নারী ও ধর্ম

  • 04 November, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 402 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নারী-বিদ্বেষী মনোভাব বোধহয় পৃথিবীর সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রণিধানযোগ্য। মানুষকে গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা, ঈশ্বরের ধারণাকে ব্যবসায়িক আয়ের উৎসে পরিণত করা, ও সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা – মনে রাখতে হবে এধরনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা। যীশু অথবা বুদ্ধের আত্মত্যাগ, পরবর্তীতে সেই ধর্মের ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারেনি। নারীকেও তাই ধর্মের পণ্ডিতেরা দ্বিতীয় শ্রেণির ভোগ্যবস্তু ভিন্ন আর কোনও কিছুই ভেবে উঠতে পারেননি।

হিব্রু আদি বাইবেল অথবা ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম খণ্ড, বুক অব জেনেসিসের একটি অংশে স্পষ্টতই উল্লেখ রয়েছে, পুরুষ যে একলা জীবন কাটাবে – ঈশ্বর বা স্রষ্টার এমনতরো ব্যবস্থা উপযুক্ত মনে হয়নি। তাই পুরুষের একাকীত্ব দূর করতে, ও তাকে সর্ববিষয়ে সাহায্য করতে তিনি নারী সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন। অর্থাৎ কি না সৃষ্টির সময় থেকে, (পড়ুন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সৃষ্টির সময় থেকে) নারীকে কেবল পুরুষের সহচর ও আজ্ঞাবহ হিসেবেই দেখিয়ে আসা হয়েছে। নারী সেখানে পুরুষের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় সহায়তা, সেবা, বিনোদন, ও ভরণপোষণের অন্যান্য উপকরণ যোগানোর দায়িত্ব নেবে, ও বিনা প্রশ্নে পুরুষের নেতৃত্ব বা আধিপত্যকে সসম্ভ্রমে স্বীকার করে নেবে – এমনটাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষকে শিখিয়েছে। যে কারণে বোধহয় একটিও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ক্ষেত্রে ‘প্রফেট’ বা ‘প্রবর্তক’ হিসেবে তো নয়ই, এমনকি ‘প্রফেট’এর সহচর হিসেবেও তেমন প্রত্যক্ষ ভাবে, গুরুত্ব-সহকারে কোনও নারী চরিত্রকে উঠে আসতে দেখা যায় না। আজ অবধি প্রায় সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ক্ষেত্রে, সেই ধর্ম-প্রশাসনের চূড়ান্ত নীতি-নির্ধারকমণ্ডলীর সভ্য বা সদস্য হিসেবে কোনও নারীকে অভিষিক্ত বা নির্বাচিত হতে দেখা যায় না। খ্রিস্টান বাইবেলেই যেমনটা উল্লিখিত রয়েছে, “প্রত্যেক সংসারের শীর্ষে থাকবেন সেই সংসারের পুরুষ প্রতিনিধি, সেই পুরুষ খ্রিস্টের প্রতি অনুগত হবেন। প্রত্যেক নারী তাঁর পুরুষের প্রতি অনুগত হবেন, যেমন ভাবে খ্রিস্ট অনুগত হবেন তাঁর পিতা ঈশ্বরের প্রতি …” ইত্যাদি।

 

সত্যি কথা বলতে নারী ও ধর্ম বিষয়ক কোনও আলোচনায় পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্ম বা ধর্মশাস্ত্রগুলির বিষয়ে আলোচকের যতখানি ব্যুৎপত্তি থাকা প্রয়োজন, তা অনেক কালের অধ্যয়ন দাবি করে। কাজেই এই আলোচনায় যে কয়েকটি মাত্র ধর্মের উল্লেখ করব, সেগুলির প্রত্যেকটির প্রতি আমার আচরণ পক্ষপাতদোষের ঊর্ধ্বে থাকবে এমনটা বলতে পারি না। ব্যুৎপত্তি না থাকার কারণে, শাস্ত্রবাক্যের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো পারিপার্শ্বিক ঘটনা, সেই বিষয়ক সামাজিক প্রতিক্রিয়া, আলোচনা, জনতার আচরণ, বা সেই সমস্ত কিছুর থেকেই হয়তো এই আলোচনার রসদ খুঁজতে চাইব। শাস্ত্রের চেয়েও সমাজে সেই শাস্ত্র বা নীতির যে প্রয়োগ, তাই বোধকরি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। উত্তম শাস্ত্র হয়েও যদি প্রবর্তনের নিরিখে তা দুর্বল ও সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেই শাস্ত্র বা শাস্ত্রের ব্যাখ্যাকর্তাদেরও কঠোর সমালোচনার মুখে পড়া উচিত বলে মনে করি। সবার উপরে মানুষ, ও মানবতা ভিন্ন যে আর কোনও বৃহত্তর সত্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে না, একথা এখন স্পষ্টের চেয়েও স্পষ্ট উচ্চারণে ঘোষণার সময় এসেছে।

 

জন্মসূত্রে আমার উপরে হিন্দু-ধর্মের তকমা বর্তিয়েছে। যদিও আজ যুক্তি ও যৌবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে নিজেকে সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী ও ধর্ম-বিরোধী হিসেবে ঘোষণা করতে আমি এতটুকুও কুণ্ঠা বোধ করি না। বিশশতকের মহান চিন্তানায়ক বার্ট্রাণ্ড রাসেলেরই বক্তব্য উদ্ধৃত করে আমি সদর্পে এও জানাতে চাই, “পৃথিবীর সমস্ত সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই, সামাজিক বিবর্তন, আধুনিকতা ও আত্মগঠনের পক্ষে একইরকমে ক্ষতিকর ও পরিত্যাজ্য বলে মনে হয়।” এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তক, অধ্যাপক অম্লান দত্তের আরেকটি বক্তব্যকে মনে পড়ে গেল। প্রাবন্ধিক তাঁর আলোচনায় বলেছেন, “হিন্দুসমাজে (এই) অসাম্য যেভাবে আছে একরকমের বিকৃত ধর্মের সহায়তা ছাড়া সেটা সম্ভব হত না। শুচিতা সম্পর্কে এক মানবতাহীন ধারণা এই সমাজকে আচ্ছন্ন করে আছে। … হিন্দু বহু মন্দিরে নিচুজাতের মানুষের প্রবেশ নিষেধ। কারণ তাতে নাকি মন্দির অপবিত্র হবে। অথচ ব্রক্ষ্ম সর্বব্যাপ্ত। সারা পৃথিবীই ঈশ্বরের মন্দির। সেই মন্দিরের ভিতরই শূদ্রের বাস। তা হলে পৃথিবী তো অপবিত্র হয়েই আছে!” [উদ্ধৃতি সৌজন্যঃ ‘শান্তির সপক্ষে’, অম্লান দত্ত, ১৯৯২] অস্পৃশ্যতার এই ঘৃণ্য ধারণা যেভাবে হিন্দুধর্মকে বহুস্তরে বিভক্ত করে রেখেছে, তা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। ১৯২৩এর এক আলোচনায় তিনিও স্পষ্টই বলেছিলেন, “হিন্দু বিপুল অথচ দুর্বল”। মানুষের পারস্পরিক ঐক্য বা সম্মানের প্রশ্নে হিন্দু ধর্মের এই যে ‘বৈশিষ্ট্য’, তা নিঃসন্দেহে লজ্জার ও পরিত্যাজ্য। কাজেই, খ্রিস্টান ধর্মে নারীকে যেভাবে ঘোষিত অক্ষরেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক (নাকি বলব ‘সৃষ্টি’?) হিসেবে দেখানো হয়েছে, ‘হাজার বৎসরের সুপ্রাচীন’ হিন্দুতত্ত্বের প্রধান পুরোহিতেরাও সেই বিষয়ে তেমন একটা প্রগতিশীলতার পরিচয় দিতে পারেননি। এই বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হওয়া যাক।

 

বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ-নিবারণের প্রশ্নে ঈশ্বরচন্দ্র যেভাবে প্রাচীন শাস্ত্রবাক্যকে যুক্তি ধরে ধরে তুলে এনে বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেই পরিশ্রমের ফসল আজও আমাদের এমন একেকটি আলোচনার রসদ যুগিয়ে চলেছে। আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে মনুর বিধান অথবা মনু-সংহিতা নামক শাস্ত্র(?)গ্রন্থটির বিষয়ে নানান স্তর থেকে, নানান কারণে বিশেষ আগ্রহের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। সেই বইটি থেকেই কয়েকটি শ্লোক, বিদ্যাসাগর-কৃত অনুবাদ ও বিশ্লেষণ-সহ নীচে উল্লেখ করতে চাইব।

 

“মদ্যপাসাধুবৃত্তা চ প্রতিকুল্য চ যা ভবেৎ।

ব্যাধিতা বাধিবেত্তব্যা হিংস্রার্থঘ্নী চ সর্ব্বদা।।”

 

[ব্যাখ্যাঃ যদি স্ত্রী সুরাপায়িণী, ব্যাভিচারিণী, সতত স্বামীর অভিপ্রায়ের বিপরীতকারিণী, চিররোগিণী, অতিক্রূরস্বভাবা ও অর্থনাশিনী হয় তৎসত্ত্বে অধিবেদন, অর্থাৎ পুনরায় দার পরিগ্রহ করিবেক] এবং,

 

“বন্ধ্যাষ্টমেহধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা

একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্ত্বপ্রিয়বাদিনী।”

 

[ব্যাখ্যাঃ স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুত্রা হইলে দশম বর্ষে, কন্যামাত্রপ্রসবিনী হইলে একাদশ বর্ষে ও অপ্রিয়বাদিনী হইলে কালাতিপাত ব্যতিরেকে, অধিবেদন করিবেক]

 

অর্থাৎ কি না ‘হাজার বৎসরের সুপ্রাচীন’ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, স্ত্রী চিররোগিণী হলে অথবা অপ্রিয়বাদিনী হলেও — কালাতিপাত ব্যতিরেকে সেই ধর্মে পুনর্বিবাহের বিধান রয়েছে। কিন্তু কেবলই কি মনু-সংহিতার উল্লেখেই এই শাস্ত্রের নারীবিদ্বেষী রূপকে সবখানি উন্মোচন করা চলে? মনু-সংহিতার পাশাপাশি বরং যম-সংহিতা ও ব্যাস-সংহিতার দুইখানি শ্লোক-বাক্যকেও এই ক্ষেত্রে প্রকাশ করা যাক।

 

“মাতা চৈব পিতা চৈব জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা তথৈব চ।

ত্রয়স্তে নরকং যান্তি দৃষ্ট্বা কন্যাং রজস্বলাম্।।

যস্তাং বিবাহয়েৎ কন্যাং ব্রাক্ষ্মণো মদমোহিতঃ।

অসম্ভাষ্যো হ্যপাংক্তেয় স বিপ্রো বৃষলীপতি।।” — যমসংহিতা

 

[ব্যাখ্যাঃ কন্যাকে অবিবাহিত অবস্থায় রজস্বলা দেখিলে, মাতা, পিতা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, এই তিন জন নরকগামী হয়। যে ব্রাক্ষ্মণ, অজ্ঞানান্ধ হইয়া সেই কন্যাকে বিবাহ করে, সে অসম্ভাষ্য, অপাংক্তেয় ও বৃষলীপতি। উল্লেখ্য, যে কন্যা অবিবাহিত অবস্থায় পিতৃগৃহে রজস্বলা হয়, সেই কন্যাকে বৃষলী বলে]

 

“যদি সা দাতৃবৈকল্যাদ্রজঃ পশ্যেৎ কুমারিকা।

ভ্রূণহত্যাশ্চ তাবতাঃ পতিতঃ স্যাত্তদপ্রদঃ।।” — ব্যাসসংহিতা

 

[ব্যাখ্যাঃ যে ব্যক্তি দানাধিকারী, যদি তাঁহার দোষে কুমারী ঋতুদর্শন করে; তবে ঐ কুমারী, অবিবাহিত অবস্থায় যত বার ঋতুমতী হয়, তিনি ততবার ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত, এবং যথাকালে তার বিবাহ না দেওয়াতে, পতিত হন]

 

কাজেই বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের সপক্ষে যেভাবে ‘হাজার বৎসরের সুপ্রাচীন’ হিন্দুশাস্ত্রের রচয়িতারা কলম শানিয়েছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আর তাঁদেরকে বিশেষ সম্মান জানানো উচিত বলে মনে হচ্ছে না। [যদিও এক্ষেত্রে এও বলে রাখা উচিত, শাস্ত্রানুসারেই মনুর বিধান কলিযুগে অচল। এই বিষয়ক শ্লোক স্পষ্ট অক্ষরেই পরাশর-সংহিতার পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। তবে, সেই অজুহাতে হিন্দুশাস্ত্র বা হিন্দুধর্মের নারীবিদ্বেষী যে রূপ, তাকে কোনও ভাবেই লুকিয়ে রাখা চলে না।]

 

সামাজিক ধর্মপালনের বিষয়েও যদি দেখি, হিন্দু সামাজিক শাস্ত্রে যে দুইখানি আকরগ্রন্থ রয়েছে তাতে পুরুষোত্তম রামের যে চরিত্র দেখা যায়, নারী-সম্মানের প্রশ্নে কি তাঁকে আদৌ মানবোত্তম অভিধা’তে ভূষিত করা চলে? অথবা দ্রৌপদীর প্রতি যে ইঙ্গিত ও ব্যবহার বারেবারেই উঠে আসতে দেখি, তাকেও কি কোনও ব্যাখ্যাতেই শোভন, রুচিশীল অথবা ভদ্র কোনও বিশেষণে উল্লেখ করা যায়? অনায়াসেই যুদ্ধজয়ী রাম, প্রজাদের অপপ্রচারের বশবর্তী হয়ে নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে সর্বসমক্ষে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে বলেন। একাধিকবারে ‘পুরুষোত্তম ভগবান’এর এমনতরো ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। দ্রৌপদীকে কত অনায়াসেই মাতা কুন্তী ভিক্ষাদ্রব্য হিসেবে পাঁচভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে নিতে বলেন। এহ বাহ্য, স্বর্গারোহণের সময় পাঁচ স্বামীর মধ্যে অর্জুনের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত পক্ষপাত থাকার কারণে দ্রৌপদীই প্রথম স্বর্গলাভ থেকে বিচ্যুত হন। নারীর প্রতি ন্যূনতম  সম্মান বা শোভনতা প্রদর্শনের কোনও উল্লেখই তো এখনও অবধি চোখে পড়ল না। সামাজিক ক্ষেত্রে পেশা থেকে শুরু করে লিঙ্গ বা জাতি-বিষয়ক সর্বক্ষেত্রে এতখানিই অসাম্যের উদাহরণ ‘হাজার বৎসরের সুপ্রাচীন’ হিন্দু-ধর্মের অক্ষরে অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।

 

আদতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এমন নারী-বিদ্বেষী মনোভাব বোধহয় পৃথিবীর সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রণিধানযোগ্য। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল ব্যবসা ও বিভাজন। মানুষকে গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা, ঈশ্বরের ধারণাকে ব্যবসায়িক আয়ের উৎসে পরিণত করা, ও সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা – মনে রাখতে হবে এধরনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা। যীশু অথবা বুদ্ধের আত্মত্যাগ, পরবর্তীতে সেই ধর্মের ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারেনি। নারীকেও তাই ধর্মের পণ্ডিতেরা দ্বিতীয় শ্রেণির ভোগ্যবস্তু ভিন্ন আর কোনও কিছুই ভেবে উঠতে পারেননি। নারীমাংসের প্রতি পুরুষের আজন্ম-লালসাই ধর্মের বাণীরূপে সুললিত ব্যাখ্যায় নারীকে অবদমিত করে রাখার এক অন্য মাধ্যম হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। বাইবেলের রাজা জেমস সংস্করণ থেকেই বরং উদ্ধৃত করা যাক,

 

“How beautiful are thy feet with shoes, O prince's daughter!

The joints of thy thighs are like jewels,

The work of the hands of a cunning workman.

 

Thy navel is like a round goblet,

Which wanteth not liquor: Thy belly is like an heap of wheat Set about with lilies.

 

Thy two breasts are like two young roes That are twins.”

 

কে বলে ধর্মশাস্ত্রে যৌনতার উল্লেখ নেই? কে বলে ধর্মশাস্ত্রে নারী-সম্ভোগের কথা আসেনি? অথচ এই বর্ণনায় কিন্তু আমি কোনও আপত্তি দেখছি না। প্রকৃতির যে প্রাকৃতিক-জৈবিক সত্যগুলি রয়েছে তাকে প্রকাশ করতে চাওয়াটা আমি অন্যায় বলে মনে করি না। কিন্তু আপত্তি আসে তার ব্যাখ্যাতেই। গির্জার বড়কর্তারা “ধমক দিয়ে বলেন, এ প্রেম রূপক-রূপে নিতে হবে, এ প্রেমের সঙ্গে মানব-মানবীর প্রেমের কোনও সম্পর্ক নেই – এ প্রেম নাকি ‘দি মিউচেল লাভ অব ক্রাইস্ট আন্ড হিজ চার্চ’ বর্ণনা করেছে। চার্চের বড়কর্তা স্বয়ং পোপ। এখানে আমি পোপের স্বার্থান্বেষী করাঙ্গুলি-সংকেত দেখতে পাই।” [উদ্ধৃতি সৌজন্যঃ ‘অবিশ্বাস্য’, সৈয়দ মুজতবা আলী, ১৯৪৩]

 

অথচ এরই পরবর্তীতে আমরা দেখি একদিকে গির্জার যাজকদের তরফে নিঃশেষে তাঁদের স্ত্রীকে ভোগ করে চলা। অন্যদিকে বিজ্ঞান-স্বাস্থ্য সমস্ত ধরনের যুক্তির বিপরীতে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে অস্বীকার করা। “আমি বাতিকগ্রস্ত একজন যাজককে চিনতাম যাঁর স্ত্রী ন’বছরে ন’টি সন্তানের জন্ম দেন। ডাক্তারেরা তাঁকে বলেছিলেন, যদি তাঁর আর একটিও সন্তান হয়, তাহলে তিনি মারা যাবেন। পরের বছর আরও একটি সন্তান হয়, এবং যাজকের স্ত্রী মারা যান। একজনকেও গির্জার তরফে নিন্দা করা হয় না। যাজক পুনরায় দার-পরিগ্রহ করেন। … গির্জার প্রতিনিধিরা এই মত পোষণ করেন, যদি দুজন বিবাহিত হন এবং স্বামী যদি আরেকটি সন্তান প্রত্যাশা করেন তবে স্ত্রীর শত অনিচ্ছাসত্ত্বেও যৌনসঙ্গম বৈধ।” [উদ্ধৃতি সৌজন্যঃ ‘কেন আমি ধর্ম বিরোধী’, বার্ট্রাণ্ড রাসেল, ১৯৫৭]। দুই প্রধান ধর্মের বিষয়ে ইত্যাবধি এই নিবন্ধে আলোচনা করা গেল।

 

শাস্ত্রীয় ইসলাম বিষয়ে আমার ব্যুৎপত্তি নগণ্য। কাজেই সেই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা আমার তরফে বাগাড়ম্বর ভিন্ন আর অন্য কোনও কিছুতেই পর্যবসিত হবে না। তবে নারী-স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের যে মনোভাব, সামাজিক ক্ষেত্রে ‘পর্দা’ ও ‘শরিয়া’র বিষয়ে যে তুমুল বিতর্ক, হট্টগোল, ইরান ও আফগানিস্তানের মহিলাদের তরফে যে দীর্ঘ অত্যাচার সয়ে আসা ও আন্দোলন – সেই প্রসঙ্গে নারী ও ধর্মের পরস্পরবিরোধী চেহারাটাই যে ইসলামের ক্ষেত্রেও নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে তা আর আলাদা করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তদুপরি শাস্ত্রীয় ইসলাম নিয়েই যদি বা প্রশ্ন করতে হয়, সম্প্রতি পঁচাত্তরবর্ষীয় একজন সাহিত্যিককে যে বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ছুরির আঘাতে চোখ হারাতে হয়েছে, সেই বিষয়টিকে নিয়েই বা আমরা প্রশ্ন তুলব না কেন? ইতিহাস ও যুক্তির আলোয় ইসলামিক শাস্ত্রে স্যাটানিক ভার্সেসের অন্তর্ভুক্তি অথবা বিযুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা উঠুক। পাগান কোনও ঈশ্বরীর প্রতি বা ঈশ্বর-ভাবনার প্রতি সামাজিক কারণে যদি ইসলামকে শুরুর সময়ে আংশিক সমর্থন জানাতে হয়েও থাকে, আজ সেই তথ্যকে জোর করে অস্বীকার করারও কোনও সঙ্গত কারণ দেখিনা। নারী সমাজের ভোগ্যবস্তু নয়, অস্পৃশ্য নয়, অদ্ভুৎ কোনও লজ্জার বিষয় নয়। নারীর অস্তিত্ব, তার হকদার অস্তিত্ব। নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষ বা প্রকৃতির অস্তিত্ব সম্ভব নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নামে যে প্রতিষ্ঠানগুলি এই মৌলিক সত্যকে সূচনাকাল থেকে আজ অবধি অস্বীকার করতে চেয়েছে, বিজ্ঞান ও যুক্তির পৃথিবীতে বরং তাদেরই অস্তিত্বের অসারতা অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।

 

ধর্ম বা প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বরের আজ মনে রাখা উচিত, তাঁরা এই বিরাট প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা নন – প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জটিলতা আজ অবধি মানুষের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট না হলেও, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা সামাজিক স্তরে প্রচলিত যে ঈশ্বরের ধারণা - তা আদতে মানুষেরই মস্তিষ্কজাত, এবং সেই ধারণার জন্ম হয়েছিল কেবলমাত্র বিভাজন ও ব্যবসার প্রয়োজনেই। তাই নারীর অস্তিত্ব বিষয়ে, বা তার চলন-বলন-আচরণের বিষয়ে, তেমন কোনও প্রতিষ্ঠানেরই ‘আদেশনামা’ জারির কোনও অধিকার আমরা সর্বোতভাবে মানতে অস্বীকার করি। এই অধিকারেই আমাদের লিঙ্গসাম্যের আন্দোলন।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment