আজকের অবরোধ-বাসিনী

  • 08 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1214 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
নারীর কথা ও নারীর ব্যথা রোকেয়ার লেখায় বারবার এসেছে। একশো  বছর আগে রোকেয়া নারী মুক্তির ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি জানতেন অবরোধ প্রথা কতখানি ভয়ানক। আজও আমরা অবরোধবাসিনীদের প্রত্যক্ষ করি যাঁরা অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে না পেরে গুমরে মরে!

রোকেয়া তার অবরোধ-বাসিনীতে যে অবরোধ প্রথার বর্ণনা করেছিলেন, সেই প্রথা সত্যিই আজ নেই, এখন তাহলে আমরা আহা কী আনন্দ, কী আনন্দ বলে নেচে গেয়ে, লম্ফঝম্প করতেই পারি তাই না? একটু থামুন, নাচগান পরে করবেন। একশো  বছর আগে রোকেয়া নারী মুক্তির ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ রোকেয়া প্রসঙ্গে বলেছেন— ‘রামমোহন দিয়েছেন বাংলার নারীকে প্রাণ, বিদ্যাসাগর দিয়েছেন জীবন। আমরা বলতে পারি, রোকেয়া দিয়েছেন নারীকে আত্মমর্যাদার সচেতনতা।’ আবার, ডঃ গোলাম মুরশিদ ‘প্রথম বাঙালি নারীবাদী বেগম রোকেয়া’ প্রবন্ধে বলেছেন— ‘অবরোধের দারুণ যন্ত্রণা ব্যক্তিগত জীবনেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সে তো করিমুন্নেসা এবং সেকালের লক্ষ লক্ষ মহিলারাও করেছিলেন। কিন্তু অবরোধ মোচন করতে হবে, তার চেয়েও বড়ো কথা নারী সমাজকে মুক্ত করতে হবে বহু শতাব্দীর দৃঢ়মূল বন্ধন থেকে— এ চেতনা তিনি কোথায় পান, তা বলা শক্ত।’

‘বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি’  শীর্ষক  প্রবন্ধটি আসলে  বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সম্মেলনে সভানেত্রী হিসেবে লিখিত অভিভাষণ। এই বক্তৃতার মধ্যে রোকেয়া জানিয়েছেন— ‘আমি আজীবন কঠোর সামাজিক ‘পর্দার’ অত্যাচারে লোহার সিন্দুকে বন্ধ আছি — ভালরূপে সমাজে মিশিতে পারি নাই, কিন্তু সিন্দুকে বন্ধ থেকে — বন্দী থেকে কী করে মুক্ত জীবনাভিজ্ঞতার এতো আস্বাদন আমাদের দিলেন!’ এ লিখিত বক্তৃতায় তিনি বলেছেন— 

‘‘বলিতে আপন সুখ পরনিন্দা হয়

মাতা যদি বিষ দেন আপন সন্তানে

বিক্রয়েন পিতা যদি অর্থ প্রতিদানে”।

নারীর কথা ও নারীর ব্যথা রোকেয়ার লেখায় বারবার এসেছে। বিশ শতকের একজন মুসলিম বাঙালি মহিলা লেখক হয়ে তিনি অত্যন্ত আধুনিক ছিলেন। তিনি জানতেন অবরোধ প্রথা কতখানি ভয়ানক, তাই তিনি  বলেছেন— “আমাদের অবরোধ প্রথাটা বেশি কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। ওই সকল কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে। আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব।” আবার তিনি বলেছেন— “অবরোধ প্রথাকে প্রাণঘাতক কার্বনিক অ্যাসিড গ্যাসের সহিত তুলনা করা যায়। যেহেতু তাহাতে বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় বলিয়া লোক কার্বনিক গ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করিবার অবসর পায় না। অন্তঃপুরবাসী নারী এই অবরোধ গ্যাসে বিনা ক্লেশে তিল তিল করিয়া নীরবে মরিতেছে।” অবরোধবাসিনীতে অবরোধ সম্পর্কিত যে সাতচল্লিশটি কাহিনী আছে, সেই  কাহিনীগুলি শ্লেষাত্মক ভাবে লেখা হয়েছে।

অবরোধবাসিনীর সূচনাতেই রোকেয়া লিখেছেন— “কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষদের বিরুদ্ধে নহে, মেয়ে মানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ির চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোক দেখিতে পায় না।

বিবাহিত নারীগণও বাজিকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাশাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেঁচকের মতো লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশি শরীফ।”

এইসময়  হয়তো সেই যুগের মতো পর্দা প্রথার প্রচলন নেই, তবে আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে অবরোধবাসিনীরা রয়েছেন। সেইরকম কয়েকজন অবরোধবাসিনীর ঘটনা আমরা এবার জেনে নেব।

অবরোধ-বাসিনী— ২০

জনৈকা পাঞ্জাবী বেগম সাহেবা নিম্নলিখিত  কোন উর্দু কাগজে লিখিয়াছেন:

আমরা একটা গ্রামে কিছুকাল ছিলাম। একবার  কোন সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়ীতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানে গিয়া কুমারী মেয়েদের প্রতি যে অত্যধিক জুলুম হইতে দেখিলাম, তাহাতে আমি প্রাণে বড় আঘাত পাইলাম।

আমরা যথাসময় তথায় পৌঁছিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, বাড়ীর মেয়েরা কোথায়? শুনিতে পাইলাম তাহারা সকলে রান্নাঘরে বসিয়া আছে। আমি তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলে, কেবল একা আমাকে সেইখানে ডাকিয়া লইয়া গেল। রান্নাঘরে ভয়ানক গরম, আর স্থানও অতিশয় অল্প। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখিয়া সেইখানে বসিয়া সেই “জুলুম” কিন্তু মিষ্টভাষিণী বালিকাদের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিলাম।

একজন দয়াবতী বিবি আমাদের প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া বলিলেন, “তোমরা সাবধানে লুকাইয়া উপরে চলিয়া যাও।”

আমি মনে করিলাম, সম্ভবতঃ পুরুষমানুষদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই সাবধানে লুকাইয়া যাইতে বলিলেন। কিন্তু পরে জানিলাম, এ পর্দ্দা সাধারণ অভ্যাগতা মহিলাদের বিরুদ্ধে ছিল। উক্ত বিবি সাহেবার হুকুমে দুইজন মেয়েমানুষ মোটা চাদর ধরিয়া পর্দ্দা করিল, আমরা সেই চাদরে অন্তরাল হইতে উপরে চলিয়া গেলাম।

উপরে গিয়া আমি আরও বিপদে পড়িলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম, ছাদের উপর আরামে বসিবার কোন কামরা হইবে, অথবা কমপক্ষে বর্ষাতি চালা হইবে। কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না। একে ত প্রখর রৌদ্র, দ্বিতীয়তঃ বসিবারও কিছু ছিল না। সমস্ত ছাদ জুড়িয়া অর্দ্ধ শুষ্ক ঘুঁটে ছড়ান ছিল; তাহার দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছিল। বহু কষ্টে একজন চাকরাণী একটা খাটিয়া আনিয়া দিল, আমরা অগত্যা তাহাতেই বসিলাম। নীচে বাজনা বাজিতেছিল, উৎসব হইতেছিল। কিন্তু অভাগিনী অনূঢ়া বালিকা কয়টি অপরাধিণীর ন্যায় রৌদ্রে বসিয়া ঘুঁটের দুর্গন্ধে হাঁপাইতেছিল। কেহই ইহাদের আরামের জন্য একটুকু খেয়াল করিতেছিল না।

আজকের অবরোধ-বাসিনী : ঘটনা ১

কেন আসিলাম হায় এ পোড়া সংসারে

কোন এক গ্রামে আমারও ছোটবেলা কেটেছে। আমি যেখানে থাকতাম ঠিক তার পাশের বাড়িতে কয়েকজন বালিকা থাকতো। তাদের অবস্থা উপরের কাহিনির মতো ছিল। তারা জোরে কথা বলতে পারতো না, বাড়ি থেকে বেরতো না। কারও সঙ্গে মিশতো না। অবরোধে থাকতে থাকতে একসময় তাদের বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পুনরায় তাদের অবরোধবাস শুরু হয়। কেউ আর বাপের বাড়ি আসতো না। ছোট মেয়েটা বছর খানেক আগে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে, একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি এসে, আবার অবরোধবাস শুরু করেছে। ইদানীংকালে মেয়েটির কিঞ্চিৎ মস্তিক বিকৃত ঘটেছে বলে মনে হয়! কারণ সে মাঝেমধ্যে ছাদে উঠে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে, এবং হিহি করে হাসে!

অবরোধ-বাসিনী— ১৩

আজিকার (২৮ শে জুন ১৯২৯) ঘটনা শুনুন। স্কুলের একটী মেয়ের বাপ লম্বা চওড়া চিঠি লিখিয়াছেন যে, মোটর বাস তাঁহার গলির ভিতর যায় না বলিয়া তাঁহার মেয়েকে “বোরকা” পড়িয়া মামার (চাকরাণীর) সহিত হাঁটিয়া বাড়ী আসিতে হয়। গতকল্য গলিতে এক ব্যক্তি চায়ের পাত্র হাতে লইয়া যাইতেছিল, তাহার ধাক্কা লাগিয়া হীরার (তাঁহার মেয়ের) কাপড়ে চা পড়িয়া গিয়া কাপড় নষ্ট হইয়াছে। আমি চিঠিখানা আমাদের জনৈকা শিক্ষয়িত্রীর হাতে দিয়া ইহার তদন্ত করিতে বলিলাম। তিনি ফিরিয়া আসিয়া উর্দ্দু ভাষায় যাহা বলিলেন, তাহার অনুবাদ এইঃ “অনুসন্ধানে জানিলাম হীরার বোরকায় চক্ষু নাই। (হীরাকে বোরকা মে আঁখ নেহী হায়)! অন্য মেয়েরা বলিল, তাহারা গাড়ী হইতে দেখে, মামা প্রায় হীরাকে কোলের নিকট লইয়া হাঁটাইয়া লইয়া যায়। বোরকায় চক্ষু না থাকায় হীরা ঠিকমত হাঁটিতে পারে না—সেদিন একটা বিড়ালের গায়ে পড়িয়া গিয়াছিল,— কখনও হোঁচট খায়। গতকল্য হীরাই সে চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা দিয়া তাহার চা ফেলিয়া দিয়াছে।”*

দেখুন দেখি, হীরার বয়স মাত্র ৯ বৎসর— এতটুকু বালিকাকে “অন্ধ বোরকা” পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সন্মান রক্ষা হয় না!

আজকের অবরোধ-বাসিনী: ঘটনা ২

কেন জন্ম নিলাম পর্দানশীন ঘরে

কলেজে পড়াকালীন একজন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে হীরার মতো অন্ধ বোরকা পরে রাস্তায় চলাফেরা করতো। কালো বোরকায় নিজেকে আগপাশতলা মুড়িয়ে প্রতিদিন কলেজে যেত। সে কেবলমাত্র আমার সফর সঙ্গী ছিল। পার্ক সার্কাস থেকে বাসে আমরা যেতাম। সেও শিয়ালদা নামতো, তার কলেজও ভিন্ন ছিল। তার মুখ কোনদিন আমি দেখিনি। গল্প হতো অনেক। সে একদিন আফশোস করে বলেছিল, আমার তোমাদের মতো জামাকাপড় পরতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আব্বা জানতে পারলে আমার পড়াশোনা করা বন্ধ করে দেবেন। আমি পড়তে চাই। তবে তোমাদের মতো নর্মাল জীবন পেলে মন্দ হতো না! কি আর করা যাবে! এমন ঘরে জন্মেছি!

অবরোধ-বাসিনী— ১২

পশ্চিম দেশের এক হিন্দু বধূ তাহার শাশুড়ী ও স্বামীর সহিত গঙ্গাস্নানে গিয়াছিল। স্নান শেষ করিয়া ফিরিবার সময় তাহার শ্বাশুড়ী ও স্বামীকে ভীড়ের মধ্যে দেখিতে পাইল না। অবশেষে সে এক ভদ্রলোকের পিছু পিছু চলিল। কতক্ষণ পরে পুলিশের হল্লা।— সেই ভদ্রলোককে ধরিয়া কনষ্টেবল বলে, “তুমি অমুকের বউ ভাগাইয়া লইয়া যাইতেছ।” তিনি আচস্বিতে ফিরিয়া দেখেন, আরে! এ কাহার বউ পিছন হইতে তাঁহার কাছার খুঁটি ধরিয়া আসিতেছে। প্রশ্ন করায় বধূ বলিল, সে সর্ব্বক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়া থাকে— নিজের স্বামীকে সে কখনও ভাল করিয়া দেখে নাই। স্বামীর পরিধানে হলদে পাড়ের ধূতি ছিল, তাহাই সে দেখিয়াছে। এই ভদ্রলোকের ধূতির পাড় হলদে দেখিয়া সে তাঁহার সঙ্গ লইয়াছে!

আজকের অবরোধ-বাসিনী: ঘটনা ৩

অগ্নিদাহ সম আজি জ্বলে মোর হিয়া

আমার এক বন্ধুর মায়ের সঙ্গে একবার উপরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। তিনি মুখচোরা মানুষ। স্বামীর কথাই ওঠেন বসেন। কোন কথার অন্যথা করেন না। তিনি একবার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে মেলা দেখতে গিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ভিড়ে তিনি একজনকে তার স্বামী ভেবে, তার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন থাকায় তিনি আর মুখ তুলে লজ্জায় স্বামীকে দেখেননি। অনেকদূর যাবার পর, ভদ্রলোক বুঝতে পারেন পরস্ত্রীর হাত ধরে তিনি এতটা রাস্তা এসেছেন! সারাজীবন তিনি স্বামী, সন্তানদের দাবড়ানি খেয়ে অসহায় হয়ে উঠেছেন। আমাকে একবার বলেছিলেন, আমি আগে এরকম ছিলাম না রে! বাপের বাড়ি সব কাজ করতাম। কিন্তু বিয়ের পর নানান বাধানিষেধের ফলে, আমি এমন পুতুলে পরিণত হয়েছি।

অবরোধ-বাসিনী— ২৪

বেহার অঞ্চলে শরীফ ঘরানার মহিলাগণ সচরাচর রেলপথে ভ্রমণের পথে ট্রেণে উঠেন না। তাঁহাদিগকে বনাতের পর্দ্দা ঢাকা পাল্কীতে পুরিয়া, সেই পাল্কীতে ট্রেণের মালগাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হয়। ফল কথা, বিবিরা পথের দৃশ্য কিছুই দেখিতে পান না। তাঁহারা ব্রুকবণ্ড চায়ের মত Vacuum টিনে প্যাক হইয়া দেশ ভ্রমণ করেন। কিন্তু এই কলিকাতার এক ঘর সম্ভ্রান্ত পরিবার উহার উপরও টেক্কা দিয়াছেন। তাঁহাদের বাড়ীর বিবিদের রেলপথে কোথাও যাইতে হইলে প্রথমে তাঁহাদের প্রত্যেককে, পাল্কীতে বিছানা পাতিয়া, একটা তালপাতার হাত পাখা, এক কুজা পানি এবং একটা গ্লাসসহ বন্ধ করা হয়। পরে সেই পাল্কীগুলি তাঁহাদের পিতা কিম্বা পুত্রের সম্মুখে চাকরেরা যথাক্রমে— (১) বনাতের পর্দ্দা দ্বারা প্যাক করে; (২) তাহার উপর মোম-জমা কাপড় দ্বারা সেলাই করে; (৩) তাহার উপর খারুয়ার কাপড়ে ঘিরিয়া সেলাই করে; (৪) তাহার পর বোম্বাই চাদরের দ্বারা সেলাই করে; (৫) অতঃপর সর্ব্বোপরে চট মোড়াই করিয়া সেলাই করে। এই সেলাই ব্যাপার তিন চারি ঘণ্টা ব্যাপিয়া হয়-আর সেই চারি ঘণ্টা পর্য্যন্ত বাড়ীর কর্ত্তা ঠায় উপস্থিত থাকিয়া কড়া পাহারা দেন। পরে বেহারা ডাকিয়া পাল্কীগুলি বনাতের পর্দ্দা ঢাকা অবস্থায় রাখিয়া চাকরেরা সরিয়া যায়। পরে কর্ত্তা স্বয়ং বন্দিনীদের অজ্ঞান অবস্থায় বাহির করিয়া যথারীতি মাথায় গোলাপজল ও বরফ দিয়া, মুখে চামচ দিয়া পানি দিয়া, চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়া বাতাস করিতে থাকেন। দুই ঘণ্টা বা ততোধিক সময়ের শুশ্রূষার পর বিবিরা সুস্থ হন।

আজকের অবরোধ-বাসিনী:  ঘটনা ৪

ব্যথাই হানিলে যদি হে প্রিয় নিঠুর 

গ্রীষ্মকালে বন্দিনীদের দশা ভয়ানক হয়ে ওঠে। গতবছর  গ্রীষ্ম কালে শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে ভয়ানক এক দৃশ্য দেখে শিহরিত হয়েছিলাম। লালগোলা প্যাসেঞ্জার উঠবো বলে প্ল্যাটফর্মে  অপেক্ষা করছিলাম। সেইসময় আমার পাশে একজন আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা মহিলা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আশেপাশে যারা ছিলাম তাঁকে শুশ্রূষা করতে এগিয়ে যাই। বারবার তাকে সবাই নেকাব খুলতে  বলছিলাম, তখন হন্তদন্ত হয়ে তার স্বামী সেখানে উপস্থিত হন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ভদ্রলোক বলেন— নেকাব খুলতে হবে না, এই নাও প্লাস্টিক ব্যাগ, এখানেই বমি করো। ততক্ষণে সেই মহিলা, নেকাব না খুলেই বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছেন! অপরদিকে আমরা প্ল্যার্টফর্মভর্তি লোক নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে একজন মহিলার অসহায়ত্ব অবলোকন করলাম! 

অবরোধ-বাসিনী— ২৯

একবার আমি কোন একটী লেডীজ কনফারেন্স উপলক্ষে আলীগড়ে গিয়াছিলাম। সেখানে অভ্যাগতা মহিলাদের নানাবিধ বোরকা দেখিলাম। একজনের বোরকা কিছু অদ্ভুত ধরণের ছিল। তাঁহার সহিত আলাপ পরিচয়ের পর তাঁহার বোরকা প্রশংসা করায় তিনি বলিলেন,— “আর বলিবেন না,— এই বোরকা লইয়া আমার যত লাঞ্ছনা হইয়াছে!” পরে তিনি সেই সব লাঞ্ছনার বিষয় যাহা বলিলেন, তাহা এই:

তিনি কোন বাঙ্গালী ভদ্রলোকের বাড়ী শাদীর নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন। তাঁহাকে (বোরকাসহ) দেখিবামাত্র সেখানকার ছেলে-মেয়েরা ভয়ে চীৎকার করিয়া কে কোথায় পলাইবে, তাহার ঠিক নাই। আরও কয়েক ঘর বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সহিত তাঁহার স্বামীর আলাপ ছিল, তাই তাঁহাকে সকলের বাড়ীই যাইতে হইত। কিন্তু যতবার যে বাড়ী গিয়াছেন, ততবারই ছেলেদের সভয় চীৎকার ও কোলাহল সৃষ্টি করিয়াছেন। ছেলেরা ভয়ে থরথর কাঁপিত।

তিনি একবার কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। তাঁহারা চারি পাঁচ জনে বোরকাসহ খোলা মোটরে বাহির হইলে পথের ছেলেরা বলিত, “ওমা! ওগুলো কি গো?” একে অপরকে বলে “চুপ কর!— এই রাত্রিকালে ওগুলো ভূত না হয়ে যায় না।” বাতাসে বোরকার নেকাব একটু আধটু উড়িতে দেখিলে বলিত— “দেখ্‌রে দেখ্‌! ভূতগুলার শুঁড় নড়ে—! বাবারে! পালা রে!”

তিনি এক সময় দার্জ্জীলিং গিয়াছিলেন। ঘুম ষ্টেশনে পৌঁছিলে দেখিলেন, সমবেত জনমণ্ডলী একটা বামন লোককে দেখিতেছে— বামনটা উচ্চতায় একটা ৭/৮ বৎসরের বালকের সমান, কিন্তু মুখটা বয়োপ্রাপ্ত যুবকের,— মুখভরা দাড়ী গোঁফ। হঠাৎ তিনি দেখিলেন, জনমণ্ডলীর কৌতূকপূর্ণ দৃষ্টি তাঁহার দিকে! দর্শকেরা সে বামন ছাড়িয়া এই বোরকাধারিণীকে দেখিতে লাগিল!

অতঃপর দার্জ্জিলিং পৌঁছিয়া তাঁহারা আহারান্তে বেড়াইতে বাহির হইলেন; অর্থাৎ রিকশ গাড়ীতে করিয়া যাইতেছিলেন। “মেলে” গিয়া দেখিলেন, অনেক লোকের ভীড়; সেদিন তিব্বত হইতে সেনা ফিরিয়া আসিতেছিল, সেই দৃশ্য দেখিবার জন্য ভীড়। তাঁহার রিকশখানি পথের একধারে রাঁখিয়া তাঁহার কুলিরাও গেল,— তামাসা দেখিতে। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি দেখেন, দর্শকেরা সকলেই এক একবার রিকশর ভিতর উঁকি মারিয়া তাঁহাকে দেখিয়া যাইতেছে।

তিনি পদব্রজে বেড়াইতে বাহির হইলে পথের কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিত। দুই একটা পার্ব্বত্য ঘোড়া তাঁহাকে দেখিয়া ভয়ে সওয়ার শুদ্ধ লাফালাফি আরম্ভ করিত। একবার চায়ের বাগানে বেড়াইতে গিয়া দেখেন, তিনি চারি বৎসরের এক বালিকা মস্ত ঢিল তুলিয়াছে, তাঁহাকে মারিতে!*

একবার তাঁহার পরিচিতা আরও চারি পাঁচজন বিবির সহিত বেড়াইবার সময় একটা ক্ষুদ্র ঝরণার ধারে কঙ্করবিশিষ্ট কাদায় সকলেই বোরকায় জড়াইয়া পড়িয়া গেলেন। নিকটবর্ত্তী চা বাগান হইতে কুলিরা দৌড়িয়া আসিয়া তাঁহাদের তুলিল; আর স্নেহপূর্ণ ভৎর্সনায় বলিল, “একে ত জুত্তা পরেছ, তার উপর আবার ঘেরাটোপ,— এ অবস্থায় তোমরা গড়াইবে না ত কি করিবে?” আহা! বিবিদের কারচুপি কাজ করা দো-পাট্রা কাদায় লতড়-পতড়, আর বোরকা ভিজিয়া তর-বতর! কেবল ইহাই নহে, পথের লোক রোরুদ্যমান শিশুকে চুপ করাইবার নিমিত্ত তাঁহাদের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বলিত,— “চুপ কর, ঐ দেখ মক্কা মদিনা যায়,—ঐ!”—ঘেরাটোপ জড়ানো জুজুবুড়ী,— ওরাই মক্কা মদিনা!!”

* বাঙ্গালী ও গুর্খায় প্রভেদ দেখুন; যৎকালে বাঙ্গালী ছেলেরা ভয়ে চীৎকার করিয়া দৌড়াদৌড়ি করিয়া পলাইত, সে সময় গুর্খাশিশু আত্মরক্ষার জন্য ঢিল তুলিয়াছে সে ভয়াবহ বস্তুকে মারিতে!

আজকের অবরোধবাসিনী:  ঘটনা ৫

'অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি!’ 

আমার ছোটবেলায় মুর্শিদাবাদে অতটা বোরকা পরার প্রচলন ছিল না। ইদানিং বোরকা পরার প্রবণতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন বিকেলে বন্ধুরা মিলে মাঠে খেলতে যেতাম। আমাদের পাশে আমাদের থেকে বড় দাদারা ক্রিকেট খেলতো। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যে নামার মুখে, একজন মহিলা বাদামী রঙের বোরকা পরে ঐদিক দিয়ে যেতো। দুষ্টু ছেলেরা সেইসময় নানাভাবে বোরকা পরিহিতাকে নিয়ে মজা করতো। বল ছুড়ে দিত। ঐ দেখা যায় বাদামী বস্তা বলে আওয়াজ দিত। জিন আছে, জিন যাচ্ছে বলতো। অনেক ছোট বাচ্চারা ভয় পেত। সেই মহিলাকে প্রতিদিন হেনস্তা করা হত, কিন্তু কোনদিন সেই মহিলা প্রতিবাদ করেননি!

রোকেয়ার অবরোধবাসিনীতে পর্দা প্রথার নামে নারীর প্রতি সেকালের সমাজের কঠোর রক্ষণশীল আচরণ দেখে আমরা সত্যি বিস্মিত হই, কিন্তু আজকেও আমাদের আশেপাশে এরকম হাজার অবরোধবাসিনী বিরাজমান। রোকেয়া বলেছিলেন— ‘কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক।’ কন্যাগুলোর এই বোধ এখন সেভাবে তৈরি হয়নি। এখন নিজেদের মানুষ হিসেবে ভাবতে পারলো না! তাই রোকেয়ার ভাষায় বলতে হচ্ছে— ‘ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন— অগ্রসর হউন সকলে। সমস্বরে বল আমরা মানুষ।’ 

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১২ ডিসেম্বর ২০২০ 

লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment