পরিচারিকার লকডাউন যাপন

  • 31 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1101 view(s)
  • লিখেছেন : জিনাত রেহেনা ইসলাম
লকডাউনে গৃহপরিচারিকাদের কেউ কাজ হারিয়েছেন, কারো মাইনে কাটা গেছে। এই অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য আইন নেই, ইউনিয়নের জোর নেই। মালিকদের মর্জিমাফিক পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয়। ইচ্ছে মতো ছাড়িয়ে দেওয়া যায়। লকডাউন তাঁদের জীবনকে ফেলে দিয়েছে চরম আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে।

সোশ্যাল সাইট জুড়ে বিস্তর ঘোষণা ও সহমর্মিতার পাঠ জলেই গেল। এত করেও  ‘ভাজে ঝিঙে তো বলে পটল’ রোখা গেল না। মালিকপক্ষ কাজের মেয়েদের বিনা কাজে মাইনে গুনতে অস্বীকার করল। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শিক্ষিতদের গার্হস্থ্যের কাজে নিযুক্ত মেয়েকে সবেতন ছুটির অঙ্গীকার ও প্রচার নেটপাড়ায় বিষম খেয়ে বেবাক ঘুরপাক খেতে লাগল। বাস্তবের মাটিতে দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে খালি হাতে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরল পরিচারিকা। মালিকপক্ষের  কেউ  কলিং বেলে হাত দেওয়ার জন্য বেল সানিটাইজ করতে করতে বলল, ‘ডাকতে পারতিস! এই সময়ে বাড়ির বেলে কেউ হাত দেয়? এখন স্যানিটাইজারের আকাল রে!’  টানা পাঁচ বছর কাজের পর এমন কথা শুনে আঘাত সইতে খুব কষ্ট হলেও শেষমেশ দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই হল কাজের মেয়েকে। আবার কেউ কেউ ফোন করে বলে দিল, ত্রিসীমানায় যেন দেখা না যায়! দেখলেই পুলিশ ধরছে। ভয়ে কুঁকড়ে বসে রইল  পরিচারিকা। লকডাউনের মাসের টাকাটাও হিসেব করে নিতে আসতে পারল না। মালিক তো মালিকই। কাজে রাখার ও বরখাস্ত করার অপার একনায়কতান্ত্রিক   ক্ষমতা তার। তিনিই বলে দেন কাকে কাজে রাখতে চান আর কাকে খেদিয়ে দিতে বাধা নেই তার।    

পরিসংখ্যান বলছে পরিচারিকার কাজ এই দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পেশা। বহুসংখ্যক মেয়ে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই কাজের জন্য আলাদা করে কোনও প্রশিক্ষণের দরকার নেই। শ্রমের মূল্য ধরে পয়সা না মিললেও কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতা কম। তাই এই কাজে যোগ দিয়ে উপার্জনের তাগিদ। কিন্তু এত মানুষ এই পেশায় থাকার পরেও এদের কাজের নিশ্চয়তা নিয়ে তেমন কোনও রক্ষকবচ নেই। এদের কাজ মাসের যে কোনও সময় যে কোনও কারণে চলে যেতে পারে। এবং পুরো মাসের মাইনে না দিয়েও অনুপস্থিতির দিনের মাইনে কেটে একরকম তাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। লকডাউনে পরিচারিকাদের সঙ্গে একদম সেটাই হয়েছে। লকডাউনের মাসের মাইনে ২১ বা  ২২ দিনের পেয়েছে অনেক হিসেব করে। অনেকে সেটাও লকডাউন উঠলে তবেই পাবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে যে মেস বা ভাড়া বাড়িতে তারা কাজ করত সেখানেও সকলে বাড়ি চলে যাওয়ায় টাকা পায়নি। রেশনের সাহায্য ও এলাকার ত্রাণ তাদের এবার কিছুটা বাঁচিয়ে দিয়েছে।

গঙ্গা পেরিয়ে কাজে আসে পূর্নিমা। লকডাউনের সময় মেসের ছেলেরা চলে যাওয়ার আগে চালের বস্তা দিয়েছিল। সেটায় তার চলে গেছে লকডাউনের দিন। কিন্তু হাতে পয়সা নেই। নদী পেরিয়ে মাত্র চার টাকা দিয়ে যাওয়া-আসা করতে ভাবতে হচ্ছে তাকে। এই অভাব তার থাকত না যদি সে মাস মাইনে পেত। মাসুমা প্রায় দশ বছর ধরে পরিচারিকার কাজ করছে। লকডাউনের দিনে মোবাইলে টাকা ভরতে পারছে না। পয়সা নেই। মালিককে ফোন করেছিল, ধরেনি। এদিকে স্বামী রাজ্যের  বাইরে আটকে। কি করে কি করবে বুঝতে পারছে না। সামিমা বন্ধন থেকে টাকা নিয়ে ঘরের ছাদ মেরামত করেছিল। টুকটুক কিনে দিয়েছিল স্বামীকে। দুই মাস স্বামীর রোজগার নেই। আবার নিজেও ঘরে বসে। লোনের টাকা দিতে পারছে না কিছুতেই। এমন অবস্থায় রাতের ঘুম ছুটে গেছে তার। পুতুলের স্বামী আবার দুই বৌ নিয়ে থাকে। পুতুল আপশোস করে বলে, “আমার কাজ বন্ধ, আরেকজনের কাজ তো চলছে। পুলিশের মেসে রান্না করছে সে। আমার চোখের সামনে ওদের ভালোবাসা দেখছি। আমার জীবন জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। বেশীদিন আমি ঘরে বসে থাকলে বিষ খেয়ে নেবো।“ পুতুলের কাছে এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছে তার নিজের ঘর। আবার ফরিদার হয়েছে মহা বিপদ। যে ফ্ল্যাটে কাজ করে তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে লকডাউনকালীন কাজ করতে হলে বাড়ি যাওয়া চলবে না। বাড়িতে ফরিদার অসুস্থ মা, বাচ্চা ছোটো। এমন শর্ত কিছুতেই তার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। ফরিদা রাজি না হওয়ায় তাকে কাজে আসতে বারণ করে দেওয়া হয়। কাজ তার আছে কি নেই সেটাও ফরিদা নিশ্চিত জানে না।

পরিচারিকাদের বাড়িতেও শান্তি নেই। স্ত্রীর ইনকাম নেই । আবার হাতে নগদ পয়সাও নেই। স্বামী জুয়ার আড্ডায় বসছে। নেশাও করছে। বাড়ি ঢুকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। একদিকে অভাব আর অন্যদিকে অত্যাচার সমানে চলছে।  পরিচারিকা জানেরা বলে, দুই মেয়ের জন্য খাবার জুটাতে পারছি না, আবার  দোকানে কাজ করা স্বামীর কাজও নেই। বাড়িতেই যত মেজাজ আর মারধোর চলছেই।“

বছরের শুরুতেই বাঁকুড়া থেকে এসেছিল এগারো বছরের শিখা মুর্শিদাবাদে। মালিকের  বাড়িতে থাকবে ও লেখাপড়া করাবে এই শর্তেই শিখা আসে। কিন্তু শিখাকে স্কুলে ভর্তি না করে বাড়িতে বাচ্চা ধরার কাজে ব্যস্ত করে দেওয়া হয়। মেয়ের মামা  অভিযোগ করছে যে, মেয়ে কিছুতেই থাকতে চাইছে না। কিন্তু লকডাউনের জন্য ওরা মেয়েকে নিতে আসতেও পারছে না। এইরকম অনেক পরিবারে এমন নাবালিকাকে কাজে রাখার অভ্যাস অব্যাহত। পরিচারিকারা নানা অভিযোগে জর্জরিত হয়। মৌখিকভাবে হেনস্থা তো চেনা ধারাপাত। কিন্তু শ্রম চুরির অভিযোগে মালিকের বিরুদ্ধে বিচার চায়নি পরিচারিকারা। মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমের পয়সা  কেটে নেওয়ার কথা মুখে আনতেই বিস্তর বুকের পাটা দরকার। তার উপর আবার কাজ না করে পয়সা দাবি করার কথা পরিচারিকার কল্পনা করাও পাপ। এদিকে ব্যালকনিতে শোরগোল “আমরা বেতন দিয়ে কাজের মেয়ে বিদায় করলাম।“ এই আমরা থেকে আসল আমি কে বের করে আনা শুধু দুঃসাধ্য নয়। প্রায় অসম্ভব।  তাই সেই ‘আসমান সে  গিরা, খাজুর মে আটকা’ পড়ে থাকল লকডাউনে পরিচারিকাদের জীবন।  

পরিচারিকদের পারিশ্রমিক ও কাজের সময়সীমা  বেঁধে দেওয়া খুব জরুরি। বেশ কিছু রাজ্য এ বিষয়ে  গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। রান্না করার জন্য ৫৫৩৮ টাকা বেঁধে দিয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্রিশগড় সহ বেশ কিছু রাজ্য সরকার। তাছাড়া কাজের সময় এক ঘণ্টার বেশী হলে জলখাবার দেওয়ার কথাও বলা  হয়েছিল। কেরালা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুতেও পরিচারিকাদের সামাজিক সুরক্ষা ও নানা সরকারি সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। এ রাজ্যে গৃহ পরিচারিকা ইউনিয়ন কলকাতা, হাওড়া, বীরভূম, চব্বিশ পরগনায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও সেভাবে পরিচারিকাদের অধিকার আদায়ে  সরব হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া  ইউনিয়ন থাকলে নিজেদের পক্ষ নিয়ে বলার মত অবস্থা পরিচারিকাদের নেই। তার মূল কারণ শিক্ষার অভাব। তার চেয়েও বড় কথা নিজেদের অবস্থান নিয়ে গঠনমূলক ভাবনার জায়গায় তারা আজও অবস্থান করে না। সমাজভাবনা তাদের  সে স্পেস দেওয়ার ক্ষেত্রে  বিশেষ কিছু উৎসাহ দেখায়নি। নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে নানা অনলাইন সেন্টার ও এজেন্সি। সেখানেও সেই ঘণ্টা ভিত্তিক কাজের জন্য পারিশ্রমিক। মানবিকতার অন্দরমহল ক্রমশ অবরুদ্ধ হচ্ছে। পরিচারিকাদের সঙ্গে একটি পারিবারিক একাত্মতা গড়ে উঠত। এক্ষেত্রে শুধু লেনদেনই প্রধান হয়ে উঠছে।  যান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়োগের ফলে  বিশ্বস্ততায় এক বড় চিড় ধরার সব পরিস্থতি মজুত থাকছে।

অধিকার ও দাবি বুঝে নেওয়ার জন্য বড় আন্দোলনের পথে হাঁটতে দেখা যায়নি পরিচারিকাদের। আমেরিকায় (১৮৮১) যেভাবে নিজেদের অধিকার আদায়ে আন্দোলনে নেমেছিল পরিচারিকারা তেমন কিছু এখানে হয়ে ওঠেনি। ২০১৫ সালে মেক্সিকোতে ১৫ বছর লড়াইয়ের পর গড়ে ওঠে পরিচারিকাদের ইউনিয়ন। লেবাননেও অভিবাসী পরিচারিকার মৃত্যু নিয়েও পরিচারিকারা আন্দোলনে সোচ্চার হয় ও পথে নামে। এখানে পরিচারিকাদের সম্পর্কে এমন একটা নেগেটিভ ভাবনার ন্যারেটিভ রয়েছে যে এদের বিরুদ্ধে মালিকের আনা সব অভিযোগকেই সত্য বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা আছে। তার প্রমাণ মেলে বন্দনা মহাকুর ও  জোহরা বিবির ঘটনায়। আরও হারিয়ে যাওয়া উদাহরণ আছে অনেক। কিভাবে মিডিয়া ও পুলিশের ভূমিকা একটি জীবনের ইতিহাস বদলে দেওয়ার ভূমিকায় নিজেদের রেখে দেয় তা এক ঐতিহাসিক দলিলের মত মাথা চাড়া দেয়। যে মানুষগুলো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘর মুছে, বাসন মেজে বাড়িটাকে সুন্দর করে রাখলো তাকে সেই বাড়ির বাথরুমে ঢুকতে দেওয়া হল না। যে সোফা সে প্রতিদিন ঝাড়ে সেখানে তাকে একদিনের জন্য বসতেও দেওয়া হল না। এমন এক বৈষম্যের জীবন সে মেনে নিল আজীবন। কারণ অধিকারের স্বরূপ সে জানে না। মালিক সমাজ নিজেদের শিক্ষার কাঁচের ঘরটা অধিকারের লড়াই-এর  সেমিনারে ও ভাষণে ভরিয়ে দিল। এভাবেই ক্যাকটাসে পাথরের ঘা সকলের নজর এড়িয়ে গেল।   

পরিচারিকাদের জন্য কোনোও বিমার ব্যবস্থা নেই। এদের কোনও নির্দিষ্ট ছুটির  দিনও নেই। তাদের মাইনের কোনও রসিদও নেই। নেই যাতায়তের আলাদা কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা। খুম কম পয়সায় মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতেই এদের কাজে রাখা হয়।  অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে এদের আলাদা কোনও সুবিধাও নেই। একটা বয়সের পর তারা আর দৈহিক পরিশ্রম করতে পারে না। সেজন্য তাদের কথা সরকারিভাবে কিছু ভাবা হয় না। অসময়ে কাজে বহাল না থাকলেও তাদের পারিশ্রমিক বা আগাম টাকা দেওয়ার কোনও বাঁধাধরা নিয়মও নেই। সবটাই মালিক পক্ষের উদারতা ও বিবেকের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যার পরিণতিতে পরিচারিকাদের নানাভাবে শোষণের পথ  খোলা থাকছে।

লকডাউন উঠে যাবে। কিছু পরিচারিকা কাজ ফিরে পাবে। বেশিরভাগটাই হারাবে। খুশির ইদে এদের ঘরে একটা নতুন পোশাক এল না। সারাবছর কাজ করেও এই উৎসবের দিনে প্রাপ্য হারাল ফরিদারা। পূর্ণিমারা পয়সার অভাবে কাজের বাড়িতে প্রাপ্য টাকা নেওয়ার জন্য বারবার আসতেও পারল না। ত্রাণের সন্ধানেও পৌঁছতে  পারল না সব জায়গায়। যারা কাজ হারাল  তাদের নতুন কাজ খুঁজতে সময় লাগবে। মাসের মাঝপথে নতুন নিয়োগ মালিকরা চায় না। এই দীর্ঘ অভাবের পরে আবার নতুন করে অভাবের মুখে পড়বে এই কাজে বাদ পড়া পরিচারিকারা। এদের জন্য কোনও প্যাকেজ নেই। কোনও আলাদা ঘোষণাও নেই। এদের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য ভালো একটি স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া নেই। ক্ষমতার সমীকরণে  তুলোধুনা হচ্ছে এদের জীবন। কিন্তু মরীচিকায় জল খুঁজতে যাওয়ার সাহস কার! মানুষের বোধ ও সমাজ চেতনা সমান্তরাল না চললে অসাম্যের ভার থেকে মুক্তি খোঁজা মুশকিল। একদিকে সমতার ঢক্কানিনাদ অন্যদিকে নিজের মধ্যের ইভিলসকে শর্তসাপেক্ষে বাঁচিয়ে রাখার অভ্যাস কখনোই  সমাজকে  ঠিক দিশা দেখাতে সমর্থ হবে না। যাদের পরিচারিকাদের ঢাল হওয়ার কথা ছিল। এবং  শোষণের বিরুদ্ধে পাঠ দেওয়ার কথা ছিল তারাই ওদের পিঠ দেখিয়ে চললে ভরসার হাত আর তারা কোথায় খুঁজবে? নিয়োগকর্তা মালিকের দায় নিযুক্তের প্রতি সঠিক আচরণ প্রদর্শন। এই অভ্যাস সমাজের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা ও প্রতিষ্ঠা করা। লকডাউনের যে চিত্র পরিচারিকাদের হাহাকারের কথা তুলে ধরছে তা থেকেই একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে আসা দরকার। ওদের বাঁচাবে কে? সরকার নাকি মালিক নাকি নিয়মের নতুন কোনও বজ্রআঁটুনি? 

প্রতীকী ছবি

লেখক  শিক্ষক ও সমাজকর্মী

0 Comments

Post Comment