- 23 September, 2023
- 0 Comment(s)
- 319 view(s)
- লিখেছেন : সুমিতা মুখোপাধ্যায়
W. Adams - এর ১৮৩৬ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত Second Report on state of Education in Bengal থেকে জানা যায় যে,-women followers of the 16th century Vaishnav saint Shri Chaitanya, were literate. ধর্মচর্চায় সমানাধিকারের মতোই বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গীয় বৈষ্ণব আন্দোলন কোনরকম লিঙ্গবৈষম্য না করেই স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। অধ্যাপক গবেষক শুভময় ঘোষ তাঁর “প্রাগাধুনিক বাংলাসাহিত্যে চৈতন্য-আন্দোলন ও বঙ্গনারী” গ্রন্থে লিখলেন, “বরং, এ ধর্মে ‘আধ্যাত্মিক গনতন্ত্র’-এর যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ধর্মের মতো শিক্ষার ক্ষেত্রেও তত্ত্বগতভাবে নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। ফলে এই উদার আন্দোলনের হাওয়ায় ষোড়শ শতকের শেষেই বৈষ্ণব সমাজে, পরিবারে তৈরি হয়ে যায় স্ত্রী সাক্ষরতা ও শিক্ষার একটি বাতাবরণ।” আসলে বৈষ্ণবধর্মে যেহেতু মেয়েরাও গুরুকৃত্য করতে পারতেন তাই তাঁদের জন্য শিক্ষা ও শাস্ত্রজ্ঞান আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। তাই ষোড়শশতক থেকেই বৈষ্ণবসমাজে বহু বিদূষীর দেখা মেলে। প্রতিনিয়ত জ্ঞানচর্চায় নিরত বৈষ্ণবী এই প্রাসঙ্গিকতার অনুষঙ্গে প্রথমেই যার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তিনি হলেন ষোড়শ শতকের সীতাদেবী, শ্রীনিবাস আচার্যের স্ত্রী। তাঁর সভানেতৃত্বে ঐ সময়ে বিষ্ণুপুরে পাঁচহাজার বৈষ্ণব মহিলাদের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলন ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি তাঁর দুই কন্যা যথাক্রমে হেমলতা ও কৃষ্ণপ্রিয়া-কে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে হেমলতাদেবী শ্রীনিবাস আচার্যের মালিহাটি বৈষ্ণব শ্রীপাট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। যথেষ্ঠ উচ্চশিক্ষিত না হ’লে হেমলতাদেবীর পক্ষে এ গুরু দায়িত্ব পালন করা সম্ভব ছিল না। মহাপণ্ডিত কবি যদুনন্দন হেমলতাদেবীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বাঁকুড়ার সোনামুখি থেকে তাঁর লেখা মানবীবিলাস কাব্য গ্রন্থটি পাওয়া গেছে। হেমলতার মতোই বিদ্যাচর্চায় পারদর্শিনী ছিলেন তারই ভ্রাতৃবধূ সত্যভামা। নিত্যানন্দপত্নী জাহ্নবাদেবীর সংস্কৃত ও বাংলা এই দুই ভাষাতেই ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। প্রথমবার বৃন্দাবন ভ্রমণকালে তিনি শ্রীরূপ গোস্বামীর সঙ্গে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করেছিলেন। বর্ধমানের পরম বৈষ্ণব নারায়ণ দাসের কন্যা রূপমঞ্জরী আজীবন অবিবাহিত থেকে বৈষ্ণব পিতার ইচ্ছায় ব্রাহ্মণ বৈয়াকরণিকের টোলের ছাত্রদের সঙ্গে গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাচর্চা করেছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রসহ নানা শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের জন্য পরবর্তীকালে তিনি ‘হটু বিদ্যালঙ্কার’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। অধ্যাপক গোকুলানন্দ তর্কালঙ্কারের কাছে একসময় তিনি সাহিত্য ও পরে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। অনেকেই আগ্রহের সঙ্গে তাঁর কাছে ব্যাকরণ, চরক, নিদান প্রভৃতি অধ্যয়ন করতে আসতেন। খ্যাতনামা কবিরাজরা তাঁর কাছে উপদেশ গ্রহণ করতেন। গগন চন্দ্র হোম ১৮৯০ সালে ‘সখা’-য় প্রকাশিত তাঁর “হটু বিদ্যালঙ্কার” প্রবন্ধে এক জায়গায় লিখেছেন, “জানিনা, বৈষ্ণবসন্তান বলিয়া এরূপ হইয়াছিল কি না।” এই সময় উইলিয়াম এডামের রিপোর্ট বলছে, নাটোরে এমন প্রচুর বৈষ্ণব পরিবার ছিল যারা স্ত্রীশিক্ষার প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। কালক্রমে দেখা যায় শিক্ষানুরাগের পথ ধরে বৈষ্ণবসমাজে একাধিক মহিলা কবির আবির্ভাব ঘটেছে, যেমন রসময়ী দাসী, ইন্দুমুখী, মাধুরী প্রমুখ। এই সময় বৈষ্ণবমেয়েরা অনেকেই বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীন জীবিকার্জনের তাগিদে অথবা নিছকই বিদ্যানুশীলনের টানে বাংলা ও সংস্কৃত পুঁথি নকল করতেন। এদের বলা হোতো লিপিকার। এ কাজে মহিষী ধ্বজামণি পট্ট মহাদেবীর পাশাপাশি অতি সাধারণ গৃহস্থ থেকে উঠে এসেছিলেন মুক্তকেশী বসু জায়া, রাসসুন্দরী দেবী, কৃষ্ণমণি দাসী, জয়ন্ত দেবী, প্রিয়ারী দাসী ও নবু বেউশ্যা। বেশ্যাবৃত্তির মতো পেশায় নিয়োজিত থাকলেও বৈষ্ণবসমাজ কিন্তু তাকে বিদ্যাচর্চা ও লিপিকার হিসেবে স্বাধীন জীবিকার্জনের ক্ষেত্রে কোনভাবে বাধা তো দেয়ই নি বরং তাঁকে উদ্বোধিত করেছে। স্বভাবতঃই এখান থেকেই বৈষ্ণবীদের মধ্যে বিদ্যাচর্চার সাথে স্বাধীন জীবিকার্জনের একটা প্রসঙ্গ কিন্তু উঠে আসছে।
অনুমান করা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই বৈষ্ণবমেয়েরা অনেকেই সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারের অন্দরমহলের অন্তঃপুরিকাদের শিক্ষাদান করে এঁরা নিজেদের জন্য এক-ধরনের স্বাধীন জীবিকার পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। সেই সময় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের গৃহেই বিদ্যাশিক্ষাদানের স্বল্প আয়োজন করা হোত এবং শিক্ষারভার মোটামুটিভাবে শিক্ষিত বৈষ্ণবীদের ওপরই ন্যস্ত থাকত। এমনই একজন বৈষ্ণবী শিক্ষয়িত্রী হলেন মথুরা দাসের কন্যা লালমুণি বৈষ্ণবী ওরফে লালমণি দাস। তিনি পেশায় ছিলেন একজন গৃহ শিক্ষিকা। ১৮৩৪-৩৫-এ তিনি “হাল-সহর-বাঁকুড়া”-র অস্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। আবার পুরুলিয়া সদরেও বৈষ্ণবীর অস্থায়ী মোকামের সন্ধান পাওয়া যায়। যা দেখে অনুমান করা যায় তিনি সম্ভবতঃ পেশাদার ধর্ম শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তাঁর স্বহস্ত লিখিত একটি পুঁথিও পাওয়া গেছে, “ভ্রমরগীতা। যদুনাথ দাস”। অনুলেখনের শেষে লেখা আছে, লিপিকর-শ্রীমতী লালমুণি বৈষ্ণবী।
উনবিংশশতকে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির যে একটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “আত্মজীবনী”-তে সেকালের অন্তঃপুরের শিক্ষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শিক্ষিতা বৈষ্ণবীদের দিয়ে স্ত্রীশিক্ষা দানের যে প্রবণতা ছিল সে সম্পর্কে একটা পূর্ণ আভাস দিয়েছেন।
“মা গোঁসাই ছাড়া আর এক শ্রেণির বৈষ্ণবী শিক্ষয়িত্রী সে যুগে পরিবারে পরিবারে গমন করিয়া মেয়েদের লেখাপড়া শিখাইতেন। দ্বারকানাথের পরিবারেও তাহা করা হইত......তাঁহারা প্রতিদিন পড়াইতে আসিতেন, অনেকসময় ছাত্রীদের বাটীতেও থাকিতেন। এই সকল বৈষ্ণবীয় শিক্ষাদান কেবল বাংলায় শেষ হইত না, তাঁহারা সংস্কৃত ও বৈষ্ণব স্তবগুলিও অর্থের সহিত শিক্ষা দিতেন।”
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা সৌদামিনীদেবী ১৩১৮, প্রবাসী পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’-তর্পনে লিখলেন,
“আমাদেরও প্রথম শিক্ষা একজন বৈষ্ণবীর নিকট হইতে। তাহার কাছে শিশুপাঠ পড়িতাম,এবং কলাপাতাতে চিঠি লেখা অভ্যাস করিতাম। ক্রমে তাহার কাছে রামায়ন পড়া পর্য্যন্ত আমাদের অগ্রসর হইয়াছিল। এমন সময় পিতৃদেব সিমলা পাহাড় হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমাদের শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে মন দিলেন। কেশববাবুদের অন্তঃপুরে মিশনারি মেয়েরা পড়াইতে আসিত। আমাদের শিক্ষার জন্য পিতা তাহাদিগকে নিযুক্ত করিলেন।” বৈষ্ণবীরা ঠাকুর বাড়িতে আসতেন মূলতঃ অন্তঃপুরে চারদেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ মহিলাদের জন্য, বিশেষতঃ বালিকা নববধূ ও বিবাহিতা কন্যারা এই শিক্ষিতা বৈষ্ণবীদের কাছেই নিয়মিত বিদ্যাচর্চা করতেন। এ প্রসঙ্গে গৌরি-বৈষ্ণবীর কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যে তার ব্যুৎপত্তিগত দক্ষতার কারণে একসময়ে তিনি ঠাকুর পরিবারের অন্দর-মহলে মহিলাদের গৃহশিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্নকুমারীদেবী তার শৈশবের স্মৃতিচারণায় তাঁর চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।
“প্রতিদিন গয়লানী যেমন দুগ্ধ লইয়া আসিত, মালিনী ফুল যোগাইত, দৈবজ্ঞ ঠাকুর পাঁজি পুঁথি হস্তে দোইনিক শুভাশুভ বলিতে আসিতেন, তেমনি স্নানবিশুদ্ধা, শুভ্রবসনা, গৌরী বৈষ্ণবী ঠাকুরানি বিদ্যালোক বিতরণার্থে অন্তঃপুরে আবিভূর্তা হইতেন। ইনি নিতান্ত সামান্য বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্না ছিলেন না। সংস্কৃত বিদ্যায় ইহার যথেষ্ঠ বুৎপত্তি ছিল, অতএব বাংলা ভাল জানিতেন ইহা বলা বাহুল্য.........তখন বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় হয় নাই। বৈষ্ণব ঠাকুরানি যে পুস্তক হইতে বর্ণবোধ করাইতেন, তাহার নাম শিশুবোধক......অক্ষরমালা, বানান, দেবদেবী-বন্দনা,যামবর্ণনা, লিপিলিখন-প্রণালী-এ সমস্তই এই একখানি পুস্তকের মধ্যে স্তূপীকৃত।”
এই সময় মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত হিন্দু বিত্তশালী ব্যক্তি আন্তরিকভাবেই স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে গোপনে নিজেদের বাড়িতে স্ত্রীশিক্ষা দানের ব্যবস্থা করেন, যেমন প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ শিক্ষিত বৈষ্ণবীদের অন্দরের গৃহশিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন । এমন কি রাজা শিবচন্দ্র রায়বাহাদুরের কন্যা, “হরসুন্দরী দাসী পঞ্চবর্ষীয়া কালে কিশোরী বৈষ্ণবীর নিকট অক্ষর শিক্ষা করেন,...”। এদের পাঠদানের বিষয়বস্তর মধ্যে থাকত ‘রামায়ন’, ‘মহাভারত’,ও পুরাণাশ্রিত নানাধরণের পৌরাণিক গল্প।
উনিশশতকে এই স্বাধীন বৃত্তি অবলম্বনকারী বৈষ্ণবীদের সাংস্কৃতিক জগতেও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল । উপনিবেশিক সংস্কৃতির ছত্রচ্ছায়ায় শহর কোলকাতায় ক্রমবর্ধমান "জনপ্রিয় সংস্কৃতি"-র যে ধারণা ব্যাপকতা লাভ করেছিল সে ক্ষেত্রেও লক্ষ্যনীয় – “ The literary compositions of women found their way into most of the main forms of the popular culture”, প্রসঙ্গত বলা যায় , এই Women - দের একটা অংশই ছিল সঙ্গীতে পারদর্শিনী একদল বৈষ্ণবী, যারা জনপ্রিয় ধর্মীয় সঙ্গীতের ( কীর্ত্তন, পাঁচালী, কবিগান, রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক ধর্মীয় প্রেমগীতি ) ধারাটিকে যথার্থ ভাবেই জনপ্রিয় করে তুলেছিল । বিশেষতঃ রাধাকৃষ্ণের প্রেমগীতির এক ব্যাপক জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায় সেই সব মহিলা-মহলে, যারা উনিশ-শতকের কোলকাতার রাস্তায়, বাজারে, কোনো জনবহুল অঞ্চলে অথবা গ্রামবাংলার পথেঘাটে গান গেয়ে রোজগার করত । “বোষ্টম-বোষ্টমী-রা গ্রামে-নগরে ভিক্ষা করেন, নাম গান করেন,গাছতলায় বসে ভিক্ষা করেন”- উনিশ-শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শহর কোলকাতায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভূক্ত নারীকূলের এক অংশ জীবনধারণের জন্য এই মাধুকরী বা ভিক্ষাবৃত্তিকেই তাদের স্বাধীন পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই নারীকূলই সমাজে আবার ‘বোষ্টমী’ অথবা ‘নেড়ী’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন । ১৮২৬ সালে ''সমাচার দর্পন" পত্রিকায় প্রকাশিত একটা খবর, “...... ঐ (কৈকালা) গ্রামনিবাসি শ্রীযুত কৃষ্ণকান্ত দত্ত নামক এক ব্যক্তির বাটীতে সরস্বতী পুজোপলক্ষে কলিকাতা হইতে গোলকমনি ও দয়ামনি এবং রত্নমনি প্রভৃতি তিন দল নেড়িকবি গান করিতে আসিয়াছিল......”। একদা বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের ‘নেড়া-নেড়ী’ বলে বিদ্রুপ করলেও এই নেড়ি কবিদের দাপটেই একসময় পুরুষ কবিওয়ালারা বিপর্যস্ত হয়েছিলেন । সেই সময়ে এই নেড়িকবিদের নাচ ও গান শহুরে সংস্কৃতিতে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে পেশাগত প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত পশ্চাদ্পদ পুরুষ-কবির দল এদের প্রতি একদিকে যেমন প্রবল ঈর্ষাপরায়ন হয়ে উঠেছিলেন, অন্যদিকে পেশা থেকে উৎখাত হয়ে যাবার ভয়ে সরকারি সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিল। ‘সকের কবিবিষয়ক’ প্রসঙ্গে ভবঘুরে মুচে ডোম কবিওয়ালা ১৮২৮-এর ২২শে নভেম্বর ‘সমাচার দর্পন’ পত্রিকায় যে চিঠি লিখলেন তার প্রতিলিপি থেকেই এ তথ্যের সত্যতা উঠে আসে, “...... সংপ্রতি আমাদিগের অন্ন কতকগুলিন বিশিষ্ট সন্তানেরা মারিয়াছেন যেহেতুক ইঁহারা সকের কবির দল করিয়া বিনামূল্যে অন্যের বাটীতে বেতনভুক্ত কবির দল হইতে অধিক পরিশ্রম করিয়া নৃত্য গীতাদি করেন সুতরাং আমাদিগকে লোকেরা আর ডাকে না আমাদিগের উপরে এইরূপ দৌরাত্ম্য আর একবার নেড়ী বৈষ্ণবীরা করিয়াছিল অর্থাৎ তাহারা প্রায় সকল পরবে লোকের বাটীতে নাচিয়া কবি গাহিত কিন্তু তাহা সদরে কোন উপায় করিয়া নেড়ীর দায় হইতে প্রায় রক্ষা পাইয়াছি......।” অন্দরমহলেও বৈষ্ণবীদের অধীত সঙ্গীতবিদ্যার সমাদরের খবর পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের "বিষবৃক্ষ" উপন্যাসে । উনিশ-শতকে হিন্দু রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতার প্রসঙ্গটি সবসময়ই একটা তীব্র বিতর্কের অবতারণা করেছে । এর পক্ষে-বিপক্ষে প্রবল বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও, মেয়েদের স্বাধীন পেশা অবলম্বন ও স্বাধীন জীবন-যাপনের আধুনিক মনস্কতাকে কখনই সমাজ নিঃশর্তভাবে সমর্থন করে নি। স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার অনিবার্যতা উপলব্ধ হলেও তার বিস্তার বা ব্যাপকতা ছিল একান্তভাবেই পুরুষ-সমাজের স্বেচ্ছাধীন ও সীমাবদ্ধ। এরই পাশাপাশি সমাজের অন্দরে চলতে থাকা ক্ষমতায়নের রাজনীতি সবসময়ই চেয়েছে বিপরীত লিঙ্গ-কে তার অধীনে রাখতে, রক্তচক্ষু দাবি করেছে নিঃশর্ত আনুগত্যের ।
মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের এই পরিশীলিত অধ্যায়ের সঙ্গে জুড়ে গেছে ধর্মীয় শ্রেণীবৈষম্যের আর এক জটিল বিন্যাস। রক্ষনশীল হিন্দুসমাজে ‘বৈষ্ণধর্ম’ জাতিচ্যুত, সমাজ বর্হিভূত নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক মানুষের ধর্ম বলেই বিবেচিত হত। “ অজ্ঞাত বৈষ্ণবরা বাইতি, ভুঁইমালি, ধোবা, দোয়াই, ডোম, গঁড়ি, জেলে-কৈবর্ত, মালো, কাঁদরা, পোদ, রাজওয়ার, শুঁড়ি তিয়র প্রভৃতি তথাকথিত নিম্ন জাতিদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন।”। শুধু তাই নয় The census of India, Bengal 1872, এর রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ---- The followers of Vaishnavism....open their arms to those who are rejected by all others --- the outcastes, the crippled, the diseased and the unfortunate. এমন কি, “কুলীন ঘরের অবহেলিত-বউ,বালবিধবা, কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবারের বর্ষীয়সী মেয়েদের মতো অনাথিনীদের সঙ্গে সঙ্গে কুলত্যাগিনী, বৃদ্ধা বারাঙ্গনা প্রভৃতি যে সব মহিলারা সমাজের কোথাও স্থান পেতেন না, তাঁরা আশ্রয় পেতেন বৈষ্ণব আখড়ায় ”, আর বারাঙ্গনাদের বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হতে দেখে একসময়ে সবচেয়ে বেশি কটাক্ষ করেছিলেন সমাজতাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ পন্ডিত যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। এ যে কেবল শহর কোলকাতার চেনা ছবি তা নয়, পাশাপাশি গ্রামবাংলার ছবিটাও ছিল প্রায় একই ধাঁচের। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে কুলীন বিধবা, বিবাহিত অথবা অবিবাহিত মেয়েরা গৃহত্যাগ করে বৈষ্ণবদের আখড়ায় স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছে । “Widows, married as well as unmarried women deserting their homes to join some vaishnavite akhara or monastery. Here religious norms allowed them a freedom of movement, an access to all corners of society, both high and low and a certain liberty in their relation with men , privileges which were out of reach for rich and middle class Bengali women of the time. Many of this vaishnavite went around singing and begging from door to door.” এ কথা বলাই যায় যে স্ব-নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের তীব্র বাসনায় মেয়েরা গৃহত্যাগী হয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে বৈষ্ণবীয় ধর্মচেতনার উদার প্রাঙ্গণে।
তবে পরিণতি যে সবটুকুই ইতিবাচক এমনটা কখনই বলা যায় না। এটাও অনস্বীকার্য যে কতগুলো ক্ষেত্রে বৈষ্ণবীয় উদারনৈতিক রসতত্ত্ব এক ধরনের দৌশ্চারিত্র্যের মৌল কারণ হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণবীদের freedom of movement অনেক সময়ই স্বেচ্ছাচারিতার চেহারা নিয়েছে। শোনা যায়, প্রাচীন গৌড়ে, রাজশাহীর খেতুরিতে, ও নারায়নগঞ্জের কাছে লাঙ্গলবন্ধের মেলায় একটা নির্দিষ্ট জায়গা বোষ্টম-বোষ্টমীদের ‘প্রেমতলা’ নামে চিহ্নিত করা থাকত । সেখানে ‘ফৌজদার’-কে পাঁচসিকি দক্ষিণা দিলেই একজন বোষ্টম একজন বোষ্টমী লাভ করতে পারত। অন্যদিকে পাঁচসিকা দক্ষিণা দিয়েই আগের বোষ্টমীকে ত্যাগ দিয়ে নতুন বোষ্টমীর সঙ্গ করা যেত । “বোষ্টমী-বর্জন এবং গ্রহণ সহজ ব্যাপার ছিল;......তাঁরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ধার ধারতেন না ।” ডঃ সুশীল কুমার দে সঙ্কলিত প্রবাদ বিষয়ক গ্রন্থটি থেকে কয়েকটি উদ্ধৃত প্রবাদ এইরকম ,
ক) যুবতীর কোল, শিঙ্গি মাছের ঝোল, মুখে হরিবোল ।
খ) আগে বেশ্যে পরে দাস্যে, মধ্যে মধ্যে কুটনী ।/সর্বকর্ম পরিত্যাজ্য , এখন বোষ্টমী ।।
গ) মাছ খাই না , মাংস খাই না, ধর্মে দিয়েছি মন ।/বৃদ্ধ বেশ্যা তপস্বিনী যাচ্ছি বৃন্দাবন।।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রমাকান্ত চক্রবর্তী মত, “ বস্তুতঃ চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব আদর্শের অধোগতিতেই এ ধরণের অশ্রদ্ধাজ্ঞাপক প্রবাদ প্রবচনের জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। অকারণে এ সমর্থনপুষ্টি লাভ করেছে বলে মনে হয় না” । মুশকিল হল কতিপয় বৈরাগী বোষ্টম-বোষ্টমীদের ব্যাভিচারের দায় গিয়ে চাপল গোটা সম্প্রদায়ের ওপর, বিশেষতঃ বৈষ্ণবীদের ওপর। স্বভাবতই স্বাধীনবৃত্তি অবলম্বনকারী খোলামেলা জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই বৈষ্ণবীরাই হয়ে উঠল সমাজে শিক্ষিত লোকের আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু । অচিরেই বৈষ্ণবী শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল যে, এরা, “ not women of good character ; and if , after receiving a limited education, they become mistress, they will prove injurious to society, instead of doing any good to it......” । উনিশশতকের পঞ্চাশের দশকের গোড়াতেই নতুন নারীশিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তথাকথিত ভদ্রলোকের অন্দরমহল থেকে বৈষ্ণবীদের পাট গেল উঠে । পরিবর্তে অন্দরমহলের মেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য ‘নর্ম্যাল স্কুল’ -এর মত প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হল , যার উদ্দেশ্য ছিল কিছু কিছু বাঙালি মেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের দিয়ে অন্তঃপুরিকাদের পড়ানো। এই সময়ই বেশ কিছু বৈষ্ণবী ‘নর্ম্যাল স্কুল’-এ শিক্ষানবিশি করেন । কিন্তু এই নিয়েও ‘ভদ্রলোক’ সমাজে প্রবল আপত্তি ওঠে । ১৮৬৬ সালে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠি বয়ান ছিল এমনই, “ঢাকায় একটি নর্মাল বিদ্যালয় হইয়াছে, কিন্তু তথায় প্রায় বৈষ্ণবীর সংখ্যা অধিক। আমরা ইহাদিগের অবমাননা করিতেছি না, কিন্তু বলিতেছি, বৈষ্ণবীদিগের উপর সর্ব্বসাধারণের ভক্তি অতি অল্প। এ অভক্তির কারণ আছে, এবং লোকে এই শ্রেণীর শিক্ষকের নিকটে যদি কন্যাগনকে না পাঠান, তাহা হইলে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই। যাঁহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া গৃহের অলঙ্কার , স্বামীর সুখ , সন্তানগনের চরিত্রের আদর্শ হইবে, তাহাদিগের শিক্ষকতা ও শ্রেণীর স্ত্রীলোকের কাজ নহে......বৈষ্ণবীদিগের প্রতি চরিত্রঘটিত আপত্তি আছে....।” হিন্দুরক্ষণশীল সমাজে বৈষ্ণবীদের একধরনের আর্থ-সামাজিক অবরোধে পড়তে হল । পুরুষ-আধিপত্যের গণ্ডি লঙ্ঘন করে বৈষ্ণবীরা স্ব-উপার্জনক্ষম ও স্বাধীন জীবনাচারণে অভ্যস্ত, এ সত্য স্বীকার করা রক্ষনশীল পুরুষ-সমাজের পক্ষে একদিকে যেমন ছিল অত্যন্ত অস্বস্তিকর, তেমনি বৈষ্ণবীদের স্বনিয়ন্ত্রিত জীবনের স্বাধীন-বার্তা পাছে অন্দরমহলের মেয়েদের প্রভাবিত করে তোলে, এ প্রকার দুশ্চিন্তাও যে ছিল না, তাও নয় ! স্বভাবতঃই চরিত্রহীন, ব্যাভিচারী বৈষ্ণবীদের সামাজিক উপস্থিতি হিন্দু রক্ষনশীল সমাজ একেবারেই ভালো চোখে দেখল না। সামাজিকভাবে বৈষ্ণবীরা একঘরে হয়ে গেল। প্রান্তিকরনের এই অসম বিন্যাসের অভিঘাত বাংলা সাহিত্যেও তৈরি করে দিল “ব্যাভিচারী বৈষ্ণবী” চরিত্রের একটা ধরন। উনিশ-শতকের মধ্যভাগ থেকেই বাংলাসাহিত্যে এই বৈষ্ণবীরা এল যৌনব্যাভিচারে অভ্যস্ত একধরনের টাইপ চরিত্র হিসেবে, যাদের জীবন-যাপনের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে থাকে উৎকট যৌনতা আর অনৈতিকতা। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও যে ছিল না তা নয় কিন্তু গুনতিতে তা নগন্য ! বাংলাসাহিত্যে বৈষ্ণবীদের ভূমিকা এই অনালচিত অধ্যায়টি পরবর্তীকালে বিশ্লেষণের জন্য তোলা রইলো।
0 Comments
Post Comment