- 30 August, 2020
- 0 Comment(s)
- 876 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০ আগস্ট, ১৮৭৭। বাংলায় ভাদ্র, ১২৮৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনও ‘গহন কুসুম-কুঞ্জমাঝে’র ললিত সুরের মূর্ছনাতে গুনগুনিয়ে উঠতে পারেননি। তখনও ভানুসিংহের ছদ্মবেশে ধরা দিতে তাঁর দেরি আছে মাসতিনেক। অগ্রহায়ণ, ১২৮৪-তে জোড়াসাঁকোয় তাঁর স্লেটের উপরে তিনি ফুটিয়ে তুলবেন ‘হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ’-এর গান। তার আগেই, ৩০ আগস্ট, ১৮৭৭ তরু চলে গেল। কলকাতায় সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল কি না জানা নেই কারোর, কেবল দিদি অরু-র মৃত্যুর পরে লেখা তরু-র কথাতে কথা মিলিয়েই আমরাও সেদিন বলতে পারতাম বোধহয়, “Of all sad words of tongue and pen/ The saddest are these – it might have been” ...
নারীর কথা নিয়ে অনেকে লিখেছেন, অনেকে বলেছেন। কিন্তু নারীর মুখে নিজের কথা, নারীত্বের কথা, নারীর কলমে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির মহীয়সী নারীদের বর্ণনা উঠে আসা, এই সবকিছুই যে-সময়ে প্রায় অবাস্তব কষ্টকল্পনা বলে মনে হত, ঠিক তেমনই একটা সময়ে আমরা তরুলতাকে পেয়েছিলাম। সে থাকলে আজ ...
আবার, হয়তো-বা একেকটা সময়ে মনে হয় – সে যেন বা না-থাকার জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছিল। হয়তো-বা সে জানত, আমরা তাকে মনে রাখব, মৃত্যুর পরে – জন্মের সার্ধশতবর্ষের পরেও।
প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধি একবার একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, এভাবে প্রত্যেক মানুষের অ্যানিভারসারি পালন করার পিছনে কোনও সদর্থক যুক্তি নেই। বরং সেই অ্যানিভারসারিগুলিতে ছুটি না কাটিয়ে, যে মানুষটির সেদিন জন্মদিন বা মৃত্যুদিন, অথবা কোনও অন্য বিশেষ উদ্যাপনের দিন – সেই মানুষটির কৃতকর্মকে যদি সেদিন এবং বাকি বছরের দিনগুলিতেও নিজেদের যাপনে স্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করার সৎ চেষ্টা করা যায়, তবেই সেই মানুষটির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হবে। তরুকে মনে করব, কেবল ভাবের কথায় ভেসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং তরুর স্মৃতিকে মনে রাখব – তার উৎকর্ষের সমকালীন প্রয়োজনেই।
তরু দত্ত (অথবা পিতৃদত্ত নামে তরুলতা দত্ত) কবি, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক – সাহিত্যের অনেক শাখাতেই সে তার প্রতিভার নজির রেখেছিল। কিন্তু ফরাসি গবেষক জেমস ডার্মস্টেটরের কলমে উঠে এল তার প্রতিভার প্রকৃত পরিচয়। ডার্মস্টেটর লিখেছেন, “(তরু দত্ত) বাংলার মেয়ে হয়েও, সে জাতিতে হিন্দু, শিক্ষায় ইংরেজ এবং হৃদয়ে ফরাসী – সে একাধারে ইংরেজী কবি ও ফরাসী গদ্যকার।” এখানে হিন্দু বলতে তরুর ভারতীয় যোগের কথাই গবেষক বোঝাতে চেয়েছেন। ১৮৬২-তে দত্তেরা সপরিবারে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। মনে-প্রাণে খ্রিস্টান হলেও, ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যেও তরুর যে প্রগাঢ় কৌতূহল এবং পড়াশোনা ছিল তার প্রমাণ তার রচনাতেই বারে বারে উঠে এসেছে। তরুর জীবনকাল ২১ বছরের, জন্ম ১৮৫৬ – মৃত্যু ১৮৭৭। ২১ বছর বয়সি আরেক বাঙালি কবিকে নিয়েও আমরা অনেক হইচই করে থাকি বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে তরুর জন্ম সুকান্তের জন্মেরও ৭০বছর আগে। সুকান্ত ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট। আর তরুর কাজের পরিধি বিস্তৃত ছিল বিশ্বসাহিত্যের দরবারে, বিদেশি ভাষাতে। তুলনায় সুকান্ত আমাদের বাংলার বা বাঙালির অনেক কাছের লোক। প্রতিভার তূল্যমুল্য বিচারের দিকে যাব না, কিন্তু তরুর চেয়ে সুকান্তকে আমরা অনেক স্পষ্ট করে চিনেছি একথা সত্যি। তার কারণ অন্যেরা বিচার করুক।
মাঝে মাঝে আমার খুব আপশোস হয় যে আমি প্রথাগত অর্থে সাহিত্যের ছাত্র নই। সাহিত্যের আলোচনাকে সঠিক ভাবে, সঠিক পরিভাষাতে ফুটিয়ে তুলতে গেলে যে ব্যুৎপত্তির প্রয়োজন তা আমার নেই। আমার আলোচনা তাই সম্পূর্ণ ভাবেই মনের, মননের, উপলব্ধির উপরে নির্ভরশীল। তরুর সম্পর্কে আজকের গবেষকেরা বলছেন যে, একটা সময়ে তরুকে কিছুটা ব্রিটিশ প্রভাবিত, কিছুটা ঔপনিবেশিক প্রচারে প্রভাবিত, এমনকি গর্বোদ্ধত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতা পাশ্চাত্যের ব্যথায় সমব্যথী একজন বলে মনে করা হত। এর কারণও হয়তো তরু নিজেই। ১৮৬৯ সালে তরুর পরিবার পাকাপাকি ভাবে ফ্রান্সে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। তরুর পিতা গোবিন চন্দ্র দত্তও ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত পুরুষ। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েদের সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষার ব্যবস্থা করতে। গোবিন চন্দ্রের ইংরেজি কবিতাও সেকালের বিখ্যাত ‘ব্ল্যাকউডস’ ম্যাগাজিনের প্রশংসায় ভূষিত হয়েছিল। গোবিন চন্দ্রের তিন সন্তান, দুই বোন তরু, অরু এবং সবার চেয়ে বড়ো ছেলে অব্জু (জন্ম ১৮৫১)। অব্জুর জীবনও সংক্ষিপ্ত, ১৮৬৫ সালে তার মৃত্যু হয়। ছেলের মৃত্যুর পরেপরেই মেয়েদেরকে সঙ্গে নিয়ে কালাপানি পার হয়ে সুদূর ফ্রান্সের নিস শহরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন গোবিন। এখানেই মেয়েদের শিক্ষার কাজকর্ম শুরু হয়। ফরাসি ইস্কুলে পড়তে পড়তে ক্রমশ ফরাসিকেই তারা বিশেষ ভাবে আপন করে নিতে শুরু করে। ১৮৭০-এ ফ্র্যাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর তরু লিখেছিল, “Not dead, - oh no – she cannot die!/ Only a swoon, from loss of blood” ... তাই কি তরু পাশ্চাত্যের সমব্যথী ? এর উত্তর তরু নিজেই দিয়ে গেছে, তার একটি বিশেষ কবিতায় (যেটি ভীষণই প্রিয় আমার)। সেটিকে আমি আমাদের আজকের আলোচনার অন্তিম বিষয়বস্তু হিসেবে সযত্নে তুলে রেখে দিয়েছি। এখন বরং তরুর অন্য কয়েকটি কবিতার শিরোনামের দিকে চোখ ফেরানো যাক।
১৮৫৪-তে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন ‘শকুন্তলা’, ১৮৬০-তে ‘সীতার বনবাস’। সহজবোধ্য বাংলায় প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের নারীসত্তাকে বিশেষ ভাবে তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন। তার অনেক আগেই, তরু লিখল সাবিত্রীর কথা। অবশ্য তরুর রচনা ছিল ইংরেজিতে। আম-বাঙালির কাছে সে লেখা পৌঁছোলো না। দুর্ভাগ্য তরুর, জীবিতকালের মধ্যে তার রচনাগুলির প্রায় কোনোটিই প্রকাশের আলো দেখেনি। কেবল বেরিয়েছিল একটি অনুবাদের বই, যার নাম “আ শিফ গ্লিনড ইন ফ্রেঞ্চ ফিল্ডস”। সে আলোচনায় পরে আসছি। সাবিত্রীতে তরু লিখল সাবিত্রী-সত্যবানের উপাখ্যান। সাবিত্রীর সৌন্দর্য বর্ণনায় সে কোনোরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গেল না। একজন পুরুষ যেভাবে একজন নারীকে দেখে বা এতটাকাল ধরে দেখে এসেছে, সেই একইরকমের বর্ণনা। টানাটানা চোখ, গভীর কেশ, সদ্যফোটা পদ্মের ন্যায় সুন্দর – ইত্যাদি চিরকালীন অতিকথন। সাহসের প্রথম পরিচয় দেখা দিল সত্যবানের সঙ্গে সাবিত্রীর পরিচয়ের পর। যেখানে সাবিত্রী নিঃসংকোচে তার পিতাকে জানাল যে সে সত্যবানকে ভালবেসেছে। সে বলেছে যে সত্যবানের দিকে চেয়ে থাকতে তার ভালো লাগে। তাকে মনে মনে কাছে পেতে ভালো লাগে। সবশেষে মৃত্যুর বিপক্ষে দাঁড়িয়েও সাবিত্রীর সংগ্রাম, যমের কাছ থেকে সে জিতে আনবেই সত্যবানের জীবন। সতীদাহের ভারতবর্ষে, স্বামীর মৃত্যুতে কাতর হয়ে ভেঙে পড়াটাই যেখানে নারীর একমাত্র পরিচয় বলে গণ্য হত – সেই ভারতবর্ষের মানুষ হয়েও তরু তার কবিতার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল সাবিত্রীকে, যে অসহায় অবস্থায় প্রাণত্যাগ করেনি – বরং স্ত্রী হয়েও স্বামীকে উদ্ধার করে আনার প্রশ্নে জীবনপণ করেছিল। সেই পুরুষশ্রেষ্ঠতার যুগে দাঁড়িয়ে সাবিত্রীর কথা বলতে চাওয়াটাও যে মৌলিক প্রচেষ্টার উদাহরণ। তরু তাই সাহসের সঙ্গে লিখেছিল,
“As for Savitri, to this day
Her name is named, when couples wed,
And to the bride the parents say,
Be thou like her, in heart and head.”
মস্তিষ্ক এবং হৃদয় – নারীর যে কেবল হৃদয় নয়, বুদ্ধিও রয়েছে – স্বাধীন চিন্তার অধিকার রয়েছে, কত সহজে তরু সেকথা লিখেছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে। আজও সেই অধিকারকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত।
সীতাহরণের সময় মারীচের জাদুতে বিভ্রান্ত হয়ে লক্ষ্মণের প্রতি সীতার তিরস্কারকে মনে রেখে তরু লিখল ‘লক্ষ্মণ’। নিজের বাবাকে নিয়ে সে লিখেছিল, ‘আ মঁ প্যার’ (আমার বাবাকে)। তরু লিখেছিল ‘আওয়ার ক্যাসুরিনা ট্রি’র মতো কবিতা। ইংরেজিতে কবিতার পাশাপাশি, ফরাসি ভাষাতেও সে লিখে ফেলল ‘কুমারী দারভেরের জার্নাল’-এর মতো উপন্যাস। এরপর ফের সে ইংরেজিতেও লিখতে শুরু করেছিল ‘বিয়াঙ্কা অর দ্য স্প্যানিশ মেডেন’ নাম্নী আরও একটি উপন্যাস, যেটিকে সে অবশ্য শেষ অবধি সমাপ্ত করে যেতে পারেনি। মৌলিক কবিতা-উপন্যাস রচনার পাশাপাশি, প্রবন্ধ এবং অনুবাদের জগতেও তরু ছাপ রেখেছিল। মূল ফরাসি থেকে সে ক্লারিস বাদেরের রচনা ‘প্রাচীন ভারতীয় নারী’ বইটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে চেয়েছিল। ফরাসি থেকে তরু ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিল ভিক্টর হুগো, শার্ল বোদল্যের, ভলতেয়ার, লামার্তিন সহ অজস্র কবির রচনা। এমনকি স্যুলি প্রুদম, তখন তিনি তরুণ এবং সবেমাত্র লেখার জগতে এসেছেন – তরু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতাও ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিল। তরু চলে যাবার পর অনেকগুলি বসন্ত পেরিয়ে, ১৯০০ সালের কোনও এক সময় – এই স্যুলি প্রুদমই পৃথিবীর প্রথমজন হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পাবেন। তরু কি সে কথা টের পেয়েছিল কোনোদিন ? তরু বলে যায়নি আমাদের।
তরুর জীবদ্দশায় প্রকাশিত তার একমাত্র বইটি ছিল অনুবাদের, “আ শিফ গ্লিনড ইন ফ্রেঞ্চ ফিল্ডস” – বিভিন্ন ফরাসি কবির ১৬৫টি কবিতার অনুবাদ, এরমধ্যে ১৫৭টি কবিতাই সে নিজে অনুবাদ করেছিল। বাকি ৮টি কবিতায় দিদি অরুর অবদান রয়েছে। এ ছাড়াও, এই বইটিতে রয়েছে তরুর কলমে প্রায় ৪০পাতার একটি তুলনাত্মক আলোচনা, এই সমস্ত কবি এবং তাঁদের কবিতার বিষয়ে। তরুর দৃষ্টিতে, তরুর চিন্তায় অবাক হতে হয়েছিল পাঠকবর্গকে। তরুর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় তার কলমে “এনশিয়েন্ট ব্যালাডস অ্যান্ড লেজেন্ডস অব হিন্দুস্তান”, একদিন যার ভূমিকা লিখবেন কবি এডমন্ড গস। ভারতীয় সংস্কৃতিকে নিজের ভিতরে রসিয়ে নিয়েছিল তরু, সে কি সত্যিই ঔপনিবেশিক!
বিলেত থেকে সপরিবারে দেশে ফিরেছিলেন গোবিন চন্দ্র। তাঁরা তখন থাকতেন রামবাগানের ১২নম্বর মানিকতলা স্ট্রিটের ঠিকানাতে। বাগমারিতে তাঁদের একটি বাগানবাড়ি ছিল। সেই বাগানেই তরু গড়ে তুলেছিল তার স্বর্গোদ্যানের জগৎ। বিলেত থেকে যে রকমারি ফুলের বীজ নিয়ে এসেছিলেন তরুর মা, সেগুলিকে বাগমারির বাগানে ফুটিয়ে তোলাতেই ছিল তাদের সুখ, অরুর আর তরুর। ফরাসি পাউরুটির নামে নাম মিলিয়েই তরু তাদের বেড়ালের নাম রেখেছিল বাগেৎ। পোষা ঘোড়াদুটির কপালেও জুটেছিল দুটি ফরাসি নাম, জানেত এবং জাঁতিই। গবেষক চিন্ময় গুহ-র রচনা থেকেই এই তথ্যগুলিকে সাজিয়ে দিলাম। ১৮৭৪-এ অরুর মৃত্যু তরুকে আরও অনেকটা একলা করে দিল। তরুর সময় ফুরিয়ে আসছিল, হাতে আর বেশি সময় ছিল না তার।
তরুর কবিতা “বাগমারি” – পেত্রার্কান এবং স্পেনসেরিয়ান দু-ধরনের সনেটের বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে লিখিত একটি রচনা, যেখানে বাইবেল বর্ণিত ইডেনের স্বর্গোদ্যানের আদলে তরু তুলে এনেছে তাদের বাগমারির বাগানটিকে, আশ্চর্য দক্ষতায়। সেখানে সে ইডেনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ব্রিটিশ বা ফরাসি বাগানের কথা বলতে চায়নি। যা কেবল একঘেয়ে একরঙা সবুজের মতো – বরং সে বলতে চেয়েছে বাগমারির বাগানে, তাদের একেকটি প্রাচ্যদেশীয় বাগানের রঙের বৈচিত্রের কথা। কচি সবুজ তেঁতুল পাতার কথা সে বলেছে। বলেছে ঘনরং আমপাতার কথাও। সুউচ্চ থামের মতো উঠে যাওয়া ধূসরবরণ তালগাছের কথা সে লিখেছে, লিখেছে ঋজু শিমূলের টকটকে রাঙাবরণ ফুলের কথাও। রঙের সেই ঝরনাতলায় হঠাৎ যেন কার ট্রাম্পেটের আওয়াজ। লালরং যেন কখন রূপকে ব্রিটিশ কোম্পানির ভয়-পাওয়ানো পোশাকটাকেই মনে পড়িয়ে দিয়েছে। তাই বুঝি তরু সেই ট্রাম্পেটের আওয়াজকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। তাকে সে রেখেছে তার বাগানের বাইরেটায়। ঘনসবুজ, হালকা সবুজ, নানারঙের তার এই স্বর্গোদ্যানের অভ্যন্তরটিতে কোনও কবি ছাড়া ‘অ’কবিদের যে প্রবেশ নিষেধ।
১৮৭৭-এর ৩০ আগস্ট, যক্ষার সঙ্গে তরুর লড়াই ফুরলো। ২১ বছরের সেই অন্য বাঙালি কবিটির মতোই, তরুরও প্রাণ কেড়েছিল সেই একই রোগ। রাজরোগের কবলে পড়ে রাজরানির মতোই তরু চলে গেল, অনন্ত বসন্তের দেশে। সে দেশের কবিতাকেও সে আর অনুবাদ করে পাঠাল না। তরুদের মত একেকজনের জন্য, সহস্র বছরের অপেক্ষাও বোধহয় যথেষ্ট নয়। আরও একটু সময় কি দেওয়া যেত না তরুকে? সরোজিনী নাইডু অথবা ঘরের মানুষ আশাপূর্ণা-মহাশ্বেতাদের চেয়েও, অনেকবছর আগেকার সেই ফরাসি দেশকে ভালোবেসে ফেলা, মনেপ্রাণে আন্তর্জাতিক উচ্ছল সেই কিশোরীকে, কবিকে - আমরাও বোধ করি আরেকটু ভালো ভাবে ভালবাসতে পারতাম তখন। তরুর কথাতেই,
“Of all sad words of tongue and pen/ The saddest are these – it might have been” ... ভাল থেকো তরু, তোমার কখনও বয়স হবে না আর।
ঋণস্বীকারঃ
[১] নাতালি এ. ফিলিপস, ‘ক্লেমিং হার ওন কনটেক্সটসঃ স্ট্র্যাটেজিক সিঙ্গুল্যারিটি ইন দ্য পোয়েট্রি অব তরু দত্ত’, নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি জেন্ডার স্টাডিজ, ইস্যু ৩.৩, ২০০৭
[২] চিন্ময় গুহ, ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’, সিগনেট প্রেস, ২০১৬
ছবি : সৌজন্য : উইকিপিডিয়া
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment