- 19 July, 2025
- 0 Comment(s)
- 384 view(s)
- লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৯৬ সালে যখন পাহাড়ের সরকারী কলেজের চাকরিতে যোগদান করলাম তখনও বিশাখা নির্দেশিকা কর্মক্ষেত্রে কায়েম হয়নি। অবশ্য তখন রাজস্থানে ভানওয়ারি দেবীর মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটে গেছে। ১৯৯৭ সালে বিশাখা নির্দেশিকা কায়েম হল ঠিকই কিন্তু এই ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ভাবা যায়! চাকরি করছি কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে নির্দেশিকা সরকার বলবৎ করেছে তার সম্বন্ধে অবহিত নই আমরা মেয়েরা! হ্যাঁ শুধু আমি নই, আমার মহিলা সহকর্মীদের মধ্যে কেউই বোধহয় তখন এই সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নয়। অথচ যৌন হেনস্থার ঘটনা যে ঘটে না এমন নয়। আমার সঙ্গেই ঘটেছে। আমার একজন সহপাঠিনীর প্রতিবেশী ছিলেন সেইসময়কার অধ্যক্ষ। বয়স্ক ব্যক্তি। স্ত্রীও কলেজে পড়ান। একজন কন্যা ভিন্নভাবে সক্ষম। পুত্র কলেজে পড়ে। আমায় আমার কর্মস্থলে পৌঁছে দিতে গেছিলেন আমার মা-বাবা। আমি জয়েন করার পর তারা অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন। আবেদন করলেন, আমার খেয়াল রাখতে। সেই ব্যক্তিও সেই দায়িত্ব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ঘাড়ে তুলে নিলেন। বাড়ি থেকে বহু দূরে চাকরি করতে এসে অভিভাবকদের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং পীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাব ভেবেছিলাম । কিন্তু সেটা তো হলই না, আবার নতুন আপদ চেপে বসল। প্রিন্সিপ্যালের কোয়ার্টার থেকে তার চেম্বারে পৌঁছতে গেলে আমাদের বিভাগের সামনে দিয়ে করিডর দিয়েই তাকে যেতে হবে। যাওয়া আসার পথে ওই প্রিন্সিপ্যাল আমার বিভাগে উঁকি মারতেন। কথায় কথায় তার চেম্বারে ডাকতেন এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলতেন। যে মিটিংএ আমার থাকার কথা নয় সেই মিটিংএ উপস্থিত থাকতে বলতেন। একবার উনি একটি দূরের স্কুলে ইন্টারভিউ নিতে যাবেন। সঙ্গে আমায় যেতে বললেন। এই সমস্ত কিছুই কিন্তু জয়েন করার একমাসের মধ্যে। আমি তো আতঙ্কে কাঁপছি। সদ্য যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে তারা পরামর্শ দিল, ইংরেজি বিভাগের নতুন জয়েন করা সহকর্মীকেও সঙ্গে নিতে বলো। তাই বললাম। উনি যাই হোক রাজি হলেন। মোটামুটি নিরুপদ্রব ঘুরে আসা হল। কিন্তু ফিরে এসে অশান্তি বাড়ল। একবার তিনি চেম্বারে আমায় ডেকে বললেন, তোমায় প্রতিদিন একবার না দেখলে ভালো লাগে না। আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাওয়ার অবস্থা। আগে থেকেই আমার মধ্যে কিছু হিস্টিরিয়াসুলভ উপসর্গ দেখা গেছিল, এখন তার প্রকোপ বাড়ল। সদ্য জয়েন করেছি, আমায় এখনও লোকজন চিনে উঠতে পারেনি। ভাবছে, এক হাতে আর কী তালি বাজে? ভিক্টিম ব্লেমিংটাই তো দস্তুর। এখনো সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে, বলাই বাহুল্য। এক মাসের মাথায় কলকাতা ফিরলাম। আমার প্রেসিডেন্সি কলেজের মাষ্টারমশাইদের জানালাম। শিক্ষক সমিতির অফিসে গেলাম। তাদের পরামর্শ পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেয়ে, শক্ত হয়ে আবার পাহাড়ে ফিরলাম। এবার অন্য উপদ্রব শুরু হল। অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা প্রিন্সিপ্যাল মশাইয়ের সহ্য হল না। তাকে ডেকে নরমে গরমে হুমকি দিল। কিন্তু সেও কম যায় না। অধ্যক্ষ মশাইকে বুঝিয়ে দিল, তিনি অনধিকার চর্চা করছেন। আমাদের বিয়েতে বাবা নেমন্তন্ন করার জন্য ফোন করলে তিনি আরো চারটি খারাপ কথা শুনিয়ে দিলেন। জানা গেল, আমাদের কয়েকজন সহকর্মীকে হুমকি দিয়েছেন, আমাদের আমন্ত্রণে বিয়ের আসরে উপস্থিত হলে তিনি ‘দেখে’ নেবেন। বিয়ের পর অবশ্য লোকটা ম্যাজিকের মতো ব্যবহার বদলে ফেলল। আমরা নাকি ওর মেয়ে-জামাই, এইসব! যাই হোক তারপর থেকে আর বেশি আমাদের ঘাঁটাতে সহস পায়নি। যতদূর মনে পড়ছে, উনি আর বেশিদিন ওই কলেজে থাকেননি। তারপর যিনি অধ্যক্ষ হলেন তার আপাতদৃষ্টিতে ওই সমস্যা নেই। তবে মহিলা শিক্ষকদের কথা আর ভাবে কয়জন পুরুষ অধ্যক্ষ? কলেজে মহিলা অধ্যাপকদের জন্য তখন আলাদা বাথরুম ছিল না। আমাদের বিভাগের কাছে যে বাথরুম তাতে জল ছিল না। চূড়ান্ত অপরিষ্কার। অধ্যক্ষকে বারবার বাথরুমের কথা বলা সত্ত্বেও তিনি কর্ণপাত করেননি। একদিন রসিকতা করে বললেন, ‘তোমরা মেয়েরা পাখি হয়ে যাও, সলিড ইউরিন করো। তাহলে আর বাথরুমের দরকার হবে না’। আজ হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিতাম। কিন্তু তখন বোকা ছিলাম। অজ্ঞ। চুপচাপ সেই রসিকতাটা হজম করেছিলাম কিন্তু ভুলিনি। আমার ট্রান্সফার অর্ডার বেরনোর পর রিলিজ পেতে খুব ভুগিয়েছিলেন সেই ব্যক্তি।
পাহাড়ের পর বদলি হয়ে এলাম কলকাতার কাছে যে কলেজে সেই কলেজের অধ্যক্ষের ব্যবহার খুব গোলমেলে। শিক্ষকদের সঙ্গে চাইলে খুব খারাপ ব্যবহার করতে পারেন, আবার দরকারমতো মুখে মধু ঝরে। কারুর কারুর সঙ্গে ব্যবহার খুবই মধুমাখা। সব প্রশাসকদের সম্বন্ধে এই কথাগুলো কমবেশি সত্যি। আমাদের বিভাগে একটি মেয়ে জয়েন করল। তখন যে পার্টি ক্ষমতায় ছিল তার নেত্রীগোছের। অন্তত ভাবখানা তাই। তার বর পার্টির হোলটাইমার। আমি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে গেলাম। জয়েন করলাম যখন তখন আমার মেয়ের বয়স মাস তিনেক। জয়েন করার পর বেশ অসুবিধ হতো। আমি তখন বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করাই। দেড় ঘণ্টা বাসে করে কলেজে পৌঁছনোর পর হয়তো দেখছি, জামা ভিজে গেছে। চূড়ান্ত অস্বস্তিকর অবস্থা। এখানকার বাথরুম খুব বিশ্রি। সেখানে ঢুকে যে চেঞ্জ করে নেব তার অবস্থা নেই। আমি প্রথম কয়েকদিন আমার অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে ক্লাস adjust করে নিচ্ছিলাম। বরিষ্ঠ পুরুষ সহকর্মীদের তরফ থেকে সহযোগিতার অভাব না থাকলেও কনিষ্ঠতম সহকর্মী মেয়েটি ভাবল, এই সুযোগে অধ্যক্ষ মশাইয়ের কাছে আসা যাক। আমার নামে নিয়মিত লাগান-ভাজান শুরু করল। একদিন অধ্যক্ষ আমায় ডেকে পাঠাল। হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে আমায় যাচ্ছেতাই অপমান করল। উত্তরে কী বলেছিলাম তখন মনে নেই। প্রত্যাশিতভাবেই আমি উত্তেজিত, traumatized। এটাও এক ধরনের যৌনহেনস্থা তো বটেই। তখন সরকারী কলেজের প্রত্যেকটি বিভাগ আত্মপর্যবেক্ষণের খাতা রাখত। সাদা বাংলায়, কদিন আসছি, কদিন ছুটি নিচ্ছি, কটা ক্লাস নিচ্ছি, রোজকার ভিত্তিতে নিজেই নিজের কাজের খতিয়ান রাখা। মাসের শেষ সেটা বোধহয় অধ্যক্ষের কাছে যেত। আমি সেখানে একটা বড় নোট দিলাম। লিখলাম আমি একজন lactating mother. আমি সব দায়িত্বই পালন করব, কিন্তু আপাতত কিছুদিন, আমার রুটিন মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। দিন কয়েক আমার ক্লাস সুবিধেমতো সাজিয়ে নিতেই হবে। এই নোট দেখে আর কিছু উচ্চবাচ্য করেনি সেই অসভ্য লোকটা। এক দুই মাসের মধ্যেই আমি পুরনো ছন্দে ফিরে এসেছিলাম। যদিও থেকেই থেকেই আয়াদিদি দেরি করে আসার কারণে দেরি হয়ে যেত। অনেক সময় না খেয়েই চলে আসতাম। আয়াদিদি না এলে তো কামাই করতে হত। এই সময়টা কর্মক্ষেত্রে একটু সংবেদনশীলতার, সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সে আর কয়জন পায়?
এখন মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের জন্য ২৬ সপ্তাহ করা হয়েছে। সন্তান জন্মের পর এই সময়টুকু কর্মরত মেয়েদের দরকার। সন্তান লালনপালনের জন্য child care leave চালু হয়েছে। এটাও জরুরি অবশ্যই। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় শিশুপালন এখনো মেয়েদেরই দায়িত্ব, সে কর্মরতা হও বা গৃহবধূ হও। তাই তোমাকেই ছুটি নিতে হবে। এমনিতেই মেয়েরা কর্মক্ষেত্র ও সংসার সামলাতে জেরবার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ঐ ছুটিটুকু তাই অক্সিজেনের মতো কাজ করে। বাবাদের উচিত সন্তানপালনের মায়েদের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া। নেওয়া উচিত কিন্তু নেয় কয়জনা? যদি নেয় তাহলে অবশ্যই তাদেরও ছুটি দরকার।
এদিকে সেই মেয়েটির দাপট উত্তরোত্তর বাড়ছিল। ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা তার। থেকে থেকেই আমায় বেকায়দায় ফেলার ছক আঁটত। কে না জানে মেয়েদের একাংশ চিরদিনই পিতৃতন্ত্রের ধারক-বাহক হয়ে কাজ করেছে! এর সঙ্গে যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা যুক্ত হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা! কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হেনস্থায় এদের সায় থাকে, কখনো সক্রিয় ভূমিকা থাকে।
আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। কয়েকজন সিনিয়র পুরুষ অধ্যাপক স্টাফরুমে বসেই ধূমপান করত । লম্বা চওড়া ধোঁয়া ছাড়ত। বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা কথা শুনত না। একদিন আমি প্রবলভাবে প্রতিবাদ করলাম। অর্থনীতি বিভাগের একজন বর্ষীয়ান অধ্যাপক সদম্ভ ঘোষণা করলেন, ‘আমি এখানেই বসে সিগারেট খাব’। এদিকে মেয়েদের মধ্যে অনেকেই সিগারেটের ধোঁয়া নিয়ে মৃদু অভিযোগ করত, কিন্তু জোর গলায় কিছু বলতে পারত না। কারুর হাঁপানির সমস্যা। এমনিতেই প্যাসিভ স্মোকিং এর ক্ষতি অনেক। যাই হোক, পরে অবশ্য লোকটি এই অসভ্য অভ্যেসটি পরিত্যাগ করেছিলেন। যৌনহেনস্থা না হলেও এইগুলো হেনস্থা তো বটেই! মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে কর্মজগতে প্রবেশ করার রাস্তাটা হাজারো কাঁটায় আকীর্ণ। আজকেও পথটা মসৃণ নয়। প্রতিনিয়ত লড়াই। বেশি জানলে, বুঝলে, প্রতিবাদ করলে, প্রশ্ন করলে, আজও মেয়েদের যৌন অতাচারের মাধ্যমে, মানসিক অত্যাচারের মাধ্যমে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। ধর্ষণ করা হয়, খুন করা হয়। দোষ দেওয়া হয় মেয়েটাকে। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।
অনেকেই প্রশ্ন করে, যখন ঘটনাটা ঘটল, তখন প্রতিবাদ করলে না কেন? এতদিন পরে বলছ কেন? সাম্প্রতিককালে কসবা ল’ কলেজের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুইএকজন মেয়ে মুখ খুলেছে। তাদের শোনানো হচ্ছে, অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে... ইত্যাদি... । এর উত্তরে আমি বলব, অনেকসময় অন্যায় ঘটলেও ভয়ে আতঙ্কে প্রতিবাদ করা যায় না। চাকরি যাওয়ার ভয়, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের ভয়, সমালোচনা, নিন্দার ভয়। কারণ আজও যৌন হেনস্থার ভিক্টিমের দিকেই আঙ্গুল ওঠে প্রথমে। তার কিছু গোলমাল আছে, তাই এমনটা তার সঙ্গেই ঘটল। অন্যদের সঙ্গে তো ঘটল না! এই ভয়কে অতিক্রম করতে কয়েক দিন, কয়েক বছর, এমনকি কয়েক দশকও লেগে যেতে পারে। আমি তখন চুপ ছিলাম বলে আজকের সোচ্চার হয়ে ওঠাটা মিথ্যে হয়ে কখনোই যেতে পারে না।
আরেকটা কথা। Cis hetero মেয়েরা অন্য cis hetero মেয়েদের সরাসরি যৌন হেনস্থা হয়তো করে না বা করতে পারে না, কিন্তু পুরুষের যৌন হেনস্থায় সহায়ক বা abettor এর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। পিতৃতন্ত্রের ধারক-বাহক, চূড়ান্ত ‘ক্ষমতায়িত’ মহিলারা শাশুড়ি হিসেবে পুত্রবধূদের নির্যাতন করে, আর কর্মক্ষেত্রে মহিলা সহকর্মীদের নির্যাতন করে। তাদের সময় child care leave ছিল না, তারা সুপারওম্যানের মতো কীভাবে ঘর ও বাহির সামলেছে, সন্তান ও কর্মক্ষেত্র সামলেছে, এই কিস্যা শুনে শুনে কান পচে গেছে। আর সন্তানহীন মহিলাদেরও ঈর্ষানলপ্রসূত নানা তীর্যক কুমন্তব্যে স্টাফরুমে থেকে থেকেই তুমুল বিবাদ লেগে যায়। আমি সরকারী কলেজে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। তবে অধ্যক্ষের চেয়ারে আসীন যিনি তাঁর সদর্থক মনোভাব থাকলে এই সব সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। মেয়েদের দ্বারা মেয়েদের হেনস্থা আরো অন্যরকমও হয়। আমার যেমন হয়েছিল সহকর্মী মেয়েটির দ্বারা আমার দ্বিতীয় কর্মস্থলে। হেনস্থাকারীকে বয়সে বড় হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। আর পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে যদি মিশে যায় আধিপত্যকারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে টিকি বেঁধে থাকার ব্যাপারটা তাহলে তো কথাই নেই। গেট আউট! হ্যাঁ এটাও কয়েক মাস আগে শুনতে হয়েছে আমায়! আর যাদের সংবেদনশীল, ন্যায়-অন্যায়বোধসম্পন্ন বন্ধু ভেবেছিলাম তারাও আমায় হতবাক করে চুপ করেছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার এমনই মহিমা!
0 Comments
Post Comment