ঈদের উপহার

  • 20 April, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 69 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
একমাস পরে বাড়ি এল সামসু। সাকিলা মাছ ভাজতে ভাজতে খুন্তিটা নামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে  যেতে গিয়ে  কী মনে করে, থমকে যায় সাকিলা।  শ্বশুর, শাশুড়ি,  এখন সামসুকে  ঘিরে থাকবে।  ওদের সামনে নিজেকে অনাহূত বলে মনে হবে সাকিলার। সাকিলা আছে জেনেও সামসু রুবির দিকে তাকিয়ে কথা বলবে।  আড় চোখে সাকিলাকে  দেখে শাশুড়ি টুক করে বলে উঠবে, “চুলোয় কিছু চাপিয়ে আসনি তো?”  শ্বশুর  সামসুর জন্য সরবত করে  আনার তাগাদা দেবে সাকিলাকে।

      কাল রাতে শুতে যাবার সময়  সাকিলা ভেবে রেখেছিল-  আজ সারাদিনে  কখন কোন কাজটা করবে। সেই মতো  ভোর হবার কিছুটা আগে  উঠে কাজে হাত লাগিয়েছে সে। কাজগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে কিছুটা সময় হাতে রাখতে চায়। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে,  প্রতিদিনের  নির্দিষ্ট  কাজগুলোর সাথে কিছু বাড়তি কাজ এসে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে।

  আগামীকাল ঈদ। আর সব বাড়ির মত সাকিলাদের বাড়িতেও তার আয়োজন চলছে। সিমুই ভাজা, নারকেল কোরানো, পায়েসের জন্য দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে রাখা, পোলাও এর চাল ছেড়ে, বেছে রাখা।

       শেষ রোজার দিনে ইফতারে কিছুটা বাড়তি আয়োজন  লাগে। পাড়ার মসজিদে  ইফতার পাঠাতে হবে। পাড়ার কিছু গরীব –মিসকিন আছে রোজকার মত আসরের পর তারা এসে পড়বে।  তাছাড়া আশ-পাশের দু একটা বাড়িতে  ইফতার দেওয়া নেওয়া তো আছেই। দিনে খাওয়ার ব্যাপার না থাকলেও রাতের রান্নার যোগাড় আছে।  দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেনা সাকিলা।  রোজার শেষের দিকে এমনিতেই  শরীর কিছুটা  কাহিল ; হাত-পা যেন আর চলছেনা।

     সাকিলার শাসুড়ি কুলসুমা ফজরের নামাজ শেষ করে  কোরান শরিফ খুলে বসেছে। মাঝখানে  একবার উঠে,  সাকিলাকে কয়েকটি কাজের কথা বাতলে দিয়ে আবার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। সংসারের কোনও কাজে  আজ তাকে পাওয়া যাবেনা,  সাকিলা বুঝে গেছে।

        ননদ রুবি ঘর দোর গোছাতে ব্যস্ত। বিয়ের পর এটা তার প্রথম ঈদ। কাল  বিকালে ওর বর সোহেল আসবে- ঈদের সালাম জানাতে।  রুবিকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। সে অকারণ এদিক সেদিক ঘুরছে, মাঝে মাঝে আয়নায় নিজেকে দেখে নিচ্ছে।  রুবিকে দেখে  দু’ বছর আগে নিজের জীবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে সাকিলার।

  “দেখে কাজ করবে তো? কোন দিকে মন থাকে?  একটা দিন একটু  ঢিল দিয়েছি কী ওমনি !” ওথলানো দুধের ওপর এক আঁজলা পানি সজোরে  ঝাপটে দিয়ে  ঝাঁঝিয়ে ওঠে কুলসুমা।  কিছু একটা  কাজের কথা মনে পড়ে যেতে, সাকিলার খোঁজে  এদিকে এসেছিল সে।

  সাকিলা অপ্রস্তুত। ডেকচির  দুধটা কখন ওথলাতে শুরু করেছে খেয়াল করেনি। হাতা দিয়ে  দুধটা নাড়তে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে।

  “ভাবি, মেহদি পরবে না?” একটা বাটিতে কিছুটা বাটা মেহদি নিয়ে দাওয়ার ধারিতে পা ঝুলিয়ে বসে হেঁকে বলে  রুবি।

“কী করে পরব? আমার তো  কাজ শেষ  হয়নি এখনও“

“তোমার শুধু কাজ আর কাজ। আগে মেহদি পর, কাজ না হয় খানিক পরে করবে। কাজ কী পালিয়ে যাচ্ছে ?”  হাতে মেহদি দিয়ে নক্সা আঁকতে আঁকতে রুবি বলে।

  সাকিলা কাছে গিয়ে দ্যাখে,  রুবি তার  হাতের  পাতায়  “S”  ইংরাজী বর্নটি যত্ন করে আঁকছে।

“এস না, তোমার হাতে  ভাইয়ার নামটা এঁকে দি। ভাইয়া দেখলে খুশি হবে।”   ঠোঁট চেপে মৃদু হেসে  রুবি  বলে।

“ধ্যাত! আম্মা, আব্বার চোখে পড়ে গেলে লজ্জার কথা হবে !  আমি যাই, গুচ্ছের কাজ জমে আছে।”

“ তাহলে থাকো কাজ নিয়ে! কাল সাদা হাতেই ঘুরবে।”  কৃত্তিম রাগ দেখায় রুবি।

      সাকিলার ভ্রুতে ভাঁজ পড়ে। রুবি একটু কাজে হাত লাগালে সাকিলাও এখন মেহদি পরতে পারতো। ঈদের আগের দিন হাতে মেহদি লাগাতে  কার না মন চায়। একথা রুবিকে বুঝিয়ে বলতে হবে। যাকগে, রুবির নতুন বিয়ে হয়েছে, কাল ওর বর আসবে। ওর সাথে  সাথ দেওয়া কী  সাকিলার সাজে। অভিমান সরিয়ে  সমবয়সী ননদটির প্রতি  কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকায় সাকিলা। তারপর সিন্দুক থেকে কাঁচের, চীনা মাটির বাসন পত্র  বের করে  রান্না ঘরে গোছ করায় মন দেয়।

   সকালের দিকে চুড়িওয়ালী এসেছিল। ডালায় রঙ্গীন  চুড়ির হালি সাজিয়ে। ঈদের আগের দিন সমস্ত বাড়ির মেয়ে-বৌরা  হাত ভর্তি করে রঙ - বেরঙ এর কাঁচের  চুড়ি পরে। কেউ কেউ ইমিটেশন এর চুড়িও পরে, যার যেমন পছন্দ।  রুবি পরেছে লাল রঙের কাঁচের চুড়ি।  সাকিলা নীল। সাকিলার প্রিয় রঙ নীল।  সেই কবে থেকে ,অপরাজিতা ফুলের মত নীল একটা শাড়ির ভীষণ শখ সাকিলার। মুখ ফুটে একথা কাউকে বলা হয়নি। মনের কথা সহজে মুখে আনতে পারেনা সে।   

“কই গেলে কোথায় সব?”  কানকোয় দড়ি বাঁধা  বড় সাইজের একটা  বোয়াল মাছ  হাতে ঝুলিয়ে রান্নাঘরের ছাঁচতলা থেকে হাঁক দেয়  সাকিলার শ্বশুর রফিক আলি।

“এই অবেলায় মাছ কোথায় পেলেন আব্বা?  মাথার কাপড়টা সামান্য টেনে, গলাটা যথাসাধ্য  নরম করে সাকিলা বলে।

     “আব্বাসের তগিতে  ধরা পড়েছে। ওই যে, যে ছেলেটি মাঝে মাঝে মাছ দিয়ে যায়। মতিনের পুকুর থেকে  লুকিয়ে ধরেছে।  আজকের দিনে বোয়াল মাছের খদ্দের পাবে কোথায়?  আমাকে এসে ধরল। পাঁচ কান হলে  মাছ, তগি  দু’টোই যাবে, উল্টে  শেষ রোজার দিনে  হ্যানোস্থা  হবে  ছোঁড়াটার। কী আর করি, বকা ঝকা করে শেষে কিনে নিলাম।  সামসুও ভালোবাসে। মেসে  তো আর এসব মাছ  খেতে পায়না”। রান্নাঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা  স্ত্রীর কাছ থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে  এক নাগাড়ে এতগুলো কথা সাকিলাকে বলে চলে রফিক আলি।

   সাকিলা  এত বড় মাছ  কোনওদিন কাটেনি। তাছাড়া রান্নার কাজ এখনও কিছুটা বাকি। শ্বশুরের হাত থেকে মাছটা নিয়ে, সেটাকে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

      “কী হলো? দাঁড়িয়ে রইলে যে?  না যাও তো  বল, আমিই যাচ্ছি। সব দায় তো আমারই!  এদিকে ইফতারের  সময় হয়ে এল, কিছুই যোগাড় হয়নি দেখছি!  যেদিকটা না দেখব! একজনা তো কাজ-কাম মাথায় তুলে লোকের বাড়ি বাড়ি ঈদের বাজার দেখে বেড়াচ্ছেন!  আর একজন  অবেলায় এক বোয়াল মাছ এনে হাজির করলেন! শেষ রোজার দিনটায় ধীরে সুস্থে মুখে পানি দোবো তার জো নাইকো! সবাই  মিলে আমাকে পাগল করে ছাড়বে!” খেজুর ডাঁটির দাঁতনটা আরও জোরে জোরে  চিবোতে শুরু করে কুলসুমা।

     সাকিলার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়না। চোখের পানি চোখে সামলে, মাছ আর বটি নিয়ে  একটু আড়াল খোঁজে সে।

    জুতোর  ভারী  শব্দ, ব্যাগ ভর্তি  ছোটো-বড় প্যাকেটের খড়খড় আওয়াজ  জানান দেয় সামসু এল।   

“মা, আব্বা, তাড়াতাড়ি এস, ভাইয়া এসে গেছে”।  রুবি তড়বড় করে ওঠে । সাকিলার শাশুড়ি ব্যস্ত হয়ে, দাওয়ায়  ফ্যানের তলায় একটা চেয়ার টেনে  দিয়ে বলে, “আয় বাপ, বস। কত রোগা হয়ে গেছিস?”

     একমাস পরে বাড়ি এল সামসু। সাকিলা মাছ ভাজতে ভাজতে খুন্তিটা নামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে  যেতে গিয়ে  কী মনে করে, থমকে যায় সাকিলা।  শ্বশুর, শাশুড়ি,  এখন সামসুকে  ঘিরে থাকবে।  ওদের সামনে নিজেকে অনাহূত বলে মনে হবে সাকিলার। সাকিলা আছে জেনেও সামসু রুবির দিকে তাকিয়ে কথা বলবে।  আড় চোখে সাকিলাকে  দেখে শাশুড়ি টুক করে বলে উঠবে, “চুলোয় কিছু চাপিয়ে আসনি তো?”  শ্বশুর  সামসুর জন্য সরবত করে  আনার তাগাদা দেবে সাকিলাকে।

        সাকিলার পা দুটো ভারী হয়ে বসে যায় রান্না ঘরের মেঝেয়। সে উবু হয়ে বসে কাঁচের গ্লাসে  পানি আর চিনি  চামচ দিয়ে নাড়তে  শুরু করে।  গ্লাসের গায়ে চামচের  টুং টাং শব্দ, সাকিলার হাতের বসমা দেওয়া নীল কাঁচের চুড়ির রিন ঝিন শব্দ ছোটো ছোটো তরঙ্গ হয়ে দুলতে থাকে সাকিলার  থমকে থাকা টৈ-টম্বুর দিঘীজলে।  সেই  সব তরঙ্গ, তরঙ্গায়িত হয়ে  ছড়িয়ে পড়ে সাকিলার সারা শরীরে। লোমকূপ জুড়ে বাজনা বেজে ওঠে।বাজনার শব্দ  সাকিলা শুনতে পায়না, কেবল তার স্পন্দন  তীব্র ভাবে অনুভব করে।  সেই স্পন্দন ক্রমশ স্তিমিত হতে হতে তিরতিরে এক সুখ হয়ে জড়িয়ে যায় সাকিলার দু-চোখের পাতায়,চিবুকে,ঠোঁটের কোনে । রান্না ঘরেরে জানালা গলে একটুকরো পাঁশ রঙা আকাশ সাকিলার চোখে ধরা দেয়।  সেখানে তখন ঝিকিয়ে আছে কুমড়োর ফালির মতো ঈদের চাঁদ।

  “তুমি এবার শুতে যাও। অনেক রাত হোল। কাল ভোরে উঠতে হবে।“ খেয়ে দেয়ে সবাই শুতে চলে গেছে, সাকিলাকে তখনও কাজ করতে দেখে  কুলসুমা বলে।

    “এবার যাব।” রান্নাঘর পরিষ্কার করতে করতে  সাকিলা বলে।

        কাল ভোরে  গোসল করে রান্না ঘরে ঢুকতে হবে। হাতের  কাছে সব কিছু গোছানো  না থাকলে  কাল কাজ সারতে দেরি হয়ে যাবে। পাড়ার  সব মেয়ে-বৌরা  সাজ-গোজ করে এবাড়ি ওবাড়ি গল্প-গুজোব করে বেড়াবে।  বছরে মাত্র দুটো দিনের কয়েকটি মাত্র ঘণ্টা, যখন নিষেধের  চৌকাঠ  আপনা থেকেই সরে যায়, সাকিলাদের  সামনে থেকে; তখনও যদি কাজ সারা না হয় সাকিলার, তাহলে ঈদের দিনটাই তো মাটি!

      “তোমার শ্বশুরের নতুন পাজামা- পাঞ্জাবী, টুপি, রুমাল, আতর সব এক জায়গায় গোছানো আছে তো? উনি তো ফজরের নামাজ শেষ করেই ঈদ-গা  যাবার জন্য তাড়াহুড়ো করবেন।  হাতের কাছে  না পেলেই চেঁচামেচি করবে।”  দু’চোখে উৎকন্ঠা ছড়িয়ে সাকিলার দিকে তাকায় কুলসুমা।

শাশুড়ির এই অহেতুক চিন্তাটুকু উপভোগ করে সাকিলা। স্মিত হেসে বলে, “রুবি সমস্ত গুছিয়ে রেখেছে”।

     রফিক আলি ঈদের সকালে খুব পরিপাটি করে সাজগোজ করেন। মাথার টুপি থেকে পায়ের জুতোটি পর্যন্ত নিখুঁত হওয়া চাই। ভারি চমৎকার দেখায় তখন।  ওই চেহারাটির পাশে  আর একটি পাঞ্জাবী পাজামা পরা চেহারা  সাকিলার  চোখে  ভেসে ওঠে, যার মাথার টুপিটা সাকিলার  ভারি অপচ্ছন্দের। সারা রোজার মাস ধরে একটু একটু করে আদল পাওয়া কুরুশে বোনা একটা  টুপি উস্খুস করে ওঠে  সাকিলার মনে।  বালিশের তলায় রাখা টুপিটা সামসু দেখতে পেয়ে যায়নি তো!

    ভোর রাতে ছেড়ে যাওয়া ঘরটাকে  আজ  অচেনা মনে হয় সাকিলার। সামসুর ছেড়ে রাখা জামা-প্যান্ট, আলনায় দোমড়ানো লুঙ্গী, গামছা, টেবিলের ওপর গুটিয়ে পড়ে থাকা রুমাল, সিগারেটের প্যাকেট, ঘড়ি, পার্স সব মিলিয়ে ঘনিষ্টতার  ওম জড়িয়ে আছে সারা ঘরটায়। সামসু  ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুমিয়ে পড়ারই কথা। অফিসের খাটা-খাটনির পর আবার এতটা জার্নি। রাতও তো কম হয়নি?

  সামসু ঘুমিয়ে গেলে ওঠাতে ইচ্ছা করে না সাকিলার। অথচ প্রতিক্ষীত এই রাতের স্বপ্নই তো উপবাসের ক্লান্তি ভুলিয়ে  প্রাণবন্ত  করে রেখেছিল সাকিলাকে। সময়ের খুদ কুঁড়ো বাঁচিয়ে কল্পিত কথোপকথন জুড়ে জুড়ে তৈরি কথা-কাহিনী  ঘাই মারতে থাকে, মনের অতল থেকে উঠে আসতে চায় হুড়মুড়িয়ে। আলনা থেকে  একটা কাচা শাড়ি তুলে, পরনের  তেল-মশলার দাগ লাগা  শাড়িটা পাল্টায় সাকিলা। টেবিলের ওপর একটা বাটিতে খানিকটা বাটা মেহদি, রুবি রেখে গেছে।  কী মনে ক’রে  বাটিটা নিয়ে বিছানায় গুছিয়ে বসে সাকিলা।

“শাড়িটা দেখলেনা যে?” আচমকা বলে ওঠে সামসু।

সামসু জেগে আছে, তার অপেক্ষায় জেগে আছে। সাকিলার দু’ চোখ খুশিতে ঝিকমিক করে  ওঠে। সামসুর দিকে  তাকিয়ে  নরম সুরে বলে, “তুমি  দেখাবে তবে তো?”

“ব্যাগের মধ্যে আছে নিয়ে এস”।  সামসু উঠে বসে।

ব্যাগের ভিতর থেকে একটা বড় প্যাকেট তুলে নিয়ে সামসুর পাশে ঘনিষ্ট ভঙ্গীতে বসে সাকিলা। সামসু প্যাকেট খোলে- একটা কালো রঙের  জরিপাড়  তাঁতের শাড়ি,  একই রঙের সায়া, ব্লাউজ।

“পছন্দ হয়েছে তো?”

“অন্যটা কী রঙের ছিল?”

“নীল। সেটা রুবি নিয়েছে। এটা পছন্দ হয়নি?”

“না, তা ঠিক নয়। কালো রঙটা আমাকে তো মানায় না তাই! সাকিলার গলায় একরাশ জড়তা।

“তাহলে, রুবির সাথে  বদলা বদলি  করে নিও।”

“রুবি পছন্দ করে নিয়েছে, ও আমি পারব না।”  

“তাহলে আর কী, এটাই পোরো। তোমাকে বেশ মানাবে। কে কী বলল তা নিয়ে এত ভাব কেন?” সামসুর গলায় তোষামদের সুর।

“ কেউ কিছুই বলেনি তো? তুমিই একদিন  আমাকে কালো শাড়ি পরতে বারণ করেছিলে, তাতে নাকি আমাকে আরও কালো দেখায়।“

  “ আমি! কই মনে পড়ছে না তো?“

“আর মনে করার দরকার নেই। আমি কাল অন্য একটা শাড়ি পরে নেবো। পরে তুমি এটা পালটে নীল রঙের এনে দিও।” আদুরে গলায় কথা কয়টি বলে নখ খুঁটতে থাকে সাকিলা।

“একটা শাড়ি বার বার পাল্টানো আমার ধাতে নেই। পরতে হয় পোরো, নয়তো রুবিকে দিয়ে দিও। রাত কত হলো খেয়াল আছে? আমার ঘুম পাচ্ছে।”

  এতক্ষণ পর সাকিলার মনে হয়, সত্যিই রাত হয়েছে, বাইরে- ভিতরে  সুনসান লাগে  তার। শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ নাড়াচাড়া শেষ করে সেগুলোকে ভাঁজে ভাঁজে মেলাবার চেষ্টা  করে  সে। সামসুর শেষ কয়েকটি কথায়  সাকিলার কাজের নিপুনতা প্রশ্রয় পায় ।

“কী হলো? কথা বলছনা যে? আচ্ছা, শাড়িটা কালো না হয়ে নীল হলে  কী এমন আহা মরি  ব্যাপার হতো বুঝি না! মাঝরাতে একটা শাড়ি নিয়ে কচকচানি ভালো লাগছে না। ছাড় তো?”  সাকিলার হাত ধরে  হ্যাঁচকা টান দেয় সামসু।

       সামসুর হাতের চাপে সকালে পরা কাঁচের চুড়িগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিছানায়। দু-একটা  টুকরো বসে যায়  সাকিলার কব্জিতে। শাড়ির প্যাকেট, মেহদির বাটি সব কিছু নিয়ে বিছানায় ছিটকে পড়ে সাকিলা। বালিশের তলায় কুরুশে বোনা টুপিটা দুমড়ে যেতে থাকে।

 

   দুপুর গড়িয়ে গেছে। ঈদের ব্যস্ততা আর নেই। আবার সবাই যে যার মতো। সামসু দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে ট্রেন ধরেছে। কাল তার অফিস আছে। একটু আগে  রুবির বর সোহেল এসেছে।

“সোহেল ভাই তোমার জন্য কী এনেছে দেখতে এলাম।” অবসর বুঝে ওদের ঘরে ঢোকে সাকিলা।

    একটা নীল প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে  সোহালের কাছ থেকে পাওয়া – লাল টুকটুকে একটা শাড়ি, চুড়ি, সাজ গোজের টুকি টাকি জিনিস, সেই সাথে রুবির প্রিয় এক গোছা লাল গোলাপ, এক এক করে সাকিলার সামনে মেলে ধরে রুবি।

“ভাইয়া তোমার জন্য কী এনেছে গো?” মুচকি হেসে বলে রুবি?

“তুমি তো দেখেছ, সেই শাড়িটা!”

“শাড়ির  কথা বলছি নাকি? ওতো সবার জন্যই এনেছে। তোমার জন্য আলাদা করে কী এনেছে সেটা বল?”

“ আলাদা করে? কই কিছু  আনেনি তো।”

“বাজে কথা বোলোনা । একমাস পর ভাইয়া বাড়ি এল, আর তোমার জন্য ওই  একটা শাড়ি ছাড়া অন্য কিছুই আনেনি? দেখাবে না তাই বল!”  রুবির গলায় খুনসুটির সুর।

   “আমাকে  ভাগ দেবার  ভয়ে  মুখ একেবারে চুপসে হয়ে গেছে।  আচ্ছা বাবা, দেখাতে হবেনা। তোমার বরের দেওয়া জিনিস তোমারই থাক।” সাকিলাকে চুপ করে থাকতে দেখে রুবি  হাসে ।

          সোহেল ও যোগ দেয় সেই হাসিতে।

   এবারকার ঈদের উপহারটার ভাগ কাউকে দিতে পারবে না সাকিলা। তার একান্ত হয়ে থাকবে অনেকদিন। আগের বার ঈদে পাওয়া শাড়িটার আঁচল দিয়ে কব্জির কাটা জায়গাটা ঢেকে নেয় সাকিলা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment