পিসিমাদের ভাতের হোটেল

  • 08 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 668 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এই শহরে পিসিমাদের টিকে থাকাটা ক্রমশই আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। পুঁজির বিন্যাস এমনই, এই শহরে এখন পুঁজির মাৎসন্যায় অবস্থা। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাচ্ছে অনায়াসেই। চৌধুরীদের বাড়ির মতো পুরনো বাড়িগুলিকে সস্তাদরে একবার কিনে নিতে পারলেই গ্যারাজ স্পেস, পার্কিং-লট, ওপেন গার্ডেন, এমন সমস্ত বিষয়ই তখন ক্রেতা-প্রোমোটারদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সময় কালুয়া বা ঘন্টুদের রোজগারের সময়। এভাবেই হচ্ছে কর্মসংস্থান। উচ্ছেদ এইভাবেই।

বড়দি, মেজদি, ছোড়দি; ঘন্টুর বাবা-কাকারা আজীবন তিনজনকে এই নামে ডেকে এসেছে। তাই ঘন্টুও ডাকে পিসি; বড়, মেজ, ছোট। পিসিমাদের ভাতের হোটেল বড় রাস্তার উপরে। লর্ডসের মোড় থেকে যে রাস্তাটা দূরদর্শন ভবনের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরে খানিক এগুলেই ভারত পেট্রোলিয়ামের আপিস। এখানে একটা চারমাথার মোড়। তারই বাঁদিকের ফুটপাথে কোণাকুণি ঘেঁষে পিসিমাদের হোটেল। পিসেমশাইদের খবর কেউ রাখেনি। সবকজন পিসিদের বিয়েও হয়নি বোধহয়। বড়জন আর ছোটজনের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বড়জনের ছিল সম্বন্ধ করে আয়োজন, ছোটজনের মনে প্রেমের ফুল ফুটেছিল। সেসব ঘন্টুর জন্মেরও আগেকার কথা। ফি শুক্রবারেই সিনেমা হলগুলোয় তেড়ে টিকিট ব্ল্যাক হতো তখন। এখন সেসব দিন গিয়েছে। ঘন্টুরা অন্য বিজনেসে পা বাড়িয়েছে। বাবা-কাকাদের মতো সেকেলে টিকিট ব্ল্যাকের কারবারে কারোরই আর পেট চলে না। ক্ষুর চালাতে জানলেই আর পয়সা আসে না। ঘন্টুর গুরুদেব, কালুয়া একদিন ওকে ফিসফিস করে বলেছিল, আব্বে ঘন্টুয়া – এখন স্পেশালাইজেশনের যুগ রে পাগলা। শুধু কামকাজ জানলেই হোবে না, সেই কামকাজ কুথায় লাগাবি সেটাও জানতে হোবে। কালুয়া বাঙালি না অবাঙালি, নাকি বিহারি, মাড়োয়াড়ি – কেউ জানে না সেসব। কালুয়াদের কোনও জাত-ধর্ম-পরিচয় হয় না। কালুয়ারা কালুয়াদের মতোই ছুটতে ছুটতে, পড়তে পড়তে বেঁচে থাকে। হাতাহাতি-মারামারি-ছোরাছুরির জীবন। এদেরও মধ্যে কেউ কেউ যে কখনও-সখনও ‘আপনজন’ সিনেমার ছেনো হয়ে উঠতে চেষ্টা করে না, তেমনটা নয়। আদতে সমাজ বড় বিচিত্র এক ঠাঁই। সেই ঠাঁইয়েরই আরেক নাম জীবন।

 

পিসিমারা খুব যত্ন করে খাওয়ায় ...

ফুটপাথের হোটেলে কতই বা আর ভ্যারাইটি সম্ভব। তাহলেও, পিসিমারা খুব যত্ন করে খাওয়ায়, পাত পেড়ে দিয়ে, জল ছিটিয়ে; হাতপাখা থাকলে বোধহয় হাওয়াও করত। মাছের পদগুলোয় আলাদাই একটা স্বাদ লেগে থাকে। কোনওদিন বোয়াল মাছ, কোনও দিন বা পার্শে, কোনওদিন কাতল। লঙ্কাবাটা দিয়ে কালোজিরের ঝোল। গরমকাল হলে ট্যালটেলে কিন্তু খুব মিষ্টি একটা আমের চাটনি। মোটাচালের ভাত, আলুসেদ্ধ। নুন, লেবু, লঙ্কা। পিসিমাদের হোটেলে টেবিল খালি থাকে না কোনওসময়। দূরদর্শন ভবনের দরোয়ান মানিক, তার জন্য যেমন একখানা টেবিল আগে থাকতেই বরাদ্দ করা থাকে। এর কোনও অন্যথা চলে না। সেদিন যেমন মানিক কোনও এক অজ্ঞাত কারণবশত দু-পাঁচ মিনিট আগেই খেতে চলে এসেছিল। অন্য একটা টেবিল ফাঁকা‍ রয়েছে দেখে বসতে যেতেই বড়পিসিমার ধমক, “ওদিকে কি দেখছ বাবা মানিক, তোমার যে এইদিক পানে বরাদ্দ। দুটো মিনিট সবুর করো এখন। টেবিল খালি হলেই তোমাকে বসিয়ে দিচ্ছি।” এখানে নতুন কেউ জিজ্ঞেস করতেই পারে, টেবিলের আবার এদিক-ওদিক কিসের। কিন্তু পিসিমাদের হোটেলে তেমনটি হওয়ার জো নেই। মানিক যে টেবিলে বসতে গিয়েছিল সেখানে যে আর এক মিনিটের মধ্যেই পাশের মনিহারি-কসমেটিক্স দোকানের চিত্তবাবুর খেতে বসার কথা। ঠিকমতো ক্যিউ সামলাতে না পারলে হোটেলে যে কুরুক্ষেত্তর বেঁধে যাবে। এদিকে ছোটপিসি তখন উবেরওলাদের গাড়ি স্লো করতে দেখলেই রিনরিনে গলায় হাঁক পেড়ে চলেছে, “ভাত খাবে গো বাবারা, ভাত ? গরম গরম ভাত, পার্শে, পোনা, কাতল, বোয়াল, ডিমঝোল সঙ্গে ভাত! লেবু লঙ্কা ফিরিতে পাবে, চাটনি পাবে, ভাত খাবে গো ভাত?” সেই মায়াবী ডাকের আহ্বান উবেরওলারা উপেক্ষা করতে পারে না। কান পাতলেই নাকি শোনা যায়, পিসিমাদের হোটেলে যে কখনও খাবারের স্বাদ নিয়েছে, সে নাকি আর দ্বিতীয়বারে অন্য কোনও পাইস হোটেলের দিকে ফিরে তাকায়নি। তপ্ত ভাতের গন্ধে ভারত পেট্রোলিয়ামের মোড় ম ম করে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষাতেও, পিসিমাদের ভাত বাড়ার বিরাম নেই।

 

ঘন্টুর প্রথমে কালুয়াকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। একসাথে এতগুলো টাকা সে পাবে কখনও ভাবেনি। কিন্তু তাই বলে কাজটাও যে এমন, সে বুঝে উঠতে পারেনি। সে কালুয়াকে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করে, “এছাড়া কি আর কোনও উপায় নেই ওস্তাদ ? ওদেরকে তুলে কি লাভ হবে তোমার ?” কালুয়া রাগের চোটে হিসহিস করে ওঠে, “আব্বে উজবুক, এত কথায় তোর কি কাম বে ? পয়সা নিবি, মাল খালাস করবি। এত টাকা বাপের জন্মে কোনওদিন দেখেছিস! স্পেশালাইজেশনের যুগ, আর কামিয়াবির যুগ রে এখন। কাম করবি, টাকা নিবি, ব্যস। চল ফোট এখন! মেলা বকিস না।” কালুয়ার মুখ দিয়ে ভক ভক করে একটা পচা গন্ধ আসে। ঘন্টু চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কালুয়া আবার কথা বলে, “আব্বে ঘন্টুয়া, তুই দেখি কবে থেকে এমন ভেড়ুয়া হয়ে গেলি রে ? এত্ত চাপ নেওয়ার মোতো কি এমন আছে এতে শুনি ? আব্বে বিল্লুয়া আর সিরাজভাইও তো থাকবে তোর সঙ্গে নাকি ? পেট্রল-মেট্রল তো ওরাই আনবে। তুই শুধু ও’ঘরটাকে দেখিয়ে দিবি ওদের; আর কেউ বেগড়বাঁই কিছু করলে এদিক-ওদিক চমকিয়ে দিবি একবার, ব্যস! এতনা দিন ধরে তুই কি শিখলি বে আমার কাছে থেকে ? চল হ্যট এবার! ন্যাকাকান্না কাঁদছে দেখ।” ঘন্টু বুঝতে পারে যে চিঁড়ে ভেজার নয়। সে আস্তে আস্তে কালুয়ার কাছ থেকে উঠে আসে। এত গুণ্ডামি করেও বাংলার গন্ধটা কেন জানিনা এতদিনেও ঘন্টু সইতে পারে না। ওর গা গোলায় খুব।

