‌যুগান্তরের বজ্রনির্ঘোষ­ : পদ্মরাগ

  • 06 December, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1711 view(s)
  • লিখেছেন : উত্তরা চক্রবর্তী
রোকেয়া যখন ১৯০২ সালে পদ্মরাগ লিখেছিলেন—এমন স্পষ্টভাবে মেয়েদের আত্মনির্ভর, পুরুষের প্রভুত্বমুক্ত স্বাধীন অস্তিত্বের কথা আর কোনো লেখক তখনও বলেননি। ১৯২৪ সালেও, যখন পদ্মরাগ প্রকাশিত হল তখনকার সাহিত্যে এ ধরনের লেখালেখি কমই দেখা গেছে। অতএব বলা যেতে পারে, রোকেয়ার পদ্মরাগ–ই বাংলা সাহিত্যে প্রথম নারীবাদী উপন্যাস।

কথা ছিল ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার মৃত্যুদিন উপলক্ষে ৬ ডিসেম্বর ‘এসকেসিউ’ একটি আন্তর্জালিক আলোচনাসভা করবে। বক্তা ছিলেন ‘এসকেসিউ’-এর কার্যনির্বাহী সমিতির সদস্য অধ্যাপক উত্তরা চক্রবর্তী। রোকেয়াকে নিয়ে ‘এসকেসিউ’-এর পোর্টালে একটি লেখা দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু ২৯ নভেম্বর আকস্মিকভাবে আমরা হারিয়েছি উত্তরাদিকে। তিনি আমাদের ছেড়ে গেলেও রেখে গেছেন অমূল্য দর্শন। রোকেয়ার প্রাসিঙ্গকতা নিয়ে উত্তরাদির বহু লেখা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পত্রিকা ও পুস্তকে রয়েছে। আজ তারই একটি পুনঃপ্রকাশ। নিবেদিত হল ‘এসকেসিউ’-এর  সকল সদস্যের শ্রদ্ধা। উত্তরা চক্রবর্তীর জন্ম ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৪, মৃত্যু ২৯ নভেম্বর ২০২০।

রোকেয়ার পদ্মরাগ উপন্যাসটি আমি প্রথম পাই আবদুল কাদির সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত রোকেয়া রচনাবলীতে। গ্রন্থাকারে বইটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। পদ্মরাগ রোকেয়া নিজেই প্রকাশ করেন। ১৮৮ পৃষ্ঠার বই, প্রথম প্রকাশ হয় ১৩৩১ বঙ্গাব্দে। বইয়ের ভূমিকা, ‘‌‌নিবেদন’‌ অংশে রোকেয়া লিখছেন—“‌প্রায় ২২ বৎসর পূর্ব্বে এই উপন্যাসটি লিখিত হইয়াছিল।” অর্থাৎ রোকেয়ার যখন বাইশ বছর বয়স তখন তিনি এই উপন্যাসটি রচনা করেন। কাদির সাহেব সম্পাদিত রচনাবলীর ‘পরিশেষে’ ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক বিনয়ভূষণ সরকারের লিখিত পদ্মরাগ উপন্যাসের ভূমিকা এবং বাংলার তৎকালীন স্কুল ইনস্পেক্টর আবদুল করিমের লেখা পরিশিষ্টের অংশ বিশেষ মুদ্রিত করেছেন। এ ছাড়াও মোহাম্মদী পত্রিকার ১৩৩৭, শ্রাবণ সংখ্যার গ্রন্থ সমালোচনায় শাহাদাত হোসেন লিখিত সমালোচনাটিও প্রকাশ করেছেন। বিনয়ভূষণ সরকার ভূমিকায় লিখেছিলেন—“ ...কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি খৃষ্টান—সকল সমাজেরই অনেক ক্ষতস্থান দেখিয়া মর্ম্মে ব্যথা অনুভব করিতে হইবে। গ্রন্থকর্ত্রী শুধু ক্ষতস্থানে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াই আপনার কর্তব্য শেষ করে নাই—‘‌তারিণী–ভবনের’‌ পরিকল্পনায় তিনি ব্যাধির সমাধানেরও ইঙ্গিত করিয়াছেন।” স্কুল ইনস্পেক্টর আব্দুল করিম পরিশিষ্টে লিখেছেন—“.‌.‌.‌ Please accept my most hearty congratulations on the completion of your ‘Padmarag’...‌Of the new novels I have read one is East Lynne by Mrs Henry Wood, your book will be in Bengali what East Lynne is in English...’‌’‌ শাহাদাত হোসেন আবার লিখেছেন— “.‌.‌. ‌সেবাই যে নারীর চরম ও পরম ধর্ম্ম আমরা সিদ্দিকা–চরিত্রে তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাই।’‌’‌ যদিও তিনি এও লিখেছেন—“.‌.‌. ‘তারিণী–ভবন’ লেখিকার নিছক কল্পনার সৃষ্টি নয়। তাঁহার ব্যক্তিগত জীবনের আদর্শও এই তারিণী–ভবন”। অথচ সেই আদর্শটির কথা খুলে  লেখেননি মোহাম্মদীর গ্রন্থ সমালোচক।                                       

সমকালীন সাহিত্যসমাজে ‘‌পদ্মরাগ’‌ সমাদৃত হলেও বইটির মূল উদ্দেশ্য এবং রোকেয়ার প্রধান বক্তব্য উপর্যুক্ত তিন আলোচকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছেই বলে মনে হয়। মোহাম্মদীর গ্রন্থ সমালোচক মনে করেছেন— “.‌.‌. নারীর মূল আদর্শ ‌.‌..‌‌ সেবা।’‌’‌ উপন্যাসের নায়িকা সিদ্দিকা তাই মাথা পেতে নিয়েছেন, এমন কথা বলে প্রথামত সামাজিক ধারণাই বদ্ধমূল করেছেন। পদ্মরাগ উপন্যাসে রোকেয়া খোলাখুলি এবং স্পষ্টভাবে নারী–পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে যে অসাম্য এবং অন্যায় চলে আসছে তার সরব বিরোধিতা করেছেন। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায়  নারীর অসহায় দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে অবস্থানের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন—রোকেয়া তারিণী–ভবনের মধ্য দিয়ে মেয়েদের স্বনির্ভর, স্বাধীন অবস্থান ও অস্তিত্বের সন্ধান দিয়েছেন। বিনয়ভূষণ সরকার অবশ্য এ কথা লিখেছেন যে, তারিণী–ভবনের মধ্য দিয়ে লেখিকা সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু বিনয়ভূষণ উল্লেখ করলেও বাকি দুজন এ বিষয়ে নীরব। শাহাদাত হোসেন তারিণী–ভবনের আদর্শ রোকেয়ার আদর্শ বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু রোকেয়া বা তারিণী–ভবনের ‘আদর্শ’ ব্যাখ্যা করেননি। বিনয়ভূষণও এ ব্যাপারে বিশদ লেখেননি। তাঁদের  এই নীরবতা সচেতনভাবেই। রোকেয়ার সমকালীন সমাজ, কী হিন্দু, কী মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়া, উচ্চশিক্ষা, এমনকি স্বাধীন উপার্জন মেনে নিলেও মেয়েদের পুরুষকর্তৃত্বহীন অবস্থান তখনও মেনে নেয়নি (মুসলিম সমাজে উচ্চশিক্ষিত উপার্জনরত মেয়েদের সংখ্যা বিশের দশকে নগণ্য, হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও অতি কম। তিরিশের দশকে রোকেয়ার মৃত্যুর বছর থেকেই উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু–মুসলমান মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্বামী ছাড়া, বিবাহ ছাড়া মেয়েদের অস্তিত্বের যর্থাথতা আছে কিনা তাই নিয়ে বির্তক চলছিলই।)‌ 

১৯০২ সালে লিখিত পদ্মরাগের পাণ্ডূলিপি গ্রন্থাকারে ছাপা হল ১৯২৪ সালে। যখন রোকেয়ার বয়স চুয়াল্লিশ। তাঁর কথামত পদ্মরাগ লেখা হয়েছিল যখন তাঁর বয়স বাইশ। বাইশ বছরের   রোকেয়া তখন অবিরত লিখছেন নবনূরে। ১৯০২ সালের সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হল তাঁর দিগন্ত কাঁপানো প্রবন্ধ ‘আমাদিগের অবনতি’‌।  যেখানে তিনি লিখেছিলেন—“আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পরও দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই। যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা ক‌রিয়াছেন, তখনই ধর্ম্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে...। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্ম্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ...ধর্ম্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত। পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয় ...ধর্ম্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছে।” বাইশ বছর বয়সী রোকেয়ার এই বজ্রনির্ঘোষ যুগান্তরের ইঙ্গিতবাহী। রোকেয়া নিজেই যুগান্তরের নারী; আক্ষরিক অর্থে, ব্যাপক এবং গূঢ় অর্থে তো বটেই। জন্মেছিলেন ১৮৮০, লেখালেখি শুরু ১৯০২ সালে। নতুন সহস্রাব্দে। শৈশবে কড়া অবরোধের অনুশাসনের আড়ালে লুকিয়ে বাংলা এবং ইংরেজি শেখা বড়ো বোন করিমুন্নেসা এবং বড়ো ভাই ইব্রাহিম খানের কাছে। জীবন কেটেছে অবরুদ্ধ অন্তঃপুরের অন্তরালে। মুক্তির আস্বাদ পেলেন কী আশ্চর্য, বিয়ের পর। বিপত্নীক, দ্বিগুণ বয়সী স্বামী সাখাওয়াত হোসেনই নতুন জীবনের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তাঁর সামনে। এক জীবন  থেকে আরেক জীবনধারায় নতুন সহস্রাব্দে উত্তরণ, যুগান্তরেরই সামিল। নবনূর–এর পাতায় ‘গৃহ’, ‘‌অলঙ্কার’, ‘অর্দ্ধাঙ্গী’—একের পর এক নির্ভীক বলিষ্ঠ প্রবন্ধগুলির পাশাপাশি সেই সময়েই লিখেছিলেন ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাস। বিষয়গুলির সঙ্গে পদ্মরাগের বিষয়ের সাযুজ্য লক্ষ্যণীয়। ‘পুরুষের প্রভুত্ব’ ‘আমাদিগের অবনতির’ মূল বক্তব্য; পদ্মরাগ উপন্যাসেও তাই। সেই সঙ্গে মেয়েদের স্বাধীন সত্তা, স্বনির্ভর অবস্থানের প্রশস্ত পরিসর তৈরি করা, বিবাহই মেয়েদের জীবনের শেষ কথা নয়— এমন যুক্তি একাধিকবার উপস্থিত করা— এইসব বিষয়গুলি একটি নিটোল উপাখ্যানের স্বচ্ছন্দ গতির মধ্য দিয়ে রোকেয়া উপস্থাপন করেছিলেন। কেন তখন, যখন লেখা হয়েছিল পান্ডূলিপি ছাপলেন না গ্রন্থাকারে, সে প্রশ্ন গবেষক, পাঠকের মনে  অবধারিত জাগে। উত্তর তাঁকেই খুঁজে নিতে হয়। নবনূরে প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিম  সমাজে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। এর ফলে ‘‌মতিচূর’‌ প্রবন্ধ সংকলনে তিনি ওই প্রবন্ধগুলিকে একত্রে বাঁধলেন। নিজেই ‘বিজ্ঞাপনে’ লিখলেন ‘সংশোধিত ও অনেকস্থলে  পরিবর্তিত’ রূপে প্রবন্ধগুলি  নতুন করে প্রকাশিত হচ্ছে। কেন এই সংশোধন, কেন এই পরিবর্ত্তন, রোকেয়া তা নিজে ব্যাখ্যা করেননি। অতএব পাঠক–গবেষককে খুঁজে নিতে হয় ব্যাখ্যা। বাইশ বছর বয়সি রোকেয়া হয়ত বা সমালোচনার দাপটে বিভ্রান্ত। তাই এই সর্তকতা। বহির্জগতের কোন চাপে রোকেয়া আগের লেখা প্রবন্ধগুলি পরিবর্ত্তন করলেন, তা বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না এবং সেই একই কারণে পদ্মরাগের মত একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেও তার প্রকাশে উদ্যোগী কেন তিনি হননি, সে কথাও পাঠক বুঝে নেন। বাইশ বছর পরে প্রকাশিত হওয়ার পরও পদ্মরাগ যে তৎকালীন সমাজে অস্বস্তির কারণ ঘটিয়েছিল,  আলোচকদের এড়িয়ে যাওয়া আলোচনা থেকেই তা বোঝা যায়। একশো বছরেরও বেশি আগে লেখা এবং প্রায় একশো বছর আগের প্রকাশিত উপন্যাসটি যে একটি বলিষ্ঠ বক্তব্যের ব্যতিক্রমী রচনা এখনও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক তাও আজকের পাঠকের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

পদ্মরাগ উপন্যাসের গতিধারা তারিণী–ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও পদ্মরাগ উপন্যাসের একটি প্রেমের উপন্যাসও বটে। সিদ্দিকা ও লতীফ আলমাসের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ এবং তাঁদের প্রেম ও নিজেদের সম্পর্কের পরিচিতি জানা সত্ত্বেও লতীফের প্রেম এবং তাঁর বিয়ের  প্রস্তাব সিদ্দিকা প্রত্যাখ্যান করায় উপন্যাসটিকে একটি অন্য মর্যাদার স্তরে নিয়ে গেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সিদ্দিকার তারিণী–ভবন ছেড়ে চূয়াডাঙ্গায় জমিদারি দেখাশোনা এবং তাঁর বড় ভাই   সোলেমানের আদর্শে প্রজাবর্গের হিতার্থে নিজেকে নিবেদিত করার সিদ্ধান্ত পাঠককে বিভ্রান্ত করে। দীন–তারিণী দেবীও বিভ্রান্ত হন। কেন–না চূয়াডাঙ্গার পিছিয়ে পড়া গ্রাম্য সমাজের নিয়ম অনুযায়ী সিদ্দিকাকে অবরোধ মুক্ত জীবন ছেড়ে আবারও অবরোধের আওতায় জীবন কাটাতে হবে। অল্প আগেই এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে সিদ্দিকা দীন–তারিণী দেবীকে বলেছে— “আমি আজীবন তারিণী–ভবনের সেবা করিয়া নারী–জাতির কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করিব এবং অবরোধ–প্রথার মূলোচ্ছেদ করিব।’‌’‌ সিদ্দিকার চরিত্রের এই দ্বৈরথ ও জটিলতা উপন্যাসের নান্দনিক মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে তারিণী–ভবনের প্রাত্যহিক কর্মধারা অভিনবত্বের সন্ধান দেয়। তারিণী–ভবন প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছিলেন দীন–তারিণী দেবী। একটি বালিকা বিদ্যালয়, একটি ‘নারীক্লেশ–নিবারণী–সভা’ এবং স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত, পরিবার, সমাজে অত্যাচারিত, পরিত্যক্ত মেয়ে, মহিলাদের আশ্রয়স্থল— এইসব নিয়েই তারিণী–ভবন। এখানে মেয়েরা নানা ধরনের কর্মোদ্যোগে নিযুক্ত থেকে নিজেদের ভরণপোষণ চালায়। হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান, বাঙালি , বিহারি, এংলো ইন্ডিয়ান— সকল সম্প্রদায়ের ও জাতির নারী একসাথে নতুন আশা ও উৎসাহে দিনযাপন করছে। প্রায় একশো বছর পরে পাঠক উপন্যাস পাঠের পরে বুঝতে পারেন রোকেয়া একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তারিণী–ভবনের প্রস্তাবনা করেছিলেন। ধর্মের ও সম্প্রদায়ের ভিন্নতা উপেক্ষা করার ব্যাপার ছিল তো বটেই, উপরন্তু সংসার ও পুরুষের প্রভুত্বের বাইরে নারীর স্বাধীন এবং স্বনির্ভর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার কথাও তিনি সবলে বলেছেন। রোকেয়া লিখছেন—‘‘বিদ্যালয়টিতে বালিকাদের কি করে ‘সুকন্যা, সুগৃহিণী এবং সুমাতা’ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়।’’  আবার একই সঙ্গে লিখছেন— ‘‘তারিণী–ভবনের আদর্শ হল তাহারা আত্ম–নির্ভরশীল হয় এবং ভবিষ্যৎ–জীবনে যেন কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ পিতা, ভ্রাতা বা স্বামী–পুত্রের গলগ্রহ না হয় এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখা।’’ উপন্যাসের শুরুতে এ ধরনের পরস্পর–বিরোধী উক্তি বাইশ বছরের রোকেয়ার নজর এড়িয়ে গিয়েছিলও হয়তো–বা। আবার যখন প্রকাশ করেন চুয়াল্লিশ বছর বয়সি রোকেয়া উক্তিদ্বয় বাদ দেন না। কেন না ১৯২৪ সালেও বাঙালি সমাজে সুমাতা, সুগৃহিণী হতে হলে স্বামীর বাধ্যতা এবং পুত্রের অনুমতি–সাপেক্ষ জীবন অভিপ্রেত। ব্যতিক্রমী নারীর সংখ্যা বড় বিশেষ চোখে পড়ে না।  

সৌদামিনী, সকিনা, ঊষা, হেলেন— উপন্যাসের এইসব চরিত্রের জোরালো বক্তব্যগুলি কাহিনির গতি এবং ঘটনার সাযুজ্য তৈরি করেছে। সিদ্দিকার মুখে—‘‌‘আমরা কি মাটির পুতুল যে, পুরুষ যখন ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করিবেন, আবার যখন ইচ্ছা গ্রহণ করিবেন? আমি সমাজকে দেখাইতে চাই যে ... তোমরা পদাঘাত করিবে আর আমরা পদলেহন করিব সেদিন আর নাই’‌’; কিংবা ঊষার মুখে— ‘‌‘এই যে ‘পতি পরম গুরু’‌— এই ভাবটাই মারাত্মক ...অবলা, সরলার জন্য পতি বিনে নাই গতি’’; অথবা সৌদামিনীর মুখে—‘‌‘কন্যা পণ্যদ্রব্য নয়’’‌‌; সকিনার উক্তি—‘‘স্বামীর ঘর করাই নারীজীবনের সার নহে’’। আসলে এইসব কথাগুলি রোকেয়ারই মনের কথা। পাঠক রোকেয়ার নির্ভীক, জোরালো মতামত সম্বন্ধে অভিহিত হন।  

পদ্মরাগ উপন্যাসের গঠন–কাঠামোও অভিনব। সাধারণত উপন্যাসের গঠনের যে বিস্তার দেখা যায় এই উপন্যাসে তা নেই। স্থান, কালের কোনও বর্ণনামূলক বিস্তার বা চরিত্রগুলির বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য রূপায়ন এখানে দেখা যায় না। একেবারে সরাসরি চরিত্রগুলি রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হয়। উপরন্তু উপন্যাসের মধ্যে নাটকের মত চরিত্রের ‘প্রবেশ’, ‘প্রস্থান’ বা মুখের ভাবের অথবা মনোভাবের প্রকাশ বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা আছে।  লক্ষ্যণীয় যে, পদ্মরাগ উপন্যাস মূলত নারীপ্রধান। একমাত্র উল্লেখযোগ্য পুরুষ চরিত্র লতীফ আলমাস। অতজন তেজোদৃপ্ত নারী চরিত্রের পাশে লতীফকে খানিকটা নিষ্প্রভই মনে হয়। পদ্মরাগ উপন্যাসে নারীর সমস্যা এবং তার দূরী–করণ নিয়েই শুধুমাত্র মগ্ন ছিলেন না রোকেয়া। তাঁর চিন্তাভাবনার দ্বিতীয় বিষয়  স্বদেশ, স্বাধীনতা, ইংরেজ শাসনের অপকারিতা ইত্যাদি ব্যাপারেরও সবিস্তার উল্লেখ করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে স্বদেশের সার্বিক অবনতি, ইংরেজ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। রবিন্‌সন্‌ সাহেবের স্বীকারোক্তি— ‘‘‌আমি চূয়াডাঙ্গায় অনেকদিন নীলের চাষ করিতেছিলাম, কত লোকের প্রতি অত্যাচার করিয়াছি, তাহার ইয়ত্তা নাই, কত শস্যপুর্ণ ক্ষেত্র নষ্ট করিয়াছি তাহার সংখ্যা নাই…।’’‌ লতীফের ব্যঙ্গোক্তির মধ্যেও ইংরেজ শাসনের অপকারী দিকটি ফুটে ওঠে— ‘‘‌রবিন্‌সন্‌ প্রাণপন সেই অসহায় বালিকাকে আসামী সাজাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন…। গবর্নরের চাকরদিগকে উৎকোচ দ্বারা রবিন্‌সন্‌ বশীভূত করিয়াছিলেন। পুলিশও তাহার করায়ত্ত ছিল। পুলিশকে খুনী আসামী ধরিতেই হইবে; তাহারা সহজেই একটি অসহায় বালিকাকে ‘আসামী’ বানাইতে অনর্থক অন্য আসামী ধরিবার কষ্ট স্বীকার করিবে কেন।’‌’ ইংরেজের অত্যাচারের বিশদ বিবরণ এবং ব্রিটিশ শাসনের কুটিল নীতি বিশেষ করে ইংরেজ পুলিশের, এবং বঙ্গদেশীয় মানুষের প্রতি অবজ্ঞা ও ভেদনীতি— এ সমস্তেরই পরিচয় পাওয়া যায় রবিন্‌সনের আক্ষেপ এবং লতীফের মুখে পুলিশের ভূমিকা বর্ণনায়।

আরেক বিষয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দীন–তারিণী দেবীর প্রতিষ্ঠিত তারিণী বিদ্যালয়। পরবর্তী নয় বছর পরেই রোকেয়া তাঁর স্কুল তৈরি করেছিলেন (১৯১১)। স্কুল সংক্রান্ত তাঁকে   যেসব জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেগুলি কী আশ্চর্যভাবে তিনি পদ্মরাগ উপন্যাসে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। রোকেয়া কি ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টা ছিলেন?

উপন্যাসের একেবারের শেষ পঙ্‌ক্তি কয়েকটি ব্যঞ্জনাময়। পাঠকের মনে এক আক্ষেপ থেকেই যায়। লতীফ এবং সিদ্দিকার ‘শেষ দেখা’ কি শেষ দেখাই?  এখানেই উপন্যাসের মাধুর্য।

উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের পরিশিষ্টে স্কুল ইনস্পেক্টর আবদুল করিম সাহেব  Mrs. Henry (Ellen) Wood‌–এর লেখা ‘‌East Lynne’‌ উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৮৬১ সালে লেখা East Lynne একটি অতি–নাটকীয় উপন্যাস, যার সঙ্গে পদ্মরাগের তুলনা চলে না। শুধুমাত্র একটি আবাসগৃহের কেন্দ্রীয় অবস্থনের গুরুত্ব ছাড়া। East Lynne একটি বাড়ির নাম। সেখানে নায়িকা ইসাবেলার সুখের জীবন যাপিত হয়েছিল একসময়। কিন্তু ইসাবেলা অন্য এক ব্যক্তির প্রেমে পড়ে স্বামী–পুত্র এবং সুখের আবাস ছেড়ে চলে যায়। তারপর অনেক ঘাত প্রতিঘাতে সে ফিরে আসে সেই বাড়িতে ছদ্ম পরিচয়ে, গবর্নেস হিসেবে, নিজের ছেলে–মেয়ের কাছাকাছি থাকার জন্য। মৃত্যুর সময়ে স্বামীর কাছে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করে যায়। এই মেলো–ড্রামাটিক কাহিনির সঙ্গে পদ্মরাগের কোনো মিল নেই। উপরন্তু ইসাবেলার দিশাহারা, পথভ্রান্ত, আবেগপ্রবণ মনোভাব ও কার্যের সঙ্গে পদ্মরাগের কোনো চরিত্রের সঙ্গে কোনো মিল নেই। পদ্মরাগের সব চরিত্রগুলিই দৃঢ় ও বলিষ্ঠ।

উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে ইংরেজি সাহিত্যে বেশ কয়েকজন মহিলা সাহিত্যিকের লেখা উপন্যাস পাওয়া যায়। তার মধ্যে Lucy Maud Montgomery–এর লেখা Blue Island অথবা Louisa May Alcott– এর প্রথম দিকের রহস্য উপন্যাসে মেয়েদের আত্ম–নির্ভর অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয় Charlotte Bronte–এর লেখা Jane Eyre. একটি অনাথ বালিকার বড়ো হয়ে ওঠা এবং আশ্রয় ও ভালবাসার জন্য  অন্বেষণ। কিন্তু এই খোঁজার মধ্যে তার স্বাধীন সত্তাকে বিসর্জন দিতে রাজি ছিল না সে। ১৮৯৯ সালে আমেরিকান লেখিকা Kate Chopin লিখেছিলেন Awakening। ‌এটা একেবারেই নারীবাদী উপন্যাস। Virginia Woolf–এর প্রবন্ধ সংকলন A Room of One’s Own (১৯২৯)–এর অনেক আগেই রোকেয়া নবনূরে ‘গৃহ’ ( ১৯০২) প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‌আমাদিগের গৃহ নাই’‌— নারীর পরিসরহীনতার কথা সোচ্চারে বলেছিলেন। ১৯০২ সালে লেখা এবং ১৯২৪ সালে প্রকাশিত পদ্মরাগের সর্বত্র তিনি নারীর নিজস্ব স্থান ও স্বাধীন পরিসরের কথা বলেছেন Virginia Woolf–এর আগেই। 

১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘স্ত্রীর পত্র’, ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর  ছোট গল্প  ‘অপরিচিতা’। ‘অপরিচিতার’ শেষে কল্যানীর বিয়ের বাইরে বৃহত্তর ব্যস্ত কর্মজীবনের কথা বলেছেন। ‘স্ত্রীর পত্রে’ বিবাহ ও সংসারের বন্ধন–ছিন্ন মৃণালের স্বাধীন অস্তিত্বের সরব ঘোষণা দিয়ে গল্প শেষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লক্ষ্য করার ব্যাপার যে, এই দুটি গল্পই কিন্তু লেখা হয়েছে রোকেয়ার পদ্মরাগ লেখার পরে। অতএব বলতে পারাই যায়, রোকেয়া যখন ১৯০২ সালে পদ্মরাগ লিখেছিলেন—এমন স্পষ্টভাবে মেয়েদের আত্মনির্ভর, পুরুষের প্রভুত্বমুক্ত স্বাধীন অস্তিত্বের কথা আর কোনো লেখক তখনও বলেননি। ১৯২৪ সালেও, যখন পদ্মরাগ প্রকাশিত হল তখনকার সাহিত্যে এ ধরনের লেখালেখি কমই দেখা গেছে।

অতএব বলা যেতে পারে, রোকেয়ার পদ্মরাগ–ই বাংলা সাহিত্যে প্রথম নারীবাদী উপন্যাস। তারপরেও কি এ রকম নারীচরিত্র–প্রধান, নারীর কর্মময়–জীবন–ব্যাপ্ত  বিষয় নিয়ে আর কোনো উপন্যাস কি লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে?‌

সৌজন্য চরাচর। চরাচর প্রকাশনীর পদ্মরাগ (পুনর্মুদ্রণ, জানুয়ারি, ২০২০) গ্রন্থের ভূমিকা। 

ছবি: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিউ-এর একটি সভায় বক্তব্য রাখছেন উত্তরা চক্রবর্তী। রয়েছেন মালেকা বেগম, সিউ-এর সভাপতি মলয় সেনগুপ্ত। 

0 Comments

Post Comment