আচার এবং কুসংস্কার

  • 12 August, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1035 view(s)
  • লিখেছেন : রোশন কুমার
‘‌ভয় দেখানো’‌ সংস্কার ও আচারগুলোর বেশিরভাগই মেয়েদের বা মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়ে আসছে। ছেলে সন্তানদেরও এ ধরনের কিছু কথা বলা হয় । তবে সেগুলো ছেলেদের ওপর যত না প্রভাব পড়ে, তার চাইতে অনেক বেশি প্রভাব পড়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে।

আচার ও সংস্কার দুই-‌ই ভালো। তবে আক্ষরিকই ‘‌অতি’‌ আচার অত্যাচার হয় আর সংস্কারের সঙ্গে ‘‌কু’‌ আর ‘‌অপ’‌ যোগে তৈরি হয় সমস্যা! ব্যক্তিগত ভাবে আমার চিরকালই মনে হয়েছে আচারে অতি যোগ আর সংস্কারে ‘‌কু’‌ বা ‘‌অপ’‌ যোগ হওয়ার একটাই মূল কারণ— বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া বা অন্ধ বিশ্বাস। বলা সহজ, কিন্তু করা নয়। ছোট বেলায় আমারও মনে হত কেন অনেক বড়রা ছোটদের কারণ না বলে অদ্ভুত কিছু ভয় তৈরি করে— যেমন ‘‌জুজু আছে’‌, ‘‌ভগবান পাপ দেবে’‌, ‘‌শ্বশুরবাড়ি’‌ দূরে হবে ইত্যাদি — কথা শোনানোর চেষ্টা করেন। এই কথা শোনানো বা আচার-‌ব্যবহার-‌সভ্যতা ইত্যাদি শেখাতে কিছু তো একটা প্রয়োজন, সে ভয় হোক বা বিজ্ঞানসম্মত কারণ। এইখানেই আসে ওই কথা, বলা সোজা, করা নয়। ছোট বাচ্চা থাকলে তাদের অগণিত প্রশ্নের জবাব দেওয়া বা বদ অভ্যাস তৈরি হওয়া আটকানো অত সহজ নয়। দু-‌একটা অযৌক্তিক কথা অভিভাবকদের মুখ থেকে বেরিয়ে যেতেই পারে, তবে সেটা সন্তানদের অল্প বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে না পাল্টালে তৈরি হবে সমস্যা। কারণ? ছোটদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সোজা নয়, আবার তাদের বদ অভ্যাসও তৈরি হতে দেওয়া যায় না, তবে এই যে, বিনা প্রশ্নে যা খুশি শুনলেই মেনে নেওয়ার স্বভাব তৈরি হচ্ছে! সেটাও তো ঠিক হচ্ছে না! 

আমাদের বাংলায় বাড়ির বড়োদের বলা এরকম কোটি কোটি কথা আছে যেগুলোর কারণ থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু ওই সময় ও ধৈর্যের ওভাবে সেগুলো ছাড়াই শুধু মাত্র ভয়ই এগুলো ছোটদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুনতে হয়। সব বাড়িতে এরকম নয়। তবে বেশিরভাগ বাড়িতেই। 

সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যাবে, এই ‘‌ভয় দেখানো’‌ সংস্কার ও আচারগুলোর বেশিরভাগই মেয়েদের বা মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়ে আসছে। ছেলে সন্তানদেরও বলা হয় অনেক এ ধরনের কথা। তবে বলাই যায় যে, সেগুলো যত না তাদের ওপর প্রভাব ফেলে তার চাইতে বেশি প্রভাব পড়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে। মেয়েরা অদ্ভুতভাবে এগুলো পরের প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গেই পুরুষেরাও এইসব বাঁধনগুলোর সুযোগে মহিলাদের গলায় পিতৃতন্ত্রের আরও শক্ত গিঁট বেঁধে দেবে। 

আমার মা কোনোদিন কোনো ধরনেরই এই ‘‌কু’‌ বা ‘‌অপ’‌ সংস্কার শেখাননি। কোনোদিন কোনো আচারের কথাও তোলেননি। মানে ওই ‘‌সন্ধ্যে বেলায় এলো চুলে ঘুরতে নেই’‌ ধরনের কথাগুলো। তবে মজার ব্যাপার হল, এই নিয়ে লেখার কথা ভেবেছি শুধু মাত্র আমার দিদার জন্য। আমার দিদা (মায়ের মা) সবসময় কিছু করতে বললে বা কোনো ‘‌আচার’‌ শেখালেই তার সঙ্গে অবশ্যই তার কারণটা বলে দিতেন। দিদার কাছেই শেখা কয়েকটির কারণ বলি। 

‘‌সন্ধ্যে বেলায় চুল খুলে ঘুরতে নেই ভূত ধরে’‌— এই ব্যাপারটা দিদা আমাকে বুঝিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন— বিজলি বাতির ব্যবহার ছিল না আগে, সকালেই রান্না হয়ে যেত সব, সন্ধ্যে নামার আগে চুল আঁচড়ে বেঁধে নিলে কোনো কিছুতে চুল পড়লে সেটা দেখা যাবে। যদি তারপরেও কেউ চুল খুলে রাখে, তার মাথা থেকে খাবারে চুল পড়ার সম্ভাবনা থাকে। আগে তো অত পড়াশোনার বা যুক্তি দিয়ে বোঝার রেওয়াজ ছিল না। তাই ছোট থেকে মেয়েদের এরকম ‘‌ভূতে ধরবে’‌ বলে ভয় দেখানো হত। আরেকটা কথা দিদা বলেছিলেন— ‘‌পা ছড়িয়ে খেতে বসলে শ্বশুরবাড়ি দূরে হয়’‌। খানিকটা ওই চুল বেঁধে নেওয়ার মত একইভাবে ছোট মেয়েদের ভয় দেখিয়ে আচার শেখানোর জন্যই এটারও প্রচলন। তবে এর পিছনের যুক্তিকে বেশ খুলেই বুঝিয়েছিলেন দিদা। বলেছিলেন— যে কেউই পা ছড়িয়ে খেতে বসলে সেটা ঠিক না। দেখতে যেমনটা খারাপ লাগে, তেমনটা আশপাশ দিয়ে কারও যাতায়াতেও অসুবিধা। দূরে শশুর বাড়ির ভয় দেখানো এইভাবেই সৃষ্টি। এর সঙ্গে দিদা একটা মজার কথাও যোগ করেন— ‘‌তোদেরকে এই ধরনের ক্ষেত্রে— বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেব বলে ভয়টা দেখানো যায়।’ 

অবাক লাগে এই ভেবে, আমার দিদা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছিলেন (খুবই ছোট ছিলেন) সেই মানুষটি যদি এইসব সংস্কার আমাকে সব ভেঙে বুঝিয়ে তা কতটা বিজ্ঞানসম্মত আর কতটা শুধুই ভয় দেখানোর চেষ্টা এসব বোঝাতে পারেন, ২০২০-‌তেও কিছু অভিভাবক কীভাবে তাঁদের মেয়েদের ‘‌বেশি পেকে গেলে ব্রণ হয়’ বলেন? আমি জানিনা আমার দিদাকে কেউ এইগুলো ভাবতে বা বুঝতে সাহায্য করেছিলেন কিনা। তবে যদি করেও থাকেন, তারপরেও তো উনি আমাকে না বলতে পারতেন। কিন্তু বলেছেন। তাই আমি গুরুত্ব বুঝেছি, কুসংস্কার বা অপসংস্কার অথবা এইসব আচারের ব্যাপারগুলো শুধু না মানাটাই বড় নয়, এর পিছনের কারণ দেখাটা বড়। কেন এগুলো শুরু হল? আর কেনই বা আমরা আবার এইগুলো ছোটদের বলছি? 

আরেকটা ছোট উদাহরণ। যা থেকে হয়তো বা আরেকটু পরিষ্কার করে বোঝাতে পারবো, কেন বলছি মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ধরনের আচারের বেশিরভাগ সময় কোনো কারণ থাকে না, থাকে মাথামুণ্ডহীন ভয়, এবং সবথেকে বেশি থাকে পিতৃতন্ত্রের চোখ রাঙানি। আমরা অনেকেই ‘‌জন্ম বারে নখ কাটতে নেই’ এটা শুনেছি (আমাকে আমার বাড়ির কেউ বলেনি কোনোদিন)। একদিন এই ব্যাপারটা নিয়ে দিদার সঙ্গে মজার এক আলাপ আলোচনায় দিদাকে বললাম—আচ্ছা, কেনো বল তো এটা বলে অনেকে? দিদা বললেন— এটার কোনো বিজ্ঞানসম্মত অথবা ভয়গত কোনো কারণই ওঁকে কেউ বলেনি, খুঁজেও পাননি তিনি। তারপর মা বলে, ‘‌আরে শুধু তাই নাকি? সন্তানের, স্বামীর জন্মবারেও নখ কাটতে হয় না মেয়েদের, এইরকমই বলে, যারা এগুলো মানে তারা’। আমি খানিক হা করে গিয়ে দিদাকে জিজ্ঞেস করি— ‘‌দিদা, যে মহিলার ৫টা সন্তান আর তাদের আলাদা বারে জন্ম, আর আরেক বারে স্বামীর, আর আরেক বারে তার নিজের, তখন সে কি বন মানুষের মত নখ রেখে ঘুরবে?’ দিদা বললেন— ‘ও, তখন মহিলার নিজের বারটা বাদ দিয়ে দিতে পারেন।’ সঙ্গে এটাও বলেন— ‘‌এগুলো আলোচনা করার দরকার নেই, এগুলোর কোনো মানে নেই।’ বড় হয় কলেজে একদিন একটি মেয়ের মুখে শুনি ‘‌ছেলেদের শুক্রবারে নখ কাটলে শুক্র ক্ষয় হয়।’ আমার জানা নেই এর কী মানে, বা এর পিছনের যুক্তি কী! ছেলেদের একটি দিনেই অসুবিধা, মহিলাদের কিন্তু সন্তান, স্বামী এবং সবশেষে নিজের বারটাও! 

তবে এসব থেকে পরিষ্কার হয়, আচার, সংস্কার শিখতে হবে এবং সামাজিকও হতে হবে। তাই বলে যুক্তিহীন কথা প্রশ্নহীন ভাবে মেনে নেওয়া এবং পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানো দুইই সমান অপরাধ। 

আমার দিদা যদি যুক্তি দিয়ে এগুলোর কাটাছেঁড়া করে থাকতে পারেন, আমরা কেন করবো না? আমাদের মনে রাখতে হবে যেকোনো অযৌক্তিক ভয়ের জায়গাকেই পিতৃতন্ত্র খুব সুন্দর করে ব্যবহার করে, মহিলাদের আরো বেশি করে দমিয়ে রাখতে।‌

প্রতীকী ছবি

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় - শিক্ষার্থী

0 Comments

Post Comment