 

ভারত পেট্রোলিয়ামের মোড় থেকে কেউ যদি বা অটোতে চেপে যাদবপুরের দিকে আসে, মোড় থেকে বিক্রমগড় বাজার অবধি আসতে আসতেই ডানপাশে একটা মস্ত মজা পুকুর পড়ে। পুকুরপাড়ে নোংরা আর প্লাস্টিক জমে জমে পাহাড় হয়ে রয়েছে। রাস্তার বামদিকেও একটা জলাজমি সোজা চলে গিয়ে সাউথ সিটির কম্পাউণ্ড ওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে। জলাজমির আগে, সেই পোড়ো জমিটার শেষ মাথাতেও একটা ভাঙাচোরা গ্যারেজের দোকান রয়েছে। পুকুরটার একপাশে দুচারঘর মতো একটা বস্তি রয়েছে। তারই একপ্রান্তে পিসিমাদের বাসস্থান। দরমার একফালি একটি কুঠুরি-ঘর। দুর্গন্ধে অথবা অসুখ-বিসুখ-ম্যালেরিয়াতে পিসিমাদের মোটামুটি অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ঘরে ঘরে পাকা বাথরুমের বিলাসিতা এখানে চলে না। ভরসা বলতে সেই পেট্রোলিয়ামের মোড়ের মাথায় বছরখানেক আগে গজিয়ে ওঠা একখানি সুলভ শৌচালয়। সেদিন অনেক রাত্তিরে ছোটজনের ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ।

 

শীত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অল্পস্বল্প গরমে ঘামও দিতে শুরু করেছে। জলতেষ্টা পেয়েছিল ছোটর। কলসি থেকে গড়িয়ে জল খেয়ে ছোটর মনে হল, পেট্রোলিয়ামের মোড় থেকে তার একটিবার ঘুরে আসা প্রয়োজন। এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কাপড়টা একটু ঠিক করে নিয়ে, হাতে একটা জলের বোতল নিয়ে ছোটজন রাস্তায় বেরুল। ফটফটে স্ট্রিটলাইট। জনমনিষ্যি নেই। বাইরের হাওয়াতে এখনও একটু শিরশিরে ভাব রয়েছে। ছোট পায়ে পায়ে রাস্তার মোড়ের দিকে এগুল। মোড়ের মাথায় একটা বড়োসড়ো নিমগাছ। দৈত্যের মতো ঝুপসি হয়ে রয়েছে। অন্ধকার। সেখানেই যেন একটা নড়াচড়ার ইঙ্গিত দেখতে পেল সে। ওই নিমগাছের ওধারেই তো তাদের হোটেল। নিমগাছটার এধারে চৌধুরীদের ভিটে। অনেককালের পুরনো দোতলা বাড়ি তাদের। তারা কেউ আর এদেশে থাকে না। বাড়িটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ছোটজনের মনে কেমন জানি সন্দেহ জাগল হঠাৎ। অনেকদিন ধরেই তো কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে যে, চৌধুরীরা নাকি বাড়ি বেচে দিয়েছে। এলাকার উঠতি প্রোমোটার সরোজ পাড়ুই, তাদেরই গ্রুপের হাতে গেছে ওটা। পাড়ুইয়ের সঙ্গে আবার মস্তান কালুয়ার ভাব আছে। ছোটর মনটা কু ডাকছিল। সে মোড়ের দিকে না এগিয়ে তাদের হোটেলটার দিকেই এগুল।

 

একটা লোক একটা বড় প্লাস্টিকের জ্যারিকেন থেকে কি যেন একটা ছিটিয়ে দিচ্ছে। গন্ধটা ভক করে ছোটর নাকে এসে লাগল। সে অস্ফূটে একটা চিৎকার করে লোকটার দিকে ছুটে যাবে, আরেকটা লোকও যেন কখন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে। সে তার ডানহাত তুলে ছোটর দিকে হঠাৎ তেড়ে এল। হাতে একটা ভোজালি চকচক করছে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় পরিষ্কার। ছোট আবার চিৎকার করল। কেউ শুনতে পাচ্ছে না। তেড়ে আসা লোকটাকে কোনও ভাবে কাটিয়ে পেট্রল ঢালছিল যে লোকটা, ছোট একেবারে তার গায়ের উপরে গিয়ে পড়ল। তিন নম্বর ছেলেটাকেও তখনই দেখল সে। নিজের চোখকেও তার তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এতদিনকার সম্বল, তিলে তিলে গড়ে তোলা একটা স্বপ্ন। ছোটজন প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করতে চেষ্টা করছিল। মাথার উপরে সজোরে একটা ভারী কিছুর আঘাত। অজ্ঞান হতে হতেও শেষবারের মতো গলা চিরে সে চিৎকার করে উঠল। দূর থেকে কারোর ছুটে আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ছোটজনের আর কিছুই মনে পড়ল না।

 

এই শহরে পিসিমাদের টিকে থাকাটা ক্রমশই আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। পুঁজির বিন্যাস এমনই, এই শহরে এখন পুঁজির মাৎসন্যায় অবস্থা। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাচ্ছে অনায়াসেই। চৌধুরীদের বাড়ির মতো পুরনো বাড়িগুলিকে সস্তাদরে একবার কিনে নিতে পারলেই গ্যারাজ স্পেস, পার্কিং-লট, ওপেন গার্ডেন, এমন সমস্ত বিষয়ই তখন ক্রেতা-প্রোমোটারদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সময় কালুয়া বা ঘন্টুদের রোজগারের সময়। এভাবেই হচ্ছে কর্মসংস্থান। উচ্ছেদ এইভাবেই।

 

ছোট, হাসপাতাল থেকে এখনও ফেরেনি। এখনও তাই দুপুর হলেই পিসিমাদের হোটেল থেকে উবেরওলাদের উদ্দেশ্যে সেই রিনরিনে হাঁক শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু এযাত্রা অন্তত পিসিমাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়নি। সেদিন রাত্তিরে ছোটজনের চিৎকার শুনে বস্তির বেশ কয়েকজন বেরিয়ে এসেছিল। ঘন্টু, বিল্লু, সিরাজেরা কোনওমতে ছুটে পালিয়েছিল সেদিন। পিসিদের থানায় যেতে বলেছিল সবাই। কিন্তু পিসিরা যায়নি। থানায় যেতে হলে অনেক ঝামেলা আবার। একা একা কালুয়াদের সঙ্গে লড়া চলে না। বরং পাড়ার সকলে যদি এভাবে এককাট্টা হয় ...

 

শোনা যাচ্ছে পাড়ার বড়রা কেউ কেউ নাকি চৌধুরীদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। সমাজকে উন্নত করতে গেলে, সমাজকে শোধরাতে গেলে – সেই সংশোধনগুলিকে সমাজের ভিতর থেকেই উঠে আসতে হয়। পিসিরা অবিশ্যি এতকিছু বুঝে পা ফেলেছে, তেমনটা নয় বোধহয়। আবার অন্যদিকে সহজ সরল সদিচ্ছেটাই সময়ে সময়ে যে কতখানি জোরদার একেকটা অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়, আমরা নিজেরাই বোধকরি তা ঠাহর করে উঠতে পারি না। এখন বেশ গরম পড়ে গিয়েছে। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টু ফিরছিল। মুখ শুকনো। কালুয়া আজ প্রচণ্ড ভাবে তাকে কথা শুনিয়েছে। সরোজ পাড়ুইও নাকি তাকে ছেড়ে দেবে না। সে নাকি ইচ্ছে করে ছোটপিসিমার চিৎকার থামাতে বেশি সময় নিয়েছে। ঘন্টুর কপালে ঘাম। জীবনটাই চাপের শালা, আর বাঁচতেই যেন ইচ্ছে করে না। অদ্ভুৎ এক অস্বস্তিতে পুড়তে পুড়তেই ঘন্টু হাঁটছিল। খেয়াল ছিল না কোন পথে সে এসে পড়েছে। বিল্লু ওকে কদিন পাড়ায় ঢুকতে বারণ করে দিয়েছিল। ঘন্টুর সে কথা খেয়াল ছিল না।

 

“ভাত খাবে গো বাবারা, ভাত ? গরম গরম ভাত, শোল, পার্শে, পোনা, কাতল, ডিমঝোল সঙ্গে ভাত! লেবু লঙ্কা ফিরিতে পাবে, চাটনি পাবে, ভাত খাবে গো ভাত?”

 

গলাটা একটু অচেনা, কর্কশ। ছোটপিসিমা তো এখনও হাসপাতাল থেকে ফেরেনি। একা মেজপিসিমাই দোকানে পাহারা দিচ্ছে। “ভাত খাবি নাকি হতচ্ছাড়া ?” গলাটা যেন আরও একটু কর্কশ শোনাল। ঘন্টুর দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলা হয়েছে। “লাউ দিয়ে শোলমাছের তরকারি করেছি আজ, ডাঁটা দিয়ে কুমড়ো-ঝিঙে দিয়ে চচ্চড়ি আছে রে হতভাগা। সুক্তো খাবিনে ?” মেজপিসিমা বিড়বিড় করে বকে চলেছে, “আজকে যে ছোটর বাড়ি আসার দিন। বড় তো তাই গেল হাসপাতালে, ছুটি করিয়ে আনতে। এখন তুই গিলে যা দিকিনি দয়া করে, অল্পপেয়ে ড্যাকরা আমার। পেটের জ্বালাতেই তো যত অকাজ-কুকাজের কথাগুলো মাথায় বিজবিজ করে তোদের। নাহয় শোলমাছটা আমিই খাওয়ালাম আজ। সবজি ভাতের পয়সাটা দিস। খেতে বোস এবার।”

 

ঘন্টুর কি করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ দেখে দূরদর্শনের দরোয়ান মানিক তার ডানহাতটাকে শক্ত করে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে টেবলে নিয়ে এসে বসিয়েছে। মানিক গরগরে গলায় তার কানে কানে বলে, “লজ্জা হয় না তোদের, পিসি বলেছে চিত্তবাবুর দোকানে তোর আর বিল্লুর একটা হিল্লে করিয়ে দেবে। আমার হাতে থাকলে, আঙুলগুলো মটমটিয়ে ভেঙে দিতাম।” ঘন্টুর হাতটা একবারের জন্য মড়মড় করে ওঠে। ওতে আর যন্ত্রণা লাগে না তার। কেবল চোখদুটো কেমন জ্বালা করে ওঠে। সে হাত দিয়ে ভাত মাখছে। সুক্তোর গন্ধে চারিদিক ম ম করে কেমন। পিসিমাদের হোটেল চালু আছে, চালু থাকবে।

 

আজও পিসিমাদের বিশ্রামের সময় নেই।

 

লেখক : গবেষক,প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

আলোকচিত্র : সৌজন্য ময়ূরীকা মুখোপাধ্যায়

 

0 Comments

Post Comment