- 17 May, 2025
- 0 Comment(s)
- 225 view(s)
- লিখেছেন : শ্রীরূপা মান্না
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কর্তৃক একটি সরকারি নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে, চাইল্ড ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট অফিসারের একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকবে চাইল্ড ম্যারেজ প্রহিবিশন অফিসার হিসেবে। হঠাৎ করে ২০২৪ সালে এরকম একটি অর্ডার বের হওয়ার কার্যকারণ কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয় নয়। পরিসংখ্যান বলছে পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহের হার বেশ ঊর্ধগামী এবং এই পরিসংখ্যান অস্বস্তিতে ফেলছে এ রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নকে, প্রশ্নের মুখে ফেলছে সরকারি ব্যবস্থাপনাকে এবং ল’ অ্যান্ড অর্ডারকেও। দুঃখজনক সত্যি এটাই যে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (৫) অনুযায়ী ২০২১ সালের রিপোর্ট বলছে গোটা দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দ্বিতীয়, প্রথম বিহার। দেশে যত বাল্যবিবাহ হয়েছে তার ১৫ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা। এমনকি শিক্ষার হার কম থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য রাজ্যগুলি যেমন উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা এগুলিতে বাল্যবিবাহের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম। বিদ্যাসাগর রামমোহনের ইতিহাস বহন করে চলা বাংলার এই রূপ সত্যিই লজ্জাজনক।
_বিবাহ একটি পিতৃতান্ত্রিক যূপকাষ্ঠ_
বাল্যবিবাহের সংখ্যা কেন বাড়লো, এই প্রশ্নটি অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের একটি বিষয় মাথায় রাখতেই হবে, তা হ’ল চলমান অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শ্রেণীর অবস্থান। সমাজের সবচেয়ে নিম্নবিত্ত অংশের মধ্যেই বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশী। শিক্ষালাভের সুযোগ, শিক্ষান্তে কর্মের অধিকার, কাজ পাওয়ার সুযোগ সবটাই দুর্লভ যে শ্রেণীর মানুষের কাছে, তাদের কাছে বাল্যবিবাহের কোনও খারাপ অর্থ নেই। আসলে এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও পিতৃতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থা মেয়েদের ওপর বাধ্যতামূলক সংসারের উপার্জনের দায় ন্যস্ত করেনি, নারীর শ্রমকে সীমায়িত করে রেখেছে চার দেওয়ালের মধ্যে গৃহের পরিসরে, ফলে তার শ্রমের মূল্য আজও উদ্বৃত্ত মূল্যই রয়ে গেছে; এই পিতৃতান্ত্রিক ভাবনারই ফলশ্রুতি নিম্নবিত্ত পরিবারে বাল্যবিবাহের প্রকোপ। ভাবনা এটাই যে একটা পেটও কম খেতে দিতে হলে একটা পরিবারে খানিক হলেও আর্থিক সাশ্রয় হয়। যদিও কার্যকালে উল্টোটাই বাস্তব সত্য হয়ে ওঠে। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে দেখা যায় মেয়েরাই রোজগারের একটা বড় অংশ বা বলা ভালো সিংহভাগ দায় বহন করে। তাত্ত্বিকভাবে 'উইমেন হেডেড হাউসহোল্ড' বলতে যা বোঝায় সেটাই দেখা যায় বেশীরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারে অর্থাৎ কেউই উপার্জন না করে বসে থাকেন না, যদিও সেই উপার্জন কতটা ব্যয় করার ক্ষমতা থাকে মেয়েদের হাতে, সেটা আলাদা প্রশ্ন। যাইই হোক, এই যে কন্যাসন্তানকে ‘দায়’ মনে করার পিতৃতান্ত্রিক ভাবনাটি কিন্তু অক্ষত।
গ্রামাঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কিশোরী মেয়ের বিয়ে দেওয়ার একটা বড় কারণ মেয়েটির নিজস্ব কোনও প্রেমসম্পর্ক স্থাপন হয়ে যাওয়ার ফলাফল। বহুক্ষেত্রে দেখা যায় কিশোরীবয়েসের একটি মেয়ে যদি কারওর সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং পরিবার ও গ্রামের মানুষের কাছে তা জানাজানি হয়ে যায়, তখন হয় পরিবার থেকে ওই সম্পর্ক মেনে নিয়ে যুগলের বিয়ে দেওয়া হয় অথবা কিশোরীর তড়িঘড়ি অন্য কোনও ‘সুপাত্র’ দেখে বিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের সমাজে একটি মেয়ের যৌনতা, আবেগ এগুলোর নিয়ন্ত্রক কখনওই সে নিজে নয়, এই নিয়ন্ত্রণের রাশ থাকে পরিবার ও সমাজের কাছে। মেয়েদের বহু অধিকার থেকেই এই সমাজ বঞ্চিত করে রাখে, তবে সর্বাগ্রে যে অধিকার থেকে একটি মেয়ে বঞ্চিত হয় তা হ’ল তার নিজের শরীর। যেহেতু নিজের শরীর ও যৌনতার সাথে পরিবার ও সমাজের ‘মানসম্মান’ নামক অলীক একটি বিষয় যুক্ত থাকে, তাই স্বেচ্ছায় একটি প্রেমের সম্পর্ককে বিয়ে ছাড়া বয়ে নিয়ে চলার পরিসর মেয়েদের হাতে থাকে না। ‘নাম খারাপ হয়ে যাবে’ এই মর্মে মেয়ের পরিবার সদাচিন্তিত থাকে, কারণ মেয়েদের ব্যবহার্য যৌনবস্তু রূপেই দেখা হয় আজও। একজন মেয়ে যদি কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সাথে প্রেমের সম্পর্কে থাকে, এবং যদি সম্পর্কটিকে পারিবারিক স্বীকৃতিও দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রেও ‘বিয়ে’টাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, কারণ সম্পর্কের পরিণতি ‘বিয়ে’ না হ’লে মেয়েটির ‘সতীত্ব’-এ দাগ পড়তে পারার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর যদি পরিবার থেকে সম্পর্কটিকে না মানা হয়, তাহলে তো কথাই নেই, অতি শীঘ্র তাকে অন্যত্র পাত্রস্থ করে দেওয়া হয়।
_শিক্ষার বেহাল পরিকাঠামো ও বাল্যবিবাহের আন্তঃসম্পর্ক_
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ার সাথে সাথেই বিয়ে, ভিন রাজ্যে চলে যাওয়া, ইলোপমেন্ট এগুলোর সংখ্যাও বেড়েছে শেষ চার পাঁচ বছরে। করোনা মহামারির সময়ে দীর্ঘদিন লকডাউনে যখন একদিকে প্রায় দেড় দুই বছরের জন্য স্কুল কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেল আর অন্যদিকে মানুষের বিশেষ করে ডেইলি ওয়েজ লেবারার অর্থাৎ দিনমজুরির পেশায় যুক্ত থাকা মানুষদের রোজগারে ভাটা পড়ল, তখন স্কুলছুট কিশোর কিশোরীদের সংখ্যা এক লাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। বলাই বাহুল্য একইসাথে শিশুশ্রমিক আর বাল্যবিবাহ বেড়েছিল। সেই বৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণ করা আর সম্ভব হয়নি পরবর্তী সময় ধরে। কেননা, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থাটাই কেমন যেন হেলে পড়ল সেই সময় থেকেই। একটা ছোট্ট বিষয় উল্লেখ করি। এই লকডাউনের সময়ে অনলাইন এডুকেশন নেওয়ার জন্য স্কুলের একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীকে প্রায় বাধ্য করেছিল সরকার। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণী অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রস্তুত ছিল না তখনও, তখন সরকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্মার্ট ফোনের ব্যবস্থা করলো। কথা ছিল সরকার পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশান সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর জন্য ট্যাবের ব্যবস্থা করবে যা কেবলমাত্র পড়াশুনোর কাজেই লাগবে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো না থাকায়, সরাসরি তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা প্রত্যেকে স্মার্ট ফোন কিনলো। গ্রামেগঞ্জে বহু অভিভাবক ও শিশুদের নিয়ে কাজ করতে থাকা কর্মীরা সরাসরি এই স্মার্টফোনকে দায়ী করেন বাল্যবিবাহের জন্য। কারণ বহুক্ষেত্রে দেখা যায়, ১৫-১৬ বছরের কিশোর কিশোরীরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় বিয়ে করতে। হাতে হাতে স্মার্টফোন থাকায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে বটে, কিন্তু বিন্দুমাত্র অ্যাডাল্ট এডুকেশন, সেক্স এডুকেশন না পাওয়া, বিকল্প শিক্ষা না পাওয়া একটা প্রজন্মের কাছে এই টেকনোলজির সঠিক ব্যবহারের জ্ঞানটাই তো নেই। ফলে কোনওরকম জীবনশৈলীর পাঠ না দিয়ে এই বিপজ্জনক জিনিসটি কিশোর কিশোরীদের হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকারকেই দায়ী মনে করেন বহু অভিভাবক, শিক্ষক শিক্ষিকারাও। এছাড়াও এই বহুদিন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায়, স্কুল বিমুখতা ভয়ানকভাবে বেড়েছিল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এর ফলে দেখা গিয়েছে, দীর্ঘ লকডাউনের পরবর্তী সময়ে স্কুল খুললেও কিশোর-কিশোরীরা আর স্কুলে আসছে না নিয়মিত। এর ফলে স্বাভাবিক মেলামেশা-বন্ধুত্ব এগুলো থেকে তারা দূরে সরে গিয়ে বিভিন্নরকম কাজ করে বসছে যা ঠিক ঐ বয়েসে করার কথা নয়। এসবক্ষেত্রে বহু সময় কিশোরকিশোরীরা পাচারকারীদের হাতে গিয়ে পড়ছে, জীবনে অসংখ্য বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে অজানা জীবনের ফাঁদে পড়ে গিয়ে।
শুরুতেই যে কথাটি বলছিলাম, তা হ’ল শ্রেণী ব্যাপারটিকে মাথায় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে বাল্যবিবাহের সমস্যাটিকে। এই যে ঘটনাগুলি আখছার ঘটছে, যদি সমীক্ষা করা যেত আলাদা ক’রে তাহ’লে দেখা যেত নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাল্যবিবাহের সংখ্যা সবসময় বেশী। এর একটা কারণ লেখার শুরুতেই বলেছি। আরেকটা বড় কারণ হ’ল মেয়েদের শিক্ষাদানে অনীহা। কন্যাশ্রী পাওয়ার কারণে বিদ্যালয়ে নাম তো তুলেই আসে একজন কিশোরী কিন্তু সঠিক পড়াশুনোর পরিবেশ না পাওয়ায় তার বিদ্যালয় বিমুখতা তৈরী হয় অনেক বেশী। একই সাথে দেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক পরিবেশে শিক্ষান্তে কাজ না পাওয়ার কারণেও এই শিক্ষাবিমুখতা আরও বাড়ছে। শিক্ষার পরিসর যথার্থ না পেলে একটি মেয়ের নিজের উপার্জনক্ষমতা সীমিত হয়, ফলে বিয়ে তার কাছে সামাজিক আশ্রয়ের নামান্তর হয়ে ওঠে। আরেকটা বিষয় হ’ল নিম্নবিত্ত পরিবারে কিশোর-কিশোরীদের প্রতিপালনের জন্য সময় থাকে না পরিবারের জ্যেষ্ঠদের ফলে সেই মানসিক বিকাশের ঘাটতি থাকলে, কোনোভাবেই এই বাল্যবিবাহ আটকানো সম্ভবপর হচ্ছে না।
_যা করণীয়_
এখন প্রশ্ন তাহ’লে “কী করিতে হইবে?” সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, বিশেষত নারী ও শিশু কল্যাণ ও সামাজিক সুরক্ষা দপ্তর একরকমভাবে নিরন্তর চেষ্টা করছে, যাতে বাল্যবিবাহ কোথাও হ’লে সেটাকে আটকানো যায়। প্রত্যেক থানার সেকেন্ড অফিসার এরজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, এছাড়া ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার, চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট অফিসার, চাইল্ড প্রটেকশন অফিসারের ওপর সরাসরি এই দায় আছে। গ্রামে বা মফঃস্বলে আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এরকম খবর পেলে সাথে সাথেই এদের সাথে যোগাযোগ করা হয়ও। কিন্তু এগুলো হচ্ছে দাবানলে বালতি বালতি জল ঢালার প্রচেষ্টা মাত্র। আসলে সমস্যা যেখানে লুকিয়ে আছে, সেই সামাজিক বোধ, শিক্ষা সংস্কার, সচেতন করার প্রয়াস সেখানে অনেক ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। অভিযোগ পেয়ে তার ভিত্তিতে বাল্যবিবাহকে অপরাধ আকারে দেখে শাস্তিবিধান করে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যায় না। শিশু অবস্থা থেকেই সঠিক শিক্ষাদান, কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিতে তাদের মানসিক শারীরিক সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা, সর্বোপরি সঠিকভাবে যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে সচেতন সমাজ গড়া সম্ভব নয়। বিদ্যালয়ের সঠিক পরিকাঠামো তৈরী করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী করে আর সর্বোপরি এই চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে শিক্ষান্তে সবার হাতে যোগ্য কাজের পরিসর তৈরী করতে হবে সরকারকে। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার, সচেতন করার উদ্যোগ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই নিবদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত এবং সোশ্যাল ক্যাপিটাল থাকা নাগরিক সমাজকে আলোকবর্তিকা হাতে নেওয়ার দায় নিতেই হবে। বিদ্যাসাগরের জন্মকর্মের দুইশত বছর পরেও যদি সামাজিক চিত্র একইরকম রয়ে যায়, তা ভয়ানক লজ্জার, সেই লজ্জার ভার আমাদের সকলকে বহন করতে হবে এবং সচেষ্ট হতে হবে তার থেকে উত্তরণের জন্য।
লেখক : সমাজকর্মী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment