মৃত্যুর ঘ্রাণ

  • 01 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 458 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
চারদিক ঘোর অন্ধকার। তার উপর ঝম ঝম বৃষ্টি। মেঘনা ছুটতে থাকে। পায়ে পা জড়িয়ে গিয়ে আছাড় খায়। সামনে একটা ঝুপড়ি দেখে সেখানে ঢুকে ধপ করে বসে পড়ে সে। লঝমিদের শুয়োরের খোঁয়াড়। ধাড়ি শুয়োরটা তাকে দেখে ঘোঁত ঘোঁত করে ওঠে। তার পর কি ভেবে তার নোংরামাখা শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়ে। বাচ্চাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাদের পাশে  নিজের অর্ধ-নগ্ন দেহটা গুঁজে দিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে মেঘনা।                         

আজকাল কাগজ খুললেই চোখে পড়ে নারী নিগ্রহের ঘটনা। তিন বছরের শিশুকন্যা থেকে বয়স্কা রমণী কারো নিস্তার নাই নারীমাংস লোলুপ পশুদের হাত থেকে। এই অসুস্থ, বিকৃত মনস্ক মানুষগুলো সবসময় যে অচেনা বা কোনো গুণ্ডা বদমাস তা কিন্তু নয়। কখনও সখনও তারা আমাদেরই নিকটজন। তাই একান্ত বিশ্বাসে একজন মেয়ে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। এমনই একটি ঘটনা নিয়ে আমার আজকের গল্প।

  আকাশে মেঘ দেখেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল মেঘনা। তাকে বের হতে দেখে তার মা বলেছিল, “মেঘ মাথায় করে কোথায় চললি?” উত্তরে মেঘনা বলেছিল, “অরুদের বাড়ি যাচ্ছি মা!”।

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, অতখানি পথ যাবি? কাল যাস!

 কাল গেলে হবেনা! পলাশদাকে দিয়ে অরু আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। কি একটা বিশেষ দরকার। আমার মোবাইলটা খারাপ না হলে মোবাইলে কথা বলে নিতাম। যাই হোক তুমি চিন্তা করোনা। সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসব।

অরুর আসল নাম অরুন্ধতী। মেঘনার সহপাঠী। ক্লাস ফাইভ থেকে ওদের বন্ধুত্বের শুরু। ক্লাস ইলেভেনে উঠে এখন ওরা হরিহর আত্মা। পলাশ অরুন্ধতীর দু বছরের বড় দাদা। কলেজে পড়ে। পলাশের সাথে মেঘনার সহজ সম্পর্ক। সে আর অরু পলাশদার সাইকেলে চড়ে কত কত জায়গায় ঘুরেছে। খাঁ-পুরের মেলায় নাগর দোলনায় চাপার স্মৃতি আজও বিড়ম্বনায় ফেলে মেঘনাকে। নাগর দোলনা জিনিসটাকে বড় ভয় মেঘনার। মনে হয় এই বুঝি দড়ি ছিঁড়ে মানুষজন সব ছিটকে পড়বে। অরুর জোরাজুরিতে চেপে বসেছে সে। দু-চার পাক ঘুরতেই মাথা ঘুরে একেবারে অজ্ঞান। পলাশ এখনও এটা নিয়ে খ্যাপায় মেঘনাকে।

  মেঘনাদের পাড়া ছাড়ালেই হরিজন পাড়া। রাস্তার পাশেই লছমিদের শুয়োরের খোঁয়াড়। জায়গাটা সর্বক্ষণ দুর্গন্ধে ভরে থাকে। ধাড়ি শুয়োরটা সারা গায়ে নোংরা মেখে ঘুরে বেড়ায়। তার পিছনে নোংরা মাখা একপাল ছানা পিল পিল করে হাঁটে। দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে মেঘনার। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সাইকেলটায় দ্রুত প্যা্ডেল করতে থাকে। লাল দিঘির পাড়ে পৌঁছে বুক ভরে শ্বাস নেয় সে।

অরুদের বাড়ি এলে অরু বলে, “আমি আবার কখন তোকে ডেকে পাঠালাম?”

তবে পলাশদা যে বলল, তোর নাকি খুব দরকার। এক্ষুনি আমি যেন তোদের বাড়িতে আসি।

ধ্যাৎ! দাদা তোর সাথে মজা করেছে। দাদকে চিনিসতো?

কোনো মানে হয়? আমি তাহলে যাই বুঝলি? কাল স্কুলে যেতে যেতে কথা হবে।

এসেই যখন পড়েছিস তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে আয়।

 না রে! মেঘ করেছে। মা বেরোতে বারণ করছিল। শুধু তোর কথা ভেবে এতটা পথ এলাম। কাকু-কাকিমাকে দেখছি না যে?

 মা-বাবা কেউ বাড়ি নেই। ছোটোমামার শরীর খারাপ। তাকে দেখতে গেছে। আজ ফিরতে পারবেনা। ওই দ্যাখ দাদা আসছে।

পলাশদা! শুধু শুধু তুমি আমাকে এতটা পথ আসা করালে? পলাশকে দেখে কপট রাগ দেখায় মেঘনা।

ভারি তো পথ? এপাড়া থকে ওপাড়া। আর শুধু শুধু কে বলল? কারণ একটা নিশ্চয় আছে। পলাশ বলল।

 কি কারণ শুনি?

 মশলা মুড়ি।

 মশলা মুড়ি? মেঘনা, অরু দুজনের কণ্ঠেই বিস্ময়।

 মশলা মুড়ির নাম শুনিসনি মনে হচ্ছে? অরু ভাল মশলা মুড়ি বানাতে শিখেছে। ভাবলাম বৃষ্টির দিনে খাব। তিন জন  হলে জমবে ভাল? তাই একটু কায়দা করে তোকে ডেকে আনলাম। তুই এমন করছিস মনে হচ্ছে যেন কোন অন্যায় হয়ে গেছে।

তোমরা দুজনে খাও। আমি চললাম। বাড়িতে চিন্তা করবে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রাখে মেঘনা।

 কিচ্ছু চিন্তা করবেনা। কাকুর সাথে  দেখা করে বলে দিয়েছি তুই আজ ফিরবি না। মা-বাবা বাড়ি নাই। আমার ফিরতে রাত হবে। তুই অরুর সঙ্গে আমাদের বাড়িতে থাকবি। এবার ভ্যানতাড়া রেখে বস তো?

কিন্তু! আজ আমার অন্য কাজ ছিল। মেঘনা ইতস্তত করতে থাকে।

 অন্য কাজ অন্যদিন করবি। বসবি চল। মেঘনার পথ আগলে দাঁড়ায় পলাশ।

তুই যে রাত করে ফিরবি আমাকে আগে বলিসনি তো দাদা? অরু বলে।

এই তো বললাম। তুই একা থাকবি বলেই তো মেঘনাকে ডেকে আনলাম।

 খুব ভাল হলরে মেঘনা? সারারাত দুজনে গল্প করব। সেবারের মত। সবাই নবারুনদার বিয়েতে বরযাত্রী গেল। তুই আমাদের বাড়িতে থাকলি। দুজনে গল্প করতে করতে খেয়ালই নাই কখন সকাল হয়েছে, মা-বাবা ফিরে চলে এসেছে। আজ থেকে যা। খুব মজা হবে। অরু খুব খুশি।

 বাবাকে ঠিক করে বলেছতো পলাশদা? বাবা আজকাল কানে কম শুনছে। নইলে চিন্তা করে মরবে?

বলছি তো বলেছি। বিশ্বাস না হয় গিয়ে শুধোগে। যা ভাগ! রাগ দেখায় পলাশ।

 আর তোকে যেতে হবেনা। উঠে আয়। মেঘের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ। বৃষ্টি এল বলে। চল, জম্পেশ করে  আদা দিয়ে চা বানাই। অরু এসে মেঘনার হাত ধরে।                    

 আর মশলা মুড়ি? পলাশ বলে ওঠে।

 মশলা মুড়ি হচ্ছেনা।

 কেন? মুড়ি নাই?

শুধু মুড়ি থাকলেই বুঝি মুড়ি মশলা হয়ে যাবে? শশা,চানাচুর কিছুই তো নাই?

যাহ্ বাবা! অতিথিকে ডেকে এনে তার সৎকার হবেনা?এখন উপায়?

পলাশের কথা বলার ঢঙ্গে অরু,মেঘনা না হেসে পারেনা।

উপায় একটা আছে রে দাদা? টুম্পাবৌদির কাছ থেকে চেয়ে আনি। বৌদির কাছে নিশ্চয় থাকবে। মেঘনা, তুই আদা,পেঁয়াজ কুচো কর। আমি যাব আর আসব।

একটু আচারের তেল চেয়ে নিস! পলাশ চেঁচিয়ে বলে।

অরুদের রান্নঘরে কোথায় কি আছে সব মেঘনার জানা। চৌকির তলায় আলু পেঁয়াজের ঝুড়ি। নীচু হয়ে ঝুড়ি থেকে আদা,পেঁয়াজ তুলতে থাকে সে। হঠাৎ পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে মেঘনা। চৌকির তলা থেকে শরীরটা বের করে ঘুরে তাকিয়ে দেখে, পলাশ  পিছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।

পলাশদা! কিছু চাই? ভীষণ চেনা পলাশদাকে কেমন যেন অচেনা লাগে মেঘনার।

 হ্যাঁ চাই! মেঘনার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে পলাশ।

একি? হাত ধরছ কেন? ছাড়? হাতটা ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে মেঘনা।

 ছাড়বার জন্য এত কৌশল করে ডেকে এনেছি নাকি? অন্য হাত বাড়িয়ে রান্নাঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয় পলাশ।

মানে? এসব কি বলছ তুমি? দরজা বন্ধ করছ কেন? খাঁচায় বন্দি পাখির মত ছটফটিয়ে ওঠে মেঘনা।

 এই! বেশি ত্যাঁদড়ামি করবি না। যা বলছি শোন? হ্যাঁচকা টানে মেঘনাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে পলাশ।

 না-আ-আ! ছেড়ে দাও? প্রাণপণে বাধা দিতে থাকে মেঘনা।

“তবে রে!” পলাশ মেঘনার হাতটা মুচড়ে ধরে। যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে মেঘনা। আধো অন্ধকারে সে দেখতে পায় পলাশের দুচোখে ধক ধক করছে শয়তানী। তার বুকের ভিতরটা ভয়ে হিম হয়ে ওঠে। তবু মুখে সাহস দেখিয়ে সে বলে, “ভাল হচ্ছেনা! আমাকে যেতে দাও বলছি! না হলে আমি অরুকে সব বলে দোব”। কোনো কথা শোনার মত অবস্থায় পলাশ নাই। সে এক হাতে মেঘনার মুখ চাপা দিয়ে অন্য হাত দিয়ে তাকে জাপ্টে ধরে। মেঘনা তার সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু পেরে ওঠেনা। শরীরের এখানে ওখানে তীব্র দহন অনুভব করতে থাকে সে। ঘেন্নায় তার শরীর রি রি করে ওঠে। সে মিনতি করে,“পলাশদা! আমি তোমাকে নিজের দাদার মত দেখি! আমাকে যেতে দাও! তোমার দুটি পায়ে পড়ি!”পলাশ এক ধাক্কায় মেঘনাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে দেয়। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায় মেঘনা। সে চিৎকার করতে থাকে, “অরু-উ-উ! আমাকে বাঁচা-আ-আ! অরু-উ-উ!”

 ততক্ষণে প্রবল বৃষ্টি নেমেছে। রান্নাঘরের টিনের চালে ঝমঝম আওয়াজে মেঘনার করুণ আর্তি চাপা পড়ে যায়। পলাশের মুঠোবন্দি অসহায় মেঘনা বুঝতে পারে কি হতে চলেছে তার সাথে। তার একটা হাত তখনও মুক্ত। সেই হাত দিয়ে সে মেঝে হাতড়াতে থাকে। হঠাৎ তরকারি কাটা বটিটা  তার নাগালে এসে পড়ে। চকিতে বটিটা তুলে তার শরীরে হুমড়ি খেয়ে পড়া পলাশের মাথায় সজোরে আঘাত করে সে। আচমকা আঘাতে পলাশ উলটে পড়ে যায়। সেই অবসরে মেঘনা দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। তারপর উঠোন পার হয়ে সোজা রাস্তায়। লোডশেডিং হয়ে গেছে। চারদিক ঘোর অন্ধকার। তার উপর ঝম ঝম বৃষ্টি। মেঘনা ছুটতে থাকে। পায়ে পা জড়িয়ে গিয়ে আছাড় খায়। উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছোটে। একসময় সে থামে। শরীরে এক বিন্দু শক্তিও বুঝি অবশিষ্ট নাই আর। সামনে একটা ঝুপড়ি দেখে সেখানে ঢুকে ধপ করে বসে পড়ে সে। লঝমিদের শুয়োরের খোঁয়াড়। ধাড়ি শুয়োরটা তাকে দেখে ঘোঁত ঘোঁত করে ওঠে। তার পর কি ভেবে তার নোংরামাখা শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়ে। বাচ্চাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাদের পাশে  নিজের অর্ধ-নগ্ন দেহটা গুঁজে দিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে মেঘনা।“মা-আ-আ! মা গো-ও-ও! আমি মরে যাচ্ছি-ই-ই”!

লেখক : ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

 

                        

 

 

।                          

 

 

0 Comments

Post Comment