- 14 May, 2020
- 0 Comment(s)
- 832 view(s)
- লিখেছেন : সাইদুর রহমান
‘অর্গানাইজেশন অফ ইকোনোমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (OECD)-এর একটি সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, একজন ভারতীয় পুরুষ দিনে ঘরের কাজ করেন গড়ে ১৯ মিনিট, সেখানে একজন মহিলা করেন ২৯৮ মিনিট। এরসাথে রানাবান্না, কাপড় কাচা, ঘর মোচা, ঘর গোছানো, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, তাদের জন্য টিফিন তৈরি করা সহ সংসারের আরও যাবতীয় কাজ জড়িয়ে আছে। এই গৃহশ্রমের জন্য উক্ত মহিলা বা সোজা কথায় বাড়ির গৃহিনীরা বেতন পান না। আবার জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৫-১৬) অন্য একটি সমীক্ষাতে বলা হয়েছে, ভারতের ৫২ শতাংশ মহিলা এবং ৪২ শতাংশ পুরুষ মনে করেন ঘর গৃহস্থালীর কাজে স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলার অধিকার স্বামীদের আছে। (সূত্রঃ এই সময়, ২২-০৪-২০২০)। কিন্তু, একই কাজে বা অপরাধে স্বামীদের গায়ে স্ত্রীদের হাত তোলার অধিকারের কথা বাস্তব তো দূর অস্ত, কল্পনাতেও আসেনা। এই লেখার শুরুতেই উক্ত সমীক্ষাটি পাশে রাখলাম। কারণ, এই সমীক্ষা ‘কোভিড ১৯’ জনিত লকডাউনের আগের। আর লকডাউনের পরে এই হিসেব দেশের বিশেষ করে গ্রাম বা শহরের বস্তিগুলিতে, যেখানে স্বামীরা বেশির ভাগ সময়ই কাজের সূত্রে বাইরে থাকে, সেখানে বাড়ির মেয়েদের সাংসারিক দায় ও দায়িত্ব কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
লকডাউন চলছে। ঘরে বাইরে কাজ নেই। অভাবের সংসার। দিন আনে দিন খায়। যে কয়েকটি টাকা হাতে ছিল কবেই শেষ হয়ে গেছে। অতএব সংসারে নিত্য ঝগড়া, মারামারি। ঝগড়ায় এগিয়ে থাকে বউটি, আর মারামারিতে স্বামী। সকালে খাবার হয়নি, এক বছরের বাচ্চাটি দুধের জন্য সকাল থেকেই কেঁদে যাচ্ছে। বউয়ের মেজাজ ভাল নেই। মেজাজ ভাল নেই স্বামীরও। রাগের মাথায় বউয়ের গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে স্বামী হয়ত বলল, ‘দেখছিস না মাগী চারিদিকে লকডাউন চলছে। কোথাও কাজ নেই’। বউ তখন জোরে কাঁদতেও পারে না। কারণ, বাচ্চাটি তখন আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। সেই কান্নায় চাপা পড়ে যায় মায়ের বুকে জমে থাকা একবুক কান্না। সে তখন শুকনো বুকে বাচ্চাকে চেপে ধরে চোখের জল মুছে। তারপর বিকেলে পাড়ার ছেলেদের তুলে দেওয়া এক কিলো চালে দুটো আলু ফেলে সেদ্ধ করে দু-মুঠো ভাত পেটে দেওয়ার জন্য। রাত্রিতে স্বামী বউকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, ‘আমি তো তোকে মারতে চাইনি রে। এই অভাবের সময়ে মেজাজ ভাল নেই। তুই তো জানিস তোকে কত ভালবাসি’। আর বউ ফুঁফাতে ফুঁফাতে স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে দেয়।
কিংবা, ধরা যাক মিনসুরা বিবির (নাম পরিবর্তিত) কথা। স্বামী মিনহাজুদ্দিন এখন কেরালায়। নির্মাণ কাজে মাস পাঁচেক আগে কাজে গিয়েছিলেন। লকডাউনে আটকে গেছেন, ঘরে ফিরতে পারেননি তিনি। এদিকে বিঘে খানেক যে ভুট্টা লাগানো ছিল, ঝড় বাদলায় নষ্ট হতে বসেছে। কী আর করা যায়! মিনসুরা কাস্তে হাতে নিজেই নেমে পডলেন। প্রায় দশ দিন ধরে ভুট্টা কেটে মাথায় করে বাড়িতে জমা করে, ভুট্টা ঝাড়াইয়ের মেসিন ডেকে নিয়ে এসে ভুট্টা মাড়িয়ে ঘরে তুলেছেন তিনি। কিংবা, সখিনার (নাম পরিবর্তিত) মা। স্বামী এখন মুম্বাইয়ে। ছয় মাস হয়ে গেল। লকডাউনে তাঁরও ঘরে ফেরা হয়নি। এদিকে ঘরে যে টাকা ছিল, গত মাসেই শেষ হয়ে গেছে। রেশন থেকে যে চাল, গম দেওয়া হয়েছিল তাও শেষের পথে। পেটে টান পড়তে শুরু করেছে। ঘরে দশ ও ছয় বছরের দুই ছেলে, আর তিন বছরের এক মেয়ে। অগত্যা সখিনা নিজেই কখনও নিড়ানি, কখনও কাস্তে হাতে অন্যের জমিতে কাজ করে চলেছেন। দশ বছরের ছেলেও মাঝে সঙ্গ দিচ্ছে মাকে।
বিশ্বজুড়ে লকডাউনের এই মুহূর্তে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা সহ গোটা রাজ্যের গ্রামগুলোর প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ শ্রমিক ভিন রাজ্যে আটকে আছেন। লকডাউনে তাঁরা কেউ ঘরে ফিরতে পারেন নি। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন বউরা, বাড়ির মহিলারা। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় তাঁদের সাথে। স্বামীদের গলাভেজানো কথা তাঁরা শোনেন আর অভয় দেন —‘চিন্তা করোনা। আমি তো আছি। সব সামলে নিব।’ এবং তাঁরা সব সামলেও নিচ্ছেন।
“স্বামী ঘরে ফেরেনি। হাতে টাকাও নেই। পেট তো আর সে কথা শুনবে না। মেয়েটাকেও কিছু খেতে দিতে পারছি না। এখন ঘরে বসে মান সম্মান দেখানোর সময় নয়। কাজ করেই বাঁচতে হবে’ — বলছিলেন মেহেরুন্নেশা বিবি।
আর প্রায় একই কথা হালেমা খাতুন, তানজুরা খাতুন, আয়েশা বিবি, মদিনা বিবি, টিয়ার মা, রফিকের মা, ঘরামির বউ, শফিকের বউদের। বিয়ের পর কখন যে শরিফা খাতুন ‘টিয়ার মা’, আর শবনম আনজুম ‘ঘরামির বউ’ হয়ে গেছে তাঁরা বুঝতেই পারেনি। তাদের আসল নামে কেউ চেনে না, জানে না। সংসারের ঘূর্ণিপাক আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আধিপত্যে এইভাবেই তাদের নাম পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে পরিচয়।
আর যাদের স্বামীরা বাইরে যায়নি কাজের জন্য! এখানেই যারা কাজ করে। তারাও একরকম কাজ হারিয়ে মহা বিপদের মাঝে করুণ অবস্থা। সেখানে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীও কিছু একটা কাজ গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে। ভাবছে এই দুঃসময়ে কীভাবে স্বামীকে, পরিবারকে একটু সাহায্য করা যায়। তবে কাজ যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। লকডাউনের মাঝেই তীব্র গতিতে চলছে মাঠের কাজ। মাঠে গম, ভুট্টা, ধান পেকে গেছে। সেগুলিকে কেটে ঝাড়াই বাছাই করে ঘরে তোলা। আবার জমিতে চাষ দেওয়া। সেচ দেওয়া। তিল বোনা হয়ে গেছে। এখন পাট বোনার মরসুম। মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রাক্টর, ধান, গম, ভুট্টা ছাড়াই বাছাইয়ের মেসিন। সকাল হলেই কাস্তে হাতে, কোদাল কাঁধে মাঠে হাজির চাষি ভাই। অথচ সবাই জানে দেশে লকডাউন চলছে, তাঁরা প্রত্যেকে খোঁজ রাখেন দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কত বাড়ল, আর কত মানুষ সুস্থ হল। শুধু দেশ নয়, বিদেশের খবরও নিয়মিত রাখেন তাঁরা। ফজলুল করিম। পঞ্চান্নর কাছাকাছি বয়স। সাত সকালে মাঠে গিয়েছিলেন লাঙ্গল বাইতে। ভুট্টা কাটা হয়ে গেছে। এখন চাষ দিয়ে সেচ দিতে হবে। দুপুর বেলা ঘরে ফিরে গোরুর কাঁধের জোয়াল থেকে লাঙ্গল নামিয়ে উঠোনে নিম গাছের ছায়ায় বসে আরাম করছিলেন। কথায় বলছিলেন, ‘আমেরিকা অত উন্নত দেশ। ওখানেই যখন হাজার মানুষ মরে যাচ্ছে, তখন আমরা তো কিছুই না। এখানে যখন মড়ক লাগবে, তখন গাঁয়ের পর গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।’ তারপর যারা লকডাউন মানছে না, এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছে তাদের উদ্দ্যেশ্যে দু-একটা গালি দিয়ে ঘরে ‘কলতলা’র দিকে উঠে গেলেন স্নান করতে। সাবান দিয়ে স্নান করার আগে এক গ্লাস জলও স্পর্শ করবে না। সাবান আর গামছা হাতে বউ যে ‘কলতলা’য় দাঁড়িয়ে আছে।
আবার ফিরে আসি মেহেরুন্নেশা, মিনসুরাদের কথায়। জন্ম থেকেই এঁরা মাটির সাথে সম্পৃক্ত, এঁরা যেন মাটিরই প্রোডাক্ট,— তাই তাঁদের মাটির কাছাকাছি থাকতে হয়। মাটি থেকে আলাদা করলে এঁদের অস্তিত্ব থাকে না। স্বামীরা তো বেশির সময়েই বাইরে, বিদেশেই কাজ করতে চলে যান। দু মাস, তিন মাস তাঁরা ঘরে ফেরে না। বা ফিরলেও একমাসের বেশি ঘরে থাকে না। ঘরে মাস খানেক থেকে আবার তাঁরা ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে পাড়ি দেন। তখনও তো সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় বউদেরই, বাড়ির মহিলাদেরই। সকাল হলেই ঘুম থেকে তুলে ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠানো, তাদের টিফিন বানিয়ে দেওয়া, রেশন আনতে যাওয়া, স্বামী কাজ করে টাকা পাঠিয়েছে — টাকা তুলতে ব্যাংকে যাওয়া, এ টি এম এর সামনে লাইন দেওয়া, বিকেলে ‘স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী’র মিটিংয়ে উপস্থিতি, বাড়িতে পাঁচটি ছাগল আছে — তাদের জন্য মাঠে ঘাস কাটতে যাওয়া, টাটির ঘরটা ভেঙে দেয়াল পাকা করতে হবে, স্বামী বছর দুই কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছে- তা দিয়ে ইট আনতে হবে, ঘরে লেবার আছে, কাঠা বিশেক জমি আছে — সেখানে ভুট্টা লাগাতে হবে, — সংসারের কত কাজ তাকে একাই সামলাতে হয়। সামলে চলেনও। আর এই ‘লকডাউনে’র ঘোর দুর্দিনে তাঁদের কাজ আর দায়িত্ব আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। তার সাথে চতুর্গুণ বেড়েছে সংসয়, অনিশ্চিয়তা এবং দুর্ভাবনাও। স্বামী ঠিকঠাক ঘরে ফিরতে পারবেন তো! যদি আর ফিরতে না পারে! যদি কোনও দুঃসংবাদ আসে। কেউ আবার আরও বেশি করে ভাবেন — স্বামী ঘরে সতীন সাথে ফিরবে্ন না তো! কারণ, স্বামীদের ভিন রাজ্যে গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার উদাহরণও প্রচুর। অনেকে বউ সাথে করেই নিয়ে চলে আসেন। আবার কেউ বিয়ে করে রেখে আসেন। ফলে এই লকডাউনের বাজারে বউদের অবস্থা এখন একাধিক দিক থেকে করুণ, ভয়ের, এবং আতঙ্কেরও। তবু, এই ভয় আর আতঙ্ককে সাথে নিয়েই তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কারণ তাঁদের এগোতে হবে। পেছনে ফেরার যে কোনও রাস্তা নেই।
ছবি: প্রতীকী
0 Comments
Post Comment