- 10 February, 2021
- 0 Comment(s)
- 1870 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
"আর এক কুঠরিতে গিয়া দেখিলেন, মস্ত রাজ দরবার, রাজদরবারে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি জ্বল্ জ্বল্ করিতেছে, চারিদিকে মণি-মাণিক্য ঝক ঝক করিতেছে। কিন্তু রাজসিংহাসনে রাজা পাথরের মূর্তি, মন্ত্রীর আসনে মন্ত্রী পাথরের মূর্তি, পাত্র-মিত্র, ভাট বন্দী, সেপাই লস্কর যে যেখানে, সে সেখানে পাথরের মূর্তি। কাহারও চক্ষে পলক নাই, কাহারও মুখে কথা নাই।
রাজপুত্র দেখিলেন, রাজার মাথায় রাজছত্র হেলিয়া আছে, দাসীর হাতে চামর ঢুলিয়া আছে, সাড়া নাই, শব্দ নাই, সব ঘুমে নিঝুম। রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চলিয়া আসিলেন।" (ঘুমন্ত পুরী, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার )
রূপকথার সেই ঘুমন্ত পুরাবাসীদের মতোই আমরাও মরণ ঘুমে আছি! কে জানে কবে আমাদের মরণ ঘুম ভাঙবে! আমাদের মনে কোন প্রশ্ন নেই, প্রতিবাদ করার কোন জায়গা নেই। তাই, আমরা সমাজের সমস্ত অনিয়মকে মাথা নত করে মেনে নিয়ে, এগিয়ে চলেছি! একবিংশ শতাব্দীর যান্ত্রিকতার যুগে পৌঁছে যখন সমাজের অসমতা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে হয়, মনের কি যে একটা অবস্থা হয় তা বর্ণনাতীত। আমাদের সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে, শিশুরাও এই কবল থেকে রক্ষা পায়নি। সারা বিশ্বে কার্টুন নিয়ে বহু তর্ক, বিতর্ক আছে। টেলিভিশন কার্টুনগুলিতে নারীদের ডামি হিসাবে চিত্রিত করা হয়। আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি তথ্য থেকে জানা যায়-
Male cartoon characters still outnumber female cartoon personalities by 4-1, exactly the same as in the '70s, when sexism dominated the airwaves even more than today, Drs. Mary Hudak and Cynthia Spicher of Allegheny College told participants at the 105th annual meeting of the American Psychological Association. ( তথ্যসূত্র: The Baltimore Sun, ১৯/৮/১৯৯৭ )
শিশুদের কার্টুনে আমরা সেই একই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় রীতি দেখতে পায়। ইদানিং, গল্পে হয়তো কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, তবে সামগ্রিক ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে সেই সর্ষের মধ্যে ভূত খুঁজে পাওয়া যাবে। মিডিয়া প্রডিউসাররা বিশ্বাস করে পুরুষেরা নারীদের মূল চরিত্রে দেখতে পছন্দ করে না, এই কারণে প্রধান চরিত্রে পুরুষদের উপস্থাপন করা হয়। সারা বিশ্ব জুড়ে, আজকের এই প্রযুক্তির যুগে এনিমেটেড চরিত্রগুলি শিশুদের মনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। Geena Davis Institute on Gender in Media তাঁদের গবেষণা তথ্য প্রকাশ করে, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কি সাংঘাতিক বৈষম্যময় টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলি। এই গবেষণায় সারা বিশ্বের ৫০৩৪টি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তারমধ্যে এনিমেটেড চলচ্চিত্র রয়েছে। এই বিশ্লেষণে দেখা গেছে প্রায় সমস্ত ধরনের অনুষ্ঠানে পুরুষদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সমস্ত অনুষ্ঠানে নারীদের থেকে পুরুষেরা ২:১ অনুপাতে এগিয়ে আছে। প্রায় সমস্ত অনুষ্ঠানে নারীদের ঘরের কাজ করতে দেখা যায়, নারীরা আবেদনময়ী, আবেগপ্রবণ ,দিবা-স্বপ্নে বিভোর। তাদের একমাত্র চাহিদা রোম্যান্টিক ভালবাসা!
জনপ্রিয় কার্টুনগুলি লিঙ্গ ছকের থাবা থেকে মুক্তি পায়নি। বিদেশি জনপ্রিয় কার্টুনগুলিতে সেই লিঙ্গ ছক বিরাজমান। দা ফ্লিন্টস্টোন ও টেক্সাস ল্যাবরেটরিতে কার্টুন চরিত্রের চলন,বলন, শরীরী ভাষা ও নিত্যদিনের কাজকর্মের মধ্যে বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়। কার্টুন নেটওয়ার্কের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জনি ব্রাভো, স্কুবি ডুবি হোয়ার আর ইউ। জনি ব্রাভো কার্টুনে আমরা দেখি জনির পুরুষালি সুঠাম দেহ, মহিলাদের প্রতি সে আকৃষ্ট, সবসময় মহিলাদের সঙ্গে ফ্লাট করছে। অন্যদিকে, স্কুবি ডুবিতে মহিলা চরিত্রদের দুর্বল ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিপদে পড়লে পুরুষেরা মহিলাদের উদ্ধার করছে। মহিলাদের নির্বোধ,অবলা দেখানো হয়েছে। প্রায় সবার প্রিয় কার্টুন টম এন্ড জেরি। এই কার্টুনে কি পরিমাণ হিংসাত্মক কার্যকলাপ দেখানো হয় সে প্রসঙ্গে আর নাই বা বললাম! এই জনপ্রিয় কার্টুনে টমকেও পৌরুষপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে,তার প্রেমিকা টুডলসকে আকৃষ্ট করতে দেখা যায়। পেপ্পা পিগ এই সময়ের জনপ্রিয় কার্টুন। এই কার্টুন নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। পেপ্পা পিগের অনেক পর্বে বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা গেছে। তবে পেপ্পা পিগের ২০০৯ সালের একটি পর্বে, যৌনতাবাদী ভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল বলে লন্ডন ফ্রায়ার ব্রিগেড টুইটারে তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল-
Come on @peppapig, we’ve not been firemen for 30 years. You have a huge influence on kids & using out of date stereotypical gender specific wording prevents young girls from becoming firefighters. Join our #Firefightingsexism campaign
আমাদের দেশেও বিদেশি কার্টুনের মতো প্রধান চরিত্রে পুরুষদের রমরমা দেখা যায়। ছোটা ভীম কার্টুনে লিঙ্গবৈষম্য দেখা যায়। ছোটা ভীমে জনপ্রিয় চরিত্র চুটকি। চুটকি কার্টুনের অন্যান্য চরিত্রদের থেকে ফর্সা, সুন্দর। তার লাল টুকটুকে গাল। সে ছেলেদের সঙ্গে খেলা করে ঠিকই, তবে পাশাপাশি ঘরকন্নার কাজ দক্ষ হাতে সামলায়। তবে ভীমের মত কখন তাকে শক্তিশালী রূপে দেখা যায় না। আবার, কুম্ভ কর্ণ কার্টুনে তারাকেও দেখা যায় ঠাকুমার সঙ্গে রান্না করতে। সে কুম্ভ,কর্ণের সঙ্গে নানান দুঃসাহসিক কাজের সঙ্গী হয় তবে পাশাপাশি সে যে লক্ষ্মী মেয়ে সেটা দেখাবার জন্যই বোধহয় তাঁকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করতে হয়!
ভারতীয় এনিমেশনে মহিলা চরিত্রগুলির বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় পিতৃতান্ত্রিক ছকে তাঁদের আঁকা হয়েছে, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁদের জীবন আটকিয়ে।
সারা বিশ্ব জুড়ে ডিজনি কার্টুন, চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ডিজনি চলচ্চিত্রও ভয়াবহ লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। লিঙ্গ ছকের বৈষম্যে চারটি সাধারণ উদাহরণ হল- ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, ঘরোয়া আচরণ, পেশা এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্য। সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে ডিজনির রাজকুমারীদের ব্যক্তিত্ব মাপা হয়। আবার, পুরুষেরা তাঁদের পুরুষালি সাহসিকতায় মহিলাদের আকৃষ্ট করে। ১৯৩৭ সালের স্নো হোয়াইট এন্ড সেভেন ড্রফস চলচ্চিত্রে স্নো হোয়াইটের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে দেখানো হয়েছে তরুণী মেয়েদের অন্যদেরকে খুশি রাখতে গেলে - ঘর পরিষ্কার, রান্না, এবং বাড়ির অন্যান্য কাজ জানলেই চলবে। আগের ডিজনি রাজকুমারী চলচ্চিত্রে আমরা দেখেছি- স্নো হোয়াইট, অরোরা, সিনড্রেলা, এরিয়েল, বেল তাঁদের সত্যিকার প্রেম খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাঁদের প্রিন্স চার্মিং-এর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতিটি ডিজনি রাজকুমারী নিখুঁত সুন্দরী, তাঁদের সরু কোমর, মাথাভর্তি চুল,অসাধারণ গান গেয়ে রাজকুমারদের মন জয় করে নেয়। ছোট শিশুরা এই বৈষম্য দেখে বড় হচ্ছে! তাঁদের মনে কতটা কুপ্রভাব পড়ছে আন্দাজ করা যাচ্ছে! প্রতিটি ডিজনি রাজকুমারীরা দুটি কাজ দক্ষতার সঙ্গে করে- ঘর পরিষ্কার এবং গান। নতুন ডিজনি প্রিন্সেসরা অতিরিক্ত সুন্দরী, তবে তারা আতুপুতু মার্কা নয়, একটু লড়াকু। নতুনদের ভিড়ে টিয়ানার কথা আলাদা করে বলতে হয়। টিয়ানা প্রথম কালো ডিজনি রাজকুমারী। তবে টিয়ানার গড়ন বাকি রাজকুমারীদের মত।
শিশুরা কার্টুন দেখতে দেখতে কল্পনার জগতে বাস করতে শুরু করে। শিশুপুত্ররা ছোট থেকে বিশ্বাস করে মেয়েরা দুর্বল। ছোটদের কিছু সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে তারা জানাচ্ছে- কার্টুন দেখে তারা জানতে পেরেছে মেয়েরা ভিতু হয়, দুর্বল হয়! সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ডিজনি-চলচ্চিত্র দেখে শিশুকন্যাদের ‘প্রিন্সেস এফেক্ট’ নামক মারাত্মক মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। শিশুকন্যারা ছোট থেকে নিজের শরীর নিয়ে অতি মাত্রায় সচেতন হয়ে পড়ে। ত্বকের রঙ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। ছোট থেকে রূপকথার গল্প শুনে,ডিজনি প্রিন্সেসদের দেখে বড়ো হওয়া শিশুকন্যাদের ভবিষ্যৎ খুব একটা আনন্দের হয় না, মনের অজান্তে তাঁরা গভীর অসুখের শিকার হয়। শিশুপুত্র বা শিশুকন্যা যখন রূপকথার গল্প শোনে বা দেখে তখন কল্পনাতে ভেসে যায়। তাঁরা বাস্তব ও কল্পনার গোলক ধাঁধায় দুলতে থাকে। একসময় শিশুরা নিজেদের সত্যিকারের রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা ভাবতে শুরু করে। সবথেকে বেশি শিশুকন্যাদের মধ্যে এই প্রভাব দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রভাবকে বলা হয়ে থাকে ‘প্রিন্সেস এফেক্ট’। প্রতিটি ডিজনি রাজকুমারী- এলসা, জেসমিন,এরিয়েল, বেল, স্নো হোয়াইট, সিনড্রেলার ছিপছপে গড়ন, সুন্দর ত্বক, টুকটুকে গাল, বড় চোখ, সরু কোমর। এই রাজকুমারীদের দেখে ছোট শিশুকন্যারা সুন্দর হতে চাই। ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার একটি পোলে দেখা গেছে ৫০% বেশী ৩-৬ বছর বয়সী শিশুকন্যারা মোটা হয়ে যাবে বলে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। আবার, যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিংহাম ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সারাহ কোয়েনের এক বছর ধরে ১৯৮ জন শিশুর (যাদের গড় বয়স ৫ বছর) উপর একটি গবেষণা চালান, সেই গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশুকন্যারা নিজের শরীর নিয়ে অসন্তুষ্ট, তাঁরা প্রায় সবাই ডিজনি-রাজকুমারীদের চলচ্চিত্র দেখে। সুন্দরী এবং নিখুঁত দেহের এই রাজকুমারীদের দেখে ৩ বছর বয়স থেকে ছিপছিপে গড়নের শরীর চাইছে! সময়ের অনেক আগে একটি শিশু বড় হয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা বয়ঃসন্ধিকালে মারাত্মক বডি-ইমেজ সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।
এতক্ষণ যে কার্টুন ও কার্টুন চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করলাম, তাতে দেখা যাচ্ছে মেয়েদের চরম অবমাননা করা হচ্ছে। শিশুদের কার্টুন, কার্টুন চলচ্চিত্রে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে দেখানো হয়। শিশুদের কার্টুনে প্রেমকে কেন প্রাধান্য দেওয়া হয়? প্রিন্স চার্মিং-এর স্বপ্ন, ঘরকন্নার কাজ, আই-ক্যান্ডি সাজ সব মিলিয়ে একটি কার্টুনকে কি ভাবে ছোটদের বিনোদন বলা যায়? অভিভাবকরা নিশ্চিন্ত মনে শিশুদের কার্টুন দেখার অনুমতি দেন। তবে, কার্টুন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ সচেতনতার প্রয়োজন আছে।
রাজা বলিলেন, -“তুমি কোন দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র, আমাদিগকে মরণ-ঘুমের হাত হইতে রক্ষা করিলে!“ (ঘুমন্ত পুরী, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ) আমাদের সকলের সমাজের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা আছে, ঘুমন্ত পুরী গল্পে রাজপুত্র যেমন কাঠি ছুঁইয়ে সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল, তেমনি আমাদের ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সেই মায়াবী কাঠির স্পর্শ!
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৪ আগস্ট ২০২০
ছবি সংগৃহীত
লেখক : অধ্যাপক ও সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment