বিবাহিত নারী (সপ্তদশ পর্ব)

  • 10 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 532 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
আমরা প্রায়শই বলেছি প্রদেশের সেই সব বুর্জোয়া মহিলাদের কথা যাঁরা হাতে সাদা দস্তানা পরে থাকেন এটা নিশ্চিত করার জন্য যে, আসবাবের ওপর কোনো অদৃশ্য ধুলোও পড়ে নেই। এইরকম প্রজাতির মহিলাদেরই কয়েক বছর আগে পাপিন বোনেরা মেরে ফেলেছিল। অপরিচ্ছন্নতার প্রতি তাঁদের ঘৃণাকে আলাদা করা যায় না বাড়ির পরিচারকদের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি এবং নিজেদের প্রতি তাঁদের ঘৃণার স্বরূপ থেকে।

আমরা প্রায়শই বলেছি প্রদেশের সেই সব বুর্জোয়া মহিলাদের কথা যাঁরা হাতে সাদা দস্তানা পরে থাকেন এটা নিশ্চিত করার জন্য যে, আসবাবের ওপর কোনো অদৃশ্য ধুলোও পড়ে নেই। এইরকম প্রজাতির মহিলাদেরই কয়েক বছর আগে পাপিন বোনেরা মেরে ফেলেছিল। অপরিচ্ছন্নতার প্রতি তাঁদের ঘৃণাকে আলাদা করা যায় না বাড়ির পরিচারকদের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি এবং নিজেদের প্রতি তাঁদের ঘৃণার স্বরূপ থেকে।

অল্প সংখ্যক মহিলাই আছেন যারা তাঁদের যৌবন থেকেই বেছে নেন এরকম প্রবল বিষণ্ন অনৈতিকতা। জীবনকে যাঁরা উদারভাবে ভালোবাসেন, তাঁরা এই কাজ করতে পারেন না। সিদো সম্পর্কে কোলেত আমাদের বলেন :

চটপটে এবং অস্থির ছিলেন তিনি। তবে পরিশ্রমী গৃহবধূ ছিলেন না। ছিলেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুরুচিসম্পন্ন, বিরক্তিকর। তবে বাতিকগ্রস্ত, একাকী প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের থেকে অনেক দূরে ছিল তাঁর অবস্থান, যিনি গণনা করেন তোয়ালে, চিনির দলা এবং ভরতি বোতল। হাতে ফ্লানেল নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে হাসতে হাসতে দীর্ঘ সময় ধরে জানলা মুছতে থাকা বাড়ির চাকরের ওপর নজর রাখতে রাখতে তিনি স্বাধীনতার জন্য অধৈর্য কান্নার মতো বিচলিত বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন : “অনেক সময় আর যত্ন নিয়ে যখন আমি চিনা কাপ মুছি, তখন আমি বাস্তবিকই বুঝতে পারি যে আমি বুড়িয়ে যাচ্ছি”। তবে কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজের প্রতি অনুগত থাকেন। তারপর চৌকাঠের দু-ধাপ পেরিয়ে চলে যান বাগানে। মুহূর্তের মধ্যেই প্রশমিত হয় তাঁর বিষণ্ন উত্তেজনা এবং বিরক্তি।

এই স্নায়বিক দুর্বলতা আর বিরক্তি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন কামোত্তেজনাহীন অথবা হতাশ অথবা বৃদ্ধ অথবা ক্ষুণ্ন অথবা স্বামী-নিন্দিত সেই সব স্ত্রীরা, যাঁরা একাকী এবং শূন্য অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকেন। এঁদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ মহিলাকে আমি চিনি যিনি প্রত্যেকদিন সকাল পাঁচটায় উঠতেন তাঁর পোশাকের আলমারি পরীক্ষা করে দেখার জন্য। তারপর আবার শুরু করতেন সাজানো-গোছানো। মনে হয়, কুড়ি বছর বয়সে তিনি বেশ প্রফুল্ল এবং লাস্যময়ী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে স্বামীর দ্বারা অবহেলিত হয়ে এক সন্তান নিয়ে তিনি একটি বিচ্ছিন্নভাবে বাস করেন। অন্যরা যেমন করে পানীয় সাজান, তেমন করে তিনি সব কিছু গোছগোছ করেন। এলিসের ‘বৈবাহিক ধারাবিবরণী’-তে দেখা যায়, গৃহস্থালির জন্য স্বাদ উদ্ভূত হয় মহাবিশ্ব শাসন করার উত্তেজিত ইচ্ছা, একটি জীবন্ত উচ্ছ্বাস এবং আধিপত্যের ইচ্ছা যা উপযুক্ত জিনিসের অভাবে শূন্যই থেকে যায়, তা থেকে। এটি অবশ্যই সময়, মহাবিশ্ব, জীবন, পুরুষ এবং যা কিছুর অস্তিত্ব আছে সেই সব কিছুর উদ্দেশে ছুঁড়ে দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ।

রাতের খাবারের পর রাত ন-টা থেকে তিনি ধুয়ে যাচ্ছেন। এখন মধ্যরাত। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তাঁর মনোবল আমাকে বিরক্ত করছিল। সেই মনোবল যেন আমার বিশ্রামকে অলসতা দেখিয়ে আমাকে অপমান করছিল।

এলিস : আপনি যদি জিনিসগুলি পরিষ্কার করতে চান, তাহলে প্রথমে হাত নোংরা করতে ভয় পাবেন না।

শীঘ্রই বাড়িটি এত পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, আমরা তার মধ্যে থাকার সাহসই করবো না। বাড়িতে শয্যা থাকলেও আশা করা হচ্ছে আপনি তার পাশে কাঠের মেঝেতে শুয়ে থাকবেন। গদি, তাকিয়াগুলি হবে খুব পরিষ্কার। মাথা বা পা রেখে সেগুলিকে নোংরা বা বিবর্ণ করে দেওয়ার ভয় আপনি পাবেন। আর প্রত্যেকবার কার্পেটের ওপর আমি পা রাখামাত্রই কার্পেট পরিষ্কার করার মেশিন আমাকে অনুসরণ করে যাতে কার্পেটের ওপর আমার তৈরি করা দাগগুলো মুছে ফেলতে পারা যায়।

সন্ধ্যায় :

--সব কাজ শেষ।

তাঁর কি প্রয়োজন প্রত্যেকটি জিনিস, ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি আসবাব সরানো? কি প্রয়োজন বাড়ির মেঝে, দেওয়াল, সিলিং-এর সব দিক স্পর্শ করা?

এই মুহূর্তে তাঁর অন্তর্বর্তী গৃহিণীসত্তাই জিতে যায়। যখন তিনি আলমারির ভিতরের ধুলো পরিষ্কার করেন, তখন তিনি জানালার জেরানিয়াম গাছগুলোকে ধুলায়িত করে দেন।

তাঁর মা : এলিস সবসময়ই এত ব্যস্ত থাকে যে ও লক্ষই করে না যে ও জীবিত আছে।

গৃহকর্মই প্রকৃতপক্ষে নারীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিজের থেকে অনেক দূরে পালাতে দেয়। শার্দন যথার্থই বলেছেন :

এটি এমন একটি নিখুঁত এবং বিশৃঙ্খল কাজ যার কোনো বিরাম বা সীমা নেই। বাড়ির মধ্যে একজন স্ত্রী নিশ্চিতভাবেই সবাইকে দ্রুত খুশি করতে গিয়ে নিজের ভেঙে-পড়ার সীমানায়, বিক্ষিপ্ত অবস্থায় এবং মানসিক শূন্যতার গিয়ে পড়েন যা তাঁকে শেষ করে দেয় ...

এই পলায়ন, এই ধর্ষ-মর্ষকাম, যেখানে নারীরা অবিরত বস্তু এবং নিজের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান, সেখানে প্রায়শই একটি স্পষ্ট যৌন চরিত্র থাকে। “বাড়ির কাজকর্মের জন্য যে-পরিমাণ শরীরী কসরতের প্রয়োজন, তা হল মহিলাদের অভিগম্য পতিতালয়”, বলেছেন ভিওলেত ল্যদুক। এটা বিস্ময়ের যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার স্বাদ সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে হল্যান্ডে, যেখানে মহিলারা কামোত্তেজনাহীন। আর এই স্বাদ পিউরিটান সভ্যতায় সর্বোচ্চ যেখানে দেহ-মাংসের আনন্দের সঙ্গেই মিশে থাকে আদর্শ নির্দেশ এবং শুদ্ধতা। ভূমধ্যসাগরের মিদি অঞ্চল যদি নোংরা আনন্দের মধ্যে বাস করে, তার কারণ কেবল এটা নয় যে সেখানে জল দুর্লভ : দেহ-মাংস এবং নিজের জান্তবতার প্রতি ভালোবাসা মানুষের গন্ধ, অপরিচ্ছন্নতা এবং এমনকি কীটমূষিকাদি সহ্য করার পক্ষে সহায়ক।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment