- 22 November, 2022
- 0 Comment(s)
- 239 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আগুন শেষ অবধি খোমেইনির দরজাতেও গিয়ে পৌঁছল। গত শনিবারের খবর অনুযায়ী ইরানের খোমেইন শহরে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা তথা ১৯৭৯ সালে ইরানের যে বিপ্লব আন্দোলন, তারই অন্যতম প্রধান নেতা, প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ক আয়াতোল্লাহ খোমেইনির জন্মস্থান তথা বাসভবনে ইরানের বিদ্রোহী জনতা অগ্নি-সংযোগ করেছে। বর্তমানে সেই বাসগৃহটি জাতির নেতা খোমেইনির বিভিন্ন স্মৃতিদ্রব্য দিয়ে সাজানো, সংরক্ষিত একটি মিউজিয়ম হিসেবেই ব্যবহার করা হতো। তবুও, খোমেইনির জন্মস্থান ও বাসভবন হিসেবে এই বাড়িটির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় তিন মাস ধরে চলতে থাকা ইরানের যে আন্দোলন, এই অগ্নি-সংযোগের ঘটনা নিঃসন্দেহে তারই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠতে চলেছে।
আগুন লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই আগুনকে ঘিরে উপস্থিত জনতার উল্লাস ও উদযাপনের ছবিও ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দাবানলের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এই ঘটনা এমনই এক সময়ের ঘটনা, যে সময়ে দাঁড়িয়ে কানাঘুষোয় খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ইরানের মোল্লা-সরকার নাকি বিক্ষোভ আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া সমস্ত ব্যক্তিকেই শূলে চড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এই মুহূর্তে ইরানে বিক্ষোভ আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া প্রতিবাদীর মোট সংখ্যা প্রায় ১৫,৮০০র কাছাকাছি। এই সমস্ত বিক্ষোভকারীকেই যে শূলে চড়ানো হবে, ছড়িয়ে পড়া এই তথ্য বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, তা আদতে সত্য নয়। কিন্তু তা হলেও, ২৯০ আসন বিশিষ্ট ইরানের সংসদ কক্ষে ২২৭জন সাংসদই মানবাধিকারের কোনওরকম তোয়াক্কা মাত্র না করে এই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। সকল বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হতে চলেছে তা হয়তো সময়ই বলবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই কুর্দিস্তানের গায়ক সনম ইয়াসিনকে প্রশাসনিক প্রতিনিধির বিরুদ্ধে ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শোনানো হয়েছে। যদিও এই বিচারের কতটুকু বৈধতা আছে তা আপনারাই বিচার করবেন। বিচারের সময় সনমকে তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে অবধি দেখা করার কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি। একতরফা ভাবেই এই রায় ঘোষিত হয়েছে। এই সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতেই আয়াতোল্লাহ খোমেইনির বাসভবনে অগ্নি-সংযোগের ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। মাহশার লড়াই বিস্ফোরণ হয়ে ফেটে পড়েছে আজ ...
এখানেই শেষ নয়। যে রাত্তিরে এই লেখা লিখতে বসেছি, তার মাত্র কিছুক্ষণ আগেই ফুটবল বিশ্বকাপের মঞ্চে ইরান বনাম ইংল্যাণ্ডের খেলা শেষ হয়েছে। খবরে প্রকাশ, ম্যাচ শুরুর আগে সাংবাদিক সম্মেলনে ইরানীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক সরাসরি দেশে চলতে থাকা প্রতিবাদ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং ম্যাচ শুরুর সময় জাতীয় ফুটবল দলের প্রত্যেক সদস্য মাঠে নেমে, খোমেইনি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে স্টেডিয়ামে বেজে ওঠা জাতীয় সঙ্গীতে অবধি গলা মেলাননি। আন্দোলনের ব্যাপ্তি যে কতদূর ছড়িয়েছে এমন একেকটি ঘটনার মাধ্যমেই তা পরিষ্কার। মাহশার লড়াই বৃথা যায়নি। তার মৃত্যুর মাধ্যমে সে আরও লক্ষ মানুষকে জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এর শেষ কোথায়?
নিঃসন্দেহে ইরানে মোল্লা-তন্ত্রের পতন এই আন্দোলনের অন্তিম লক্ষ্য হওয়া উচিত আন্দোলনকারী-বিক্ষোভকারীদের মনোভাবও সেই দিকেই ইঙ্গিত দেখিয়েছে। কিন্তু ১৯৭৯র যে বিপ্লব পারস্যের শাহকে মসনদ থেকে সরিয়ে খোমেইনি-তন্ত্রের সূচনা ঘটিয়েছিল, সার্বিক অর্থে – অর্থাৎ কি না, একই সঙ্গে ব্যক্তি-নাগরিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে তার যে ব্যাপ্তি পরিলক্ষিত হয়েছিল, মাহশার আন্দোলন এখনও সেই স্তরে পৌঁছিয়ে উঠতে পারেনি। সরকারি তরফে যে তুমুল দমনপীড়ন এখনও নেমে আসতে চলেছে, তার বিপরীতে সমাজের সর্বস্তর থেকে প্রতিবাদ আন্দোলন উঠে আসা জরুরি। এছাড়াও বৃহত্তর আন্দোলন শুরু হলে পরে, দমনপীড়ন যেমন ভাবে বাড়তে থাকবে – ঠিক তেমনই বাড়তে শুরু করবে পশ্চিমি দুনিয়ার বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ। এঁরা না থাকেন হোমে, না লাগেন যজ্ঞের অনুষ্ঠানে। এঁরা কেবল সুযোগ বুঝে নিজেদের পেট্রো-ডলারের ধারাটুকুকে অক্ষয় রাখতে, রামের সঙ্গে শ্যামের ও শ্যামের সঙ্গে যদুর ঝগড়া লাগিয়ে রাখতে বহুমূল্য সময় ব্যয় করেন। অতীতে লিবিয়া ও সিরিয়ার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই পরিণতি আমরা দেখেছি। ইরানের ক্ষেত্রেও যেন এমনতরো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেই দিকেই আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।
সাধারণ মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত, এই আন্দোলন – চাপিয়ে দেওয়া মোল্লা-তন্ত্রের বিরুদ্ধে। চরম অস্বাস্থ্যকর ও সম্মানহানিকর বোরখা-নীতির বিরুদ্ধে। মোল্লা-তন্ত্র যেন মার্কিন-তন্ত্র অথবা রুশ-তন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত না হয় সেই দিকটিতেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে মোল্লা-তন্ত্রকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি শহরে, প্রতিটি মহল্লায় আরও সার্বিক ভাবে মানুষের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে।
একথা সত্যি, হাজার মাইল দূরত্বে বসে সেদেশের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রভাবিত করবার মতো কোনও অতিমানবিক ক্ষমতাই আমাদের নেই। আমাদের কেবল ক্ষমতা রয়েছে সহমর্মিতা জ্ঞাপনের। ক্ষমতা রয়েছে আলোচনার মাধ্যমে, প্রচারের মাধ্যমে সেই আন্দোলনের ব্যাপ্তিটুকুকে আমাদের চেনা পরিসরে, আমাদেরই চারপাশেকার মানুষজনেদের ভিতরে ছড়িয়ে দেওয়া। ইরানের খেলোয়াড়েরা আজ আক্ষরিক অর্থে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বিশ্বের দরবারে যে প্রতিবাদের বক্তব্যকে তুলে ধরলেন, ইরানের যে মেয়েরা লাঠি, গুলি, চাবুক এমনকি ফাঁসিকাঠের হুমকিকেও তুচ্ছজ্ঞান করে লড়াই করে চলেছেন – আমরা যদি অন্তত সেই সমস্ত গৌরবগাথাকে প্রচারের দায়িত্বটুকুও নিতে অস্বীকার করি, তাহলে বৃথাই আমাদের মানবাধিকার আন্দোলন, বৃথাই আমাদের লম্বা-চওড়া ভাষণের আগ্নেয়-ক্ষমতা। সে কেবল কাগুজে বাঘেরই মতো শক্তিশালী বলে জানব। আমাদের উপরে দায়িত্ব বর্তিয়েছে এই আন্দোলনের আগুনকে, এই আন্দোলনের সৎ, স্বাভাবিক, সরল বক্তব্যকে সকল মহিলার কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া। এই আন্দোলন সমাজের প্রয়োজনে, সমাজের একই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে। মাহশার লড়াই চল্লিশ দিনে শেষ হয়ে যায়নি। উপরন্তু সেই আন্দোলন এখনও ক্রমবর্ধমান। নারীমুক্তির ইতিহাসে আমরা বোধ করি আজ নিশ্চিতরকমেই এক বিরল ইতিহাসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। সরাসরি পথ বেছে নেওয়া ভিন্ন, মোল্লা-তন্ত্রের মূলে আঘাত করা ভিন্ন, আমাদের সম্মুখে আর কোনও বিকল্পই অবশিষ্ট নেই।
এই আগুনকে যেন নিভতে না হয়, সেই অঙ্গীকারেই আমাদের কলম সচল ও অক্ষয় থাকুক।
0 Comments
Post Comment