টাগ অফ ওয়ার

  • 22 September, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 670 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
বিয়ের দিন বৌদিকে দেখে মনে হয়েছিল সিঁদুর দানের সাথে সাথে তার সমস্ত চিন্তা যেন একজোট হয়েছে মাথার মধ্যে। আমাদের কাছে ওর সঙ্কোচের ভাবটি বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেছেন পাত্রীর মা। তিনি বৌদির মাথার ঘিলুর ভিতরে কতগুলো কথা স্পষ্ট করে ঢুকিয়ে দেন, 'শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছ, একটু লজ্জা শরম করে থেকো। যা বলবেন, সব মেনে চলবে। কোন অনিষ্ট যেন না হয়। মুখে মুখে তর্ক করবে না। সকলকে সুখে রাখবে।' --নিজের সুখ বাদ দিয়ে সকলকে সুখে রাখা যায় না, সেই চেতনায় উদ্দীপ্ত এক মেয়ের গল্প।                                        

তখন সবে আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা শেষ হয়েছে। দাদা বিয়ে করে ঘরে নতুন বউ আনল। পরিবারে আমাকে নিয়ে মোট তিন সন্তান, দুই ভাই ও এক বোন। এদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ছোট। এছাড়া রয়েছেন বাবা ও মা। কাকা, জ্যাঠাদের সাথে ঝামেলা অনেক দিনের। তাই পরিবারটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে, তাও প্রায় পাঁচ বছর হল। ঠাকুমাকে বড় জ্যাঠামশাই নিজের কাছে এনে রেখেছেন। বাবা সম্পত্তি হিসাবে টাকার যে ভাগটা পেয়েছেন তা থেকে কিছু দিয়ে নিউটাউনে একটা নতুন ফ্ল্যাট কিনে আমাদের নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। তিন সন্তানকে একসাথে সামলানো এখনকার দিনে বেশ ঝক্কির ব্যাপার। তাছাড়া বাবার রিটায়ারমেন্টের সময়টাও কাছে এসে যাচ্ছে। খরচা পাতিরও তো একটা ব্যাপার আছে। বাড়িতে এই প্রথম একটা বিয়ের উৎসব লাগছে, বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা। তাই সব দিক ভেবে চিন্তে বাবা একটু তাড়াহুড়ো করেই দাদার বিয়েটা দিলেন। দাদা তখন সবে নতুন চাকরিটায় যোগ দিয়েছে। অফিসে নিজের চেয়ারটাকে পাকাপোক্ত করার সময়টাও সে পেল না। তার আগেই বাবার চাপের চোটে বসে পড়তে হল বিয়ের পিঁড়িতে। দিদির কথাটা একটু বলে রাখি। সে ইংলিশে গ্র্যাজুয়েশন পাস করে অনলাইনে কী বেশ একটা জুয়েলারির ব্যবসা শুরু করেছে এক বন্ধুর সাথে। আমি যেহেতু সবচেয়ে ছোট, তাই মা আমাকে কনে খোঁজা থেকে শুরু করে পাকা দেখা পর্যন্ত কোনও বিষয়েই নাক গলাতে দেননি। বৌদিকে দেখতে এমনিতে খুবই সুন্দর। গায়ের রঙ ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা, মুখটা একটু লম্বাটে ধরনের আর চোখ দুটো আয়তাকার। তবে তার চাহনির মধ্যে একটা অনমনীয় ভাব মুহূর্তের জন্য যেন লক্ষ্য করা যায়। বিয়ের দিন বৌদিকে দেখে মনে হয়েছিল সিঁদুর দানের পর লজ্জাবস্ত্রের সাথে সাথে তার সমস্ত লজ্জা যেন একজোট হয়ে নেমে এল মাথার ওপর। আমাদের কাছে ওর সঙ্কোচের ভাবটি আরও বাড়িয়ে তোলার কাজের দায়িত্বটি ছিল পাত্রীর মায়ের হাতে। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে তিনি জগতের সমস্ত কাজকর্ম পই পই করে বুঝিয়ে বৌদির মাথার ঘিলুর ভিতরে কতগুলো কথা স্পষ্ট করে ঢুকিয়ে দেন, 'শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছো, একটু লজ্জা শরম করে থেকো। যা বলবেন ওনারা সব মেনে চলবে। বাপের বাড়ি আসবো বলে বারবার আবদার করবে না। যত্ন করে ঘরের কাজকর্ম করবে। কোন অনিষ্ট যেন না হয়... মুখে মুখে তর্ক করবে না। সকলকে সুখে রাখবে।'

তাছাড়া আমার মা-বাবার নতুন বৌয়ের কাছে যা দাবিদাওয়া ছিল তার প্রায় সবকটাই শিখে পড়ে এসে তবে এ সংসারে পা রাখতে হয়েছে বৌদিকে।  একেবারে বৌভাতের পরের দিনে বৌদির কাছে ঘেঁষতে পারার সৌভাগ্য আমার হল। পরিচয় পর্বটা অবশ্য দাদাই সেরে দিয়েছিল। সেই দিন থেকেই বৌদির সাথে আমার খুব ভাব। বৌভাতের পরের দিনেও দিদির কয়েকজন বন্ধু আর কয়েকজন প্রতিবেশী দেখতে এল বৌদিকে। কনে কে দেখে দিদির এক বন্ধু বললে, 'ও এত শান্ত কেন? এত লাজুক এখনকার দিনে কোন মেয়ে হয়?'             

আর একজন বললে, 'চেহারা তো নয় যেন একটা কঙ্কালের ওপর চামড়া চড়িয়ে দিয়েছে।' অন্য একজন বললে, 'মেয়েটা কেমন যেন আনস্মার্ট, গাঁইয়া টাইপের। পাত্রের সাথে একেবারেই খাপ খাচ্ছে না।' 

একজন তো ফস করে জিজ্ঞাসা করেই বসল, 'বরের ভাল চাকরি দেখে গলায় ঝুলে পড়েছ নাকি?' বাইরের ঘরে মাকে পাশের বাড়ির কাকিমার সাথে গল্প করতে শুনলাম, 'কে জানে বাবা, এদের রকম সকম কিছু বুঝিনা। বৌভাতে তত্ত্ব পাঠাল তাও দু-চারজন অচেনা আত্মীয়কে দিয়ে। কনের বাপ-মা তো একবারটিও মেয়ের মুখ পর্যন্ত দেখতে এল না। এমন মনে হচ্ছে যেন মেয়েকে আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বোঝা হালকা করেছে।' 

কাকিমা জিজ্ঞাসা করলেন, 'মেয়ের কি কোন খুঁত আছে?' 

— 'তা জানিনা, তোমার দাদার তো জানই কেমন দয়ার শরীর। বেয়াইকে যা চাওয়া হয়েছিল তার কিছু কম টাকাই দিয়েছিল। তাও তো মনে হয় অনেকটাই ধার দেনা করেছে। এদের বাপের বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। বউয়ের দাদা কেমন যেন লোফার ধরনের। কোন কাজকর্ম করে না, বিয়েসাদিও হয়নি। তোমার দাদার বউমা পছন্দ হয়ে গেল, ব্যস ঘরে তুলে নিলেন। বাকি টাকা গুলো চাওয়ার আর নামও করলেন না।' 

— 'দেখো কটা দিন তাহলেই বউয়ের দোষ ত্রুটি সব বুঝতে পারবে। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে কিছু একটা গোলমাল আছে। না হলে এভাবে মেয়েকে জলে ফেলে কেউ পালায়—' 

মা অমনি কাকিমার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে তেতে উঠে বললেন, 'জলে ফেলবে মানেটা কী? আমরা কি তেমন খারাপ লোক? অন্য পরিবার হলে দেখত পুরো টাকা না পাওয়া পর্যন্ত বরকে বিয়ের পিঁড়িতেই বসতে দিত না। কেমন জানি ভয় লাগছে, ঘরে কোন শাঁকচুন্নি না ডাইনিকে এনে হাজির করেছি কে জানে?'                                   

কাকিমা এবার গলার স্বর চেপে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেন বিয়ের আগে বউকে ভাল করে দেখে নাওনি?'           

— 'যা দেখার সব তোমার দাদাই দেখেছেন। দাঁড়াও না আমি এত সহজে ছাড়ছি না কি? এ মেয়েকে নিজের মত তৈরি করে তবে ছাড়বো।' 

যদিও ওদের সমস্ত কথোপকথনটাই হচ্ছিল চাপা স্বরে, দুএকটা শব্দ দৈবাৎ একটু জোরে শোনা গিয়েছিল কিন্তু ফ্ল্যাট বাড়ির লাগোয়া ঘর তো তাই পাশের ঘর থেকে সেগুলো স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল। বউদি এসব কথাবার্তা কতটা শুনতে পেয়েছে তা বলতে পারব না। তবে আমার এগুলো মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না বলে আমি সেদিকে আর কান দিই নি। সকলে বৌদিকে দেখে চলে যাওয়ার পর দেখলাম বৌদি নিঃশব্দে ডুকরে ডুকরে কেঁদে চলেছে। গাল বেয়ে জলের ফোঁটা পড়ে তার নতুন হলুদ জামদানি শাড়িটা ভিজে যাচ্ছে। চোখ দুটো তার জলে ভরা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তার এই বাড়িটা মোটেই পছন্দ হয় নি। 

দিদি কেমন একটা তাচ্ছিল্যের চোখে বৌদিকে দেখে। দিদির সঙ্গে আমারও তেমন বনিবনা নেই। সে অনেক বেশি আধুনিক। বৌদিকে সম্মান করা দুরস্থ সে তার সাথে এমন বিচ্ছিরি ভাবে কথাবার্তা বলে, আ‌মার মনে হয় বউদি যেন ওর ভাড়া করা দাসী। এদিকে বৌদির পিছু পিছু সারাক্ষণ ঘুরঘুর করি বলে আমার একটা বদনামও রটে গেছে গোটা বাড়িতে। মা খুব বকাঝকা করেন। তবে এরজন্য আমি বৌদিকে ছেড়ে যাইনি। কারণ বৌদি আমার সব আবদার গুলোই সবসময় রক্ষা করার চেষ্টা করতো। নতুন বউ যত পুরনো হল তাকে নিয়ে অশান্তির মাত্রা ততই বেড়ে চলল। কাজে খুঁত ধরা থেকে শুরু করে অকারণে গালি বর্ষণ, পাশের বাড়ির কাকিমা-জ্যেঠিমাদের সঙ্গে আলোচনার মুখরোচক বিষয়বস্তু হয়ে উঠল বৌদি। তাছাড়া দেখলাম বৌদির কাঁধে আমাদের এতগুলো লোকের কাজকর্মের দায়িত্বভার চাপিয়ে দিয়ে মা বেশ নিশ্চিন্ত হলেন। বৌদির যে একটা মন আছে , তার যে একটা শরীরও আছে সেগুলোও যে একদিন অত্যধিক চাপের ফলে যন্ত্রের মত বিগড়ে যেতে পারে - সে কথা এ বাড়ির কারোর আর মনে হল না। বৌদি যেদিন একটু হাঁফ ছাড়ার জন্য ব্যালকনিতে এসে বসত সেটা সবার কাছে ন্যাকামো বলে মনে হত। খবরের কাগজের পাতা উল্টানোটা যেন তখন বউদির কাছে পরিণত করা হল চরম বিলাসিতায়। বৌদি ধীরে ধীরে কীভাবে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসছে তা আমি চোখের সামনে দেখলাম। শ্বশুরবাড়িতে ঘরকন্না করতে এসে তাকে পূর্বজীবনের বন্ধুবান্ধবদের ভুলতে হল। দিনে একবার বাপের বাড়িতে ফোন করতে গেলেও চাইতে হল শাশুড়ির অনুমতি। এছাড়া বাকী সময় তার ফোনটা সাজানো থাকতো ডাইনিং রুমের শো পিসে। মাঝে একবার বৌদির বাপের বাড়ির থেকে খবর শোনা গেল যে, তার দাদা নাকি কোন এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার জেরে বৌদির মা-বাবার সাথে তার তুমুল কথা কাটাকাটি হয়। আর সেই কারণেই সে বাবা-মাকে রেগেমেগে বসিয়ে রেখে এসেছে বৃদ্ধাশ্রমে। আর বাড়িতে নিজের গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে এসে থাকছে। বৌদি একবার যেতে চেয়েছিল সেখানে। খুব কান্নাকাটিও করেছিল শাশুড়ির হাতে-পায়ে ধরে। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হয়নি। বাড়ির লোকদের সেদিনের পর থেকে চরম অশ্রদ্ধা তৈরি হতে থাকে বৌদির পরিবারের ওপর। এই সমস্ত বাজে ঝামেলায় দাদাও আর বৌদিকে জড়াতে দেয়নি। বিয়ের পরও যে মা-বাবার প্রতি মেয়ের বিন্দুমাত্র টান থাকতে পারে, সে বিষয়টা কারোর মাথাতেই এল না। নিঃশব্দে সকলের কাছ থেকে চোখের জল লুকিয়ে নিয়ে সে কয়েকরাত কাঁদল। এ বাড়ির কারোর কাছে নিজের দুঃখটুকু বিন্দুমাত্র প্রকাশ পেলেই তার বিপদ বাড়বে। তাই ঠোঁটের কোণে হাসি লাগিয়েই তাকে সারাদিনটা কাটাতে হত। বৌদির মুখের ভাবটি দেখে আমার মনে হত সে যেন নিতান্তই একটা ছিন্নমূল আগাছা। যে সংসারে সে এতদিন পরগাছা হয়েছিল সেটি আজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। স্রোতের টানে ভেসে এসে নতুন যে সংসারটিতে সে উঠেছে সেটাকে যদি এখন আঁকড়ে ধরে রাখতে না পারে তবে নিজের অস্তিত্বটাই খোয়াবে কারণ সেই পুরনো আশ্রয়টিও আর নেই। 

যাক, একটা অন্যায় আবদার সে করে ফেলেছে সবদিক না বুঝেসুঝে। তাই তার শাস্তিও অবধারিত। মায়ের যেন কিছুতেই পছন্দ হত না বৌদির কাজ। সে হয়ে উঠল মায়ের কাছে চরম অকারণ অস্বস্তির একমাত্র কারণ। বাইরে কারো সাথে মায়ের ঝগড়া লাগল আর রাগটা মেটানো হত বৌদির ওপর। দিদি নিজেরই দোষে কোন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো তারও মুখ্য কারণ হতে হত বৌদিকে। এদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো, না তে না মেলানো এবং সমস্ত রকম অত্যাচার চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া ছাড়া বৌদির আর কোন উপায়ও যে ছিল না। আর আমি প্রতিবাদ করব! আমার কথা কেউ শুনলে তো।

সবকিছু একরকম ঠিকঠাকই চলছিল- বৌদির সেই ঘরকন্না, দিদির সাথে সারাদিনের খিটিরমিটির, মায়ের আদেশে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি সংসারের বেদীতে উৎসর্গ, মায়ের খুঁজে খুঁজে কাজের খুঁত বের করা ও সেই নিয়ে বৌদিকে বকাঝকা করা, দিদির কাছে মায়ের প্রতিদিনকার বৌকে নিয়ে আফসোস, বৌদির প্রতি আমার পক্ষপাত, বৌদির সাথে মায়ের একতরফা ঝগড়ার ফলে বাবার সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত, দাদার নির্বিকার চিত্তে প্রতিদিনকার অফিসে গমন ও আগমন সবকিছু একেবারে স্বাভাবিক। এ সবই সকলের গা সওয়া হয়ে গেছে। হঠাৎ গণ্ডগোলটা বাঁধাল দাদা নিজেই। সেদিন দাদার এক কলিগের অ্যানিভারসারিতে নিমন্ত্রণ ছিল। রাতে বাড়ি ফিরে আসার পর তাকে দেখে মনে হল তার মাথায় নতুন কী একটা খেয়াল চেপেছে। আমি তখন ঘরে একাই জেগে ছিলাম, ডাইনিং এ বসে বসে ফোন ঘাঁটছিলাম। দাদার অবস্থা দেখে মনে হল বন্ধুর বাড়ি থেকে খাবারের বদলে বোধহয় অপমানটাই বেশি করে খেয়ে পেট ফুলিয়ে এসেছে এবং সেটা খুব সহজে হজম হচ্ছে না। শোওয়ার ঘরে ঢুকে দাদা বৌদিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তার সাথে একপ্রস্থ কথোপকথন চালাল। তা ঠিক কতক্ষণ চলেছে সেটা আমিও বলতে পারব না। ওদের যেটুকু কথা ঘরে গিয়ে ঘুমানোর আগে শুনেছিলাম তা খানিকটা এরকম - দাদা গলার স্বর চেপে বেশ উত্তেজিত ভাবে বলছে, 'তোমাকে একটা চাকরি করতেই হবে শ্বেতা।' 

এখানে বলে রাখি শ্বেতা আমার বৌদির নাম। বৌদি থতমত খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, 'সে কী করে সম্ভব তাহলে সংসার সামলাবে কে?' 

— 'সামলানোর জন্য অনেক লোক আছে। তোমাকে আমি এই সংসারে পড়ে থেকে থেকে জীবনটা নষ্ট করে দিতে দেখতে চাইনা। আমার সব বন্ধুদের স্ত্রীরা কিছু না কিছু চাকরি বাকরি করে তাই তোমাকেও করতে হবে।'                             

— 'কী পাগলামো শুরু করেছ? জানই তো মা বংশধরের জন্য কেমন চাপাচাপি করছেন। তার ওপর চাকরি করতে গেলে বাচ্চা সামলাবে কে?' 

  — 'জানি, মা ওরকম একটু খিটিরমিটির করেন। কিন্তু তোমাকে যেভাবেই হোক স্ট্যান্ড করতেই হবে। এভাবে পড়ে থেকে থেকে কতদিন আর লোকের কথা শুনে যাবে? এখন কেউ আর ঘরে বসে শুধু  বাচ্চা-কাচ্চা সামলায় না। আমি লোক রেখে দেব।'

— 'ওরে বাবা! ঘরে আয়া রাখলে মা একেবারে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবেন।'                     

— 'আমি সব দিকটা ম্যানেজ করে নেব, তোমার চিন্তা নেই।'                                 

— 'তুমি কতটা ম্যানেজ করবে আমার জানাই আছে। সমস্ত ঝামেলা আমাকেই পোহাতে হবে। সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে।' 

দাদা এবার অধৈর্য হয়ে উঠল। এই পদ্ধতিতে যখন সফল হল না তখন সে অন্য কৌশল নিল বৌদির ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য। দাদা উত্তেজিত গলায় বলল, 'মেয়েরা আর কতদিন শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হতে থাকবে বলতে পারো? তোমার সাথে ওরা এমন ব্যবহার করে যেন তুমি মানুষই নও। তোমার কি রক্ত গরম হয়ে ওঠে না মুহূর্তের জন্যও? আজ যদি তোমার হাতে অর্থ থাকতো, একটা বাড়ি, একটা গাড়ি, কিছু সম্পত্তি সম্পূর্ণ তোমার নিজের নামে থাকতো তবে কি তুমি দেমাক দেখাতে না? এইভাবে সেই ছোটবেলা থেকে দাসীবৃত্তি করতে করতে তোমার আত্মমর্যাদা বোধটাই একেবারে চলে গেছে। এখন সময় এসেছে তোমার নিজের জন্যেও কিছু ভাবার।'

দাদার কথাগুলো শুনে এবার আমার যথেষ্ট হাসি পাচ্ছিল। যে এতদিন ধরে বৌদির সুখ দুঃখে নির্বিকার থেকেছে আজ তার মুখে নারী স্বাধীনতার কথাটা খানিকটা 'ভূতের মুখে রাম নাম'- এর মতই শোনাচ্ছিল। দাদা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সামনে কেবলমাত্র নিজের নাকটাকে যথেষ্ট পরিমাণে উঁচু দেখানোর জন্য যে বৌদিকে জোর করে শিখিয়ে পড়িয়ে চাকুরীজীবী করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তাতে সন্দেহ নেই। বৌদি এতটাই পেলব যে তাকে যে কেউ যেকোনো মুহূর্তে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে নিতে চাইলে খুব একটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না। বৌদি বোধহয় মাথা নীচু করে কোমল স্বরে বলল, 'কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব? উনি তোমার মা হন, আমার শাশুড়ি মা।'                                                 

দাদা এবার রেগে বলল, 'ঠিক আছে। তাহলে তুমি সংসারটিই সামলাও। কিন্তু জেনে রাখো আমার মন কোনোদিন পাবে না। তোমাকে আর কোথাও আমার সঙ্গে নিয়ে যাব না। যেখানেই নিয়ে যাব তুমি আমাকে সেখানেই লজ্জায় ফেলবে। এখন বুঝতে পারছি কেন বোন তোমাকে একদম পছন্দ করে না।' আমার মনে পড়লো বিয়ের আগে পাত্রী দেখার সময় তো বৌদিকে আমাদের বাড়ি থেকে কেউ এমন শর্ত দেয়নি যে ঘরোয়া কাজ জানার সাথে সাথে তাকে বাইরে বেরিয়ে চাকরি করতেও জানতে হবে। উপরন্তু মা চেয়েছিলেন তার পুত্রবধূ যেন একেবারেই চাকুরিজীবী না হয়। এর প্রতিবাদে দাদা কখনই মুখর হয়ে ওঠেনি। এরপর বৌদি হয়ত মিহি স্বরে দাদাকে আরও কিছু বলে বোঝানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু সেটা শোনার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।                                           

পরের দিন থেকে দেখলাম দাদা আর বৌদির সম্পর্কটা কেমন খারাপ হয়ে গেছে। দাদা যেন বৌদিকে পাত্তাই দিতে চাইছে না। এমনকি রাতে আর বউদির সাথে একঘরে শুতেও চাইছে না। আমার বিছানায় দাদা আমার সাথে ঠেলাঠেলি করে ঘুমিয়ে পড়ে। মা আর দিদির এই ব্যাপারটা মোটেও খারাপ লাগেনি, বরং মনে মনে বেশ আনন্দই পেয়েছিল বোধহয়। বৌদির মনে যে দ্বন্দ্বটা চলছে সেটা বাইরের কাউকে সে বলতেও পারছে না। তাই থেকে থেকে তার পেটটা কেমন ফুলে ওঠে, মাথাটা মাঝেমধ্যে ঘোরে,গা টাও পাক দিয়ে ওঠে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কাকে সন্তুষ্ট করবে আগে, সংসারের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে নাকি পতিদেবতাকে? বিধাতা তাকে এতটুকু প্রাণ দিয়েছেন বটে কিন্তু সবদিক একসাথে সামলানোর দৈব ক্ষমতা দেননি। বৌদি চিরটাকালই ঘরোয়া। এই ঘরোয়া খোলসটা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে চাকরি করাটা তার কাছে খুবই শক্ত। তবে একেবারেই সম্ভব নয় কি? খোলসটা যদিও খুব একটা বেশি পুরু হয়নি। বয়সটাও তার কম। এখন যদি তাকে ফাটিয়ে কোনোক্রমে আলোর জগতে বেরিয়ে আসতে না পারে তবে আর কোনোদিনই সে পারবে না। কারণ খোলসে বারবার চিড় ধরে না। আর সময়টাও তখন বেরিয়ে চলে যায়। 

এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। রাত তখন দশটা বাজে। আমরা সবাই একসাথে খেতে বসেছি। বৌদিই সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছিল। তখন আমাদের খাওয়া প্রায় শেষের পথে বৌদি হঠাৎই কথাটা আমতা আমতা করে পাড়ল, 'মা, আমার তো মাস্টার্সটা কমপ্লিট ছিল, এখন যদি বি এড টা করে নিয়ে-'                         

বৌদি সমানে হাত কচলে যাচ্ছে। ভয়ে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। চোখেমুখে টেনশনের ছাপ স্পষ্ট। বুঝলাম এতদিন ধরে সে একটু একটু করে বুকে সাহস সঞ্চয় করছিল মাকে কথাটা বলবে বলে। আর এও বুঝলাম যে এবার আমাদের ডাইনিং টেবিলে বড়সড় একটা পরমাণু বোমা ফাটতে চলেছে। তারপর বিস্ফোরণ! না থাকব আমি, না বৌদি, না দাদা, আর না তার ইচ্ছা। তবে সেসব কিছু ঘটার আগেই দাদা চটজলদি বম্ব ডিফিউজের কাজে নেমে পড়ল। দাদা বৌদির মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়েই বলে উঠল, 'আমিই বলেছি ওকে একটা স্কুলে চাকরি করতে।'           

মা একবার কটমট করে দাদার দিকে তাকালেন, বাবা দাদাকে 'শাবাশ!' বলে পিঠ চাপড়ে দিলেন। আমার বত্রিশটা পাটি দাঁত বেরিয়ে গেল। শুধু দিদিই ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে খাবার ফেলে উঠে চলে গেল। দিদি আসলে মন থেকে একেবারেই চাইছে না যে বৌদি কোনোভাবে তাকে ছাপিয়ে গিয়ে সকলের কাছে বেশি স্নেহের পাত্রী হয়ে যাক। তাই এত হিংসে।

এরপর বাড়িতে কটা দিন  তুলকালাম চলল বটে তবে বৌদি সমস্ত প্রতিরোধ তুচ্ছ করে দাদার হাত ধরে ঠিক ঘরের চৌকাঠ পেরুল। এতকাল ধরে বাড়িতে কোণঠাসা থাকতে থাকতে সকলের অলক্ষ্যে যে সেই কোণে এত শক্তি এসে জমা হচ্ছে তা কে জানত? আমিও বৌদির এই মনের শক্তি দেখে হতবাক। 

২                                                                    একবছরের জন্য দাদা ও বৌদি নিরুদ্দেশ। মা কেঁদে অস্থির, তবে শুধুমাত্র দাদার জন্যই। বাবার সাথে হয়ত দাদা লুকিয়ে কথা বলত কিন্তু আমাদের কারোর সাথেই সে কোনও যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেনি। বছরও ঘুরলো। দাদা ও বৌদি ঘরেও ফিরল। বাড়িতে বৌদি পড়ার মত কোন পরিবেশ পাবে না বলে দাদা নাকি ধারে কাছেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে তাকে নিয়ে থাকছিল। বি এড পাশ করার পর চেষ্টা করে একটা স্কুলে চাকরিও পেল বৌদি। সকলেই এখন খুব খুশি। তবে দিদির খারাপ লাগলেও সকলের সামনে ভাল মানুষের মত খুশি হওয়ার ভান করছে। বৌদি চাকরি পাওয়ার পর দাদা নিজেকে মনে মনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর না রাজা রামমোহন রায় ভাবছে তা ঠিক বলতে পারব না। তবে সে এই প্রথমবার ঘটা করে বৌদির জন্মদিন পালন করবে।

দাদার বন্ধুরা সবাই সন্ধ্যের আগেই খেয়ে দেয়ে চলে গেছে। অতএব সকলে মিলে ডাইনিং এ একেবারে জমিয়ে আড্ডা দিতে বসে গেছি। তবে আজকের দিনেও বৌদিকেই সকলের মুখের কাছে চা, জল, খাবার সব জুগিয়ে দিতে হচ্ছে। তার একদণ্ড বসে গল্প করার ফুরসত নেই। জ্যেঠিমা বৌদির চাকরি পাওয়ার খবরটা শুনেই আনন্দিত হয়ে বললেন, 'বাহ! বেশ ভাল মেয়েকেই বউ হিসাবে পেয়েছ। একেবারে যেন মা লক্ষ্মী, এক হাতে সংসার সামলাচ্ছে আর এক হাতে সেই সংসারে অর্থাগম ঘটাচ্ছে।'       

মা নাকের ডগাটাকে বেশ করে উঁচিয়ে বললেন, 'সাধে কি বেছে বেছে অমন বউ ঘরে আনলাম? আমি তো জানি ও সবদিকটা সামলাতে পারবে। আমিই তো ওকে জোর করলাম একটা চাকরি করার জন্য।'                 

আমি হতবম্ব আর দাদাও। আত্মীয়ের সামনে মা ভোল বদলে ফেলেন জানতাম, তা বলে এতটা মিথ্যে! দাদা তার ক্রেডিট নিতে রৈ রৈ করে উঠে পড়ে লাগল, 'কোথায় তুমি শ্বেতাকে বলেছিলে চাকরি করতে? যা করার সব ব্যবস্থা তো আমিই ওকে করে দিলাম। ওর মধ্যে যে ট্যালেন্ট আছে সেটা এর আগে তোমরা কেউ চোখেই দেখতে পাওনি। তুমি তো শুধু বাচ্চা সামলাতে বলেছিলে শ্বেতাকে।'             

দিদি অমনি সকলকে চমকে দিয়ে বলে উঠলো, 'আসলে আমিই বৌদিকে ইন্সিস্ট করতাম চাকরি করার জন্য। দাদা, তুই দেখিস নি আমি ওকে সারাদিন গেঁয়ো গেঁয়ো বলে খ্যাপাতাম? আর সেটাতেই সে মনে মনে রাগ পুষে রেখেছিল। এখন সুযোগ পেয়েই তার শোধ নিয়েছে। না হলে শুধু তোর কথাতে বৌদি কখনও রাজি হত নাকি?' 

বাবা গম্ভীর ভাবে বললেন, 'আমিও তো সেই কবে থেকেই বউমাকে বলে আসছি আগে নিজেরটা দেখবে তারপর পরেরটা।'

যদিও বাবার মুখে এমন মন্তব্য এই প্রথম শুনলাম। সবাই কিছু না কিছু বলছে তাই আমিই বা আর বাদ যাই কেন? তাই ফস করে বলে ফেললাম, 'তখন বৌদির মনে আমিই প্রতিদিন সাহস জোগাতাম, না হলে ও যা ভীতু।'                                         

বৌদি যে কখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে তা আমি লক্ষ্যই করিনি। জ্যেঠিমা বোধহয় বৌদিকে লক্ষ্য করেই কথাটা বললেন, 'তাহলে তোমাদের পরিবার তো একেবারে আদর্শ পরিবার, শ্বেতা! কিন্তু মাঝে কানা ঘোষা শুনেছিলাম বউ নাকি তোমাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে?'

মা তখন জ্যেঠিমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, 'নিন্দুকেরা অমন কথাই বলবে। বউ তখন হোস্টেলে পড়াশোনা করতে গেছিল।' 

এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কারণ আমি জানি মা মিথ্যে বলতে অভ্যস্থ তাই তার মুখে বাধাবাধির কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু এরপর বৌদি যেটা বলল তার জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। খুব সাবলীল ভাবেই বৌদি বলে চলল, যেন তার মনের ভেতরের এতদিন কার লুকিয়ে রাখা কথাগুলো সে বাইরের সকলের সামনে পরিস্ফুট করে দিতে চাইল, 'জ্যেঠিমা, এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম বইকি। কিন্তু দেখলাম তাতেও নিস্তার নেই। এমন অনেক ব্যবহার আমি এনাদের কাছ থেকে পেয়েছি যেগুলোর সঠিক জবাব দিতে না পারা পর্যন্ত মনে শান্তি পাচ্ছিনা। কী করবো বলুন তাই আবার এই সংসারেই ফিরে আসতে হল।' 

সেইদিনকার মত আমাদের গল্পের আসর এখানেই বন্ধ হয়ে গেল।

লেখক : কলেজ শিক্ষার্থী ও ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment