পর্দা এবং পছন্দ – একটি বিপ্রতীপ সমীকরণ

  • 28 October, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1420 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
একদা ‘অবাঙালি মুসলমানদের পোশাক’ বলে চিহ্নিত যে আচ্ছাদন আপামর বাঙালি মুসলিম মেয়েদের কাছে ব্রাত্য ছিল – সেই হিজাব, বোরখার ‘বাঙালি’ দোকান এখন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মহল্লায় গজিয়ে উঠেছে। কারণ হিসাবে মূলত দুটো মত উঠে আসে – প্রথমত ধর্মীয় ভক্তিরসের প্রাধান্য এবং দ্বিতীয়ত পশ্চিমা ফ্যাশনের সাথে পশ্চিম-বিরোধী ইসলামিক সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা। মূলত পাশ্চাত্যে উদ্ভূত ব্যক্তিস্বাধীনতাকামী ও নারীবাদী স্লোগান ‘মাই বডি-মাই চয়েস’ -কেই বুমেরাঙের মত ব্যবহার করছে এই পর্দাসীন মেয়েরা।

আজ থেকে বছর পনেরো আগের গ্রাম বা শহরের রাস্তাঘাটের সাথে আজকের দৃশ্যাবলীর যে ফারাকটা দ্রুত চোখে পড়ে তা কেবল রাস্তার খানাখন্দহীন মসৃনতা কিম্বা উড়ালপুলের গতিময় উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নেই , আছে আরেকটি দৃশ্যে — হিজাব কিম্বা বোরখায় মুখ-মাথা ঢাকা মহিলাদের পর্দাপ্রিয়তা।

একুশ শতকের প্রথমভাগেও শাড়ি কিম্বা চুড়িদারের উপরে বাড়তি কাপড়ের আচ্ছাদনকে বিদেশি সংস্কৃতি বলেই ব্রাত্য রাখা হত বাঙালি ‘মুসলিম কালচারে’। এমনকি হজ করে এলেও হাজিদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখে বোঝার উপায় থাকত না যে তিনি আরব-ফেরত। কিন্তু এখন সম্যক চেনা যায়, বলা ভাল চিনিয়ে দেওয়া হয় যে কে হাজি  অথবা ‘সহি’ মুসলিম আর কে পাজি অথবা মুনাফেক ( আল্লা, রসুলে, কোরানে, ইসলামে ভক্তি নেই এমন মুসলিম ) !! 

একদা ‘অবাঙালি মুসলমানদের পোশাক’ বলে চিহ্নিত যে আচ্ছাদন আপামর বাঙালি মুসলিম মেয়েদের কাছে ব্রাত্য ছিল — সেই হিজাব কিম্বা বোরখার ‘বাঙালি’ দোকান এখন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মহল্লার অলিগলিতে গজিয়ে উঠেছে। এর পেছনের কারণ হিসাবে মূলত দুটো মত উঠে আসে — প্রথমত ধর্মীয় ভক্তিরসের প্রাধান্য এবং দ্বিতীয়ত পশ্চিমা ফ্যাশনের সাথে পশ্চিম-বিরোধী ইসলামিক সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা। মূলত পাশ্চাত্যে উদ্ভূত ব্যক্তিস্বাধীনতাকামী ও নারীবাদী স্লোগান ‘মাই বডি-মাই চয়েস’ -কেই বুমেরাঙের মত ব্যবহার করছে এই পর্দাসীন মেয়েরা ও তাদের পরিজনেরা।

প্রশ্ন ওঠে বোরখা বা হিজাব কি সত্যিই ধর্মীয় পোশাক?

কিছুদিন আগেই পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ধর্ষণের জন্য মেয়েদের পোশাককে দায়ী করেছিলেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারাও বহুবার মেয়েদের উপর ঘটা অত্যাচারের জন্য মেয়েদের পোশাককেই দায়ী করেছেন, মুসলিম ধর্মগুরুরা তো অলিগতিতে, ফেসবুক ইউট্যুবে হামেশাই ‘ওয়াজ’ দিয়ে বুঝিয়ে দেন ‘ইসলাম দিয়েছে নারীকে এমন সর্বোচ্চ সম্মান, যা নাকি নারীর স্বাভাবিক পোশাকের উপর চাপানো বাড়তি কাপড়ের ভাঁজেই সুরক্ষিত থাকবে!’ 

বাংলাদেশের ‘ভাইরাল’ হুজুর তো খোদ কোরান থেকে ‘বার্তা’ দিয়েছিল যে, মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতই লোভনীয় দ্রব্য। সুতরাং মেয়েদের, তেঁতুলে স্বাদ রক্ষার্থে, স্বাভাবিক পোশাকের উপর এত পরিমাণ আচ্ছাদন চাপাতে হবে, চলাফেরা এতটাই সংক্ষিপ্ত করতে হবে— যাতে পুরুষের খারাপ-নজর না পড়ে, জিভে জল না আসে! এসব ‘ট্র্যাশে’র যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়ে তর্কবিতর্কে যাওয়াটা বাতুলতা। দেখি ধর্মের বিধান কী?

কোরানের সুরা নূর বলছে “হে বিশ্বাসী নারীদল! তোমরা তোমাদের দৃষ্টিকে নিম্নমুখী করে রাখো এবং হেফাজত করো নিজেদের লজ্জাস্থান। এটা তোমাদের পবিত্রতার পক্ষে সর্বাধিক কার্যকর।”

আবার সূরা আহজাবে আছে ‘হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরকে নিজেদের উপর টেনে নেয়।’

এরকম প্রচুর জায়গায় নারীদের ঢেকেঢুকে রাখার ফতোয়া দেওয়া হলেও কোরানে কোথাও ‘হিজাব’ কিম্বা ‘বোরখা’ শব্দের উল্লেখ নেই। ব্যপার হল, ‘পবিত্রতা’ ও ‘লজ্জাস্থান’ দুইই খুব গোলমেলে জিনিস। পবিত্র শরীর মানে কি যৌনতাহীন মানুষ? তাহলে সে কি আদৌ সুস্থ? এবং কে পবিত্র তা খালি চোখে কীভাবে বোঝা যাবে— এটা নিয়ে যেমন ধোঁয়াশা আছে, তেমনি ‘লজ্জা’ জিনিসটা কে কোথায় লুকিয়ে রাখে তাও বোঝা দায়!

তবে এটুকু স্পষ্ট বোঝা যায় নারীদের উপর চাপানো ধর্মীয় ফতোয়াটির সাথে হিজাব কিম্বা বোরখার কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। ‘ঢেকে রাখা’ কিম্বা ‘পর্দা করা’ বিধানটিই আরব মূলুকে একটি কালো অদ্ভূতুড়ে আলখাল্লায় মুড়ে পালন করার চল। কিন্তু চোদ্দ হাত শাড়ির বঙ্গদেশে এই পোশাক যে একেবারেই বিজাতীয় তা বলা বাহুল্য। নারী-সম্মান রক্ষায় ইসলামিক ফতোয়ার শালীনতা প্রমাণে এবং জিন্স-স্কার্ট-শার্টের মত পাশ্চাত্য পোশাকের যুতসই জবাব দিতেই আরবমূলুকের পোশাককে এদেশের মেয়েরা জাপ্টে ধরছে একধরনের রিভেঞ্জ-স্টাইল স্টেটমেন্ট দিতেই।

ধর্মের সাথে সরাসরি যোগ থাকলে ধর্মপালনের সময় অর্থাৎ ইদে মহিলাদের নতুন ঝকমকে চুড়িদার-শাড়ি কেনার লাইনের চেয়ে কালো বোরখার দোকানের লাইন লম্বা হত, পরবে আত্মীয় স্বজনের সাথে সেলফি তোলার সময়ও তাদের হিজাব-বোরখার রকমারি জৌলুস দেখা যেত, অন্যান্য ঝকমকে পোশাক নয়। কিন্তু এক বিচিত্র সমীকরণে ধর্মীয় উৎসবগুলোয় এই অন্ধকার-পোশাক যত না প্রাধান্য পায়, তারচেয়ে শতগুণ বেশি দেখা যায় বছরের বাকি সময় রাস্তায়-বাজারে। যা তাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি বা সম্প্রদায়ভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে, পৃথক করে আর পাঁচজনের থেকে। সুতরাং হিজাব-বোরখা আদতে একটি সাম্প্রদায়িক পোশাক— যা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ভিড়কে মানবসমুদ্র থেকে সহজে আলাদা করতে শেখায়।

যেখানে সাধারণ পোশাকে জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের মহামিলনে একাত্মতার সুযোগ থাকে, সেখানে বাংলার মুসলিম মহিলাদের আরবের মেয়েদের মত হিজাব-বোরখা পরিধান, তাকে যতটা ‘ধার্মিক’ বানায় তারচেয়েও বেশি আসলে বাংলার ‘কালচারে’ মেরুকরণ বাড়ায়, ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসের বৈচিত্র্যের মধ্যে সমষ্টিগত ঐক্যের বদলে মূলধারার বঙ্গ সংস্কৃতির সাথে একধরনের দূরত্ব তৈরি করে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে প্রায় ক্লিশে হওয়া স্লোগান হল—‘মাই বডি -মাই চয়েস’। এই স্লোগানকে হাতিয়ার করেই প্রতি বছর ১লা ফেব্রুয়ারি তারিখে উদযাপিত হয় ‘বিশ্ব হিজাব দিবস’ । ২০১৩ সালে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি মহিলা নাজমা খান প্রথম এই দিবসের সূচনা করেন শুধুমাত্র মুসলিম মেয়েদের উদ্দেশ্যেই নয়, বরং অমুসলিম মেয়েদেরও হিজাব-বোরখা পরায় উৎসাহিত করতে।

‘হিজাব ইজ মাই ফ্রিডম’, ‘হিজাব ইজ মাই প্রটেকশন’, ‘হিজাব ইজ মাই চয়েস’, ‘হিজাব ইজ মাই কভার’ ইত্যাদি স্লোগানে প্রতিবছর মুখরিত হয় মুসলিম বিশ্ব। 

ফ্রিডম, প্রটেকশান, চয়েস — উপরোক্ত স্লোগানগুলোয় ব্যবহৃত শব্দগুলোর ‘পর্দা’র সাথে পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক আছে। একটা আচ্ছাদন যা কোনও কিছুকে ঢেকে রাখে, বন্ধ রাখে, আড়ষ্ট করে চলাফেরায় —তা কীভাবে ‘ফ্রিডম’-এর সমার্থক হয়!

নারী একটি ভোগ্যপণ্য (তেঁতুলের মত লোভনীয়ও বটে!) তাই তাকে কালো আলখাল্লায় ঢেকে রাখো— এই ধারণা থেকেই হিজাব বা বোরখার জন্ম। এইরকম ধারণাকে প্রোমোট করা এবং মৃতের কফিনের মত পোশাক কীভাবে একজন শিক্ষিত রুচিশীল প্রাণবন্ত বাঙালি মেয়ের ‘চয়েস’ হতে পারে! নাকি রক্ষণশীল বাড়ির মেয়েদের চলাফেরার পথে মোল্লাদের নিষেধের রাশ কিছুটা আলগা হওয়ার আশায় তাদের এই ‘চয়েস’— যা আমরা নিকট অতীতে দেখেছি তরুণী অভিনেত্রী জায়রা ওয়াসিমের প্রতি। বলিউডে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় ছাপিয়ে কেবলমাত্র পোশাকবিধি নিয়ে মোল্লাদের হান্টার এমন প্রবল আঘাত হেনেছিল, যাতে তাকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছিল ‘অভিনয় ছাড়াটা আমার চয়েস!’

বাকি রইল প্রটেকশান! এ তো প্রশ্নাতীত ট্র্যাশ! হিজাব বা বোরখা মেয়েদের নিরাপত্তা কতটা সুনিশ্চিত করে তা রক্ষণশীল মুসলিম বাড়ির কিম্বা তামাম ইসলামিক দুনিয়ার অত্যাচারিত-লাঞ্ছিত মেয়েদের চেয়ে ভাল কেউ জানে না।

‘ফ্রিডম অফ চয়েস’-কে হাতিয়ার করে হিজাব-বোরখার সপক্ষে জাতিসঙ্ঘে গলা ফাটানো ইমরান খানের মত ইতিউতি অনেকেই বলে থাকেন “পশ্চিমে নারীদের শর্ট পোশাক পরিধানে যদি আপত্তি না থাকে, তবে কেন আপত্তি থাকবে হিজাব ও পর্দার উপর?”

নিঃসন্দেহে জিন্স-শার্টের মত হিজাবও বিদেশি পোশাক। কিন্তু শার্ট-প্যান্ট, শর্টস-স্কার্ট যে বিভাজন ঘটাতে পারছে না, হিজাব অত্যন্ত স্পষ্ট করে সেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটাচ্ছে। হিজাব অনুচ্চারিত স্বরে বলছে ‘আমার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান-জৈন বন্ধুদের থেকে আমি আলাদা। আমি কিছুতেই বিবিধের মাঝে একাত্ম হব না, সমাজের মূলধারার সাথে মিশব না।’

মূলত ধর্ম বিশ্বাস, আরবীয় কালচারে প্রশ্নহীন আস্থা এবং বিশ্বায়নের দৌড়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির রিভেঞ্জ-স্টাইল হিসেবেই পর্দার সাথে পছন্দ (মাই চয়েস) মিশিয়ে ২০১৬ সাল থেকে আমেরিকাসহ নানা দেশেই আয়োজিত হচ্ছে ‘অল-হিজাব-ফ্যাশান-শো’। আশ্চর্য হলেও এটাই সত্য যে, যেখানে ইসলামে ছবি তোলাই হারাম, সেখানে পরপুরুষের সামনে মডেলদের ক্যাটওয়াক অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহিলাদের প্রতি অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি ধর্মকে পাশ্চাত্য-আধুনিকতার রাঙতায় মুড়ে— অনেকটা ওই বকচ্ছপ কিম্বা হাঁসজারু থিওরি অনুসরণে!

আসলে ধর্মকর্মের জুজুর চেয়েও বড় ইন্ধন জোগাচ্ছে মহম্মদের আমল থেকে চলে আসা মেয়েদের ব্রেইনওয়াশ, যা তাদের হাতে-পায়ে পরানো শেকলকেই মহার্ঘ্য অলংকার ভাবতে শিখিয়েছে। যেখানে মুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি আদ্যোপান্ত বন্দির ভূতুড়ে পোশাক। আর এমনই জোর সেই ব্রেইনওয়াশের যে এই অদ্ভূতুড়ে ফ্যাশানিস্তদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন তুলছে না, হিজাব যদি এত ধর্মসম্মত আদর্শ ইসলামিক পোশাক হয় তবে কেনই বা তা চাপানো হবে শুধু নারীদেহের উপর?

উলটে হিজাব দিবস পালনে সাইকেল র‍্যালিতে যোগ দেওয়া হিজাবী মেয়েরা বলছে, ফ্রিডম অব চয়েসে পোশাক পরিধানে যে কারও স্বাধীনতা থাকতে পারে।  সাইকেল চালিয়ে প্রমাণ করতে চাই যে হিজাব পরে সব করা সম্ভব। তবে যে পোশাকেই নিজেকে ঢেকে রাখা হোক না কেন, মন যেন উন্মুক্ত থাকে।”

প্রশ্নটা এইখানেই ওঠে যে, সর্বযুক্তিতে বিভাজনকামী, বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ কি আদৌ কোনো মুক্তমনা, উদারনৈতিক, প্রগতিশীল জনজাতির ফ্যাশান-স্টেটমেন্ট হতে পারে?

 

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৪ আগস্ট ২০২১

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

 

0 Comments

Post Comment