- 09 December, 2023
- 0 Comment(s)
- 671 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
আজ থেকে একশো চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের নারীর সমানাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ রোকেয়ার জন্ম। জন্মস্থান রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রাম। এক সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশে। বিত্তের প্রাচুর্য সেখানে ছিল। ছিল লেখাপড়ার প্রচলনও। তবে তা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য। মেয়েদের মানতে হত পর্দাপ্রথা। কেবল পুরুষের সামনে নয়, বাইরের মহিলাদের সামনেও ছোট্ট রকুকে এই রেওয়াজ মেনে চলতে হত। হয়তো-বা সেখান থেকেই প্রথাভাঙার জেদ চেপে বসে তাঁর। বন্দি-জীবনের কষ্ট নিয়ে বড়ো হওয়া রোকেয়া দেখলেন অবরোধ-প্রথার অর্থহীনতাকে। প্রত্যক্ষ করলেন নারীদের ওপর সমাজের নিপীড়ন। ঘরে আগুন লাগলেও প্রাণরক্ষার জন্য নারীরা বাইরে বেরোবে না, যদি সামনে পুরুষ থাকে। মেয়েদের এই চোখের জল রোকেয়ার অন্তরে সৃষ্টি করলো ক্রোধের দহন। তবে, এই দাহ পোড়ায় না, বরং গঠন করে। এই দাহই ভবিষ্যতে সৃজনাত্মক রূপ পেল ‘অবরোধবাসিনী’ বইতে। সাধে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, কাব্য বুঝে লাভ আছে, তবে কবিকে বুঝতে পারলে আরও লাভ। কারণ কাব্যের ভিতর কবির অবিকল ছায়া থাকে।
আজকের এই ধর্ম-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে ধর্ম সম্বন্ধে রোকেয়ার অভিমত বেশ সমসাময়িক। ধর্মের আধ্যাত্মিকতা নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনোরূপ সংশয় ছিল না। রোকেয়া বারবার বলেছেন, ইসলাম ধর্ম মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে। আসলে রোকেয়ার আপত্তি অন্য জায়গায়। ধর্মের নামে সমাজ কীভাবে ধর্মাচরণ থেকে দূরে সরে গেছে সেটাই তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য। ‘রসনা-পূজা’ রচনায় তিনি দেখিয়েছেন রমজান মাসে সংযমের নামে অতি-ভোজন। দিবাভাগে খোদাকে নির্মল চিত্তে স্মরণের বদলে চলে সান্ধ্যকালীন বিপুল আহারের তোড়জোড়। স্বাভাবিকভাবেই, ধর্মের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সেখানে ব্যর্থ। রোকেয়ার আপত্তি এখানেই। ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে অন্য একটি আপত্তিও আছে রোকেয়ার। তার কারণ, পুরুষসমাজের নিষ্ঠুরতম নারীপীড়ন। যে-ধর্মের দোহাই দিয়ে একাদশীর দিন একটি বাচ্চা মেয়েকে জল খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করা হয়, সেই ধর্মকে মানবেন কেন রোকেয়া? ফলত, স্পষ্ট ভাষায় লিখলেন : “মুনিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন”। যে-ধর্মাচরণ এক ধর্মের মানুষের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের বিভেদ করে, হিংসা-হানাহানিকে উসকে দেয় প্রতিনিয়ত, সেই ধর্ম ছিল রোকেয়ার কাছে পরিত্যাজ্য। নিজের কল্পিত নারীস্থানে তাই একটিমাত্র ধর্মকেই তিনি স্থান দিলেন। সেই ধর্ম হল ‘প্রেম ও সত্য’। কারণ নিজের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মানুশাসন কেবল মানুষের মধ্যে দাসত্বের ভাবকেই দৃঢ় করেছে। তা কিছুতেই মানুষের উন্নতি বা উদারতার সহায় হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কল্পিত ‘নারীস্থান’-এ সব ধর্মকেই বাতিল করে দেন রোকেয়া।
মানকুমারী বসু লিখেছেন :
কাঁদ তোরা অভাগিনী, আমিও কাঁদিব
আর কিছু নাহি পারি, ক’ ফোঁটা নয়ন-বারি
ভগিনী! তোদেরি তরে বিজনে ঢালিব।
কবির এই মতের সঙ্গে রোকেয়া সহমত হতে পারেননি। কেঁদেকেটে জীবন কাটানোকে তিনি নিছক একটি জীবনের অপচয় বলে মনে করেছেন। তাই ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ আস্থা রেখেছেন মেয়েদের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর। বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন তাদেরকে। মেয়েরা সেখানে প্রমাণ করে দিয়েছে বিজ্ঞানের ক্ষেমংকর রূপ। দেখিয়ে দিয়েছে বিনা রক্তপাতে বুদ্ধি আর বিজ্ঞানের জোরে যুদ্ধ জয়ের কৌশল। চরিত্রের মুখ দিয়ে রোকেয়া সেখানে প্রকাশ করলেন নিজের মনের কথা : “স্ত্রীলোকের মস্তিষ্ক পুরুষের অপেক্ষা ক্ষিপ্রকারী, এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন। পুরুষ কেবল সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পূর্বে অনেক ভাবে--অনেক যুক্তিতর্কের সাহায্যে বিষয়টি বোধগম্য করে। কিন্তু রমণী বিনা চিন্তায়ই হঠাৎ সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়”। তিনি বুঝেছিলেন মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার গুরুত্ব। নিজ উদ্যোগে তাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদ্যালয়ের। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাঝপথে রণে ভঙ্গ দেননি। শুধু কলকাতায় মেয়েরাই নয়, গ্রাম-বাংলা বা মফস্সলের মেয়েরাও যাতে পড়াশোনার অধিকার থেকে বঞ্চিত না-হয়, তার জন্য বোর্ডিং-এর ব্যবস্থাও রাখতে চেয়েছিলেন।
রোকেয়ার অনেক রচনায় পুরুষের প্রতি বিদ্বেষের পরিচয় পাওয়া গেছে। এই ক্রোধ কিন্তু আকস্মিক নয়, বরং তা ধারাবাহিক, অনবরত। পুরুষ তাঁর কাছে ‘নরাকারে পিশাচ’। ‘পদ্মরাগ’-এ দেখুন পুরুষকে কীভাবে বিদ্রুপ করা হয়েছে : “ডাকাতী, জুয়াচুরি, পরস্বাপহরণ, পঞ্চ ‘মকার’ আদি কোন্ পাপের লাইসেন্স্ তাঁহাদের নাই?” পুরুষের প্রতারক-পরিচয় তাই রোকেয়ার বহু রচনায় ঘুরে-ফিরে এসেছে। ‘ডেলিশিয়া হত্যা’-য় পুরুষের চেয়েও উচ্চে স্থান দেওয়া হয়েছে কুকুরজাতিকে। স্বাভাবিকভাবেই রোকেয়ার কাছে পুরুষের বাইরের জগতে বিচরণ নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। অন্তঃপুরে তাঁদের আটকে রাখতে পারলেই অনেক বিপদ এড়ানো যেতে পারে। পরম তৃপ্তিতে সুলতানা তাই বলেছেন : “আমি প্রাণে বড় আরাম পাইলাম;- পৃথিবীতে অন্ততঃ এমন একটি দেশও আছে, যেখানে পুরুষজাতি অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকে”।
আসলে যুক্তিবাদী রোকেয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি শারীরিক বলের আধিক্যহেতু পুরুষের প্রভুত্ব। পুরুষের ন্যায় সমান সুবিধালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত বলেই নারীরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছেন। আর এই কাজে পুরুষসমাজ অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে ধর্ম-অস্ত্রকে। নারীদের অনগ্রসর করে রাখার এই পুরুষতান্ত্রিক কৌশলকে রোকেয়া মানতে পারেননি বলেই তাঁর কিছু রচনায় পুরুষ-বিদ্বেষ লক্ষ করা যায়। পুরুষ সমাজের কাছে আবেদন জানিয়ে রোকেয়া বলেছিলেন : “ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই, তাহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ-মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান ভূষণে অলঙ্কৃতা করিতে চেষ্টা করিবেন”। রোকেয়া প্রত্যক্ষ করেছেন, পুরুষ শাসিত সমাজ কীভাবে আইনের দোহাই দিয়ে মিথ্যা অজুহাতে নারীদের পিতৃ-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে। রোকেয়া বলেছেন : “আইন আমাদের ন্যায় নিরক্ষর অবলাদের জন্য নহে”। এই বঞ্চনা থেকেই পুরুষ সমাজের প্রতি রোকেয়ার ক্ষোভ। ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ না-করে তিনি চেয়েছিলেন কায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে। পুরুষ-সমাজের বদলে পুরুষই তাই হয়ে উঠেছে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশের কেন্দ্র।
সুযোগের অভাব, শিক্ষার অভাবকেই রোকেয়া চিহ্নিত করেছিলেন স্ত্রীজাতির অবনতির কারণ হিসাবে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধর্মের অজুহাত। ধর্ম ও স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে রোকেয়ার ধারণা সে যুগের প্রেক্ষিতে তাই বেশ বৈপ্লবিক। এদিক থেকে বিদ্যাসাগর বা কেশব সেনের সমতুল্য তিনি। বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের ইতিহাসে তিনিই হলেন ‘আলোক শিখা’।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১০ ডিসেম্বর ২০২১
0 Comments
Post Comment