রায়াদির ক্লিনিক (পর্ব ১)

  • 19 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 815 view(s)
  • লিখেছেন : রুমেলিকা কুমার
আমাদের দেশে মনের গুরুত্ব নেই । মানুষের গুরুত্ব নেই। মানসিক রোগ তো দূরের ব্যাপার। যে মানসিক একাকিত্ব, যে পরিবেশে কাউকে পাশে দেখতে না পেয়ে, নিজেকে কারুর সাথে মেলাতে না পেরে,  নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে খুঁজে না পেয়ে, গলায় দড়ি দিল আঠারো বছরের মেয়েটা — সেই মানসিক যন্ত্রণাতেই বোনের গায়ে হাত তুলছে তার মা। জানিনা বয়স বাড়লে পুঁচকেটা কোন মানসিক যন্ত্রণা ভোগের দাবিদার হয়ে উঠবে। লজ্জা, না অপরাধবোধ, না রাগ।

একদিন ক্লিনিকে বসে আছি। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি বাইরে একটা পুঁচকে লাফালাফি করছে। পাশে মা। মায়ের আঁচল ধরে টানছে। মাস্কটা ফেলার পর দুম করে এক ঘা খেল। খানিকক্ষণ চুপ। আবার টুকটুক করে নড়ছেচড়ছে। খান দুই তিন পেশেন্টের পর নাম্বার এল। এসে বসলেন চেয়ারে।

রোগী দেখলে একটা বিশেষ দক্ষতা তৈরি হয়। ডাক্তারি শেখা, হাত পাকানো ইত্যাদি বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার বিশেষ উন্নতি ঘটে। আউটডোরে বসেই প্রথম বুঝেছি ইংরাজি বিভিন্ন যে টার্ম পড়ে ডাক্তারি শিক্ষা পেয়েছি, হিস্ট্রি নেওয়ার সময় বিভিন্ন ধরনের যে শব্দ শিখেছি, সেগুলো প্রায় খেলো। আউটডোরে বসে প্রথম মনে হয়েছে সিলেবাসে বাংলা ভাষায় হিস্ট্রি নেওয়া শেখালে মন্দ হত না। যেমন ব্যথার রকমভেদ। Throbbing pain, মানে দপদপ করছে। Tingling sensation, মানে ভীষ্মের শরশয্যা। সহস্র সূচ বিঁধছে, ঝিনঝিন করছে। কেউ তো আর এসে বলে না Tingling sensation হচ্ছে। আগে কি হচ্ছে বলুন বলার পর ইতিহাস ভূগোল শুনে ভাবতে বসতাম এর ইংরাজিতে কি লিখব। চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে রোগীরা ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে কার পরে কে। আর আমার মাথায় ঘুরছে মাথা ঘোরার ইংরাজি কী।

তো যাই হোক। ভদ্রমহিলা এসে চেয়ারে বসলেন। চেনা প্রশ্ন – হ্যাঁ বলুন কি সমস্যা।

— আমার মাঝেমধ্যেই মাথা গরম হয়ে যায়।

— মাথা গরম হয়ে যায় মানে? ব্যথা করে? দপদপ করে? কী হয়?

— না না ব্যথা করে না। দপদপ না। সেরকম কিছু না। কেবল মনে হয় প্রচণ্ড মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আর ম্যাম বহুদিন ধরেই পেটে বাচ্চা আসছে না।

— প্রেশার আছে? থাইরয়েডের ওষুধ খান? থাইরয়েডের রক্ত পরীক্ষা করিয়েছেন কখনো?

— হ্যা করিয়েছি। মাস ছয়েক আগে। প্রচণ্ড মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। তখন বাড়ির লোক ডাক্তার দেখায়। সবই নর্মাল আছে বলেছে ডাক্তারবাবু। সুগার নেই। প্রেশার মাপিয়েছিলাম তখন নেই বলেছিল।

হাত বেঁধে কিছুক্ষণ প্রেশার মাপা চলল। নর্মাল। রিপোর্টগুলোও দেখলাম। মাস ছয়েকের পুরোনো। তবে নর্মালই।

— আচ্ছা সমস্যাটা কবে থেকে শুরু হয়েছে?

— মাসিকের সমস্যা আছে?

— না। প্রত্যেক মাসেই তো হয়।

— কদিন?

— ওই তিন চারদিন।

— আপনার একটাই মেয়ে? কত বছর বয়স? সিজার না নর্মাল ডেলিভারি?

— না ম্যাম দুটো। বড়োটার জন্ম ১৮ বছর আগে। আর ও দেড় বছর আগে। নর্মাল দুজনেই।

— আচ্ছা। বড় মেয়ে কি পড়ছে?

— না ও মারা গেছে।

— কি হয়েছিল?

— আসলে ও আত্মহত্যা করে। গলায় দড়ি দিয়েছিল।

ঝোড়ো ইন্টারভিউ আচমকা হ্যাঁচকা টানে থেমে যায়। এরপর কী জিগ্যেস করা যায় জানিনা। কীভাবে তাকানো যায় তাও জানিনা। তবু আমতাআমতা করে জিগ্যেস করলাম— না মানে কেন?

— আসলে ও খুব শান্তশিষ্ট চাপা স্বভাবের ছিল। নিজের কিছু হলে কাউকে জানাত না। খিদে পেলেও মুখ ফুটে বলত না খিদে পেয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক দিল। আশুতোষ কলেজে  অনার্সে ভর্তি করালাম। ওখানেই একটা ছেলের সাথে ভাব ভালোবাসা হয়। তারপরে নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল হওয়ায় মেয়ে গলায় দড়ি দেয়।  

— মাথা গরম হবার সমস্যা কি এরপরেই শুরু হয়েছে আপনার?

— হ্যা এরপরেই। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড মাথা গরম হয়ে যায়।

পাশে বাচ্চাটা তখন আমার চেয়ারের হাতল ধরে গভীর পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। ইন্টারভিউ তখন থেমে গেছে। একপক্ষই শুনে যাচ্ছি। পুঁচকেটার দিকে তাকিয়ে মহিলা বলে চলেছেন—

— যখন খুব মাথা গরম হয়ে যায়, এ চেঁচাতে থাকে, বিরক্ত করে, মাঝেমধ্যে ওর গায়ে হাত তুলে ফেলি। নিজেকে সামলাতে পারিনা। বাড়ির সবাই আমাকে বলে ডাক্তার দেখাতে। এমন কেন হচ্ছে বুঝি না। আমার আবার বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ও মারা যাবার পরই বাড়ির লোক বলে আরেকটা বাচ্চা নিতে। তারপরই এ হয়। এখন আবার বলছে দুটোই তো মেয়ে হল আরেকবার যদি চেষ্টা করা যায় …

বাইরে তখনো তিন চার জন। মনে হয় ডাক্তারের দায় বড় দায়। সমাধান দেবার দায়। সুস্থ করার দায়। উত্তর থাকার দায়।

— দেখুন মনে তো হচ্ছে সমস্যাটা মানসিক। খুব ভালো করে সামলে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না, বেশিদিন হয়ওনি। খানিক তারই প্রতিফলন। মাঝেমধ্যে বিস্ফোরণ ঘটছে … আর আপনার মাসিক ঠিকঠাক হলে বাচ্চা নিতেই পারেন। তবে নিজে চাইছেন না যখন মনে হয় একবার এটা জানানো উচিত আপনার স্বামীকে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা উচিত।

— তাহলে কী করব বলুন?

— ঘুম হয়? খুব বেশি চিন্তা করেন কি?

— ঘুমের সমস্যা তো হচ্ছে। চিন্তা বলতে বয়সে বাচ্চা নিয়েছি, আবার মানুষ করব কী করে। এসব নিয়েই …

— বুঝলাম। পারলে একটু মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো উচিত আপনার। প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং করাবেন। কিন্তু কোনোরকম মানসিক চিকিৎসা ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে বলে তো মনে হয়না।

— আচ্ছা। তাহলে কী করব বলুন?

— বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলুন। দু সপ্তাহ পরে স্বামীকে নিয়ে আসুন। একসাথে কথা বলি আপনাদের দুজনের সাথেই। তারপর কোথায় দেখাবেন বলে দেব। সেভাবে দেখাতে পারেন।

— আচ্ছা ম্যাম। তাহলে তাই করব। আসি আজকে। দু সপ্তাহ পর আসব …

— দু সপ্তাহ পর দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সেদিনের পর প্রায় পাঁচ ছয় খান দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা ফিরে আসেননি। আসবেন আশাও করিনি। পাগলের ডাক্তার দেখাতে বলেছি। এরপরেও ফিরে এলে অন্য কোনো সৌরজগতে বিচরণ করছি বলেই মনে হত হয়ত। হয়ত নিজেই আসবেন না ঠিক করেছেন। হয়ত বাড়ির লোক বলে দিয়েছে ওখানে আর দেখাতে হবে না। ভালই হয়েছে। না এসে বিশ্বাসের ভিত মজবুত রেখেছে।

আমাদের দেশে মনের গুরুত্ব নেই। মানুষের গুরুত্ব নেই। মানসিক রোগ তো দূরের ব্যাপার। যে মানসিক একাকিত্ব, যে পরিবেশে কাউকে পাশে দেখতে না পেয়ে, নিজেকে কারুর সাথে মেলাতে না পেরে,  নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে খুঁজে না পেয়ে, গলায় দড়ি দিল আঠারো বছরের মেয়েটা — সেই মানসিক যন্ত্রণাতেই বোনের গায়ে হাত তুলছে তার মা। জানিনা বয়স বাড়লে পুঁচকেটা কোন মানসিক যন্ত্রণা ভোগের দাবিদার হয়ে উঠবে। লজ্জা, না অপরাধবোধ, না রাগ।

কিছু কিছু বাচ্চাকে দেখেই মনে হয় এই ছেলেটাই স্যারের চেয়ারে চক ঘষে রেখেছিল। একে দেখেই শিখতে বলছিল মা। এ বেশি পাওয়ার জন্যই আজকে থাপ্পড় খেলাম। এরজন্য কোনোদিন মার খাব না ভাগ্যিস। ওই পুঁচকেটাকে দেখে ভেবেছিলাম এই কচিকাঁচার জন্যই হয়ত, হয়ত বা স্বপ্ন দেখা যায়, ভরসা করা যায়, ভালো থাকা যায়।

পিছন করে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন চোখে পড়ছিল সেই ঘূর্ণিতে তোলপাড় খেতে চলা  আরেকটা শৈশব। ভালো থাকা, ভালো রাখার যাবতীয় স্বপ্ন ধ্বংস হতে চলেছে সেই ঘূর্ণিতে।

ভদ্রমহিলা আর ফেরেন না। মানসিক স্বাস্থ্যও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আজকে খবরে দেখলাম এই প্রথমবার ভারতে প্রতি ১০০০ জন পুরুষে ১০২০ জন মহিলা সংখ্যা গোনা গেছে। মেয়েরা এগোচ্ছে।

তবু দুটো মেয়ের পর একটা ছেলে যদি হয় — সেই নিয়ে চাপ চলতে থাকে। বাচ্চা নেওয়া নিয়ে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেয় পরিবারের লোক। ঠিক আছে। কোথাও তো যৌথতা আছে। মিলেমিশে থাকা আছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে বাচ্চা নেওয়ার জন্য জোরেই হোক না সে যৌথতা …

এভাবেই যৌথভাবে দাবিয়ে রেখে এগিয়ে যাব আমরা। মেয়ের সংখ্যা বেড়েছে গর্ব করব আমরা।

দেখতে দেখতে  অভ্যেস হয়ে গেছে নাম মনে না রাখার। হোয়্যাটসাপে বন্ধু বা পরিচিত কেউ রিপোর্ট পাঠালে, রিপোর্ট দেখে থিসিস নামিয়ে ফেললেও — কার রিপোর্ট দেখছি এটা দেখার কথা মাথায় থাকে না। এসব নিয়ে মজার কিছু কীর্তিকাহিনী করেছি এখনও। যাই হোক। সে থাক। তবু এরকম কিছু মানুষ, কিছু ঘটনা, কিছু স্মৃতি, কিছু ফিরে না আসা, কিছু হাল ছেড়ে দেওয়ার নাম সবসময় মনে থাকে।

ভদ্রমহিলা চেম্বারে ঢোকার সময় ছিলেন ওরকমই এক অনামী রোগী। বেরোনোর সময় একবার অ্যাডভাইসের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম। পায়েল চক্রবর্তী।

ফিরে না আসা এক মানুষ। হাল ছেড়ে দেওয়া এক আমি।

 

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২ ডিসেম্বর ২০২১ 

লেখক: চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

 

0 Comments

Post Comment