- 19 September, 2023
- 0 Comment(s)
- 1988 view(s)
- লিখেছেন : ড. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত
প্রস্তাবনা
বিদ্যাসাগরকে নানাভাবে স্মরণ ও প্রণতি জ্ঞাপনের যে ধারা চলছে, সেইসব প্রয়াস তাঁর সমাজ আন্দোলন, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও শিক্ষাব্রতী হিসেবে অবদানের ওপর আধারিত। বস্তুত আজ যে আমি কলম ধরে এই নিবন্ধটি লিখছি সেটিও কিন্তু বিদ্যাসাগরের নির্বন্ধে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের ধারাবাহিক অভিঘাতেই। বক্ষ্যমান আলোচনায় তাই স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর যে অবদান, সে বিষয়ে আলোকপাত করে প্রণতি নিবেদন করবে এই কলমচী। সেই সঙ্গে স্ত্রীশিক্ষা মানে শুধু মাত্র যে মেয়েদের লেখাপড়া শেখা নয়, শিক্ষা যে কোথাও মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়া ও সমাজে সমানাধিকারের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও এই সূত্রে অনুধাবন করা জরুরি।
একটা ব্যক্তিগত কথা দিয়ে শুরু করা যাক। আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গিয়ে প্রথম বুঝেছিলাম বিংশ শতকের শেষ দশকেও বহু পুরুষ এমনকি কিছু মহিলাও মেয়েদের গৃহকোণ ছেড়ে কর্মজগতে এসে সমান ভাবে কাজ করার এক্তিয়ার নিয়ে নিঃসংশয় নন। তাই অবলীলায় মহিলা সহকর্মীকে চা আনার হুকুম দেবার পুরুষালী অভ্যাস কিংবা মহিলাশিক্ষক হয়ে পুরুষদের অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদ করাকে স্পর্ধা মনে করার মেয়েলিপনাও লক্ষ্য করতে হয়েছে। বস্তুত শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখেই যে মেয়েরা কর্মজগতে আসে আর শিক্ষা আছে বলেই সমানাধিকার দাবি করতে পারে, সেই পরম সত্যটা খুব গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলাম আর বুঝেছিলাম মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজন কেন সেই উনিশ শতক থেকে আজও সমান গুরুত্বপুর্ণ। সেই অনুভূতি থেকেই ফিরে তাকাতে চাই বিদ্যাসাগরের স্ত্রীশিক্ষায় অবদানের দিকে।
।১।
১৯ শতকের বাংলার নবজাগরণের প্রধানতম লক্ষণ ছিল যুক্তিবাদ ও সংস্কারমুক্তি। ঠিক এই জায়গা থেকেই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল মেয়েদের জীবনকে যেভাবে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করত নানা সংস্কারের দোহাই দিয়ে, যুক্তি দিয়ে তার মূলে কুঠারাঘাত করা। তাই বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ রোধ— এই সমস্ত কিছুই এসেছিল মেয়েদের জীবনের একটা upliftment ঘটানোর লক্ষ্যে। সেই পথে বাধা যেমন এসেছে, শাস্ত্রের দোহাই যেমন এসেছে, তেমনই বিদ্যাসাগরের মতো জেদী ও সাহসী মানুষরা পাল্টা শাস্ত্রীয় যুক্তি দিয়েই সেসব খন্ডন করে রাস্তা করে দিয়েছেন মেয়েদের পুর্নবাসনের, যার পথ বেয়ে আজ আমরা একুশ শতকে এসে দাঁড়াতে পেরেছি।
এদেশের সমাজপতিদের প্রচলিত বক্তব্য ছিল যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হয়। অন্তর্নিহিত কথাটি হল যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে তাদের নিয়ম, নীতি, শাস্ত্রবিধান ইত্যাদির গালগল্প দিয়ে বোকা বানিয়ে আর তাঁবে রাখা যাবেনা। ফলে তাদের অজ্ঞান ও মূর্খ রাখাটাই বুদ্ধির কাজ। অথচ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০তে রচিত পাণিনীর ব্যাকরণেও স্ত্রীশিক্ষার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর গ্রন্থের VI ২.৪৬নং শ্লোকে ছাত্রীশালার কথা আছে যা প্রমাণ করে মেয়েরা তখনো লেখাপড়া করতেন। এছাড়া “উপাধ্যায়া, “আচার্যা” শব্দদুটি প্রমাণ করে সেকালে নারীরা শিক্ষকতাও করতেন। প্রাচীন ভারতে গার্গী, মৈত্রেয়ী, অপালা, ঘোষার মতো বিদুষী নারীদের নামও সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
বৌদ্ধযুগেও নারীশিক্ষার প্রসার ঘটে। শীল ভট্টারিকা কর্ণাটের মহিলা কবি বিজংকারের প্রতিভার কথা বলেছেন, আবার শঙ্করাচার্যের সঙ্গে বেদান্ত নিয়ে তর্কে উভয়ভারতী নামের এক বিদুষী মহিলার কথাও জানা যায়।
মধ্যযুগে মুসলমান সমাজে মেয়েদের প্রথম স্তরে আরবি ফার্সি শিক্ষা দেওয়া হত। বদায়ুনি ও আবুল ফজলের রচনায় মহিলা কবিদের কথা পাওয়া গেছে। বাবরকন্যা গুলবদন লিখেছিলেন “হুমায়ূন নামা”। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাট আকবর পরিবারের উচ্চবর্ণের মেয়েদের শিক্ষা প্রদান করার কথা ভেবেছিলেন। জাহাঙ্গীরের ভূমিদান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এক শিক্ষিত নারী, আকবরের ধাত্রীমা মোহাম আনাগা শিক্ষিত ছিলেন, মেয়েদের জন্যে মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন।
মধ্যযুগের হিন্দুসমাজের উল্লেখযোগ্য শিক্ষিত নারী ছিলেন চাঁদবিবি। এছাড়া মঙ্গলকাব্যে ও ময়মনসিংহ গীতিকাতেও শিক্ষিত মেয়েদের তথ্য পাওয়া গেছে। কবি চন্দ্রাবতী সেই সময়ের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি নাম। অর্থাৎ ভারতবর্ষে মেয়েদের, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের সমাজের মেয়েদের শিক্ষার বিষয়টি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিদেশি শাসনগ্রস্ত হিন্দুসমাজ ধর্মের নামে নানা সংস্কারের বেড়াজালে নিজেদের সুরক্ষিত করার জন্যে যেভাবে অনুশাসন আরোপ করা শুরু করে, তাতে প্রথমেই কোপ পড়ে মেয়েদের স্বাধীনতায় এবং অনিবার্যভাবে তাদের শিক্ষায়। তারা হয়ে পড়ে অন্তঃপুরবাসিনী। এরপর একে একে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহের মতো অভিশাপ নেমে আসে মেয়েদের জীবনে।
।২।
১৯ শতকের নবজাগরণ যখন যুক্তিবাদ ও সংস্কারমুক্তির পথে পা বাড়াল রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখের প্রচেষ্টায়, তখন নতুন করে মেয়েদের জীবনকে আরেকবার পুনর্বাসন দেবার প্রয়োজন অনুভূত হল প্রবলভাবে। সতীদাহপ্রথা বিলোপ, বিধবাবিবাহ প্রচলন এল এই প্রচেষ্টাতেই। আর এল অবশ্যম্ভাবী হয়ে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনটিও।
সতীদাহবিরোধী আন্দোলনের সময় উপনিষদ ও নানা ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রামমোহন রায় তাঁর ‘‘প্রবর্তক নিবর্তক” নামের বইতে স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে সওয়াল করলেন। লিখলেন— “স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোনও কালে লইয়াছেন যে তাহাকে অল্পবুদ্ধি বলেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা এবং জ্ঞানশিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয় কিরূপে নিশ্চয় করেন?”
এই পথেই এরপর পাই বিদ্যাসাগরকে। যেমনভাবে শাস্ত্র ঘেঁটে তিনি প্রমাণ করেছিলেন বিধবার পুনর্বিবাহ অশাস্ত্রীয় নয়, ঠিক তেমন ভাবেই আবারও মহানির্বাণ তন্ত্রের একটি শ্লোক তুলে নারীশিক্ষা বিষয়টিরও শাস্ত্রীয় বিধান দেখিয়ে দিলেন। সেই শ্লোকটি এইরকম—“কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যত্নত”— যার অর্থ কন্যাকেও ঠিকভাবে পালন করতে হয় এবং যথাযথ শিক্ষাও দিতে হয়।
দেখে নেওয়া যাক বিদ্যাসাগর সক্রিয়ভাবে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে যোগদান করার আগে এ দেশে স্ত্রীশিক্ষার কাজটি কিভাবে শুরু হয়েছিল। “Historical and Topographical Sketch of Calcutta” নামক গ্রন্থে পাওয়া যায় ১৭৬০ সালে মিসেস হোজেস নামে এক বিদেশিনী মিশনারীদের সহায়তায় প্রথম একটি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। তারপরে ১৭৮৯ সালে ও ১৭৯২ সালেও বিদেশিনীদের দ্বারা আরো দুটি স্কুল স্থাপিত হয় মেয়েদের জন্যে। তবে এই স্কুলগুলিতে মূলতঃ বিদেশী বালিকারাই পড়াশনা করত। বাঙালি বাড়িতে অভিজাত পরিবারে মেয়েদের বাড়ির ভেতরেই লেখাপড়ার চল ছিল অবশ্য। কিন্তু বাঙালি সাধারণ ঘরের মেয়েদের পড়াশোনার জন্যে কোনো স্কুল তখনো গড়ে ওঠেনি।
১৮১৪ সালে ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে “Female Juvenile Society” স্থাপিত হল। এর অধীনে উল্টোডাঙায় অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হল বাঙালি মেয়েদের জন্যে। ১৮১৭ সালে রাজা রাধাকান্ত দেব প্রতিষ্ঠিত “Calcutta School Society”র অধীনে কয়েকটি স্কুলেও ছোট ছোট মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হত ছেলেদের সঙ্গে।
১৮২২ সালে পণ্ডিত গৌরমোহন তর্কালঙ্কার লিখলেন “স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক” নামে একটি বই। ১৮২৪ সালের মধ্যে তার ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হল। সেটি পাঠ্যও হল বিদ্যালয়গুলিতে। ১৮৩৬ সালে অ্যাডাম সাহেব প্রদত্ত সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায় ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত মিশনারীদের চেষ্টায় বাংলাদেশের নানা জেলায় ১৯টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয় আর তাতে প্রায় ৪৫০ জন বালিকা ছাত্রী হয়ে আসে। এভাবে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে চর্চা শুরু হয়।
১৮৪০সালে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় স্ত্রীশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন ও পুরস্কার পান। ১৮৪২ সালে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যেও স্ত্রীশিক্ষার মাহাত্ম্য নিয়ে প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়। তাঁরাও উপলব্ধি করলেন মেয়েদের শিক্ষার কতটা প্রয়োজন। এই কাজে আরো যাঁরা এগিয়ে এলেন তাঁরা হলেন রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, অক্ষয় কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ।
এর অব্যবহিত পরেই ১৮৪৭ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে বারাসাতে তৈরি হল বাঙালি পরিচালিত প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। তার পুরোভাগে ছিলেন কালীকৃষ্ণ মিত্র, নবীনকৃষ্ণ মিত্র ও প্যারীচরণ সরকার। এই কাজে সক্রিয় যোগদান না থাকলেও পূর্ণ সমর্থন ছিল যুবক বিদ্যাসাগরের। এই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীও তাঁর স্নেহভাজন কুন্তীবালা। পরবর্তীকালে স্কুলটির নাম হয় “বারাসাত কালিকৃষ্ণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়”।
।৩।
১৮৪৮ সালে বড়লাটের আইনসভার সদস্য হয়ে এলেন ড্রিংকওয়াটার বেথুন। সেই সঙ্গে তিনি বাঙলাদেশের শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতিও হলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন বেথুন। স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্যে তিনি কলকাতার মেয়েদের জন্যে বালিকা বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করলেন। ১৮৪৯ সালের ৭ মে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা হল Hindu Female School। চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় “স্ত্রী শিক্ষায় বিদ্যাসাগর” প্রবন্ধে লিখছেন যে এই বিদ্যালয় স্থাপন করে বেথুন বিদ্যাসাগরকে এর সম্পাদকীয় ভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। Honorary Secretary হিসেবে যোগদান করে বিদ্যাসাগর এই বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধান ও উন্নতির জন্যে যত্নবান হলেন। তাঁর ব্যবস্থাপনায় এই স্কুলে মেয়েদের পড়ানো হতো পাটিগনিত, পদার্থবিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি। মনুসংহিতার যে শ্লোকটির কথা আগেই বলা হয়েছে, সেই শ্লোকটি লেখা থাকত মেয়েরা যে গাড়ি করে স্কুলে আসত তার দুদিকে বিদ্যাসাগরেরই পরিকল্পনায়। এর উদ্দেশ্য ছিল যে এতে করে যদি সমাজের মানুষ বোঝে স্ত্রীশিক্ষা শাস্ত্রসম্মত ও সদাচার অনুমোদিত। কাজ শুরু হবার পরে বিদ্যালয়ের নিজস্ব বাড়ী তৈরির জন্যে অর্থসংগ্রহের কাজও চলল। ১৮৫০ সালে বিদ্যালয়ের নিজস্ব গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছে। এই কাজেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৫১ সালে বেথুনের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্যে তাঁর নামেই স্কুলের নাম হল বেথুন স্কুল।
কিছু মতবিরোধের কারণে বিদ্যাসাগর কিছুদিন পরে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। কিন্তু বেথুন স্কুল সম্পর্কে তাঁর মমত্ব অটুট ছিল আর স্ত্রীশিক্ষার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাও কমেনি। সে তথ্য আসবে আলোচনাক্রমে।
১৮৫৪ সালে বিলেত থেকেও এদেশে স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে সমর্থন আসে। মনে করা হয় ভারতে স্ত্রীশিক্ষাজনিত সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় হল প্রচুর পরিমাণে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করা। এই সূত্রে ১৮৫৬ সালে ছোটলাট সিসিল বিডনের নির্বন্ধে বিদ্যাসাগর আবারও স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে যুক্ত হন। ১৮৫৭ সালে হ্যালিডের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের দীর্ঘ আলোচনা হয় এ বিষয়ে। বিদ্যাসাগর আশাবাদী ছিলেন যে বালিকাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ সহজ না হলেও কাজটা আন্তরিক ভাবে করলে একদিন সমাজের আস্থা ও সহানুভূতি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। সেই বিশ্বাসে ভর করে অল্পদিনের মধ্যেই ১৮৫৭ সালের ৩০মে তারিখে তিনি বর্ধমানের জৌগ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় খুললেন। স্কুলটির জন্যে সরকারি অনুদানও মঞ্জুর হয়। এরপর দক্ষিণবঙ্গের হুগলির হরিপাল, বৈদ্যবাটি ও বর্ধমানে আরো তিনটি বালিকা বিদ্যালয় খোলার প্রস্তাব আসে এবং সবগুলিই সরকারি অনুমোদন পায়। স্ত্রীশিক্ষায় এই ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখে বিদ্যাসাগর একক প্রয়াসে ১৮৫৭-র নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-র মে মাস অবধি ৩৫টি বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করলেন। হুগলিতে ২০টা, বর্ধমানে ১১টা, মেদিনীপুরে ৩টে আর নদীয়াতে ১টা করে বিদ্যালয় খোলা হল। কিন্তু খানিকটা আবেগতাড়িত হয়ে এই কাজের আগে বিদ্যাসাগর সরকারি অনুমোদন নেবার কথা ভাবলেন না।
স্কুলগুলি প্রতিষ্ঠার পরে তিনি Director of School Instruction-এর কাছে মাসিক সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠালেন। এই বিদ্যালয়গুলির মাসিক খরচ ছিল ৮৪৫ টাকা করে। মোট ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৩০০। প্রথমে ভাবা হয়েছিল ছাত্রীদের থেকে মাইনে নেওয়া হবেনা এবং ২০টি ছাত্রী ভর্তি হলেই সরকারী অর্থ সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্তু ১৮৫৮ সালের মে মাসে একটি সরকারী পত্রে জানান হল যে অর্থসাহায্য বাইরে থেকে না পেয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে তার অনুমোদন দেওয়া হবেনা। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর সমস্যায় পড়লেন। স্কুলগুলি বন্ধ হবার উপক্রম হলে তিনি Director of Public Instructions-কে চিঠি দিয়ে জানালেন যে এতদিন শিক্ষকরা বিনা বেতনে কাজ করেছেন শুধুমাত্র তাঁর অনুরোধে। তাই স্কুল তুলে দেবার আগে তাঁদের প্রাপ্য অর্থ যেন সরকার থেকে মিটিয়ে দেওয়া হয়।
নানা চিঠিচাপাটির পরে যা দাঁড়াল তাতে জানা গেল ওই প্রাপ্য টাকা সরকার থেকেই মেটানো হবে। কিন্তু তারপর সিপাহী বিদ্রোহের কারণে আর্থিক অনটনের মুখে দাঁড়িয়ে সরকার আর টাকা দিতে অসম্মত হন। ১৮৫৮সালের নভেম্বরে বালিকাবিদ্যালয়কেন্দ্রিক এই বিরোধের কারণে বিদ্যাসাগর সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নেন। ফলে তাঁর ব্যক্তিগত আয়ও কমে গেল। কিন্তু বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে তিনি এবারে “নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাণ্ডার” খুললেন। এতে সমকালীন বহু ধনী মানুষ ও সরকারি কর্মচারীরা চাঁদা দিতেন। জানা যায় ছোটলাট বিডনও অর্থ সাহায্য করেন। এইভাবে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় স্ত্রীশিক্ষা প্রবাহিত থাকল বেশ অনেকদিন।
এ কথা ঠিক যে স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে ও বিপক্ষে দুরকম আচরণই সমাজে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে ১৮২২-এ গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের বইয়ের পরে ক্রমান্বয়ে ১৮৯৮ সাল অবধি স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে প্রায় ১১টি বই লেখার তথ্য পাওয়া যায়। অধিকাংশ বই-ই স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে লেখা। এর মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হল ১৮৬৫সালে লেখা কৈলাসবাসিনী দেবীর লেখা বইটি। স্কুল বুক সোসাইটি মেয়েদের পাঠোপযোগী বই প্রকাশ করতে শুরু করে। এ থেকে অনুধাবন করা যায় যে ১৯ শতকের ৬০-এর দশক থেকেই স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে জনমানসে ভাবনাগত সামান্য পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। সামাজিক টানাপোড়েনের মাঝে স্ত্রীশিক্ষার কাজ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরও যে পিষ্ট হয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁর স্কুলগুলি শত প্রতিকূলতা সত্বেও চলছিল, কারণ অনেক মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেটাও ওই জনমানস পরিবর্তনের জন্যেই।
।৪।
১৮৬৬ সালের শেষদিকে মেরি কার্পেন্টার নামে এক ইংরাজ মহিলা কলকাতায় আসেন নারীশিক্ষার প্রসারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কলকাতায় এসে তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচিত হতে চান। বিদ্যাসাগরের সঙ্গেই তিনি কলকাতার কাছাকাছি স্কুলগুলো পরিদর্শন করেন। তাঁর মনে হয় এদেশে মহিলাশিক্ষিকার বড় অভাব। বেথুন স্কুলেই নর্মাল স্কুল নামে আরেকটি বিদ্যালয় গড়ে তুলে দেশীয় শিক্ষিকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন তিনি।
এই প্রস্তাবের সমর্থনে ১৮৬৬ সালে ব্রাহ্মসমাজে একটি সভা হয় কেশব সেনের নেতৃত্বে। বিদ্যাসাগরও সে সভায় ছিলেন এবং এই কাজের জন্যে গঠিত কমিটিতে সভ্য হিসেবেও নির্বাচিত হন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মনে হয় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে যাঁরা অনুরাগী তাঁদের এই সভায় আহ্বান করা হয়নি। এছাড়াও তিনি বলেন যে সমাজে সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা ১১-১২ বছরের বিবাহিত বালিকাদেরই অন্তঃপুর থেকে বাইরে যেতে দেওয়া হয়না, সেখানে শিক্ষিকা হবার জন্যে বাড়ির মেয়েদের যে অনুমতি মিলবে না তা তো সহজবোধ্য। যদি বা কিছু বিধবা মেয়ে এ কাজে যুক্ত হয়ও, সংকীর্ণ সামাজিক মানসিকতার কারণে মানুষ এদের সন্দেহ করবে ও কটুকথা বলবে। ফলে এই সাধু উদ্দেশ্যটি বিফলে যাবে। তাঁর এই ভাবনা আর কেউ সমর্থন করলেন না—ক্ষুব্ধ বিদ্যাসাগর নিজের নাম কমিটি থেকে সরিয়ে নেন।
ব্রাহ্মসমাজের নির্বন্ধে মিস কার্পেন্টারের প্রস্তাব মেনে শিক্ষিকা তৈরির স্কুলটি খোলা হয়, কিন্তু মাত্র তিন বছর যেতেই স্কুলটিকে তুলে দিতে আদেশ দেন ছোটলাট। আসলে তিনিও বিদ্যাসাগরের মতোই বুঝতে পারেন দেশীয় রীতি মেনেই মহিলাস্কুলের প্রতিষ্ঠা করলে তবেই সেটা কার্যকরী হবে। বিদ্যাসাগরের সমাজজ্ঞান ও দূরদর্শিতা প্রমাণ হল আবারও।
যদিও ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্ত্রীশিক্ষার অনেকটাই ব্রাহ্মসমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং ব্রাহ্মমেয়েরাই প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন শিক্ষালাভে— কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার ছিল যে স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে ব্রাহ্মদের মধ্যেও অনেক স্ববিরোধ ছিল। একদিকে তাঁরা বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চান অথচ আবার অনেকেই চাননা মেয়েরা গৃহের বাইরে গিয়ে বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করুক। বিদ্যালয়ে মূলতঃ পুরুষশিক্ষক থাকাটাও একটা কারণ ছিল। এ ব্যাপারে কেশব সেনের গোঁড়ামিও ছিল প্রবল।
মিস কার্পেন্টারের স্কুলটি উঠে গেলে ১৮৭১ সালে কেশব সেন “Female Normal School” নামে একটি স্কুল স্থাপনা করেন। এই স্কুলকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মসমাজে একটা প্রবল নীতিগত বিভাজন হয়। কেশব সেন তাঁর গোঁড়ামির কারণ ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য রাখতে চেয়ে মেয়েদের জন্যে আলাদা সিলেবাস করে তার থেকে উচ্চগণিত, জ্যামিতি, লজিক ইত্যাদি বাদ দিয়ে মেয়েলি ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে উপযোগী বিষয় রাখতে মনস্থ করলেন। ব্রাহ্মসমাজের আরেক বিশিষ্ট মানুষ দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুগামীরা এমন সংকীর্ণ ভাবে তৈরি সিলেবাসকে মানতে পারলেন না। মতবিরোধের জেরে ১৮৭৮ সালে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেল।
এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উদারপন্থী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর সঙ্গে মনমোহন ঘোষ, দুর্গামোহন দাস ও তাঁর স্ত্রী ব্রহ্মময়ী দেবী প্রমুখ মিলে ১৮৭৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ৫টি ছাত্রীকে নিয়ে “হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়” নামে একটি বোর্ডিং স্কুলের সূচনা করলেন। অ্যানেট অ্যাক্রএড নামে এক নবাগতা বিদেশিনী এই স্কুলের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হলেন আর দ্বারকানাথ হলেন প্রধান শিক্ষক। মিস অ্যাক্রএড বিদেশে কেশব সেনের কথায় মুগ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু এদেশে এসে তাঁর আচরণে স্ববিরোধ আর সংকীর্ণতা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন। এবারে এই নতুন স্কুলে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে কাজ শুরু করলেন, যেমনটা করলেন দ্বারকানাথও।
স্ত্রীশিক্ষা প্রসঙ্গে এই স্কুলটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা নানা কারণে— এই স্কুলটির সঙ্গে প্রশাসনিক ভাবে যুক্ত না থাকলেও নীতিগত সমর্থনে পাশে ছিলেন বিদ্যাসাগরও। নিজে সরাসরি না পারলেও এই গুরুদায়িত্ব আরো যাঁরা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তাঁদের পাশে সর্বতোভাবে থেকে তিনি পরোক্ষে স্ত্রীশিক্ষার জন্যে আন্দোলনকেই সমর্থন করে যাচ্ছিলেন।
এই স্কুলটিতে শিক্ষালাভ করেছেন জগদীশ বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা, জগদীশ চন্দ্রের স্ত্রী লেডি অবলা বসু, ডাক্তার প্রসন্নকুমার রায়ের স্ত্রী সরলাদেবী, শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা এবং কাদম্বিনী বসু, যিনি ব্যক্তিগত পরিচয়ে পরে দ্বারকানাথের স্ত্রী হন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন ১৮৭৮ সালের এপ্রিল মাসে। এর আগে যদিও ১৮৭৭-এ পাশ করেন চন্দ্রমুখী বসুও, কিন্তু তাঁকে তখন স্বীকৃতি দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৭৮-এ অবশেষে এই দুই নারীকে একসঙ্গে স্বীকৃতি দেয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারকানাথদের আন্দোলনের ফলে। কাদম্বিনীই প্রথম মহিলা যিনি ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সাফল্য অর্জন করেন। নারীর শিক্ষায় যে সমানাধিকারের প্রশ্নে প্রথমে বিদ্যাসাগর ও পরে দ্বারকানাথ সরব হয়েছিলেন, এই ঘটনায় তারই যেন বিজয় সূচিত হল।
পরে দ্বারকানাথের স্কুলটি বেথুন স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একটি প্রথম শ্রেণীর বিদ্যালয়ের শিরোপা পায়। কাদম্বিনী সরকারি জলপানি অর্থাৎ স্কলারশিপ পান তাঁর সাফল্যের জন্যে। ফলতঃ তাঁর কলেজের প্রথম স্তর মানে এফ.এ পড়া সুনিশ্চিত হয়। ১৮৭৯ সালে বেথুন স্কুলে এফ.এ পড়ার আলাদা বিভাগ তৈরি হয় কটকের র্যাভেনশ কলেজের অধ্যাপক শশীভূষণ দত্তের দায়িত্বে। এরপরেও কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখীর সাফল্যের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। তাঁরা প্রথমে ১৮৮০ সালে এফ.এ পাশ করেন। তারপর একসঙ্গে বেথুন থেকে ১৮৮৩ সালে বি.এ পাশ করেন। অনেক বাধা পেরিয়ে কাদম্বিনী ১৮৮৩ সালে কলকাতা মেডিকাল কলেজে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পান পুরুষ ছাত্রদের সঙ্গে এবং ১৮৮৬ সালে পাশ করে হন প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার। তার আগেই ১৮৮৪ সালে চন্দ্রমুখী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে এম.এ পাশ করেন।
বেথুন স্কুলের এই কৃতী ছাত্রীদের সাফল্য বাঙালি মেয়েদের শিক্ষার জগতটিকে আলোকিত করেছিল যে শুধু তাই নয়, অন্তঃপুরের বাইরে এসে মেয়েরাও যে বিদ্যায়-শিক্ষায় পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে— এই পরম সত্যটাও প্রতিষ্ঠিত করে। এরপর থেকে প্রতিবছর বেথুন স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রতি ক্রমবর্ধমান এই আগ্রহের স্বীকৃতি দিতে ১৮৮৮ সালে স্কুলের এফ.এ বিভাগটিকে আলাদা করে বেথুন কলেজ নামে স্বতন্ত্র পরিচয় দেওয়া হয়।
।৫।
বিদ্যাসাগর ততদিনে বয়স্ক ও অসুস্থ হয়েছেন। তাঁর স্থাপিত বিদ্যালয়গুলিও বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। নানা ভাবে বিপর্যস্তও হয়েছেন তিনি আর্থিক, পারিবারিক ক্ষেত্রে। কিন্তু ১৮৪৯-এ ড্রিংকওয়াটার বেথুনের সঙ্গে যে স্কুলটি থেকে এদেশের মেয়েদের জীবনে শিক্ষার আলো জ্বালাবার জন্যে সলতে পাকাবার কাজটি শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগর— প্রায় ৩৪ বছর পরে সেই স্কুলের ছাত্রীদের সাফল্যের হাত ধরেই শুধু স্ত্রীশিক্ষাই নয়, পুরুষদের সমযোগ্যতার উচ্চশিক্ষার দরজাও খুলে গেল। পূর্ণ উজ্জ্বলতায় জ্বলে উঠল শিক্ষার প্রদীপটি, সার্থক হল বিদ্যাসাগর ও বেথুনের স্বপ্ন। সরাসরি যুক্ত না থাকলেও বেথুন স্কুলের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের হৃদয়ের যোগ কোনদিনই ছিন্ন হয়নি। তাই তাঁর স্বপ্নপূরণ করেন যে দুই নারী অর্থাৎ চন্দ্রমুখী ও কাদম্বিনী, তাঁদের সাফল্যে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে উপহার দেন শেক্সপীয়ার গ্রন্থাবলী ও সঙ্গে প্রশংসার চিঠিও। বইয়েও প্রদানকারী হিসেবে লিখলেন— “From her sincere Well-wisher ISVARCHANDRA SHARMA”।
১৮৯১ সালের জুলাই মাসে বিদ্যাসাগর মারা যাবার পরে কলকাতার একটি মহিলা পরিচালিত বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে বেথুন স্কুলের কমিটিকে ১৬৭০ টাকা পাঠানো হয়। বলা হয় কোনো হিন্দু বালিকা তার বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ শেষ করে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে চাইলে, পরবর্তী দুবছর ওই টাকাটি থেকে তাকে যেন বৃত্তি দেওয়া হয়। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পরেও স্ত্রীশিক্ষার জন্যে মেয়েদের তরফে এই সহায়তা তাঁর আদর্শের অভিঘাত এবং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনটিকে আরো একবার যেন প্রতিষ্ঠা করে।
একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি কেন এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বালিকাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন— “আমি ভাবীকালের দেশাত্মবোধ নিবেদিত মানুষের সূতিকাগৃহ প্রস্তুত করে চলেছি”। আমরা বর্তমানের মেয়েরা অতীতের সেই সুতিকাগৃহের ফসল, যারা বিদ্যাসাগরের জ্বালানো সেই আলোকে সহায় করে কর্মের ও জীবনের পথে চলতে চেষ্টা করছি, পড়ছি, উঠছি, আবার চলছি। এই নিরন্তর চলমানতায় আমাদের অবলম্বন শিক্ষা আর ক্ষতের প্রলেপ বিদ্যাসাগরের রেখে যাওয়া সেই সত্য— হ্যাঁ মেয়েরাও পারে।
প্রসঙ্গ সূত্র-
১। Peoples of the state of Education in Bengal, William Adam, CU edn,1941
২। বিদ্যাসাগর, চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯৫
৩। ঊনিশ শতকে স্ত্রীশিক্ষা, স্বপন বসু, ২০০৫
৪। প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর ,সম্পাদনা বিমান বসু, ২০০৮
৫। ‘প্রসঙ্গ নারীশিক্ষা’, কান্তি বিশ্বাস, পূর্বদেশ-কথা বিদ্যাসাগর, ২০১০
৬। ঊনবিংশ শতাব্দীর স্ত্রীশিক্ষাআন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য, ড.জয়ন্তী মণ্ডল, ২০১৪
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ২ অক্টোবর ২০২০
0 Comments
Post Comment