বেশরম আওরত

  • 05 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 575 view(s)
  • লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
তওবা তওবা বলতে বলতে বিয়ে বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান নিয়াজ মৌলবি। পাশের পাড়ার রিয়াজুলের বৈঠকখানায় গিয়ে হাঁফ ছাড়েন। এতোদিন ধরে বিয়ে পড়াচ্ছেন। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। কলেজ পড়া মেয়েগুলোর ধর্মজ্ঞান নেই। ইজ্জত মানছে না। তওবা, তওবা, বেহায়া মেয়েছেলে। গায়ের রঙের তো ওই বাহার। যদি ফর্সা হতো। ... ইসলাম ধর্মে পণ নেওয়া হারাম হলেও কোথাও তাকে নির্দিষ্ট মান্যতা দিচ্ছে মেয়েদের চেহারা আর গায়ের রঙ বিচার করে। এই গল্পের খায়তুল সেই মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিরাগভাজন হয়েছে সকলের।

তওবা তওবা বলতে বলতে বিয়ে বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান নিয়াজ মৌলবি। পাশের পাড়ার রিয়াজুলের বৈঠকখানায় গিয়ে হাঁফ ছাড়েন। এতোদিন বিয়ে পড়াচ্ছেন। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। কলেজ পড়া মেয়েগুলোর ধর্মজ্ঞান নেই। ইজ্জত মানছে না। বেগানা পুরুষের সামনে বে-আব্রু হতে শরম হলো না ওর। তওবা, তওবা, বেহায়া মেয়েছেলে। গায়ের রঙের তো ওই বাহার। যদি ফর্সা হতো। তবু এককথা। বাড়িভর্তি লোকের সামনে এই কাণ্ড! সহবত-শিক্ষা না থাকলে সে আবার মেয়েমানুষ কীসের?

নিয়াজ মৌলবির কথাগুলো শুনছিল রিয়াজুল। নিয়াজ মৌলবিকে দেখেছিল খায়তুলের বিয়ে পড়াতে ফরাজিপাড়া যেতে। কিন্তু কী হয়েছে সেখানে? মৌলবি অপমানে রেগে আছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে কারণটা স্পষ্ট হচ্ছে না।

 মৌলবি সাহেব কী ঘটল বিয়ে বাড়িতে?—রিয়াজুল জিজ্ঞাসা করল।

তওবা, জীবনে এমন ঘটনা দেখিনি বাপ। মেয়েছেলের বেলেল্লাপনা। একমাস ধরে মা-বিটিতে ঝামেলা চলছিল বিয়ে নিয়ে। আমি এসবের কিছু জানতাম না। ওই খায়তুল একদিন আমার কাছে এসে সব বলে যায়। এখন যুগের হাওয়া বাবা। কত কিছু বদলাচ্ছে। আমরা তো সব ধরে রাখতে পারি না।

-খায়তুল আপনার কাছে কী বলতে এসেছিল মৌলবি সাহেব?

-বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আত্মীয়-বন্ধুদের বলাও হয়েছে। তারপর এই বিপাক। বাপ-মা কী আর করবে? বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিল। তো মেয়েকেও সেকথা বুঝতে হতো। কিছুতেই বুঝবে না। জিদ ধরে থাকল। খায়তুলের আব্বার সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। লাভ হয়নি।

-মৌলবি সাহেব আসল কথাটা যদি ভেঙে বলেন। খায়তুলের বিয়ে কি হয়ে গিয়েছে?

-তবে আর এতো বিপত্তির কথা বলছি কেনরে বাপ। শুনলে তুমিও চেয়ার থেকে উল্টে পড়বে। বাড়িভর্তি মেহমান, বরযাত্রী। তারমধ্যে এই ঘটনা!

-তার মানে আপনি বিয়ে না পড়িয়ে চলে এসেছেন?

-শুধু আমিই না বাপ। বর, বরযাত্রী, মেহমান সব একএক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা যা কেলেঙ্কারি করল। কেউ থাকতে পারে ওখানে?

রিয়াজুলের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। আসল কথাটা এখনও মৌলবি সাহেব বললেন না। খায়তুলকে সে চেনে। বুদ্ধিমতি মেয়ে। সমাজতত্ত্বে অনার্স পড়ছে। অন্যায় মেনে নেয় না। প্রতিবাদ করতে জানে। তবে ওদের পরিবার গ্রামের কারো সঙ্গে তেমন মেশে না। সম্পদের আভিজাত্যে, অহংকারে এড়িয়ে চলে। একই গ্রামের হলেও, অনেক কিছু গোপন ওদের। খায়তুলের বিয়ের খবর জানত। কিন্তু তার মধ্যের কোন ঘটনা জানা নেই। মৌলবিকে অনুনয় করল, সব খুলে বলতে।

কথা শুরু করতে গিয়ে মৌলবির গলা কাঁপছে। - আমিই কিছু করতে পারিনি। মেয়েটাতো ধর্মের পথেই চলছিল। তা বলে অতো অবুঝ হলেও চলে না। আমাকে এসে বলল, ‘আপনাকে আমার বিয়েতে আব্বা ডাকবে। সব ঘটনা তাই বলতে এসেছি। পাত্রপক্ষ বিয়ে ফাইনাল করার পর পণের জন্য চাপ দিচ্ছে। এখন ওদের মনে হয়েছে আমার গায়ের রঙ কালো। বেশি জিনিস দিতে হবে। আব্বা-মাকে চাপ দিয়েও আমি এই বিয়ে বাতিল করাতে পারছি না। আব্বা-মাও এককথা বলছে। আমি কালো। যেখানেই বিয়ে দিক পণ নাকি লাগবেই। তাই ওরা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমি এই অপমান মানব না। পণ দেওয়া-নেওয়া যদি হারাম হয় তাহলে আপনি কি এই বিয়েতে আসবেন মৌলবি সাহেব? আপনাকে ওরা গোপন করবে পণের কথা। আমি তাই জানিয়ে গেলাম।’ কথাগুলো বলে মৌলবি একটু দম নিলেন। রিয়াজুলের তর সইছে না, -খায়তুল কীভাবে তাড়াল আপনাদের বলুন মৌলবি সাহেব।

-আমি ওর আব্বার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তিনি বেশ ক্ষুণ্ণ হলেন। কেন বিটিছেলের কথা শুনে তাকে বোঝাতে গিয়েছি। তাছাড়া মেয়ের সংসার সাজিয়ে দেওয়া ওদের কর্তব্য মনে করেন। পাত্রপক্ষ না চাইলেও দিতেন। খায়তুলের আব্বার মুখে এসব শুনে আমি আর কিছু বলিনি। পরে শুনলাম খায়তুল ফোনে পাত্রকে ধমকেছে। পণ নিচ্ছে সেকথা নাকি পুলিশকে জানাবে। ছেলেটি খায়তুলের আব্বাকে হুমকির কথা জানিয়ে দেয়। তারজন্য খায়তুলকে মেরে ঘরে বন্দি করে রেখেছিল। বিয়ের আগের দিন বেরোতে দিয়েছে। তাও নজরবন্দি ছিল। ও মেয়ে বিয়ের আসরে সবার মুখ পোড়াবে তা কেউই বোঝেনি।

রিয়াজুলের চোখে বিস্ময়। মেয়েটা সাহসী জানত। কিন্তু এতটা ভাবতে পারেনি। রিয়াজুল নিজের বিয়ের সময় আব্বা-মায়ের সঙ্গে অশান্তি করেছিল পণ নেবে না বলে। বীরভূমের এই এলাকাবাসীর মধ্যে পণ নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। যে সন্তান যত বেশি পণ শ্বশুর বাড়ি থেকে আনতে পারে, সেই সন্তানের বাবা-মায়ের গর্ব তত বাড়ে। সেখানে রিয়াজুলের মতো ব্যাংক-অফিসার পাত্র পণ ছাড়া বিয়ে করল। নানা মাত্রা জুড়লো পণবিহীন বিয়ে করার ঘটনা। কেউ বলল, বাবা-মাকে আঘাত দিল। কারো মনে হল, উদারতা দেখানোর ভান। তবে যে দু/চারজন অনুপ্রাণিত হয়ে তারিফ করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল খায়তুল। হ্যাঁ, আজ খায়তুলের জন্য তারও গর্ব হচ্ছে। মৌলবিকে রিয়াজুল বলল,- ক্লাইম্যাক্সটা তাড়াতাড়ি সারুন মৌলবি সাহেব। আর অপেক্ষা করতে পারছি না।

-ওই ঘটনার কথা বলতে গিয়েও মুখে আটকে যাচ্ছে বাপ। মেয়েকে সাজিয়ে ঘরে পর্দার আড়ালে রেখেছিল। বাইরের বারান্দায় আত্মীয় স্বজনের ভিড়। বিয়ে পড়াতে গেলাম। হঠাৎ বউ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কটা বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়ে সোফাতে বসেছিল। ওদের তুলে দিল সোফা থেকে। মানুষের ভিড়ে আধশোয়া হয়ে সেখানে শুয়ে পড়ল। লেহেঙ্গা তুলে দিল হাঁটুর ওপর। জুতোসমেত পা সোফার বাহুতে উঠিয়ে নাচাতে লাগল। মাথার ওড়না ফেলে দিল ছুঁড়ে। চোখে দিল সানগ্লাস। খোপা খুলে আলুথালু। তারপর তীব্র চিৎকার। - ‘আমাকে দেখতে এসে বরপক্ষের প্রথম প্রশ্ন ছিল, নামাজ, কোরান পড়ি কি না। ধর্মীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শুরু করল নির্যাতন। অসম্মান। অমর্যাদা। আমি কালো। সম্পদের ঘুষে আলো জ্বলবে। আমার আব্বা-মা খুব ধর্মশিক্ষা দিয়েছিল। অথচ তারাই আজ অধর্ম মেনে নিচ্ছে। মেয়েকে অসম্মানের হাত থেকেও রক্ষা করল না। তোমরা আমাকে বাঁচতে দেবে না বলে ঠিক করেছিলে। আমি তার জবাব দিলাম। মৌলবি সাহেবকেও সব বলে এসেছিলাম। উনিও কিছু করলেন না। কোনও বিরোধিতা নেই আপনাদের? এই শুয়ে থাকলাম। তোমরা জোর করে বিয়ের আসরে বসালেও আমি কবুল বলব না। এবার দিন দেখি মৌলবি সাহেব বিয়ে।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে  চুপ করলেন মৌলবি সাহেব। চোখে তাঁর অসম্মানের জ্বালা। গ্রামের লোক মেনে চলে। অথচ বাড়িভর্তি মেহমানের মাঝে এই অপমান।

- মৌলবি সাহেব, খায়তুলের এই বোধ আর প্রতিবাদকে আমি সম্মান জানাই। এমনভাবেই ঝড় তোলা দরকার। কিন্তু খায়তুলের আব্বা-মা?

-চুলের মুঠি ধরে ঘরে নিয়ে গেছে। মেয়েমানুষের এত তেজ? লোকজনের সামনে কাপড় হাঁটুতে তুলে শুয়ে থাকা? বেশরম আওরত।

সৌজন্য সৃজনী পত্রিকা ২০১৮ (শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে) 

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment