‌পৈতৃক সম্পত্তিতে মুসলিম নারীদের প্রতি বৈষম্য : আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা/‌পর্ব-‌৪

  • 23 August, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1340 view(s)
  • লিখেছেন : সফি মল্লিক 
ইসলামি রীতিকে আধুনিকীকরণ করার কোনও আন্দোলন ভারতীয় মুসলিমদের ভিতর থেকেই ‌যদি উঠে আসে, তাকে ধারণ করার রক্ষাকবচ ভারতীয় সংবিধানেই আছে। সেই বিকল্প আন্দোলনের ধারাটি ইসলাম সম্মত নয় বলে বাতিল করার কোনও সুযোগ নেই। 

পর্ব-৪

আইন সংস্কারে ভারতের সংবিধান যেসব হাতিয়ার ইতিমধ্যে দিয়েছে
ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিকভাবে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশ গেছে, তার কিছু টুকরো টুকরো আলোচনা করেছি। বর্তমান সময়ে শুধু ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখলে, স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যাবে, যদি অতীতের ও সমসাময়িক ইতিহাসের লড়াই যেসব মূল্যবান প্রাপ্তি ও সংস্কারের ছাপ রেখেছে সেগুলি বিস্মৃত হয়ে যাই। 

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবসানের সাথে সাথে আধুনিক যেসব রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে সেগুলির সংবিধানকে যথাসম্ভব ধর্মীয় রীতিনীতিকে ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় হিসাবে দেখার চেষ্টা হয়েছে। অন্যদিকে এক ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির বা পরিবারের স্বার্থের প্রশ্নগুলিকে আধুনিক রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের এক্তিয়ারের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে। যে আইন প্রতিনিয়ত সমাজ ও পরিবেশের বদলের সাথে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিবর্তনশীল। এটি একটি সুদীর্ঘ সময় জুড়ে অগণিত মানুষের লড়াই ও আত্মবলিদানের প্রত্যক্ষ অবদান। 

ভারতের সংবিধান সেরকমই এক দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রাপ্তি। ভারতের সংবিধানের মধ্য থেকে কীভাবে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের ভাই-বোনের পৈতৃক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব সে আলোচনা অবশ্যই করব। আগেই আলোচনা করেছি ইসলামিক রীতিনীতিকে মর্যাদা দেওয়া এবং মুসলিম সংখ্যাগুরু অনেক দেশেই এখন সম্পত্তির অধিকারটি চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সেই ধারা বজায় রেখেই সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা আধুনিক সংবিধানের মৌলিক উপপাদ্য ও শরিয়তে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে যে বিধান আছে তার সংঘাত এড়িয়ে কীভাবে নারী ও পুরুষে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় সেটা নিয়ে দেশের ধর্ম ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের ভাবনাচিন্তা করতে অনুরোধ করেন। সেখানে হাসিনা সম্পত্তির বণ্টনে ‘ছেলে’ ও ‘মেয়ে’ আলাদাভাবে বিবেচনার করার পরিবর্তে ‘সন্তান’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা যায় কী না সেটাও ভেবে দেখার অনুরোধ করেন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধ মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারেও চরম বৈষম্য আছে। সংখ্যালঘুদের নিজস্ব অধিকারে নাক গলানোর বিপদ মাথায় রেখে সেখানকার সরকারও আইন সংস্কার নিয়ে মাথা ঘামানো এড়িয়ে যেতে চায়। হিন্দু শাস্ত্র হোক বা ইসলামিক শাস্ত্র, কোনও শাস্ত্রই সুষম একমুখী হয় না। শাস্ত্র, পুরান, উপনিষদ যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে রচিত, তাই তার অনেক লেয়ার ও বহুমুখী অভিঘাত থাকে। সেখানে কিছু কিছু ভাষ্য পরস্পরকে কনট্রাডিক্টও করতে পারে ও বাস্তবে করেও। এমনকী স্বাধীন ভারতের সংবিধানেও সেইসব বিপরীত মুখী ঝোঁক আছে। সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ নং পর্যন্ত ধারায় ধর্ম চর্চায় ব্যক্তির স্বাধীন অধিকার নিয়ে আলোচনা করেও সেই দ্বন্দ্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই ধারাগুলি ধর্ম, ব্যক্তি ধার্মিক, ধর্মীয়গোষ্ঠী, ও ধর্মের মুখপাত্র হয়ে ওঠা নিয়ে আরও বিশদ আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

25. Freedom of conscience and free profession, practice and propagation of religion
আর্টিকেল ‌২৫ ভারতের প্রতিটি নাগরিককে নিজস্ব বিবেক ও স্বাধীন পেশার স্বাধীনতা দেয়, তার ধর্মের অনুশীলন ও প্রচারের স্বাধীনতা দেয়।
(1) Subject to public order, morality and health and to the other provisions of this Part, 
উপরের স্বাধীনতা ততক্ষণ পর্যন্ত ভ্যালিড থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না একজনের স্বাধীনতা অন্যজন তার শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ ও জীবনের জন্য হুমকি হয়ে না দেখা দেয়।
all persons are equally entitled to freedom of conscience and the right freely to profess, practice and propagate religion
অর্থাৎ আপনি যতক্ষণ অন্যের জীবনের ছন্দ বিঘ্ন না করছেন আপনার ধর্ম, ভাষা, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ যাই হোক না কেন, আপনি নিজের জীবনবোধ অনুযায়ী চলার স্বাধীনতা পাবেন।
(2) Nothing in this article shall affect the operation of any existing law or prevent the State from making any law
তবে আপনার বিশ্বাস ও লোকাচার দেশের অন্য কোনও প্রতিষ্ঠিত আইনকে খর্ব করার ক্ষমতা রাখে না। আপনার এই অধিকার সংবিধান মেনে নতুন কোনও আইন প্রণয়নে বাধাও দিতে পারে না।
(a) regulating or restricting any economic, financial, political or other secular activity which may be associated with religious practice;
বিশেষ করে অর্থনৈতিক, মুদ্রাসংক্রান্ত, রাজনৈতিক অথবা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে ধরতে যেসব আইন আছে, সেইগুলির ঊর্ধ্বে আপনার ধর্মসংক্রান্ত অধিকার নেই। যদি কোথাও মুখোমুখি লড়াই হয়, সংবিধানের ইথোস যেদিক নির্দেশ করে সেই ধারাগুলিই আপনার ধর্মসংক্রান্ত অধিকারের ঊর্ধ্বে গ্রহণযোগ্য হবে।
(b) providing for social welfare and reform or the throwing open of Hindu religious institutions of a public character to all classes and sections of Hindus Explanation I 
অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের নানা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি মানুষের জন্য খুলে দিতে যেসব আইন আছে সেগুলো আপনার মতো কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আপত্তি গ্রাহ্য হওয়ার কথা নয়। The wearing and carrying of kirpans shall be deemed to be included in the profession of the Sikh religion Explanation II in sub clause (b) of clause reference to Hindus shall be construed as including a reference to persons professing the Sikh, Jaina or Buddhist religion, and the reference to Hindu religious institutions shall be construed accordingly
অন্যদিকে কৃপাণ পরিধানকে সংবিধান সম্মতভাবে অধিকার হিসাবে দেওয়া হয়েছে
(অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ‌২৫ আলোচনা করেছে, একজন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার)

26. Freedom to manage religious affairs Subject to public order, morality and health, every religious denomination or any section there of shall have the right
২৬ নং ধারা ব্যক্তির ধর্ম ও বিবেক সংক্রান্ত অধিকারকে প্রসারিত করে সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার দিচ্ছে। ধর্মীয় বিষয় পরিচালনার স্বাধীনতাকে জনসাধারণের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্যর যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার সাপেক্ষে, প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় ও বিভাগ সৃষ্টির অধিকার দিচ্ছে নিম্নের বিষয়ে—
(a) to establish and maintain institutions for religious and charitable purposes; প্রতিষ্ঠান স্থাপনের।
(b) to manage its own affairs in matters of religion; ধর্ম সংক্রান্ত নিজস্ব বিষয় পরিচালনা করার।
(c) to own and acquire movable and immovable property; 
ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্পত্তির অধিকার। এবং
(d) to administer such property in accordance with law.
আইন মেনে সম্পত্তির দেখভাল করার অধিকার।

প্রতিবেশী দেশে আহমেদীয় গোষ্ঠীকে নিয়ে একটি বিতর্ক মাঝে মাঝেই মাথা তোলে। আহমেদীয় গোষ্ঠীকে মুসলিম বলে মানতেই চায় না অন্যান্য মুসলিম গোষ্ঠী। কে মুসলিম আর কে মুসলিম নয় এই বিতর্কের জন্য ভারতের সংবিধানের ২৫ নং ধারা ভাল সুরক্ষা দিয়েছে। এখানে একক ব্যক্তি নিজেই ঠিক করতে পারবেন তাঁর ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, দার্শনিক চিন্তা ভাবনাকে। ২৫ ও ২৬ ধারা ব্যক্তিকে নিজস্ব ধর্মাচরণের অধিকার দিয়েছে আবার সেই ধর্মটা সে কীভাবে পালন করবে তারও অধিকার দিয়েছে। সেইমত গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান করারও অধিকার দিয়েছে। এই অধিকার থেকে মুসলিমদের দেওয়ানি বিধির ক্ষেত্রে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড উচ্চ ক্ষমতা ভোগ করলেও তাঁর অধিকার প্রশ্নাতীত নয়। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড কতটা গণতান্ত্রিক ও কতটা সমগ্র ভারতীয় মুসলিমদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার অর্জন করেছে সেটাই প্রশ্নের মুখে। ভারতীয় গণতন্ত্রে যেমন বহুদলীয় ব্যবস্থা আছে, ইসলামি রীতির মান্যতা নির্ধারণ করার জন্যও বহু গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা সব সময় স্বীকার করে। ধর্মাচরণের স্বাধীনতার আইনি অধিকার বলে ভারতের কোনও মানুষ নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করলে,‌ তিনি মুসলিম রীতিনীতির কতটা গ্রহণ করবেন ও কতটা বর্জন করবেন সেটার একমাত্র নির্ণায়ক তিনি নিজেই। সেক্ষেত্রে ইসলামের বহু ধারার মধ্য থেকে কোনও এক ধারাকে গ্রহণ করে, যদি মুসলিমদের মধ্যে কোনও এক জনগোষ্ঠী পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সমানাধিকারের সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়,‌ তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সব ব্যবস্থা বর্তমান সংবিধান ইতিমধ্যে দিয়ে রেখেছে। সুতরাং ইসলামি রীতিকে আধুনিকীকরণ করার কোনও আন্দোলন ভারতীয় মুসলিমদের ভিতর থেকেই ‌যদি উঠে আসে তাকে ধারণ করার রক্ষাকবচ ভারতীয় সংবিধানে আছেই। সেই বিকল্প আন্দোলনের ধারাটি ইসলাম সম্মত নয় বা অন্য কোনও ভাবে বাতিল করার সুযোগ নেই। 

২৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী মুসলিম সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার অধিকার থাকলেও কোনও ‘একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান’ ইসলামি রীতিনীতি ও আইনের স্বত্বাধিকারীর অধিকার পেতে পারে না। এই বিষয়ে কিছুটা ধোঁয়াশার সুযোগ নিয়ে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড ইসলামিক আইনের সর্বেসর্বা হয়ে বসে আছে। তাই আইনি পথে এই লড়াইয়ে যারা নামবেন তাঁদের সঙ্গে ইসলামের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রচেষ্টাগুলি খুঁজে বার করে জল হাওয়া দেওয়া নিয়ে সচেতন থাকতে হবে।
 

আইন পরিবর্তন ও তারপর
আমার নিজস্ব ধারণায় আইন আজ না হয় কাল পরিবর্তন হবেই, কিন্তু মূল প্রশ্ন তখন ফিরে আসে যে বাস্তবিকতার বদল কীভাবে হবে? পণপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে সমাজে আজও রমরমিয়ে চলছে, তার কারণ, আইন প্রণয়ন হলেও পণপ্রথার বাস্তবিক ভিত্তির দিকে নজর দেওয়া হয়নি। ২০০৫ সালে হিন্দু আইনের সংস্কার করে সমানাধিকার স্বীকৃত হয়েছে, তারপরেও প্রকৃত পক্ষে মেয়েদের হাতে পৈতৃক সম্পত্তি, বিশেষ করে কৃষিজমি আসেনি। এর কারণ ট্রাডিশনালি দুই ভাই হলে পৈতৃক সম্পত্তিকে দুইভাগ করার মধ্যে কোনও ভাই লজ্জা পায় না, কিন্তু এক ভাই ও এক বোন হলে এবং বোন ভাইয়ের কাছ থেকে অর্ধেক সম্পত্তির দাবি করলে সেটি সমাজের চোখে ঘৃণিত হয়। বোনকে লোভী, স্বার্থপর হিসাবে চিত্রিত হতে হয়। তাই, আইন হলেও যতক্ষণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনকে অধিকার প্রশ্নে দেখা না হচ্ছে, আইন থাকলেও বোনেদের ন্যায্য সম্পদে সেইভাবে দাবি জানাতে দেখা যাবে না।

পরিবারের সংজ্ঞা বদলে গিয়ে বা সংক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে যখন সন্তান সংখ্যা এক বা দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তখন পৈতৃক সম্পত্তির ইস্যুটি শুধু মেয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি বৃদ্ধ বাবা মায়ের জন্যও ইস্যু হয়ে যায়। ভবিষ্যতে কখনও যদি জমি-জায়গার প্র‌শ্নে ব্যক্তিগত সম্পদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখনকার ব্যবস্থা যেমনই হোক, যতদিন ব্যক্তিগত সম্পদের ব্যবস্থা থাকবে ততদিন মানুষ সম্পদ সঞ্চয় করবে অনাগত ভবিষ্যতের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে। বংশ পরম্পরায় পরের প্রজন্ম বৃদ্ধ অবস্থায় তাঁদের দেখবেন এই আশাতে আগের প্রজন্ম সম্পদের সঞ্চয় করেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিয়ে মানে শুধুমাত্র ভাই ও বোনের মধ্যে বোনটিকেই অন্য বাড়িতে উঠে যেতে হবে এই ব্যবস্থার বদল হতেই পারে। ভাই ও বোনের মধ্যে কেউ অন্য বাড়িতে উঠে যাবেন, নাকি বোন বিয়ে করে তাঁর স্বামীকে সেই বাড়িতে নিয়ে আসবেন এবং ভাই ও বোন পাশাপাশি পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করবেন বা ভাই বিয়ে করে তাঁর বউয়ের বাড়িতে উঠে যাবেন এগুলির একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হতে পারে। 

প্রবন্ধের প্রথমেই যেমন উল্লেখ করেছিলাম, বিয়ের পর একজন একটি পরিবারের থেকে দুটি পরিবারের সদস্য হতে পারেন। এখন বহু পরিবারে বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখভালের দায়িত্ব উপার্জনশীল কন্যা নিলেও, গৃহবধূ কন্যারা ব্যতিক্রমী স্বামী ছাড়া ইতস্তত করেন বা নিতেই পারেন না। অনেক বৃদ্ধ বাবা মাও মনে করেন বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে তাঁদের কন্যা অন্য পরিবারের হয়ে গেছে, যেহেতু মেয়ে তাঁর সম্পদ সেইভাবে পায় না, তাই বাবা মা মেয়ের কাছে গিয়ে থাকতে  সংকোচ করেন। এরফলে অনেক ক্ষেত্রে ছেলে দুর্ব্যবহার করলেও, সেসব সহ্য করে ছেলের কাছেই থাকতে বাধ্য হন। তাঁরা মনে করেন যেহেতু তাঁর সম্পদ ছেলেই পাবে তাই অপমানিত হলেও ছেলের কাছে থাকেন। অনেক মেয়ে আজকাল নিজে থেকেই বৃদ্ধ বাবা মায়ের দায়িত্ব নিলেও,‌ যতদিন সম্পত্তির অধিকার থেকে মেয়ে বঞ্চিত থাকবে ততদিন মেয়ের কাছে বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখাশোনা ঐচ্ছিক প্রশংসনীয় কাজ হয়ে থাকবে। দায়িত্ব কর্তব্যের পর্যায়ে পৌঁছাবে না। ভবিষ্যতে যাতে পুত্র কন্যা নির্বিশেষে বৃদ্ধ বাবা মায়ের দায়িত্ব পালন করে সেরকম পরিবেশ ও অবস্থা তৈরি করা সময়ের দাবি। পৈতৃক সম্পদের সমান উত্তরাধিকার যেমন লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্ন, বার্ধক্যে বৃদ্ধ বাবা ও মায়ের দেখাশোনা করা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্যও সেরকম অবশ্য কর্তব্য। আর এই সমানাধিকারের প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের দেশে সবার আগে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের এগিয়ে আসতে হবে। পৈতৃক সম্পত্তির প্রয়োজন থাক বা না থাক, সেই অধিকার উপভোগ করে সামাজিক ট্যাবুকে দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে। ভাইয়ের কাছ থেকে সম্পত্তি বুঝে নেওয়া যাতে ঘৃণ্য বা লজ্জাজনক না হয়। এইভাবে বিয়ের পর এক পরিবার থেকে দুই পরিবারের সদস্য হয়ে নারী ও পুরুষ উভয়ের দুই বাড়িতেই একটি করে একদম নিজস্ব ঘর বুঝে নিতে হবে। সম্পদের এই অধিকার মেয়েরা বুঝে নিতে পারলে ওয়ার্কিং মহিলা বা গৃহবধূ যাই হন, একজন মহিলার তাঁর নিজের যে কোনও একটি ঘরে যাওয়ার জন্য শ্বশুর বাড়ির লোকেদের অনুমতি নেওয়ার প্রচলিত রীতিকে মুছে ফেলা সম্ভব হবে। আর মেয়েদের বাবা মায়েদের ভূমিকা এক্ষেত্রে ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। বাবা মায়েরা ছেলেদেরকে যেভাবে মানুষ করেন তার মধ্যেও বদল আনার দরকার। রোজগার, সম্পত্তি নিয়ে ভাবনা ছেলেদের মাথায় যতটা ঢোকানো হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের মাথায় সেটা ঢোকানো হয় না। বিয়ের আগে মেয়ের প্রয়োজন বাবা মেটাবে আর বিয়ের পর স্বামী, এই ভাবনা যাতে কোনভাবে মেয়েদের মাথায় না ঢোকে সে বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার। কন্যা সন্তানদেরও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতেই হবি, এই বোধটি ছোট থেকেই শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে রাখা দরকার। দেশে যতদিন ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টি বেআইনি নয়, ততদিন যেন মেয়েদের সম্পদ সৃষ্টি ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করাকে  অধিকার হিসেবে দেখতে হবে। এখনও মেয়েরা শ্বশুরের সম্পত্তির অধিকারী নয়। তাই স্বামীর সাথে সংসার করতে গিয়ে অত্যাচারিত হলে, সে যাতে নিশ্চিন্তে মা বাবার কাছে ফিরে আসতে পারে সেই ব্যাপারে তাদের অত্যন্ত যত্নশীল হতে হবে। যদিও এখন ভারতে ডিভোর্সের মামলা মেয়েটি শ্বশুড়বাড়িতে থেকেই চালাতে পারে, কিন্তু মেয়ের বাবা মা-র দায়িত্ব অনেক। 

মুসলিম ও হিন্দু মেয়েরা একই সাথে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে আলোচনা শুরু করুক। এই লড়াই শুধু আদালত বা শুধু ভুক্তভোগীর ব্যাপার নয়। সমাজের প্রতিটা স্তরের ভূমিকা আছে। যেসব মুসলিম পুরুষরা ভারতের রাজনীতিতে মুসলিমরা প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছেন বলে চিন্তিত হবেন, রাজনৈতিক অভিমুখ বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখবেন, তাঁদের সমাজে মেয়েদের প্রান্তিক হয়ে যাওয়া নিয়েও ভাবতে হবে। ভাইদের, স্বামীদের অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। কয়েক হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি এক প্রজন্মের শিক্ষা ও চেতনা দিয়ে ব্যক্তি মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেখানে রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত প্রতিটি পুরুষকে নারীবাদের মৌলিক প্রশ্নগুলিকে নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে। নিরন্তর পুরুষের নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক স্ত্রী যেমন নিজের সম্পত্তির বিষয়ে সচেতন থাকবে স্বামীকেও সচেতনভাবে স্ত্রীর সম্পদের প্রশ্নগুলি নিয়ে চর্চা করতে হবে। নারীবাদ যে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল, গৃহকাজে পুরুষ ও মহিলাদের সমান তালে হাত লাগানো শিখতে হবে। রাজনৈতিক কর্মী ভাইদের সচেতন ভাবেই বোনেদের সম্পত্তির অংশ বুঝিয়ে দিতে হবে। বোনেরা যাতে ভাইয়ের কাছে সম্পত্তির ভাগ নিতে কুণ্ঠিত না হয় তার জন্য হাজারে হাজারে উদাহরণ সমাজ জুড়ে তৈরি করতে হবে। উচ্চ শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনদের মধ্যে আপাতভাবে কোন‌ও একজনের পৈতৃক সম্পত্তির প্রয়োজন না থাকলেও সামাজিক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে এর অনুশীলনগুলি দরকার। তবেই আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেও বাস্তবে মেয়েদের অধিকার সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং তথাকথিত শিক্ষিত ও আধুনিক মহিলাদের দৃষ্টান্ত প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র ও অল্পশিক্ষিত মহিলাদের স্বপ্ন দেখতে শেখাবে। এই ভাবেই নিরন্তর আমরা লিঙ্গবৈষম্যের মান ক্রমাগত কমানোর লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারব।  

সমাপ্ত

পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ৮ জুলাই ২০২০ 

প্রতীকী ছবি

লেখক: অধ্যাপক

সৌজন্য ‌: ‘‌সহজিয়া’‌ ২০২০ ইদসংখ্যা

0 Comments

Post Comment