ে বেশি পড়াশোনা করে কাজ নেই, সমাধান বিয়ে।
উড়নচণ্ডী মেয়ে, সমাধান বিয়ে
চাকরি জুটে গেছে, এবার বিয়ে
বয়স বেড়ে যাচ্ছে, এবার বিয়ের পালা। 
স্ত্রীরোগঘটিত সমস্যা, সমাধান বিয়ে। 
এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিয়ে দিয়ে মেয়েদের স্বাবলম্বী করতে চান আমাদের দেশের অভিভাবকরা। মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার পিছনে প্রধান যে কারণগুলি থাকে সেগুলি হল—
ক) সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা 
খ) সামাজিক চাপ
গ) অভিভাবকের দায়িত্ব পূরণ 
মেয়েরা মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া বিয়ে করতে রাজি হন বেশ কিছু কারণে— 
ক) পারিপার্শ্বিক চাপ
খ) পারিবারিক চাপ
গ) আবেগে উদ্বেলিত হয়ে
ঘ) বিলাসবহুল জীবনযাপনের মোহে

আমাদের চমৎকার সমাজ ব্যবস্থা বিশ্বাস করে অসহায় অবলাদের একমাত্র আশ্রয় প্রদান করতে পারেন একজন পুরুষ। তাই একজন মহিলার নিজস্ব বাড়ি কখনও থাকে না। বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর বাড়ি, ছেলের বাড়িতে সারাজীবন আশ্রিত থাকতে হয়। যেহেতু মহিলাদের বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে পদদলিত করে রাখতে পেরেছে এই সমাজ, তাই তারা মনেপ্রাণে চায় আগামীতেও এই একই ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকুক। তারা চায় সেবাদাসী, সন্তান উৎপাদন যন্ত্র। কম খেতে দিয়ে, সম্পত্তির ভাগ না দিয়ে, সু্যোগ না দিয়ে, মগজধোলাই করে যত মহিলাদের দাবিয়ে রাখা যাবে ততই তাদের লাভ!

মহাসমারোহে বিয়ে হওয়ার পর কোন কোন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দন্তবিকশিত করে কী আনন্দ কী আনন্দ কত সুখ হে প্রভু বলে সুখে ভেসে যান, কিন্তু সকলের জীবনে সেই সুদিন আসে না। অধিকাংশ মেয়েদের সমন্বয় সাধন করে চলতে হয়। বিয়ে নিয়ে যে স্বপ্ন থাকে তা অচিরেই ধ্বংস হয়ে যায়।
২০১৮ সালের ‘‌ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর’‌ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের এক তৃতীয়াংশ  (৩১.৯%) বিবাহিত মহিলারা, স্বামী কিংবা স্বামীর আত্মীয়দের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। (তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অনলাইন, ৩০ এপ্রিল, ২০২০)

২০১৮ সালে গার্হস্থ্য হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ অন্য রাজ্যের থেকে এগিয়ে ছিল। ওই বছরেই ১৬৯৫১ টি গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে ১৬৮০০ ঘটনা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের পর উত্তরপ্রদেশের স্থান। সেখানে গার্হস্থ্য হিংসার মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ১৪২২৩ টি। পণের দায়ে ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে খুন হয়েছে ৩৫৬ জন। এক্ষেত্রেও বাকি সব রাজ্যকে পিছনে ফেলে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থানে আছে। ২০১৭ সালে পণের জন্য এই রাজ্যে মারা গেছিল ৪৯৯ জন। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে এই রাজ্যে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে ৪৪৫ জন মহিলাকে। (তথ্যসূত্র: ইটিভিভারত.কম, ১০ /১ /২০২০)

বিয়ের পর সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, নিজের মা-বাবার বাড়ি ছেড়ে নতুন মানুষদের সঙ্গে বাস করতে হয়। এরফলে কিছু মেয়ের সমস্যা হয়। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা ও অসহায়তা দেখা দেয়। একসময় মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা থেকে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বিবাহিত মহিলাদের সাংসারিক চাপে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই কারণ থেকে অনেক মহিলা অবসাদে ভোগেন। স্বাধীনচেতা মহিলাদের বিয়ের পর অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তাদের নিজস্ব মতামত যখন সংসারে প্রাধান্য পায় না, অথবা নিজের পেশা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে গেলেও স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির অনুমতি নিতে হয়, তখন তাদের মধ্যে নিজস্বতার বোধ লুপ্ত হতে থাকে। দায়িত্ব-কর্তব্যের যাঁতাকলে অনেক মহিলা নিজের মতো করে জীবন উপভোগ করতে পারেন না ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে।

সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে একজন মহিলা দৈনিক সাড়ে বারো ঘন্টা সাংসারিক কাজে ব্যয় করেন সেখানে একজন পুরুষ মাত্র আড়াই ঘন্টা সাংসারিক কাজ করেন। বেশিরভাগ দম্পতি সাংসারিক দায়িত্ব ভাগ করে নেন না। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব একা পালন করতে করতে মহিলারা একাকীত্ব আর হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। সন্তানকে কেন্দ্র করে অনেক সমস্যা পোহাতে হয় একজন মহিলাকে। আমাদের সমাজে সন্তান জন্ম দিতে না পারলে, প্রথমেই নারীদের দিকে প্রশ্নবান ধেয়ে আসে! কী হল, বিয়ে তো অনেক দিন হল, এখনও কোনও খবর নেই। কবে মা হবে? কোন সমস্যা আছে?‌— ইত্যাদি ইত্যাদি। মা-বাবা হওয়া একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই নিয়ে লোকের যে কী পরিমাণ মাথা ব্যথা! উফ, ভাবা যায় না। উচ্চ শিক্ষিত থেকে অর্ধ শিক্ষিত সকলেই একটা  পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করেন এ ক্ষেত্রে। সন্তানহীন নারীকে অহরহ বিশেষিত করা হয়— বাঁঝা, বন্ধ্যা বিশেষণে। আবার যাদের সন্তান থাকে তারাও সমস্যার সম্মুখীন হন। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর অনেক মহিলা পোস্ট পার্টাম অবসাদে আক্রান্ত হন। এইসময় পরিবারের লোকজনের সমর্থন বিশেষ ভাবে প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ মহিলারা এইসময় পারিবারিক সহায়তা পান না! অনেক সময় সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর নানা ভাবে মাকে অবহেলা করে, কষ্ট দেয়। এতেও একজন মহিলা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

বিবাহিত মহিলারা বিভিন্ন কারণে নির্যাতন কিংবা প্রবঞ্চনার শিকার হন।  কয়েকজন বিবাহিত মহিলা ও তাদের  আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে তাদের ইচ্ছা, কষ্ট, সমস্যা, অপ্রাপ্তি, হতাশা খোঁজার প্রাথমিক একটি  প্রয়াস করেছি। কয়েকজন মহিলার ঘটনা এই আলোচনায় তুলে ধরছি।
 
নাবিলার কথা (নাম পরিবর্তিত )
‘মেনে নিতে রাজী যাবতীয় কষ্ট, 
অনাহার, অনিদ্রা, যন্ত্রণা, শোক!
শুধু প্রতিটি মানুষের মনে একটি করে 
মানুষের বাস হোক।’ 
রুদ্র গোস্বামী

আমাদের দেশের মানুষদের কখনও উন্নত মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। বিবাহিত মহিলাদের মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহ আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় আমরা মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। নাবিলা মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব চাষির মেয়ে ছিলেন। সুন্দরী ছিলেন তাই বড়লোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল। এই অসম বিয়ে তার জীবনে বয়ে নিয়ে এসেছিল একরাশ যন্ত্রণা। তাঁর শাশুড়ি কোনদিন তাকে ভরপেট খেতে দিতেন না। উদয়াস্ত হাড় ভাঙা খাটুনি খাটতে খাটতে তিনি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বাপের বাড়িতে অভিযোগ জানিয়ে কোনও সুরাহা পাননি। একসময় অত্যাচারের মাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠলে তিনি বাপের বাড়ি যান, ততদিনে তিনি এক পুত্রের মা। তিনি বাপের বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিলেন— শ্বশুরবাড়ি আর যাবেন না। কিন্তু লোকে কটু কথা বলবে বাপের বাড়ি থাকলে, তাই তাকে বাধ্য করা হয় শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে।  কিছুদিন পরে তিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তবে তিনি সত্যিই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি খুন হয়েছিলেন সে বিষয়ে রহস্য থেকে গেছে!  নাবিলা মারা গেছেন ১৯৮১ সালে অনেক অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, হতাশা নিয়ে। আজকে এতবছর পরেও আমাদের সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। নাবিলার মতো কত প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে!

ইরুর কথা (নাম পরিবর্তিত )
‘আমার কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু প্রাপ্য ছিল,
একখানা ঘর সবার মতো আপন করে পাবার,
একখানা ঘর বিবাহিত, স্বপ্ন ছিল রোজ সকালে একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খাবার।’‌ 

নির্মলেন্দু গুণ

আমার বন্ধু ইরু ছোট থেকে বাধ্য মেয়ে ছিল। তার চাওয়া-পাওয়া খুব কম। এ জীবনে সে চেয়েছিল তড়িঘড়ি বিয়ে করে, জমিয়ে সংসার করতে। কলেজ শেষ হতেই তাকে পাত্রস্থ করা হল। খুব আনন্দ সহকারে সে নতুন সংসার করতে পাড়ি দিল দূরদেশে। যাইহোক, তারপর তার সাথে আমার যোগাযোগ কালের নিয়মে কমে গিয়েছিল। কদাচিৎ ফোন করত। নিজের থেকে বেশি বরের কথা বলত‌।  সংসার, শান্তির আবেশে তার গলা বুজে আসত। বেশিরভাগ সময়ে আমার বিরক্ত লাগত এত আদিখ্যেতা! তবুও, চুপ করে শুনতাম ওর কথা। একদিন ইরু খুব হৈ হৈ করে ফোন করল। তারা নাকি ফ্যামিলি প্ল্যানিং শুরু করে দিয়েছে। নতুন অতিথির জন্য কেনাকাটা শুরু করেছে। তার বর নাকি ছেলে/মেয়ের নামের শর্ট লিস্ট করে ফেলেছে। আনন্দে ইরু ছোট্ট মেয়ের মত লাফাচ্ছিল। প্রত্যাশিত ফোন এল কয়েক মাস পরে। ইরু প্রেগন্যান্ট। বিদেশে থাকার সুবাদে সে জেনে গিয়েছিল কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে। ওর প্রিয় উপন্যাস কঙ্কাবতী। তাই কন্যার নাম রাখবে কঙ্কাবতী, আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে কথা জানিয়েছিল। তারপর  অনেকদিন ইরুর ফোন পাইনি। ভেবেছিলাম হবু মা ব্যস্ত আছে। কিছুদিন পরে খবর পেলাম, ইরু ভালো নেই। মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। তারপর ইরু বেশ কয়েকবার মা হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবার এক ঘটনা ঘটেছে। ইরু আর কোনও দিন মা হতে পারেনি, সেই অপরাধে ইরুকে ওর বর ডিভোর্স দিয়েছে। ইরু ওর সুখের সংসার ছেড়ে কয়েকবছর হল, দেশে ফিরে এসেছে। তারপর আর বিয়ে করেনি। একাই থাকে। আমি কোনদিন জানতে চাইনি, কেন আর বিয়ে করেনি! একবার আমায় বলেছিল, এই বেশ ভালো আছি!

মায়সার কথা (নাম পরিবর্তিত)
‘প্রতিদিন কিছু কিছু ইচ্ছা মরে যায় 
অনিচ্ছাকৃত মরে যেতে হয় 
অযত্নে মরে যায়। 
প্রতিদিনই কিছু কিছু ইচ্ছারা 
নির্বাসিত হতে বাধ্য হয় 
নির্বাসিত হয়। 
ব্যর্থ প্রেমের মতো কিছু কিছু ইচ্ছা 
স্মৃতির অসুখে ভোগে দীর্ঘদিন, 
কিছু কিছু ইচ্ছা স্বইচ্ছায় হত্যা করি 
ইচ্ছার হননে বিবর্ণ হই বারবার 
তবু হত্যা করতেই হয়।’‌
রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ

মায়সার ছোট থেকেই পড়াশোনা করতে খুব ভালবাসত।
তার ইচ্ছা ছিল চাকরি করার। মাস্টার্স শেষ করে সে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু তাকে পারিবারিক চাপে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিয়ের আগে পাত্রপক্ষকে মায়সা জানিয়েছিল, বিয়ের পর সে চাকরি করবে। পাত্রপক্ষ তখন মায়সার পক্ষে সম্মতি দিয়েছিল। মায়সা নিমরাজি হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। বিয়ের পর মায়সা উপলব্ধি করে সে জীবনের বড় ভুল করে ফেলেছে। বিয়ের পনেরো দিনের মধ্যে মায়সার কাঁধে পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি হজ করতে যাবেন বলে বাড়িতে রাজ্যের লোকের আনাগোনা শুরু হয়। ফলে মায়সাকে দিনরাত্রি রান্নাঘরের কাজ করতে হত। মায়সার দুই বিবাহিত ননদ বেশিরভাগ সময় সপরিবারে বাপের বাড়িতে এসে থাকে। সেইসময় মায়সার কাজের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। বিয়ের ছয়মাস পর থেকেই মায়সার উপর সন্তানধারণ করার চাপ আসতে থাকে। সংসারে অশান্তি শুরু হয়। মায়সার উচ্চপদস্থ পেশায় নিযুক্ত বর নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে থাকে, বাবা- মায়ের বিরুদ্ধে কোনদিন একটি বাক্য ব্যয় করে না।  বিয়ের দেড় বছর পর মায়সা পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। চাকরির ইচ্ছা মুলতবি রেখে মায়সা সংসার, পুত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে তার একমাত্র দেবর প্রেম করে বাড়ির অমতে বিয়ে করে, ফলে বাড়িতে সারাক্ষণ অশান্তি শুরু হয়। মায়সা  বইপোকা। কিন্তু বই নিয়ে বসলে শাশুড়ির গঞ্জনা শুরু হয়ে যায়। নানান অশান্তিতে মায়সা মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মায়সার ইচ্ছা ছিল বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরতে যাবার, সে ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। বিয়ের আড়াই বছরে সে দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়। এখন দুই সন্তান হয়ে গেছে তাই চাকরির ইচ্ছা নির্বাসনে পাঠিয়ে মায়সা এখন সংসারস্রোতে ভেসে গেছে। মায়সা উচ্চশিক্ষিত মহিলা। সে তার বরের মত উচ্চপদে চাকরি করতে পারত কিন্তু তাকে প্রতারিত হতে হয়েছে।

দিয়ার কথা (নাম পরিবর্তিত)  
‘লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।’‌
হেলাল হাফিজ

দিয়া অতীব সুন্দরী, ডাকাবুকো স্বভাবের ছিল। ছোট থেকে দস্যিপনা করে বেড়াতো। সে কারণে বাবা-মা ঠিক করে রেখেছিলেন গ্র‍্যাজুয়েশন হয়ে গেলে পাত্রস্থ করবেন। 
এক আত্মীয়ের সূত্রে বিয়ের সম্বন্ধ আসে। পাত্র ব্যবসায়ী, অগাধ টাকাপয়সা। মেয়ে বিলাসবহুল জীবন কাটাবে ভেবে সেই পাত্রের সঙ্গে দিয়ার বাবা-মা ধূমধাম করে বিয়ে দেন। বিয়ের কিছুদিন পর দিয়া টের পায়, তার বর এলকোহলিক। বাবা-মা কষ্ট পাবেন, তাই দিয়া তাদের কিছু জানায়নি। বিয়ের পর প্রথম দু-বছর মদ খেয়ে এসে মাতলামো করত। কিন্তু বিয়ের তিন বছর পর থেকে দিয়া তার বরের আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে। খবর নিয়ে জানতে পারে সে অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন করা শুরু করেছে। এরপর দিয়ার উপর শারীরিক অত্যাচার শুরু হয়। দিয়া সেইসময় গর্ভাবস্থায় ছিল সেইজন্য বাপের বাড়ি চলে যায়। সেও ভেবেছিল সন্তান আসলে বর স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অসুস্থ দাম্পত্য বাঁচাতে গিয়েও বলি করা হয় কচি প্রাণেদের। দিয়ার কন্যার এখন চার বছর বয়স। অসুস্থ পরিবেশে সে বড় হচ্ছে। দিয়া অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়িতে জানিয়েছিল। পাছে লোকে কিছু বলে সেই ভয় থেকে তাকে মানিয়ে চলার পরামর্শ  বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া হয়েছে। সে মানিয়ে চলতে চলতে তীব্র বিষাদে খিটখিটে হয়ে গেছে। মাথার অবস্থা বিশেষ ভাল নেই। ইদানীং তাকে প্রফেশনাল হেল্প নিতে হচ্ছে।

ফারিয়ার কথা (নাম পরিবর্তিত) 
‘‌আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো
আমাদের মনে হবে হাজার হাজার বছর আগে
আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।’‌
জীবনানন্দ দাশ

ফারিয়া বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সুখে জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। সংসার খরচের জন্য একটি নির্দিষ্ট টাকা মাসের প্রথমে বরের হাতে দিত। প্রথমে সেই টাকা নিয়ে তার স্বামী খুশি ছিল। কিন্তু সহসা ছন্দপতন হয়। একটা সময় ফারিয়ার নিজস্ব টাকা বলে আর কিছু থাকত না। ফারিয়া তার মা, বোনকে টাকা পাঠাত। সেটা তার বর অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। ফারিয়া দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াতে ভালবাসত। ফলে সে বেড়াতে যাবার উদ্দেশ্যে টাকা সঞ্চয় করে রাখত। তারজন্য তার বর অসন্তোষ প্রকাশ করে। ফারিয়া এমন বিপদে পড়ে চুপ করে ছিল। টাকা নিয়ে একসময় তাদের মধ্যে নিত্য কলহ শুরু হল। ফারিয়া জেদি মেয়ে, সে কোনও অবস্থায় নতিস্বীকার করবে না ঠিক করে নিয়েছিল। ফারিয়া প্রচন্ড এডভেঞ্চার পছন্দ করে তাই সে পরিকল্পনা করে রেখেছিল স্কাই ড্রাইভিং করতে বিদেশ যাবে। পরিকল্পনা মাফিক সে টাকা সঞ্চয় করছিল। ফারিয়া স্কাই ড্রাইভিং করবে শুনে তার বর ক্ষেপে গিয়ে বলে— এত টাকা নষ্ট করার মানে কী! এরপর থেকে ফারিয়ার বরের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না। ফারিয়াকে নানান ভাবে মানসিক অত্যাচার করতে থাকে। স্বাধীনচেতা ফারিয়া বুঝে যায়, তার পক্ষে এ সংসার করা সম্ভব নয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় বিবাহবিচ্ছেদের। ফারিয়ার এই সিদ্ধান্ত তার বরের পুরুষ অহংকে আহত করে। ফারিয়া তার বরের ঘর ছেড়ে চলে আসার দিন ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে। তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয় তার বর। এরফলে ফারিয়ার স্নায়ুর মারাত্মক ক্ষতি হয়। চলার শক্তি হারিয়ে এখন সে জড়বস্তু হয়ে দিন কাটাচ্ছে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ফারিয়ার এ জীবনে আর পাখি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হল না।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত নারী নির্যাতনের দিক থেকে শীর্ষ স্থানে আছে। এ দেশে শিক্ষার মান বেড়েছে, তবে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। লিঙ্গভেদে নির্যাতন বর্বর মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এবার সত্যি গভীর ভাবনার সময় এসেছে। আমাদের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। অভিভাবকদের পুত্র, কন্যাকে নিরপেক্ষ ভাবে বড় করা উচিত। বাচ্চাদের লিঙ্গ নিরপেক্ষ ছড়া, কবিতা শেখান, বই পড়তে দিন। খেলনা কিনে দেবার সময় নিরপেক্ষতা বজায় রাখুন। শিশুকন্যাদের ক্যরাটে, ক্রিকেট, শরীরচর্চা শেখান। শিশুপুত্রদের ঘরের কাজ— রান্না, বাসন মাজা, সেলাই শেখান।  

ষাটের দশকে আশাপূর্ণা দেবী তাঁর ‘‌প্রথম প্রতিশ্রুতি’‌ উপন্যাসে জানিয়েছিলেন অর্থনৈতিক সচ্ছলতায় একজন নারীর জীবনে মুক্তির স্বাদ এনে দিতে পারে। আজ এত বছর পর আমাদের সমাজের মেয়েরা এই কথাটি উপলব্ধি করতে পারেননি । তাই স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে করেন। প্রত্যেকটা মেয়ের কর্তব্য পড়াশোনা শেষ করে স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করা। চাপে পড়ে বিয়ে করে সারা জীবন হায়রে কপাল মন্দ বলে দুখ কেঁদে কাটানোর মত বোকামির কোনও অর্থ হয় না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। নারীর অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবার সময় হয়েছে। নারী নির্যাতন ব্যক্তিগত কোনও সমস্যা নয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে তাকে বাস্তবায়িত করতে হবে।

২০১৮ সালে মানবাধিকার ঘোষণার ৭০তম বর্ষে সারা বিশ্বের নারীরা যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, প্রসঙ্গত ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ডের মহিলারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরব হয়েছিলেন। ভারতের নারী অধিকার কর্মী হাসনা মেহতা মানবাধিকার ঘোষণার অনেক বছর পরে, ২০১৮ সালে আর্টিকেল ওয়ানের ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশনে পরিবর্তন করেছেন। ‘সব পুরুষ জন্মগত ভাবে সমান ও স্বাধীন’ পরিবর্তিত হয়ে ‘সব মানুষ স্বাধীন ও সমান অধিকার নিয়ে জন্ম নেয়’ করা হয়েছে। ইরান (ইরানি মহিলাদের নেকাব আন্দোলন), সৌদি আরব (সৌদি আরবের মহিলাদের ভোটাধিকার, গাড়ি চালানো, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ, পোশাক নির্বাচনে স্বাধীনতা), মেক্সিকো (মেক্সিকান মহিলাদের ভালোবাসা দিবসে ফেমিসাইড লিখে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ) থেকে হালের মি টু মুভমেন্টের মত নারী আন্দোলন সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিরোধের শেষ দুর্গ কিন্তু মহিলারা। অগত্য মধুসূদন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। হোক প্রতিবাদ! 

প্রতীকী ছবি
লেখক : অধ্যাপক ও সমাজকর্মী

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৯ জুলাই, ২০২০

 

0 Comments

Post Comment