- 06 October, 2020
- 0 Comment(s)
- 899 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কখনও ভাবিনি যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি নিবন্ধের শিরোনাম থেকে আমার একটি নিবন্ধের শিরোনামকে বাছতে হবে আমায়। ছোটবেলা থেকেই জাতি-ধর্ম-সংস্কার ইত্যাদিকে গৌণ বলে ভাবতে শিখেছি। প্রসঙ্গত বলা উচিত যে, সংস্কার অর্থে যদি লোকাচার বোঝায়, অথবা মানুষের উৎসব বোঝায়— তবে তার সঙ্গে আমার কোনপ্রকারে বিরোধ নেই। আমরা দুর্গোৎসবে পাঁঠার কালিয়া, অথবা কাশ্মীরি আলুরদম, ঈদ-উল-ফিতরে হালিম, সিমুই, এবং বড়দিনে ফ্রুটকেক খেয়ে আনন্দ করে থাকি। এমনকি খাওয়ার সময় এটুকুও মনে থাকে না যে সেই কাশ্মীরি আলুরদমের মশলাটি কার আবিষ্কার অথবা বড়দিনের ফুলো ফুলো নরম কেকটিও হাওড়ার ওদিককার কোন মুসলমান বেকারিতে ‘পাক’ করা হয়েছে ইত্যাদি; আমরা কেবল খাবারের গুণগত মানটুকুকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাই। সকলের সঙ্গে বসে একসাথে খাওয়ার আনন্দময় পরিবেশটুকুকেই উপভোগ করতে চাই। কিন্তু, গত কিছু মাসে— গত কিছু বছরে, আমার ধারণাগুলো যে শুধু ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে তাইই নয়, অসহায় ভাবে এটাই দেখতে দেখতে চলেছি যে, আমার দেশ— যে দেশকে নিয়ে গর্ব করি তার ইতিহাসের সুবাদে— তার শাসকগোষ্ঠীর সুবাদে নয়, সেই দেশকে— এমনকি সেই দেশের মানুষকে আমরা কতটুকুই বা চিনেছি, চিনতে পেরেছি। কতটুকুই বা জেনেছি ... অস্বস্তিকর সমস্ত হিসেব।
হ্যাঁ, হয়তো বিষয়টা হাথরাস। হয়তো বিষয়টা বাবরির রায়, হয়তো বিষয়টা আরো কোন জটিল রাজনীতির। কিন্তু বিশ্বাস করুন— আজকাল বিতর্কে যেতেও প্রবৃত্তি হয় না। কারণ, আজকাল বিতর্কের সেই পরিবেশটুকুই হারিয়ে গিয়েছে। বিতর্ক মানে বোধহয় এখন কেবলই কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা— পারলে বোধহয় ‘হাত থাকতে মুখে কেন’ আপ্তবাক্যে আত্মতৃপ্তিকরণ। সব মিলিয়ে আধুনিক যুগ যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশাল, উদার ও উন্মুক্ত, ভার্চুয়াল একটি মল্লক্ষেত্র বিশেষ, যেখানে কোন নিয়মই মানতে নেই। দু’কথা বলতে না বলতেই বিচ্ছেদ, রক্তারক্তি, কাটাকাটির আশঙ্কা প্রবল। একটা সময় বলেছিলাম, আমার দেশ অসহিষ্ণু নয়, কোনদিনও নয়— আমার দেশ সমস্ত কষ্টকে বরণ করে নিতে জানে। সমস্ত কষ্টকে বরণ করে নিয়ে চলতে জানে। সে বিশ্বাস আমার এখনও পর্যন্ত অটুট। পরিযায়ী শ্রমিকদের গণপদযাত্রার ইতিহাসকে মনে রেখেই সে বিশ্বাস আরও অটুট হয়েছে। তবুও সামাজিক মাধ্যমের একেকজন, তাঁদের একেকটি বিশেষ পোষ্ট, একেকটি বিশেষ বক্তব্যকে চোখে দেখলেও, কানে শুনলেও গা ঘুলিয়ে উঠতে চায়। সহিষ্ণুতার সংজ্ঞাটুকুকেও তখন, বই খুলে নিয়ে আরেকটিবার — মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়।
কাঁদো প্রিয় দেশ, এই মৃত্যুউপত্যকাতে আমাদের ঠিকানা নেই ...
হাথরাস নিয়ে সহজ কয়েকটি প্রশ্ন আপনাদের সামনে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মিডিয়ার কল্যাণে এসে পড়তে পেরেছে। চুম্বকে সেগুলিকে সাজিয়ে দিচ্ছি, মনে মনে ঝালিয়ে নিন। তারপর না হয় পরবর্তী প্রসঙ্গে যাওয়া যাবে।
১) ফরেনসিক ল্যাবরেটরির নিয়ম অনুসারে, ৯৬ ঘন্টার চেয়ে বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে পরে আর প্রায় কোন ফরেনসিক প্রমাণই অবশিষ্ট থাকে না। সেক্ষেত্রে নির্যাতিতা তরুণীর ফরেনসিক নমুনাকে ঘটনার ১১দিন পরে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে কোন ফলের আশা করেছিলেন তদন্তকারী অফিসারেরা? এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
২) যদি ধর্ষণই না হয়ে থাকে, তাহলে ২৫লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের দরকারটা কোথায়? সরকারি আধিকারিক আবার সাংবাদিকদের সামনেই যেখানে পরিবারকে হুমকি দিয়ে গেছেন, যে ‘সবক’ ঠিক না থাকলে পরে এই টাকা মেলাটাও পরবর্তীতে দুষ্কর হবে।
৩) রাতের অন্ধকারে যেভাবে লাশটিকে পুড়িয়ে ফেলা হল, জ্যারিকেন থেকে গাড়ির পেট্রোল ছড়িয়ে— পরিবারকে পুলিশ দিয়ে আটকিয়ে রেখে, সেটাকে কোন ভারতীয় বা পাশ্চাত্য, বা আদিম যুগের ব্যবিলনীয় সংস্কার অনুযায়ী ‘সৎকার’ বলে দাবি করা যেতে পারে? তনুশ্রী পাণ্ডের প্রশ্নটিই যে আমার আপনার সকলের গায়েই ছ্যাঁকা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, “ও কেয়া জ্বল রহা হ্যায়!”
ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই! “ও কেয়া জ্বল রহা হ্যায়!”
কামদুনির শাস্তি হয়নি। রাজস্থানেও শুনেছি একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, যে হাথরাস নিয়ে খবর না দেখিয়ে— বিশেষ কিছু মিডিয়া চ্যানেলের মূল বক্তব্য বিষয়ই হয়ে দাঁড়াল যে, রাজস্থানের ধর্ষণ নিয়ে সকলে নিশ্চুপ কেন। খুব নোংরা ভাবে উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়, কারণ সেখানে পুলিশ দেহ পুড়িয়ে দেয়নি। কারণ সেখানে ১৪৪ধারা জারি করে রং-মত-নির্বিশেষে সমস্ত বিরোধী নেতাকে নির্লজ্জ পুলিশি কায়দায় আটকিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়নি। প্রত্যেকটি ধর্ষণ নির্লজ্জতার, নৃশংসতার চরমতম উদাহরণ। কিন্তু যদি দুটি ঘটনা ঘটে, এবং একটি ঘটনাকে চাপা দিতে শাসকপক্ষ অভূতপূর্ব ভাবে সচেষ্ট হয়ে ওঠে তবে খবর হিসেবে দ্বিতীয়টিই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রথম ক্ষেত্রে অপরাধ হয়েছে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অপরাধ তো হয়েইছে, আবারও অপরাধটিকে ঢাকার জন্যও সরকারি তরফে বন্দোবস্ত করা হয়েছে— যেটি আরেকটি, আরও বড়মাপের, আরও নির্লজ্জ অপরাধ। প্রথম ক্ষেত্রে অপরাধের সংখ্যা এক, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে একের অধিক। কাজেই, খবরের কাগজের পাতায় বা মিডিয়ার পাতায় যে দ্বিতীয়টিই প্রথম শিরোনামে আসবে তা সাধারণ যুক্তিতেই বোধগম্য হওয়া উচিত। আপত্তি হত যদি, কোন একটি খবরের চ্যানেল দুটি খবরের মধ্যে কেবল একটিকেই প্রচার করে যেত। দুঃখের বিষয় যে, নিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে একাধিক মিডিয়া গোষ্ঠী সেই কাজে লিপ্ত, এবং তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্য অনুসারে কেবলই তাঁদের ‘পছন্দের’ সংবাদটিকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রচার করে চলেছেন। সংবাদমাধ্যমের ‘স্বাধীনতা’ অক্ষয় হউক।
এখানেই সমস্ত মিটছে না। এমনও অভিযোগ এসেছে যে— কোথাও কোথাও, বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক মাধ্যমে একাধিক ভুয়ো ধর্ষণের খবর সম্প্রচার করে হাথরাস কান্ডের ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ সচেষ্ট হয়েছেন। সেই সমস্ত জায়গার পুলিশ দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থাও নিয়েছেন। নারীকে পণ্য হিসেবে দেখানোর এমন সার্থক উদাহরণ ভূভারতের কোথাওই আর মিলবে না বোধহয়। উত্তরপ্রদেশের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, নারীদেরকে ‘সচেতন’ ভাবে ব্যবহার করতে হবে, সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে চলবে না। আরেক বিধায়ক বলেছেন, ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে হলে নারীদেরকে ‘সংস্কারী’ হতে হবে। তিনি অল্পবয়সী মেয়েদের পরিবারগুলিকেও এই বিষয়ে সতর্ক হতে বলেছেন। হাথরাসের ঘটনা নিয়েও তাঁর দেবতুল্য ব্যাখ্যা সামাজিক এবং সংবাদমাধ্যমগুলিতে ইতিমধ্যেই ঝড় তুলে দিয়েছে। সমস্ত কিছু দেখতে দেখতে, ছোটবেলায় কালার্স চ্যানেলের একটি জনপ্রিয় সিরিয়ালের টাইটেল ট্র্যাকটিকে মনে পড়ে যাচ্ছিল, “না আনা ইস দেশ— মেরী লাডো ...” এদেশে তোর ঠাঁই ফুরিয়েছে এখন।
কাঠুয়া থেকে উন্নাও, শেষ অবধি হাথরাস— যে খবরে আমাদের গায়ের রোমটুকুও খাড়া হয়ে উঠতে পারত, তাও হয়েছে। শাসকদলের মদতে, হাথরাসের অভিযুক্তদেরকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের উচ্চবর্ণের হোমরাচোমরারা সকলে প্রকাশ্য সমাবেশ করেছেন। ক্ষমা তো দূরঅস্ত, অভিযুক্তদের অপরাধকেই যে শুধু তাঁরা স্বীকার করেননি তা নয়, উলটে নির্যাতিতার পরিবারের বিরুদ্ধে এফআইআরের দাবি তুলেছেন তাঁরা। দলিত, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ, উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্গ— এই সমস্ত কিছুকে তো আমরা পড়িনি কখনও, পড়তে চাইওনি বোধহয়। আমাদের পৃথিবীতে উঁচুজাত নীচুজাতের ভেদাভেদ থাকে না। অথবা আমাদের পৃথিবীটাই আসলে ভয়ানক রকমে ছোট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরাও সকলের চোখে ছোট হয়ে গিয়েছি। দেশ হিসেবে নয়, সম্প্রদায় হিসেবে নয়, এগুলি গৌণ পরিচয়, জন্মের পরবর্তী পরিচয়। মনুষ্যজন্মই হল সেই বস্তু, যা আমাদের জীবনের প্রাথমিক সত্য— আদি সত্য, একমাত্র সত্য। আমরা মানুষ হিসেবে নিকৃষ্ট হয়ে গিয়েছি। আমাদের সমস্ত অধিকার ফুরিয়েছে।
ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই!
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। শবযাত্রায় চলেছে দেশ। সেই কফিন পুরুষতন্ত্রের নয়। পুরুষতন্ত্র সেই কফিনের বাহক, ধর্মতন্ত্র সেই কফিনের বাহক, একনায়কতন্ত্র সেই কফিনের বাহক, জাতিতন্ত্র সেই কফিনের বাহক— সেই কফিনের দেহ মানবতার। সেই কফিনে বন্দী গণতন্ত্র, সেই কফিনে বন্দী বাক। অবদমিতের কফিনে পেট্রোল ঢালুক জনতা। আমরা সকলে আজ সেই কফিনের বাহক হয়ে দাঁড়িয়েছি। একদিন নয়, যুগে যুগে— বহুদিন ধরে বহুমাস ধরে, যখন আমরা স্তব্ধ ঋষিপ্রতিম প্রাজ্ঞ নীরবতাকে ‘দেহাতী অওরত’-এর সঙ্গে তুল্য হতে দেখেছি, আর সেই তুলনাতে ‘হা হা’ ইমোজি ঠুকেছি। বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেউ বা ভুল করেও সামান্য হোঁচট খেলে পরে, তাঁর সেই সৎ সলজ্জতাকে ‘পাপ্পু’ বলে ব্যঙ্গোক্তি করতে শিখেছি, বন্যাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ সদাব্রতীকে ‘দেশদ্রোহী কম্যুনিষ্ট’ বলে ভাবতে শুরু করেছি— আমাদের অধঃপতন শুরু হয়েছে সেই দিন থেকেই। এখন হা-হুতাশ করা ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই।
ছবি: সংগৃহীত
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment