প্রগতি

  • 07 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 108 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ। 
এক ঝটকায় সরে এসে বুবুনের মা সকলকে বিস্মিত করে এই প্রথম ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলো, ‘আমি কেবলমাত্র বুবুনের মা নই। শুধুমাত্র কারোর বউ কিংবা মেয়ে নই। কেন বারবার আমাকে সম্পর্কের ভিড়ে হারিয়ে যেতে হবে? আমারও স্বতন্ত্র পরিচয় আছে। সকলে কান খুলে শুনে রাখুন আমার নাম প্রগতি।’ 

‘বুবুনের মা আপনি যেখানেই থাকুননা কেন আমাদের মঞ্চের সামনে চলে আসুন, আপনার পরিবারের লোক এখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’ লোকটি পরপর তিনবার ঘোষণা করার পরেও কেউ এসে জানালো না যে সে বুবুনের মা। রাস্তার একপাশে তিন হাত উঁচু করে তৈরি করা অস্থায়ী মঞ্চের ওপর প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বুবুনের বাবা, কাকা, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা আর বুবুন অস্থির ভাবে বুবুনের মায়ের জন্যে অপেক্ষা করছে। রথযাত্রা লোকারণ্য মহাসমাগম আজও এর অন্যথা নেই। বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাইকে ঘোষণা করার পরেও যখন বুবুনের মায়ের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না তখন লোকটি হাল ছেড়ে দিয়ে জগন্নাথ মন্দির কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে হাসি মশকরায় লিপ্ত হল। বুবুনের বাবা মহেন্দ্র গিয়ে লোকটিকে আরও একবার ঘোষণা করার জন্য পীড়াপীড়ি করে নিয়ে এল বটে কিন্তু বোঝা গেল লোকটির আমোদের রেশ তখনও কাটেনি। সে মাইকে বলে চলল, ‘বুবুনের মা, এভাবে রথের মেলায় হারিয়ে গেলে চলবে? আপনার বাড়ির লোক যে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’ তারপর লোকটি কপালে হাতদুটো ঠেকিয়ে নিয়ে একবার উচ্চকন্ঠে বললো, ‘জয় জগন্নাথ!’ তারপর জনান্তিকে হেসে হেসে বললো, ‘রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়া, হ্যাঁ, দারুণ মজা।’ এরপর লোকটি একমুখ কুচকুচে কালো দাড়ি গোঁফের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে শেষবারের মত চিৎকার করে বললো, ‘বুবুনের মা রথের মেলায় হারিয়ে কার সাথে চলে গেলে গো? ফিরে এসো, বুবুন আর বুবুনের বাবা তোমার জন্য কান্নাকাটি করছে।’ এই পর্যন্ত বলে লোকটা আবার হাসতে হাসতেই মাইকের সামনে থেকে সরে গেল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে লোকটি ভক্তির আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, একে দিয়ে আর কাজ চলবে না। বুবুনের ঠাকুরদা শ্রীপদ নিজের মুখভঙ্গিমার মধ্যে দিয়ে প্রবল বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে বুবুনের ঠাকুরমা হৈমন্তীকে বললেন, ‘এই জন্যেই লোকে বলে মেয়েমানুষের বেশি আমোদ আহ্লাদ করলে ক্ষতি। কে বলেছিল তোমাকে বুবুনের মাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে? বাড়ির মধ্যে থাকতো ভালো। এইসব কিছু হয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য।’ হৈমন্তী বললেন, ‘ এই শোনো, আমার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতে এসো না। বাড়ির একদম পাশেই চেনা জায়গায় একটা ছোটো খাটো মেলা বসেছে সেখানে এসে যে বুবুনের মা ছোটো বাচ্চার মত হারিয়ে যাবে তা কেমন করে জানবো? আমার কাছে এসে জগন্নাথ দর্শনের জন্যে এমন করে আবদার করলো যে আর আসতে না করতে পারলাম না। কোনো একটা কাজ যদি বুবুনের মা ঠিক করে করতে পারে।’ এরপর মহেন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে হৈমন্তী বললেন, ‘খোকন এবার তবে কী করবি?’ মহেন্দ্রর ঘেমে ওঠা তৈলাক্ত মুখে একরাশ বিরক্তি, রাগ, ঘৃণা এসে জমা হল। সে বললো, ‘কী আর করবো, সেই থেকে তো খোঁজার চেষ্টা করেই যাচ্ছি। এত লোকের মধ্যে থেকে আর কীভাবে খুঁজবো? ফোন করছি কতবার ফোনটাও তুলছে না নির্ঘাত বাড়িতেই ফেলে চলে এসেছে।’ শ্রীপদ আপনমনেই গজগজ করতে লাগলেন, ‘আমার মান সম্মান সমস্ত কিছু একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিল। রাস্তার লোকগুলো কেমন চেয়ে চেয়ে আমাদের দিকে দেখছে আর হাসাহাসি করছে। বুবুনের মাকে নিয়ে যে এরকম দুরবস্থায় পড়তে হবে তা জীবনে ভাবিনি।’ পাশে বসে থাকা হৈমন্তী শ্রীপদর সব কথাই শুনছিলেন তিনি বলে উঠলেন, ‘এই মেয়েকে ঘরের বউ করে আনাই ভুল হয়েছে। হাড় মাস জ্বালিয়ে দিল একেবারে।’ মহেন্দ্র তার মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের কষ্টটা বুঝতে পারলো তারপর কী একটা ভেবে নিয়ে সে তার মায়ের কোলের কাছ থেকে চার বছরের ছোটো ছেলে বুবুনকে টেনে এনে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে তাকে জোর করে কাঁদিয়ে দিয়ে বললো, বল বল, মা তুমি কোথায় শিগগিরি আমার কাছে এসো, বল।’ বুবুন শেখানো বুলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে মাইকে আউড়ে চললো। মহেন্দ্র নিজে এরপর মাইকটা নিয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘বুবুনের মা তাড়াতাড়ি মঞ্চের কাছে চলে এসো, দেখ বুবুন তোমার জন্য কাঁদছে।’ বুবুনের কাকা সমীরণ দেখলো তার পরিবারের লোক বুবুনের মাকে নিয়ে যতটা না উদ্বিগ্ন তার চেয়ে অনেক বেশি বিরক্ত। এই রকম পরিস্থিতিতে কারোর মনে একবারের জন্যেও বুবুনের মায়ের ওপর কোনো বিপদের আশঙ্কা জন্ম নিল না। সমীরণ ভাবলো বুবুনের মাকে এমনিতেই কেউ পছন্দ করে না, তার ওপর এই কাণ্ড! বুবুনের মা চিরতরে মেলায় হারিয়ে গেলে সকলেরই বেশ সুবিধা হয়। সকলের কাছে গলায় বিঁধে যাওয়া কাঁটার মতো হয়ে থেকেই বা কী করবে? শ্বশুরবাড়ির সবার কাছে সর্বক্ষণ অপমানিত হওয়ার চেয়ে বুবুনের মায়ের হারিয়ে যাওয়ায় ভালো। সত্যিই রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। ছেলেবেলায় সেও একবার বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে এসে রথের মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। বাবা মাকে সামনে দেখতে না পেয়ে তখন তার সে কী কান্না। অল্প সময় পরেই তার বাবা অবশ্য তাকে ঠিক খুঁজে নেন। সমীরণের মনে পড়লো একবার বুবুনের মা তার একটা সোনার কানের দুল হারিয়ে ফেলেছিল। সেইদিন হৈমন্তী বুবুনের মায়ের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেননি। সেদিন রাতের বেলা বাড়ি মাথায় তুলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে হৈমন্তী বুবুনের মাকে টেনে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বুবুনের মা কোথাও চলে যায়নি। কোথাও যাওয়ার ঠিকানা তার জানা ছিল না। একদিকে তার সামনে শ্বশুরবাড়ির দরজা বন্ধ, অন্যদিকে বিয়ের পর থেকে বাপের বাড়িতে গিয়ে ওঠার অধিকারও সে হারিয়ে ফেলেছে। তাই সারারাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজে বুবুনের মা শ্বশুরবাড়ির বন্ধ দরজার সামনেই পড়ে রইলো। সকাল হলে লোকলজ্জার ভয়ে যখন তাকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় তখন দেখা যায় বুবুনের মায়ের গায়ে ধুম জ্বর। দুই তিন দিন এমনই অযত্নে প্রায় বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকার পর বুবুনের মা আবার উঠে দাঁড়ালো। দুর্বল শরীরেই প্রতিদিনের মত সে সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্ত কাজের ভারে নিজেকে পিষে দিল। কারোর সহায়তা ও সহানুভূতির প্রত্যাশা করার মত অলীক স্বপ্নে সে নিজেকে আবদ্ধ রাখলো না। হৈমন্তী বুবুনকে সবসময় বুবুনের মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় কারণ হৈমন্তীর ধারণা বুবুনের মা ওকে ঠিক করে মানুষ করতে পারবে না। হৈমন্তীর চোখে বুবুনের মা কোনো কাজই ঠিক করে করতে পারেনা। যে একটা সোনার কানের দুল সামলে রাখতে পারেনা সে বাচ্চা সামলাবে কী করে? একটা মানুষ কীভাবে নিজের নাম পরিচয় সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে সংসারের মাঝে টিঁকে থাকে তা বুবুনের মাকে দেখে সমীরণ বুঝেছে। 
মফঃস্বলের রথের মেলা। আশেপাশের এলাকার মধ্যে এই রথটাই যা একটু বড় হয়। সংকীর্ণ স্থানের মধ্যে রাস্তার দু ধারে সারিবদ্ধ ভাবে বসা মনোহারি জিনিস, পাঁপড়, জিলিপি,কাঁচের চুড়ি,মাটির পুতুল, ইমিটিশন গয়নার দোকানগুলির সামনে জমাট বাঁধা ভিড় মানুষের চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। সেই ভিড়ের মধ্যেই মিশে আছে কয়েকজন বেলুনওয়ালা আর কয়েকটা আইসক্রিমের ভ্যান। রথ অল্পে অল্পে যত কাছে এগিয়ে আসছে জনসমুদ্রে ততই ঢেউ উঠছে আর নামছে। সমীরণ অবাক হয়ে ভাবে এই স্বল্প পরিসরের পরিচিত জায়গায় বুবুনের মা কী করে হারিয়ে গেল। হয়ত সে ‘বুবুনের মা’ বলেই হারিয়ে গেছে। এমন সময় হৈমন্তীর গলার শব্দে সমীরণের ভাবনাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। হৈমন্তী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে,ঐ তো বুবুনের মা।’ মঞ্চের সামনে বুবুনের মাকে দেখতে পেয়ে সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হৈমন্তী দ্রুত পায়ে মঞ্চের নিচে নেমে এসেই তেড়ে গেলেন বুবুনের মায়ের দিকে এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে তিনি সবার সামনে বুবুনের মায়ের গালে সজোরে একটা চড় কষিয়ে দিলেন। সমীরণ দেখলো বুবুনের মায়ের দুটো চোখ কেমন দপ করে জ্বলে উঠলো। অন্য সময়ের মত সে চোখের জল ফেললো না, ভয়ও পেল না। এবার হয়ত তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। হৈমন্তী বললেন, ‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ বুবুনের মা, আমাদের হাড় মাস না জ্বালিয়ে শান্তি হচ্ছিল না বুঝি?’ এক ঝটকায় সরে এসে বুবুনের মা সকলকে বিস্মিত করে এই প্রথম ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলো, ‘আমি কেবলমাত্র বুবুনের মা নই। শুধুমাত্র কারোর বউ কিংবা মেয়ে নই। কেন বারবার আমাকে সম্পর্কের ভিড়ে হারিয়ে যেতে হবে? আমারও স্বতন্ত্র পরিচয় আছে। সকলে কান খুলে শুনে রাখুন আমার নাম প্রগতি।’ 

লেখক : শিক্ষার্থী, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment