- 16 September, 2023
- 0 Comment(s)
- 1422 view(s)
- লিখেছেন : সফি মল্লিক
আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রতিটি সাবালক মানুষের যেমন একটি ভোট আছে, তেমনি একটি মতামত আছে। এখন সামাজিক রাজনৈতিক শিবির মোটামুটি আড়াআড়ি ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। এখনো একটা শিবিরে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ কাল্ট ফিগার গড়ে তুলতে সচেতন প্রয়াস প্রতিনিয়ত দেখা যায়। সেখানে যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণ-এর মধ্যে বস্তুবাদের চর্চাকারীদের মধ্যে সূক্ষ্ম অবস্থানভেদে মতানৈক্য থেকে বহু গোষ্ঠীর সৃষ্টি একটি সাধারণ বিষয়। বিজ্ঞান ও যুক্তির শাণিত চর্চার শিবিরে সর্বগ্রাহ্য মতৈক্যে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হিসাবে দেখা দিচ্ছে, তখন বিদ্যাসাগরকে দেখা ও আজকের দিনে তাঁকে স্মরণ করার বহুমুখী মাত্রা থাকা অবশ্যম্ভাবী। ইউরোপে রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লব পেরিয়ে অতিউৎপাদনের সঙ্কট গোটা ইউরোপে যখন ছেয়ে গেছে তখন ইউরোপের অভিঘাত ভারতে এসে পৌঁছায়। পুঁজিবাদের বস্তুবাদী স্বর্ণযুগের মুখ ছিল ইংল্যন্ড, ফ্রান্স। কিন্তু ইউরোপে ধর্মের উপর তাদের কড়া আঘাত উপনিবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে অনেক ধীরে।
নেপলিয়ানের পরাজয়ের সাথে সাথে ১৮১৫ সালে পৌঁছে ইংল্যন্ড তার সমস্ত প্রতিযোগীকে পরাজিত করে একাধিপত্য কায়েম করলো, সেই একচ্ছত্র ইংল্যন্ড জন্মানোর মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই বিদ্যাসাগরের জন্ম। তখন ভারতের সমাজ দ্রুত বদলাচ্ছে, পুরানো কাঠামো হয় ভেঙে যাচ্ছে বা কিছুক্ষেত্রে নতুন ও পুরাতনের সম্মুখ সমর জোরদার হচ্ছে। আজকের দিনেও সামাজিক কাঠামোর দ্রুত কিছু বদলের আভাস ইতিউতি সবদিক থেকেই উঁকি দিচ্ছে। বর্তমান স্থবিরতা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়তো আর সম্ভব নয়। স্থবিরতা ভেঙে সমাজের কিছু একটা পরিবর্তনের চাহিদা সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। যে কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তি যিনি সামাজিক উথালপাথালে কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাঁকে মূল্যায়নের মূলত দুটি কারণ থাকে — ১) সেই সংস্কারের কাজ সমসাময়িক সময়ের বহুমুখী গতিপ্রকৃতির কোন নির্দিষ্ট অভিমুখকে নির্দেশ করে, সেটি সমাজের প্রগতির অনুকূলে হলে তাঁরা মনীষীর মর্যাদা পান, প্রগতির বিপক্ষে হলে খলনায়কের উপাধি পান। ২) সমসাময়িক সময়ে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কী ধরনের বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন ও সেই বাধা বিপত্তি উত্তরণের জন্য কী পন্থা নিয়েছিলেন, কতটা সফল হয়েছিলেন আর কতটা অনাগত ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে রেখেছিলেন বা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য রামমোহন রায়, মাইকেল মধুসূদন বা বিদ্যাসাগরের মত মানুষকে আজও সমাজের বিশেষ কিছু অংশের কড়া সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় পরস্পর বিপরীত শিবিরের সেই সমালোচনার মধ্যে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। যে কোনও ইতিহাস চর্চার মত এই চর্চারও একটাই উদ্দেশ্য অতীতের মনীষীদের অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের সময়টাকে বুঝতে চেষ্টা করা। এই বোঝাবুঝি থেকেও আবার দুই রকম অনুসিদ্ধান্ত হতে পারে।
১) মহাজাগতিক কোনও শক্তিধর মানুষ, ঐশী কোনও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে আসাধ্য সাধন করেছেন — এবং/বা— অতীতের সময়টা খুব ভালো ছিল, এখনকার সমাজ ও মানুষের মধ্যে সর্বত্র এমন পচন হয়ে গেছে যে ভালো কাজ করা সম্ভব না। তাই, মনীষীদের পুজা করে অন্য কোনও মনীষীর আগমনের অপেক্ষা করতে হবে।
২) অতীতের মনীষী বলে যাঁদের আমরা স্বীকার করি তাঁরা নির্দিষ্ট এক ঐতিহাসিক সময়ের ফসল। যাঁরা নিজের সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থেকে যা করেছেন তাকেও পাহাড় প্রমাণ বলা যায়। কিছু সাফল্য এসেছে, কিছু পরবর্তী কালের সাফল্যের সোপান নির্মাণ করে দিয়েছে ও কিছু ব্যর্থতাও আছে।
বাকি এই দুইয়ের বিভিন্ন পরিমাণগত মিশ্রণও আছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতে বিদ্যাসাগরের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু সমাজের চালু রীতিনীতি ও সেগুলির সংস্কার বিষয়ে বিদ্যাসাগরের পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলিকে নিয়ে এখানে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই উদ্দেশ্যে মূলত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখনী থেকে বিদ্যাসাগরের সামনে বাধাগুলি দেখার চেষ্টা করবো এবং সব শেষে বর্তমান মুসলিম সমাজের কিছু রীতি রেওয়াজের সঙ্গে তুলনা করবো। যে বিষয়গুলিতে বিদ্যাসাগরের অবদান সেগুলি— হিন্দু বিধবা বিবাহের আয়োজন, বাল্য বিবাহ ও বহুবিবাহ রোধের প্রচেষ্টা। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার পত্তন, শিক্ষার বিষয় নির্বাচন। এই বিষয়গুলি আলোচনার বাইরেই রাখবো।
বিদ্যাসাগরের কর্মযজ্ঞ শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগে রাজা রামমোহন রায় ও ডিরোজিয়ানদের প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্রিটিশরা সম্মত হয়েছিলেন। উত্তর ভারতে আসা গ্রীক পর্যটকদের কিছু বর্ণনা থেকে জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকেও সতীদাহের উল্লেখ ছিল। এই প্রথা হিন্দু ধর্মের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়েছিল বলে মনে হলেও, এটি একমাত্র ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেই একটি বিরল প্রচলন নয়। হিন্দু পুরুষের সম্পত্তি হিসাবে হিন্দু স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়ার যে চল বা বিধবার আত্মত্যাগ ভারত ছাড়াও স্ক্যান্ডেনিভিয়ান, স্লাভস, গ্রীক, ইজিপ্সিয়ান এবং চিনেও এরকম নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভারত ব্যতীত অন্য কোথাও এত দীর্ঘ সময় ধরে এই রীতির প্রচলন ছিল না। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় স্বামীদের চিতায় আত্মাহুতি দেওয়াকে যেরকম শৌর্য ও গৌরবের করে তোলা হয়েছিল, সেই গৌরবের শিক্ষাই এই প্রথা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত টেনে এনেছিল এবং সময়ের সাথে এই গৌরব গাথা ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় থেকে বৈদ্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও ছড়িয়েছিল। সতীদাহ আইন করে বন্ধ হলেও একদিকে বাস্তবিক কারণে, বাল্যবিধবা জনিত কারণে, মেয়েদের যৌন জীবনে পাহারা বসানো ও সেখান থেকে মুক্তির লুকোচুরি খেলার ইতিহাস সমসাময়িক লেখাপত্র পড়লেই বোঝা যায় এবং চারিদিকে সমাজের রসাতলে যাওয়ার আর্তনাদ দিকে দিকে ধ্বনিত হতে দেখা যায়। রামমোহন-ডিরোজিও-দের সময়টি ভারতে ফরাসী ও ডাচ পুঁজিবাদী শক্তির সঙ্গে ইংল্যন্ডের প্রতিযোগিতার কাল। রামমোহন রায় বা উইলিয়াম কেরি ওলন্দাজদের সাহায্যে সতীদাহের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুললেন। কিন্তু ১৮১৫ সালে পৌঁছে ইংরেজরা শুধু ইউরোপেই নয়, ভারতেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিকে সম্পূর্ণ কোণঠাসা করে দিতে সক্ষম হল। ভারতেও বস্তুবাদী সংস্কার হল এবং সতীদাহ নিষিদ্ধ হল। যে সমাজে বিপুল বাল্য বিবাহ ও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল সেই সমাজে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই সময়ের সবচেয়ে স্বাভাবিক ফসল। বর্ণ হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ প্রথা চালু থাকলেও সতীদাহ প্রথা বন্ধ আসলে বহু বাল্য বিধবার জীবনকে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। আইনি পদ্ধতিতে সতীদাহ বন্ধ করা হলেও জীবিত মেয়েদের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে মৃতপ্রায় হয়ে থাকতে হত। একে সতী না হওয়ার জন্য অসতী হিসাবে পরিচিতি লাভ করা, অন্য দিকে ঘরের বাইরে বের হওয়া মানেই চরিত্রহীন মহিলার অপবাদ পাওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। এক শ্রেণির অভিজাত আলালের ঘরের দুলালিরা বাল্যবিধবা হলেও, বাবা মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত না হলেও, মেয়ের পুনর্বিবাহ দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, সমাজের কঠোর নিয়ম কানুন অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ধর্মের কঠোর বিধান অস্বীকার করলে তাদের জমিদারি ও প্রজাদের কাছে স্বীকৃতি হারানোর সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এরাই প্রাথমিকভাবে তাঁদের ঘরের মেয়েদের জন্য ধর্মের মধ্যে থেকে বা ধর্মের বাইরে থেকে সমাজের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর নিয়ম শৃঙ্খলা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। বিক্রমপুরের জমিদার রাজা বল্লভ এর মত মানুষেরা প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হয়েও অসহায় ছিলেন, কারণ তাঁরা চাইলেও তাঁদের বিধবা মেয়েদের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম ছিলেন না। এই পরিস্থিতিতে বাংলার বদ্ধ জলাশয়ে তরঙ্গের সৃষ্টি করে ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি। ধর্মের উপর প্রবল আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে কলকাতার বাবু সমাজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনে ব্রাহ্ম ধর্মকে বাঁধ হিসাবে তৈরি করে রুখে দাঁড়ায়। বিদ্যাসাগর যখন ১৩ বছরের বালক তখন (১৮৩৩ চার্টার) সব ধরনের পাদ্রী ঘরানাকেই আসতে দেওয়া শুরু হল যাতে কোনো এক পাদ্রী ঘরানা একাধিপত্য কায়েম না করতে পারে। এই হল বাংলার স্বর্ণযুগের পর্যায়, বাংলার বস্তুবাদী বীক্ষার উত্থান। অক্ষয় দত্ত ও বিদ্যাসাগরের স্বর্ণ যুগ। বেকন-হিউম-দের দর্শনের বিস্তার। কিন্তু এই সুখ বেশিদিনের নয়। পুঁজিবাদ কখনই দ্বন্দ্বহীন নয়, এটাই তার মূল বৈশিষ্ট্য। হিন্দু ধর্ম বিপন্ন, এই আর্তনাদ তখন দিকে দিকে। শিক্ষিত সমাজের কেউ ব্রাহ্ম হচ্ছেন তো কেউ খ্রিস্টান। রাধাকান্ত দেবদের লড়াইকে মাটির সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে দিতে তখন রামকৃষ্ণের আশেপাশে বহু মানুষ এসে জুটেছেন, বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। সেই বাঁধের আড়ালে হিন্দু পুনরুত্থান যখন শক্তি সঞ্চয়ের আয়োজন করতে থাকে বিদ্যাসাগর তখন একা। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ ক্রিমিয়ার যুদ্ধ লাগলো ইউরোপে। আর ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে আবার মাথা তুললো। যার প্রতিফলনও ভারতে পড়লো। বিদ্যাসাগরদের দুর্দিন ঘনিয়ে এলো। ধর্মকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার ডিরোজিয়ান পন্থীদের প্রভাব রুখে দেওয়া অনেক সহজ ছিল। তন্ত্রমন্ত্র জাতপাতে ডুবে থাকা গ্রামীন বাংলায় নাস্তিকতার গ্রাহক প্রায় ছিল না বললেই চলে। রামমোহনের সময়ে ধর্মীয় সংস্কার, ধর্মীয় পথেই সামাজিক সংস্কার করার সময় বড়সড় একটা সমর্থক গোষ্ঠী পাওয়া গিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের কার্যকালকে আসলে দুটি ভাগ করতে হয়, একটি ব্রিটিশদের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিলেন আর অন্যটি বিদ্যাসাগর সর্বত্র প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরের জীবনকালের অনেক পরে আবিষ্কৃত দুটি উক্তি থেকে আমরা জানতে পারি, ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্য রেখেও ব্যক্তিগতভাবে সেগুলি সম্পর্কে কী ধারণা করতেন— ইংরেজরা জানতে চেয়েছিল, ভারতীয় দর্শনের কিছু বই কি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ানো যায় না? (তখনো ম্যাক্সম্যুলার ও ওল্ডেনবার্গ পঞ্চাশ খণ্ডের অনুবাদে হাত লাগাননি)। বিদ্যাসাগর বলেন, ওগুলো শুধু দুর্বোধ্য মনে হয় বলে অনুবাদ করা যাবে না— এমন নয়। আসলে, “there is nothing substantial in them”!— অনুবাদ করার জন্য কিছু মালমশলা থাকার দরকার হয়। ওগুলোতে সেরকম কিছু নেই। সব কিছুই বেদে আছে বা ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রে আছে এই মনোভাব তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিল না বরং কিছু তাচ্ছিল্য নিজের চেতনায় থাকলেও বিদ্যাসাগর সেই নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন। তাই বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ বা বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে চেয়ে যখন শাস্ত্রীয় ও প্রশাসনিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন তখন অনেক চুনোপুঁটিরা বিদ্যাসাগরকে মূর্খ ও নাস্তিক আখ্যা দিয়ে এক ঘরে করে দিতে চাইলেও বিদ্বজ্জনরা সরাসরি সেই পদ্ধতি নিতে পারেননি।
বঙ্কিম থেকে রামকৃষ্ণ— প্রত্যেকেই বিদ্যাসাগরের শাস্ত্র ধরে সংস্কারের পদ্ধতিতে সব থেকে বেশি বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন। শাস্ত্র ও প্রশাসনিক দুই পথেই বিদ্যাসাগর যেভাবে নিজের পন্থা খুঁজেছিলেন, সেটাতে কোন দিক থেকে বিদ্যাসাগরকে প্রতিহত করা সহজ হবে সেটা নিয়ে দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল। সেখানেও একদিকে বিদ্যাসাগর কেন ধর্ম গ্রন্থের সাহায্য নিচ্ছেন সেই প্রশ্নও উঠত। তেমনি আইন প্রণয়নের পন্থা নিলেও, সেখানে কখনো বলা হয় আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই বা আইন করে সমস্যার সমাধান হবে না। ধর্মীয় শাস্ত্র ও আইনি পন্থায় বহুবিবাহ ও বিধবা বিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের পন্থার বিরোধিতা সেসময়ে যাঁরা করেছিলেন সেগুলির সারাংশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় প্রায় একত্রে পেয়ে যাই। প্রাথমিকভাবে বিদ্যাসাগর একটি পুস্তিকা রচনা করে দেখান যে বহুবিবাহ অশাস্ত্রসম্মত তাই বন্ধ করা উচিত। তদুত্তরে শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, এবং অন্যান্য কয়জন পণ্ডিত যত খুশি বহুবিবাহের শাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করে পাল্টা প্রবন্ধ লেখেন। আজকের দিনেও পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাই বোনের সমানাধিকারের প্রশ্ন উঠলে সবাই যে সরাসরি বিরোধ করেন এমন নয়। অনেকেই প্রাথমিকভাবে মেনে নেওয়ার পরেও ঘুরিয়ে কিন্তু, তবে ইত্যাদি সহযোগে যেসব কথা বলেন সেই কথাগুলিই সেইসময়ে বঙ্কিমের কলম দিয়ে এসেছিল। আমরা বাকি অংশে সেগুলিই আলোচনা করবো।
একদিকে বঙ্কিম বলেন—‘বহুবিবাহ যে সমাজের অনিষ্টকারক, সকলের বর্জ্জনীয়, এবং স্বাভাবিক নীতিবিরুদ্ধ, তাহা বোধ হয় এ দেশের জনসাধারণের হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে। সুশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত, এ দেশে এমন লোক বোধ হয় অল্পই আছে, যে বলিবে, “বহুবিবাহ অতি সুপ্রথা, ইহা ত্যাজ্য নহে”। শাস্ত্রীয় বিধান দেখিয়ে বিদ্যাসাগর যখন বলেন যত খুশি বিবাহ করা হিন্দু শাস্ত্র বিরোধী, তখন সে সময়ের অন্য পণ্ডিতরা শাস্ত্রীয় বিধান দেখান যে কোন কোন পরিস্থিতিতে শাস্ত্রে বহু বিবাহ ‘জায়েজ’। বঙ্কিম বলেন বহু বিবাহ নিয়ে ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ সমাজে বহুবিবাহের সংখ্যা মোটেও বহুল প্রচলিত নয়— “তবে বহুবিবাহ এ দেশে যতদূর প্রবল বলিয়া বিদ্যাসাগর প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন, বাস্তবিক ততটা প্রবল নহে।” তিনি বলেন যদি ধরেও নেওয়া যায় বহুবিবাহ বহুল প্রচলিত, তাহলেও সেই বহুবিবাহ রোধ কী প্রকারে করতে চাইছেন বিদ্যাসাগর তাঁর সমালোচনা করেন। পণ্ডিত তারানাথের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন শাস্ত্র বিষয়ে মতভেদ আছে। এমনকি সাধারণ মানুষ যে শাস্ত্র মেনে চলে তাও নয়—“বঙ্গীয় হিন্দুসমাজে যে সকল সামাজিক প্রথা প্রচলিত আছে, তাহা সকলই শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রচলিত এমত নহে”। বঙ্কিম বলেন বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে শাস্ত্র নিয়ে টানাটানি করে আসলে ভুল করছেন, কারণ, শাস্ত্র মেনে চলতে গেলে সমাজে বহুবিবাহ কমার পরিবর্তে বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ইংরেজ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খুব পরিষ্কার বুঝতে পারেন, বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের উদ্ধৃতি ব্যবহার করলেও সেটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটা পন্থা মাত্র, তাই তিনি লেখেন, “কিন্তু বোধ হয়, শাস্ত্রাবলম্বনপূর্ব্বক বহুবিবাহ পরিত্যাগ করিতে বলা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য নহে। বিদ্যাসাগর মহাশয় এবং তাঁহার সহিত যাঁহারা একমতাবলম্বী, তাঁহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য এই যে, বহুবিবাহ নিবারণ জন্য রাজব্যবস্থা প্রচার হউক … নচেৎ শাস্ত্রের নামে ভয় পাইয়া হিন্দু বহুবিবাহ বা কোন চিরপ্রচলিত প্রথা হইতে নিবৃত্ত হইবেক, এমত ভরসা বিদ্যাসাগর মহাশয় করিবেন, বোধ হয় না। কিন্তু রাজব্যবস্থার পক্ষে প্রবৃত্তিদায়ক বলিয়াও এ বিষয়ে ধর্ম্মশাস্ত্রের সাহায্য অবলম্বন করা আমাদিগের উপযুক্ত বোধ হয় না”। অর্থাৎ শাস্ত্রের ব্যবহার করারও বিরুদ্ধে আবার রাজব্যবস্থারও বিরুদ্ধে। আইন প্রয়োগের বিরোধিতা করার প্রধান যুক্তি, “এ দেশে অর্দ্ধেক মুসলমান। যদি বহুবিবাহ নিবারণ জন্য আইন হওয়া উচিত হয়, তবে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্বন্ধেই সে আইন হওয়া উচিত”। আজও একটি রাজনৈতিক দলের মনের কথা। “রাজব্যবস্থাবিধাতৃগণ কি প্রকারে বলিবেন যে, “বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রবিরুদ্ধ, অতএব যে মুসলমান বহুবিবাহ করিবে, তাহাকে সাত বৎসরের জন্য কারারুদ্ধ হইতে হইবে।” বঙ্কিম লিখছেন, আইন তাহলে অর্ধেক নাগরিকদের উপর কার্যকরী করতে হবে, “আমাদিগের অবশিষ্ট প্রজা তাহাদিগের ভাগ্যদোষে মুসলমান, তাহাদিগের শাস্ত্রপ্রণেতৃগণ সুচতুর নহে, আরবী কায়দা হেলে দোলে না, বিশেষ মুসলমানের মধ্যে শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় কেহ পণ্ডিত নাই, অতএব বাকি অর্দ্ধেক প্রজাগণের হিত করিবার আবশ্যকতা নাই।” বঙ্কিম নিজেই তাঁর বক্তব্যের সারাংশ শুরু করেন বহুবিবাহ খারাপ বলে,
“১। বহুবিবাহ অতি কুপ্রথা; যিনি তাহার বিরোধী, তিনিই আমাদিগের কৃতজ্ঞতার ভাজন।
২। বহুবিবাহ এ দেশে স্বতঃই নিবারিত হইয়া আসিতেছে; অল্প দিনে একেবারে লুপ্ত হইবার সম্ভাবনা; তজ্জন্য বিশেষ আড়ম্বর আবশ্যক বোধ হয় না। সুশিক্ষার ফলে উহা অবশ্য লুপ্ত হইবে।
৩। এ কথা যদিও সত্য বলিয়া স্বীকার না করা যায়, তবে ইহার অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করিয়া কোন ফললাভের আকাঙ্ক্ষা করা যাইতে পারে না।
৪। আমাদিগের বিবেচনায় বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইনের প্রয়োজন নাই। কিন্তু যদি প্রজার হিতার্থ আইনের আবশ্যকতা আছে, ইহা স্থির হয়, তবে ধর্ম্মশাস্ত্রের মুখ চাহিবার আবশ্যক নাই”।
এই পর্যন্ত আলোচনা করার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুবিবাহের পক্ষে ছিলেন। যিনি সাম্য প্রবন্ধে যখন লিখছেন, “পুরুষগণের বহুবিবাহে অধিকার, তৎসম্বন্ধে অধিক লিখিবার প্রয়োজন নাই। এক্ষণে বঙ্গবাসী হিন্দুগণ বিশেষরূপে বুঝিয়াছেন যে, এই অধিকার নীতিবিরুদ্ধ”। তিনি যে সরাসরি বহুবিবাহের সমর্থন করে বক্তব্য রেখেছেন এরকম কোনও তথ্য নেই। আমি এখানে দেখাতে চাইছি কীভাবে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে অবস্থান ব্যক্ত করা মানুষদের চরম বিরোধিতার সম্মুখীন বিদ্যাসাগরকে হতে হয়েছিল।
আজও মেয়েদের সমানাধিকারের প্রশ্ন উঠলে, প্রাথমিকভাবে সেই সমানাধিকারে সম্মতি দিয়েও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ও পন্থার বিরোধিতা করার লোকজনের কোনও অভাব হয় না। যারা সরাসরি সমানাধিকারের বিরোধিতা করেন তাঁদের সঙ্গে লড়াইটা অনেক সহজ কিন্তু ঘুরিয়ে বিরোধিতা করা মানুষদের বিরুদ্ধে লড়াইটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। ‘সাম্য’ প্রবন্ধেই মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকারের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। “স্ত্রীপুরুষে যে সকল বৈষম্য প্রায় সর্বসমাজে প্রচলিত আছে, তন্মধ্যে পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্বন্ধীয় বিধিগুলি অতি ভয়ানক ও শোচনীয়। পুত্র পৈতৃক সম্পত্তিতে সম্পূর্ণ অধিকারী, কন্যা কেহই নহে। … …এই নীতির কারণ হিন্দুশাস্ত্রে নির্দিষ্ট হইয়া থাকে যে, যেই শ্রাদ্ধাধিকারী, সেই উত্তরাধিকারী; সেটি এরূপ অসঙ্গত এবং অযথার্থ যে, তাহার যৌক্তিকতা নির্বাচন করা নিষ্প্রয়োজন”। মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে প্রশ্নটি তুলেছিলেন কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব সেই নিয়ে কোনও বক্তব্য রাখেন নি। শুধু স্ত্রী শিক্ষার মাধ্যমে এই অসাম্য দূর হবে বলাটা খুবই লঘু বক্তব্য। মেয়েরা শিক্ষা লাভ করে বহির্জগতে গিয়ে অর্থোপার্জনের ক্ষমতা জন্মিবে ঠিকই কিন্তু সেটা তাঁর নিজস্ব সম্পদের অধিকার। পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাইয়ের একচ্ছত্র অধিকার থেকে সমানাধিকার কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেটা পরিষ্কার নয়। শাস্ত্রবিধান বদল করে? না কি আইন প্রণয়ন করে? মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরলে তাঁর সতীত্বধর্ম রক্ষণ নিয়ে তিনি সদা সচেতন ছিলেন। “স্ত্রীজাতির সতীত্বধর্ম সর্বতোভাবে রক্ষণীয়, তাহার রক্ষার্থ যত বাঁধন বাঁধিতে পার, ততই ভাল, কাহারও আপত্তি নাই”। এই বাঁধনগুলি কী ধরনের হতে পারে সে বিষয়ে জানা নেই, সতীত্ব রক্ষার্থে প্রকল্পিত বাঁধনগুলি নারীর ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করবে কিনা সে বিষয়ে জানা নেই। যেহেতু শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা এই প্রবন্ধের বাইরে রেখেছি তাই বিদ্যাসাগরের স্কুলে শূদ্র ও মুসলিমরা স্থান না পাওয়া নিয়ে আলোচনা করছি না।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে বঙ্কিম মোহাম্মদ মহসীন প্রতিষ্ঠিত কলেজ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। বহুবিবাহ শূদ্রদের মধ্যে বহুল প্রচলিত ছিল না কিন্তু তাঁদের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল। সেই বিবাহ মূলত পরিবারের মধ্যে— বড়ভাই মারা গেলে তাঁর ছোটভাইয়ের সঙ্গে বিধবার পুনর্বিবাহের প্রচলন ছিল। মুসলিম সমাজে বিধবা বিবাহে আপত্তি কোনোদিনই ছিল না। এই শূদ্রদের একটা অংশ ইংরেজদের সেপাহীর কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা বিধবা বিবাহের প্রচলনের প্রচেষ্টা দেখে প্রমাদ গুনেছিলেন। সেপাহীর অনিশ্চয়তার জীবনে, তাঁর মৃত্যুতে বিধবা বিবাহের প্রচলন শুরু হলে পরিবার পরিজন ভেসে যেতে পারে। বিধবা বউকে ঘরে বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা করাতে বাধ্য করা যাবে না, এরকম নানান কারণে সেপাহীদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের বিরোধিতাও প্রবল হয়েছিল।
সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে নতুন শাসক হলেন রানী ভিক্টোরিয়া ও সরাসরি বৃটিশ সংসদ। ইংল্যন্ডে তখন তারাই সংস্কার কর্মসূচী এগিয়ে নিয়ে চলেছেন কিন্তু উপনিবেশের ক্ষেত্রে আর তা নয়। ভারতে ১৮১৩ সালের আগের মত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়ে গেল তারা আবার। তারা ঘোষণা করল যে ধর্ম ও লোকাচারে নাক গলালে নেটিভ হিন্দু বা নেটিভ মুসলিমরা ক্ষিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু এমন ক্ষিপ্ত তো নীল চাষীরাও হয়েছিল, সেই রাগের ভয়ে তারা কি নীলকুঠি বানানো ছেড়ে দিয়েছিল? নিশ্চয়ই নয়। আসলে তাদের ভয় হল রাজন্য বর্গ, অর্থাৎ এদেশের ছোট শাসকরা, যারা আবার ফরাসীদের পাল্লায় পড়ে যেতে পারে, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর। ফলে এদেশের হিন্দু বা মুসলিম সম্ভ্রান্তরা যদি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য পুঁজিবাদী শক্তির সাহায্য নিয়ে বসে তা তারা অনুমোদন করতে পারে না। সিপাহী বিদ্রোহকে ইংরেজরা নানা সাহেব, তাতিয়া টোপিদের বিদ্রোহ হিসেবেই দেখেছিলেন। অন্যদিকে ক্রিমিয়ার এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঘোষিত কারণ ছিল ধর্মীয়, সনাতন চার্চের সাথে ক্যাথলিকদের বিরোধ, বৃটেন-ফ্রান্স ছিল ক্যাথলিকদের পক্ষে তাই ভারতে বা বৃটেনের অভ্যন্তরে খ্রীস্টান মিশনারীদের প্রতি এই বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে দেশের মধ্যে প্রশ্ন ঘনীভুত হল। তা সত্ত্বেও ভারতের রানী হিসেবে ভিক্টোরিয়া খ্রীস্টান পাদ্রীদের অধিকার আবার কেড়ে নিলেন। বৃটেন ক্রিমিয়ার যুদ্ধ চলাকালীনই সন্দেহ করছিল যে রাশিয়ার সঙ্গে নেপোলিয়নও একটি বোঝাপড়া করছেন, এবং তারা এবার ভারতের দিকে হাত বাড়াবে, তখন তারা ভীত হল। তাই ভয়ে তারা দ্রুত ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শেষ করে দেন, একটি আপোষের মধ্য দিয়ে। সুতরাং ১৮৫৭ সালের পর বিদ্যাসাগরের প্রিয় দুই প্রজেক্ট— বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ বিল পাশ হয়নি। রামমোহন যেখানে ইশ্বরতত্ত্বের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন, সেখানে বিদ্যাসাগর আরও অগ্রসর হয়ে ধর্মীয় ভাবনায় অজ্ঞেয়বাদ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। এদিকে বিদ্যাসাগরের জীবনকালের মধ্যেই হিন্দু পুনরুত্থান শুরু হয়ে যায়। বেদবেদান্তর অভ্রান্ততা নিয়ে চর্চার বিবেকানন্দীয় প্রচেষ্টার সামাজিক অর্থনৈতিক বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। রাধাকান্ত দেব হিন্দু জাগরণের প্রচেষ্টা কম করেননি, এবং তাঁর এই কাজে যথেষ্ঠ যোগ্যতাও ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বিদ্যাসাগরের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছিল, ১৮৫৭-র আগে। কিন্তু রাধাকান্ত দেবদের উত্তরসূরীরা যথা শশধর তর্কচূড়ামণি, রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং সবশেষে বিবেকানন্দ সেই সুবিধা পেলেন, এবং বিবেকানন্দই তাকে যথাযোগ্যভাবে ব্যবহার করতে পারলেন। রামকৃষ্ণ বললেন যে সব ধর্মই ভাল কিন্তু নিজ নিজ ধর্ম নিজের কাছে সত্য। এর মধ্য দিয়ে বিভ্রান্ত হিন্দু শিক্ষিতদের তিনি নিশ্চিন্ত করলেন এই বলে যে আর তাদের খ্রীস্টান হতে হবে না, হিন্দু ধর্মের খারাপ জিনিস নিয়ে লজ্জাও পেতে হবে না। কেশব সেনকেই এই অধ্যায়ের প্রথম ধারক বলা যেতে পারে। কিন্তু এর কোনোটাকেই হিন্দু পুনরুত্থান বলা যাবে না, যা বলা যাবে চিকাগো পরবর্তী বিবেকানন্দকে। অর্থাৎ আমেরিকা থেকেই হিন্দু পুনরুত্থানের রসদ এসে পৌঁছায়। বিবেকানন্দদের উত্থান বিদ্যাসগরকে সম্পূর্ণ একঘরে করে দিল। ১৮৭০-এর দশকে এসে গোটা ইউরোপ রেনেসাঁ বা পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে মানব জীবনকে নতুন দিশা দেখাতে ব্যর্থ হয়ে ঘোর সঙ্কটের মুখে এসে পৌঁছল। জার্মানি ও আমেরিকার উত্থান ঘটে গেছে। তার আগের ১০০ বছরে আমেরিকা মোটামুটি জাতি গঠন করে নিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে ফেলেছে। ১৮৪৮ সালের মধ্যেই আমেরিকা মেক্সিকো আক্রমণ করে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছা ও ক্ষমতা দুটোই জানান দিয়ে দিয়েছে ঔপনিবেশিক শিবিরে। তবু ১৮৬১ সাল পর্যন্ত তারা নিজেদের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে ফ্রান্স ও ইংল্যন্ড আমেরিকার অগ্রগতির প্রতিনিধিদের থেকেও প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের সঙ্গেই বেশি সম্পর্ক রাখতে উৎসাহী। অর্থাৎ মানব সমাজের যে অগ্রগমনের স্বপ্ন দেখিয়ে পুঁজিবাদ তার যাত্রা শুরু করেছিল, এখন থেকে সে সামনের পরিবর্তে পিছনের দিকে যাত্রা করতে চাইল। মুক্ত চিন্তা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ আর মুক্ত রইল না, জ্ঞান চর্চায় শৃঙ্খল লাগানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গেল। ভারতের বুকে বিদ্যাসাগরের মত মানুষরা যে অনুকূল পরিবেশ রাজশক্তির কাছে পাচ্ছিলেন সেটা হটাৎ উধাও হয়ে গেল। ১৮৮২ সালে রামকৃষ্ণ পরাজিত শিবিরের একলা নেতা বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করলেন, তার এক বছরের মাথায় ১৮৮৩ সালে চিকাগোতে মার্কিন পুঁজিবাদ এক বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করল, কলম্বাসের ৪০০ বছর পালন করা হল এবং আমেরিকা জানান দিল যে তারা আগামীদিনের রাজা হতে চায়। সেই প্রদর্শনীতেই হল বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন। আমেরিকাতে ১৭৯২-তে যে গ্রেট awakening হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে মার্কিন শাসকরা শিখেছিল যে revivalist আন্দোলনের ফলে চার্চ অব্ ইংল্যন্ড বিপদে পড়ে। তাই ১০০ বছর পরে, ১৮৯৩ সালে যখন আমেরিকা জাতি গঠনের পর্যায় সমাপ্ত করে উপনিবেশ গঠনে মনোযোগ দিচ্ছে, সাম্রাজ্যে পরিণত হচ্ছে তখন তারা আবার একই বার্তা দিল ওই ধর্ম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। উপনিবেশগুলিতেও যে বার্তা পৌছানো আমেরিকার বেশি দরকার। কারণ সেখানেই রয়েছে বিক্ষুব্ধ অংশ, যারা ১৭ শতকে ফেরত যেতে চায়। ভারতেও বার্তা এলো, হিন্দু পুনরুত্থানের আন্দোলনকে উস্কে দেওয়া তাদের দরকার, বৃটিশদের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে এখানে সমাজ সংস্কারকরা ভূমিকা রাখছেন, আর হিন্দু সনাতনপন্থীরা বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন, বিশেষত রাজন্য বর্গরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে তাদের শাসক বিরোধিতাকে তারা ধর্মীয় দিকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছেন আর পাশে এমনকি প্রজাদেরও পেয়ে যাচ্ছেন, যা তারা এর আগের শতকে পাননি। ১০০ বছর আগে প্রজাদের সাহায্য নিয়েই বৃটিশরা তাদের হারাতে পেরেছিল। ভারতের এই রাজন্য বর্গরাই মূলত হিন্দু জাগরণের অর্থনৈতিক ভিত্তি। এদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে মন্দির, সন্যাসীদের বা ধর্মীয় প্রচারকদের স্পন্সর করছেন এরাই। ধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিয়ে এই মহা প্রদর্শনীতে বিবেকানন্দ ডাক পেলেন এক রাজারই মাধ্যমে। মোদ্দা কথা বিবেকানন্দ কর্তৃপক্ষের নজরে এলেন, অ্যানি বেসেন্টেরও নজরে এলেন তিনি। ততদিনে ব্ল্যাভাৎস্কি ভারতে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত ইতিমধ্যেই আমেরিকাতে ১৮৭৫ সালে ব্ল্যাভাৎস্কি নামী এক মহিলার দৌলতে জন্ম নিয়েছে থিওসফিকাল সোসাইটি। এরা গোড়া থেকেই ভারতের আর্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিল। আর এই ব্ল্যাভাৎস্কিই হলেন অ্যানি বেসেন্টের গুরুস্থানীয়া। মার্কিন সরকারের সাহায্য নিয়েই, বাণিজ্য প্রতিনিধি হয়ে ব্ল্যাভাৎস্কির সঙ্গী হেনরী অলকট এসেছিলেন!
এদেশে আর্য সমাজের সাথে মিলে হিন্দু পুনরুত্থানের কাঠামোটি তখন তৈরি হচ্ছিল। অ্যানি ভারতে পদার্পণ করে কিছুদিনের মধ্যেই হিন্দু পুনরুত্থানে লেগে পড়লেন। দেখা যাচ্ছে অ্যানি বেসেন্টকে আশ্রয় দিচ্ছেন মাদুরাই, ব্যাঙ্গালোর, ভরতপুর, দ্বারভাঙা, কপুরতলা, ইত্যাদির সব মহারাজরা। বিবেকানন্দ স্বীকার করলেন যে এবার আর তার কোনো টাকা পয়সার সমস্যা হবে না, যে সব রাজারা তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাদেরকেও তিনি সব জানালেন, এবং আমেরিকার টাকায় ইউরোপ ঘুরে বেশ কয়েকজন বিদেশী শিষ্যকে নিয়ে জাহাজে করে নামলেন মাদ্রাজে। সে এক নাটকীয় অবতারণা, ভারতে মানুষ আজও হেলিকপ্টার থেকে নেতাদের নামতে দেখলে ভোট দিয়ে দেন, ফলে সেদিন মুচি-মেথর ভারতবাসী বুঝলেন যে তাঁদের নতুন ধর্মগুরু উপস্থিত। তারা মেক্সিকো জিতে বুঝেছিল যে মহিলাদের মুক্তিদাতা হিসেবে আমেরিকাকে প্রচার করা জরুরি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ যেমন বর্বর অসভ্য দেশকে সভ্য করতে এসেছিল, তেমনই ওরাও বিষয়টাকে আরও নির্দিষ্ট করলো, মহিলাদের মুক্তিদাতা হিসেবে। ঠিক যেভাবে আমেরিকা মহিলাদের মুক্তিদাতা হিসাবে প্রচার করেছিল, আজকের সময়ে মুসলিম সমাজেও মুসলিম মেয়েদের মুক্তিদাতা সাজতে একটি রাজনৈতিক দল হায়েনার মত ওঁত পেতে আছে। তার সঙ্গে তুলনা করা যায় কি না সেটা পাঠকরা বিচার করবেন। ভারতে মার্কিন শক্তি জাতপাতপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান করছিল। বিবেকানন্দের মুচি-মেথর নিয়ে বক্তব্যকে তাই খবরের কাগজগুলো সাংঘাতিক প্রচার করলো এবং মার্কিন মহিলাদের অগ্রগতি নিয়ে তাঁর উৎসাহও আমরা দেখলাম। ফলে ভারতে ব্ল্যাভাৎস্কি যখন এলেন তখন তা তাদের সেই নীতির সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ হল, আবার ১৮৭৯ সালে যখন অ্যানি বেসেন্ট এলেন তাও একই নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হল। বিদ্যাসাগরের মত মানুষরা যখন বিজ্ঞান ও আধুনিকতার সাহায্যে মেয়েদের মুক্তির দিশা খুঁজছেন, জনমানসে সেই উপলক্ষে যথেষ্ট চাহিদা তৈরি হয়ে গেছিল, সেই সময়ই রাজনৈতিক ভাবে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিমুখ না থাকা বিদ্যাসাগর পরাজিত হয়ে গেলেন। ভারতের হিন্দু পুনরুত্থান ও বিদ্যাসাগরের কোণঠাসা হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের একটু আয়ারল্যান্ডের প্রসঙ্গ টেনে আনতেই হবে। এমনিতেই ইতিহাসবিদরা ভারত আর আয়ারল্যাণ্ডের মধ্যে বহু মিল পেয়ে থাকেন, বৃটিশ উপনিবেশ, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিবাদ, জাতি হিসেবেই পরস্পরকে গণ্য করার অভ্যেস, এবং শেষ পর্যন্ত দেশভাগ, সবই দুই দেশের প্রায় এক। অ্যানি বেসেন্ট ছিলেন আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক (যদিও তিনি প্রথম জীবনে মুক্ত চিন্তক ছিলেন)। যে ক্যাথলিকরা প্রটেস্টান্ট বৃটিশ প্রভূদের সরকারী বদান্যতা পান না। আয়ারল্যাণ্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম নানা পর্যায়ে বিভক্ত, ফিয়েনপন্থী নৈরাজ্যবাদী ঘরানা থেকে শুরু করে শেষে হোম রুল-র পর্যায়, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার সাথে তার ওতপ্রোত যোগাযোগ। আইরিশ প্রবাসীরা যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধে দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীতেই ছিল, তেমনই তারা একসাথে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকাতেই জোট বেঁধেছিল, এবং মার্কিন গৃহযুদ্ধের পর ১৮৬৫ থেকে লিঙ্কনের মিলিটারি প্রধানরা তাদের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়িয়েছে, পরামর্শও দিয়েছে। আয়ারল্যান্ডে যখন বিপ্লবীরা কচুকাটা হচ্ছে তখনো আমেরিকা সেই ঘোলা জলে তাদের সাহায্যের নামে মাছ ধরতে চেষ্টা করেছে।
আজকের দিনেও মুসলিম সমাজ বহুবিবাহ, তালাক, বা পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকারের প্রশ্নের উত্তরাধিকার খোঁজার প্রচেষ্টা জারি আছে, মুসলিম সমাজ এক উথালপাথালের অপেক্ষায় আছে, তখন বিশেষ রাজনৈতিক শক্তি সেই ঘোলাজলে মাছ ধরার জন্য হামলে পড়ছে। এইসব আলোচনার অবতারণা এই জন্যই যে বিদ্যাসাগরের ব্যর্থতার যুগটি ছিল পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতার চরম যুগ, গোটা আফ্রিকা তখন সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। সেটা আবার সংকটেরও চরম যুগ। পুঁজিবাদের মুক্ত চিন্তাকে ত্যাগ করে পিছনে ফিরে যাওয়ার যুগ। ইউরোপের বস্তুবাদকে পরিত্যাগ করে আমেরিকার দেখানো পথ ধরে ভাববাদের কোলে পুনরায় আশ্রয় নেওয়ার শুরু। তা আর বিদ্যাসাগরের অবিশ্বাসী মন (agnostic) দিয়ে মোকাবিলা করা যেতো না। কিছুতে গভীর বিশ্বাস জরুরি ছিল, ভাববাদে বিশ্বাসী মনের বিপরীতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী মন প্রয়োজন ছিল যা ইউরোপে ততদিনে প্রতিষ্ঠিত। ভারতে তখনো তা অনুপস্থিত। একমাত্র যা হিন্দু পুনরুত্থানের সার্বিক, ধর্মীয়—অর্থনৈতিক ও সর্বোপরি রাজনৈতিক, প্রেক্ষাপটটিকে মোকাবিলা করতে পারবে।
বিদ্যাসাগর কেন তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারলেন না, এই প্রশ্নটি আজ অনেকে করছেন। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে যান্ত্রিক বস্তুবাদের উত্তরাধিকারী হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। ফয়েরবাখের উত্তরাধিকারী হলেন এঙ্গেলস। আর বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কাদের ছিল?
আমরা শেষ অংশে এই প্রতিকুলতার সঙ্গে আজকের মুসলিম সমাজের কিছু ইস্যুর তুলনা করবো। বিদ্যাসাগর লোকাচারের বিরুদ্ধে গিয়ে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ করতে পারলেও বহুবিবাহ রদ করতে সক্ষম হননি। মুসলিম সমাজের মধ্যে বহুবিবাহের প্রচলন আছে, তাঁদের শাস্ত্রে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও বিরোধ নেই, অনেকেই শাস্ত্রসম্মতভাবেই বহুবিবাহ করেন। আজকের দিনে বহুবিবাহর প্রচলন রাখার পক্ষে অন্যতম চাহিদা পুত্র সন্তান। মোট জনসংখ্যার কতজন বহুবিবাহ করছেন বা কতজন তিন তালাকের বলি হচ্ছেন সেই সংখ্যা বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আইনের অন্তরায় হতে পারে না, এই জনসংখ্যা দেখিয়ে আইন প্রণয়নের বিরোধিতা বঙ্কিম করেছিলেন। ইসলামি শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী পুত্র সন্তানের অনুপস্থিতিতে সম্পদ বিলি বণ্টনের আইনের যে বৈষম্য তাই একই সাথে বহুবিবাহ ও বহুসন্তানের বড় পরিবারের কারণ। এখনো পুত্রসন্তানের অপেক্ষায় একটার পর একটা কন্যা সন্তান গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়। অর্থাৎ আইন করে বহুবিবাহ রদ করা গেলে একই সাথে পরিবার পরিকল্পনায় সফলতা বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে বহুবিবাহ রদ করা সম্ভব হবে। শুধু বহুবিবাহ রদ করে পরিবার পরিকল্পনায় সফলতা আসবে না, আইন করে একটি বা দুটি সন্তান ছেলেই হোক বা মেয়ে তারজন্য কোনোরকম আইনি বৈষম্য যাতে না থাকে তাঁর জন্য মুসলিম উত্তরাধিকারের আইনকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করা আবশ্যিক। বিদ্যাসাগার থেকে আমরা শিখেছি সম্ভব হলে শাস্ত্রীয় আইনের মধ্য থেকে না হলে শাস্ত্রের বাইরে রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে সামাজিক সংস্কার অবশ্যাম্ভাবি। দরকার হলে সম্ভাব্য সব ইট-পাথর একবার করে হলেও উল্টে পাল্টে দেখতে হবে। কোনও পন্থাই ছেড়ে রাখা যাবে না।
আজ মুসলিম সমাজে বঙ্কিমচন্দ্ররা এসে গেছেন। যুক্তিবাদী হিসেবে যাঁদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তাঁরা বলছেন যে ক্রমেই আমাদের সমাজটা মুক্তমনা হচ্ছে, বহুবিবাহ, অন্যায় তালাক, বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যাসাগরের বড়ই অভাব। যিনি উপর তলায় পরিবর্তন করতে চাইবেন। আইন-রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাইবেন। কিন্তু বঙ্কিম যখন এসে গেছেন, বিদ্যাসাগরের আসতে আর বেশি দেরী নেই। তবে বিদ্যাসাগরের জন্মের জন্য যে প্রতিকুল আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি প্রয়োজন সেটুকু গড়ে দিতে হবে। প্রেক্ষাপটও ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে, অনেক আলালের ঘরের দুলালীর বিধবা কন্যার যন্ত্রণার নিরসনের জন্য বিক্রম জমিদাররা যেমন ছিলেন, তেমনি আজকের দিনেও একটি বা দুটি কন্যা সন্তানের বাবা-মায়েরা বাস্তব পরিস্থিতিকে একটা নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছেন। আজকের দিনে বিদ্যাসাগরের উত্তরসূরিদের হাত শক্ত করেই এই সময়ে ঘোলা জলে মাছ ধরার অপেক্ষায় থাকা শক্তিকে পরাস্ত করে সমাজকে পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে আটকানো সম্ভব হবে। আজকের বিদ্যাসাগরের উত্তরসূরিদের যেভাবেই হোক জয় লাভ করতেই হবে।
ছবি : সংগৃহীত
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৩১ জুলাই, ২০২০
0 Comments
Post Comment