- 11 November, 2023
- 0 Comment(s)
- 255 view(s)
- লিখেছেন : শ্রীরূপা মান্না
১৯৮৯ সালে কিম্বার্লে ক্রেনশ 'ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজিম' শব্দটি প্রয়োগ করেছিলেন যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে সমাজে স্থিত বিভিন্ন বৈষম্যগুলির বিভিন্ন অবস্থানের নিরিখে উপরিপাত হতে পারে, যার ফলে কোনও বৈষম্যকে বুঝতে গেলে লিঙ্গ-বর্ণ-শ্রেণী-ধর্ম সবকিছুর মিলিত অবস্থানের নিরিখে বিশ্লেষণ করতে হবে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও নারীদের কোনও একটি বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হলে এই 'ইন্টারসেকশনালিটি'র আতস কাঁচ দিয়েই তাকে জরিপ করতে হবে। এই ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ যা একইসাথে বহু শতাব্দীতে বিভক্ত এবং যেখানে 'নারী' নামক কোনও লিঙ্গ পরিচিতির মানুষদের কখনও সমগোত্রীয় অর্থাৎ হোমোজিনিয়াস অবস্থান নেই, কখনওই ছিল না। এই যে 'কখনওই ছিল না' কথাটাতে এতোটা জোর দিয়ে বললাম, তার কারণ অনুসন্ধান করে ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাবো, ধর্মাশ্রয়ী সমাজে প্রাচীন ভারতেও নারীদের অবস্থান কিন্তু সমগোত্রীয় ছিল না। অর্থাৎ ধর্মও নারীদের বৈষম্য থেকে মুক্তি দেয়নি। তবে এই 'প্রাচীন ভারত' শব্দবন্ধটি একটি বিস্তৃত সময়কালকে উদ্দেশ্য করে, সেই পূর্ণ সময়কাল ধরে পর্যালোচনা করার পরিসর এই প্রবন্ধে নেই। তাই খুব ওপর ওপর কিছু আলোচনা, বিভিন্ন সময়পর্ব জুড়ে ছুঁয়ে দেখাই সমীচীন হবে বলে মনে করছি। এই প্রবন্ধে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন আচরণে নারীকে যেভাবে সমাজের চোখে দেখা হয়েছে বা আরও গভীরভাবে বলতে গেলে যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে 'আদর্শ নারী' সত্তাটিকে, সেটুকুর মধ্যেই। কেন হঠাৎ হিন্দু ধর্ম নিয়ে কথা বলবো? তার কারণও নিহিত আছে আমাদের দেশের এই বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যে। গত এক দশক জুড়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি তার হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে সামনে রেখে যেভাবে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই আদর্শ হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কিন্তু আরোপিত 'আদর্শ হিন্দু নারী'র ওপরেই। তাই এক্ষণে সেই 'আদর্শ হিন্দু নারী'র নির্মাণকল্প নিয়েও কথা বলা অত্যন্ত জরুরি।
প্রথমত, বৈদিক, মৌর্য্য বা গুপ্ত যুগে 'হিন্দু' কথাটার কোনও অস্তিত্ব ছিল না ভারতবাসীর কাছে। আধুনিক সময়ের ঐতিহাসিকরা ১২০০ সনের আগের সময়টার ওপর হিন্দুত্ব আরোপ করেছেন কারণ কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ও আচার আচরণ যা ব্রাহ্মণ্যবাদ পরবর্তী কালপর্বে বহন করেছিল, তা প্রাচীন ভারতের বৈদিক সময়ের বিভিন্ন গ্রন্থ ও আচার থেকে সরাসরি অনুকরণ করা হয়েছিল। এবার ঋগ্বেদে যে মনু বা কল্পিত প্রথম মানব হিসেবে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার বা তার অনুগামীদের লিখিত তত্ত্বকে মনুবাদ ধরলে, তাতে আর্যসভ্যতায় নারীদের সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে, তা ভীষণই অবমাননাকর। সমাজের দ্বিতীয় বর্গের সম্পর্কে 'নীচ', 'কুটিল', 'দূষিত' বলে বিশেষণ উদ্ধৃত করা হয়েছে। যেমন মনুস্মৃতি থেকেই উদাহারণ দেওয়া যাক, "ইহলোকে পুরুষদের দূষিত করা স্ত্রীলোকেদের স্বভাব। এই জন্য পণ্ডিতেরা স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে অসাবধান হন না" বা "মূর্খই হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধের বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয়।" এখানে লক্ষণীয়, নারীসঙ্গই পুরুষকে সমস্ত উৎকর্ষের থেকে বিপথগামী করার একমাত্র বিষয়, এভাবে দেখা এবং দেখানোর মধ্যে নারীর প্রতি পুরুষের যৌন আকর্ষণকে 'খারাপ' বলা হচ্ছে না কিন্তু। বরং যেন তার জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়েছে। নারীর শরীর, সৌন্দর্য বা তাদের যৌনতা সুস্থ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রেণিসমাজের সভ্যতা শুরুর পর্ব থেকেই নারীর যৌনতাকে চারদেওয়ালের মধ্যে এক পতি-পত্নী বিবাহের মধ্যে আটকে রাখার প্রয়োজন হয়েছিল নির্ভুল উত্তরাধিকার চয়নের জন্য। হিন্দু ধর্মের শুরুর দিকেও ঠিক একই কারণে তাই বিভিন্ন ধর্মপালনের বিধিতে নারীর যৌনতাকে ভয়ানক, ক্ষতিকারক এইসব বিশেষণ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই কারণে নারীদের চরিত্ররক্ষা বিষয়টি সমাজে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছে এবং সমাজের নির্ধারিত ধারার একচুল এদিক ওদিক হলেই নারীকে অসম্ভব লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। মনুসংহিতার আরও কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করা যাক, "স্ত্রীগণ সৌন্দর্য বিচার করেন না। যুবা কী বৃদ্ধ সে ব্যাপারেও তাদের কোনো আপত্তি থাকে না। সুরূপই হোক বা কুরূপই হোক পুরুষ পেলেই তারা তার সঙ্গে সম্ভোগ করেন।...পুরুষের দর্শন মাত্রেই স্ত্রীজাতির মনে তার সঙ্গে মিলনের ইচ্ছা জন্মায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের চিত্তচাঞ্চল্য থাকে।" এখানেও একই প্রসঙ্গ, নারীর শরীর নিয়ে তার এজেন্সি, যাকে মেনে নিতে অপারগ ছিল সমাজ। ধর্মের আবরণে নারীর কাছ থেকে প্রথম যে অধিকারটি কেড়ে নেওয়া হয়েছে বহুযুগের পূর্বে, তা হল তার শরীর। যে শরীর নিয়ে সে জন্মেছে, লালন পালন করেছে তা তার নিজের জন্য নয়, তা অন্যের সম্ভোগের বস্তু বা অন্যের অধিকারের বিষয়। এবং এই অধিকার কেড়ে নেওয়ার সাথে সাথেই নারীকে শরীরসর্বস্বতা দিয়েই বিচার করতে শিখিয়েছে ধর্ম। একজন ব্যক্তি মানুষকে শুধু শরীর হিসেবে দেখা, তার যাবতীয় স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করারই নামান্তর, সেটিই হয়েছে সুকৌশলে। যদি এই প্রসঙ্গটিকে আর একটু গভীরভাবে ভাবি তাহলে দেখবো, হাজার হাজার বিধি নিষেধ, ধর্মের উপাচার তৈরিই হয়েছে নারীর দেহের শুচিতাকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে। আবার যে কারণে নারীর শরীর অধিকৃত বস্তু কিংবা নারীর শরীরের শুচিতারক্ষা সামজের অন্যতম দায়, সেই কারণেই যুদ্ধের সময়, পক্ষ-প্রতিপক্ষের লড়াইয়ের সময় সবার আগে আক্রমণের মুখে পড়ে নারীরা। এক গোষ্ঠীর নারীদের ওপর প্রতিপক্ষরা অত্যাচার করলে, বিশেষ করে যৌন অত্যাচার করলে সেই গোষ্ঠীর মনোবল বা দৃঢ়তাকে আঘাত করা যায়, সবচেয়ে বেশি। আবার ধর্মের নিদানে, এই আক্রমণের থেকে মেয়েদের বাঁচার উপায়টি হল মৃত্যু। যেমন ধরা যাক জহরব্রত করা, স্বামীর অনুপস্থিতিতে নারীর দায় ঝেড়ে ফেলা যেমন একটি কারণ তেমনই অন্য একটি বিষয় কিন্তু প্রতিপক্ষের হাত থেকে নারীদেহের শুচিতা রক্ষা করা। বহুযুগ আগের এই প্রথাকে গৌরবের চোখে দেখাতে শেখাচ্ছে আজকের হিন্দুত্ববাদীরা। জনমানসে বিধবা মেয়েদের সতীদাহকে প্রতিষ্ঠা করতে এই একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় রাজস্থানে রূপকানোয়ারের মত ঘটনা ঘটাচ্ছে, বাজারকে হাতিয়ার করে 'পদ্মাবত'এর মতো সিনেমা বানাচ্ছে যাতে হিন্দুনারীদের জহরব্রতকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আজকের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সমাজে নারীর অবস্থানকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ধর্মের দোহাই দিয়ে মনুবাদের হাত ধরে পশ্চাদপদ সময়ে।
প্রাক বৈদিক সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য এতো প্রকট না থাকলেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষত্রিয়দের উত্থানের সাথে সাথেই নারীদের ওপর বিধিনিষেধ অনেক বেশি আরোপিত হতে থাকে। অভিভাবকের নির্বাচন অনুযায়ী বিবাহ, নারীর ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন, বিষয়সম্পত্তিতে পুরুষের অগ্রাধিকার ইত্যাদি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিচায়ক। পরবর্তীতে, বিবাহবিচ্ছেদ ও বৈধব্যে পুনর্বিবাহের অধিকারকেও খর্ব করা হয়েছিল নারীর ক্ষেত্রে। স্মৃতিশাস্ত্রে মনু ছাড়াও, যাজ্ঞবল্ক্য, অত্রি, বশিষ্ঠ প্রমুখ মুনিদের বক্তব্য আছে নারীর কর্তব্য বিষয়ে। প্রায় প্রতিটিরই সারমর্ম ছিল যে, বিবাহিত সঙ্গী 'স্বামী' নারীর কাছে ঈশ্বর স্বরূপ পূজিত হবেন। এক্ষণে মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামী শব্দটির অর্থই কর্তা, বা যাঁর অধিকারে অপর কিছু রয়েছে, যেমন ভূস্বামী, যার ভূমি আছে। তেমনই স্বামী হলেন স্ত্রী'র প্রভু বা কর্তা। এরও পরবর্তীতে যখন রাজতন্ত্রে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পুরুষদের একাধিপত্য ক্রমবর্ধমান, তখন নারীদের শিক্ষা, শাস্ত্র অধ্যায়ন এগুলো থেকেও বিরত রাখা হল, যাতে সামাজিক উৎপাদনমূলক শ্রমে নারীর যোগদান না থাকে। অবশ্য একই সাথে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ছাড়া বাকি জাতির মানুষকেও এই অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। রামায়ণে আমরা দেখতে পাই শূদ্র শম্বুককে শাস্ত্র পাঠের অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবেই সামাজিকভাবে নারীকে ক্রমশ আবদ্ধ করা হয়েছিল চার দেওয়ালের মধ্যে গৃহস্থালীর কাজকর্মে। এটা শুধুই নিপীড়ন করে সম্ভব হয়নি, একটা সামাজিক মূল্যবোধকেও সুচারুভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে নারীর শ্রেষ্ঠত্ব হিসাবে তার সাংসারিক বিচারবোধ, মাতৃত্ব ও পরিবারের লালনপালনকেই জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে নারীকে মানসিকভাবেও পরিবারের মধ্যেই আবদ্ধ করা সম্ভব হয়। ফলে পরিবার-স্বামী-সন্তান এর সেবাযত্ন ও প্রতিপালনই যে একমাত্র নারীত্বের ধর্ম, তা নারীদের মনেও প্রবলভাবে গেড়ে বসে যায়। ধর্মের বহু রীতিনীতি, আচারপালন, ব্রতপালন শুধু এই পরিবারের সকলের কল্যাণকামনার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা যুগযুগ ধরে পালন করে আসছেন নারীরা।
'আদর্শ নারী'র নির্মাণ প্রত্যেক ধর্মই তার তার মতো করে চিরকাল করে আসছে, যুগযুগ ধরে, হিন্দুধর্মই বা তার বাইরে হবে কেন? 'আদর্শ নারী'র যে কল্পচিত্রটি ধর্ম মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়, তা আসলে শুধু ধর্ম বা সমাজ না, ধর্মভিত্তিক ক্ষমতাতন্ত্র বা রাষ্ট্র তৈরি করার জন্যও প্রধান উপাদান। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ব্যক্তি নারীর অধিকার খর্ব করা হবে এবং সচেতনভাবেই। আজকে আর.এস.এস যখন হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছে বা সেই নির্মাণকল্পে রাজনীতিকে চালনা করছে, তার লক্ষ্যও কিন্তু এই 'আদর্শ নারী'কে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করার। হিন্দু জাতীয়তাবাদেরও মূল ভূমিকায় কিন্তু রয়েছে এই 'আদর্শ নারী'র ইমেজ। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ভারতমাতার যে ছবি পরাধীন ভারতের সময়কাল থেকেই আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, তিনি গেরুয়া বসন পরিহিতা গলায় রুদ্রাক্ষের মালা এবং মাথায় সিঁদুর। প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় এই ভারতমাতা হিন্দু। এবার যদি খেয়াল করি, গেরুয়া বসন, তাহলে মনে হতে বাধ্য ত্যাগের প্রতীক এই পোষাক, অর্থাৎ তিনি ত্যাগী সর্বংসহা। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, তিনি সন্ন্যাসিনী নন কেন? সন্ন্যাসিনী তিনি নন, কারণ নারীর মূল যে লক্ষ্য অর্থাৎ সংসারধর্ম, তাতে তাকে অবিচল থাকতে হবে। তাহলে মোদ্দায় কী দাঁড়ালো, এই ভারতমাতা 'আদর্শ নারী'র চিত্রকল্প যিনি আবশ্যিকভাবেই যৌনতামুক্ত (অ্যাসেক্সুয়াল বডি) একটি শরীর, যিনি সর্বত্যাগী, সর্বংসহা একজন গৃহী। বিবেকানন্দও কিন্তু হিন্দু জাতীয়দার পক্ষে আদর্শ নারীর নির্মাণকল্পে বলেছেন, ভারতীয় নারীদের আদর্শ হওয়া উচিত সীতা-সাবিত্রী-দময়ন্তী।
মনে হতেই পারে আজকের সময় তো নয়া উদারনীতিবাদের পরবর্তী সময়, শ্রেণিসমাজে এই প্রচলিত ধর্মের অবদান ঠিক কতোটুকু? কর্পোরেট তো একরকমভাবে নারীস্বাধীনতা, নারীর অধিকারের পক্ষেই অনেকাংশে সওয়াল করে। কিন্তু এখানেই আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে পিতৃতন্ত্রের মূলগত কাঠামোর কাছে। আজকে যে ফ্যাসিজিমকে আমরা প্রত্যক্ষ করছি এই সময়ে, সেই ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনি বলেছেন "ফ্যাসিবাদকে আরও ভালোভাবে বলতে গেলে কর্পোরেটবাদ বলা উচিৎ কারণ এটা রাষ্ট্র ও কর্পোরেট শক্তির সংমিশ্রণ"। আরএসএস ঠিক এই কারণেই একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ফ্যাসিবাদী সংগঠন। একবিংশ শতকের পুঁজিবাদ বিপুল শ্রমশক্তি জোগান এবং বাজার বাড়ানোর স্বার্থেই ‘উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট' এর কথা বললেও নারী স্বাধীনতার আড়ালে নারীকে পরিবার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে সামাজিক গণ্ডিবদ্ধ করতেই অধিক সচেষ্ট। পুঁজিবাদ নারী-পুরুষ দ্বিকোটিক লিঙ্গ বিভাজন এবং লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রমের বিভাজনকে ধারণ করে এবং উদযাপন করে কারণ লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন আসলে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করে পুঁজির হাত শক্ত করে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী শোষণকাঠামোটি প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে। আবার গোলওয়ালেকরের লেখাপত্রে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে তাদের মতাদর্শগত অবস্থানের ভিত্তিমূল ছিলো মূলত ইতালিয়-জার্মান ফ্যাসিবাদী রচনা সমূহের প্রতিলিপি। আরএসএস এর 'বিশুদ্ধ হিন্দু'র কেন্দ্রীয় ধারণা আসলে জার্মান 'বিশুদ্ধ আর্য'র অনুকরণ মাত্র। বিভিন্ন রচনা থেকে তৎকালীন আর্য সমাজের যে ধারণা পাওয়া যায় তা থেকে খুব সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে তৎকালীন আর্যদের সমাজ কট্টোর পিতৃতান্ত্রিকতাকে অবলম্বন করেই গড়ে ঊঠেছিলো। আরএসএস এ নারীদের প্রত্যক্ষ প্রবেশাধিকার না থাকলেও নারীদের জন্য নির্মিত বিভিন্ন শাখায় যেমন 'রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি' বা 'দুর্গা বাহিনী' ইত্যাদিতে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের ধর্ম, পরিবার, ও রাষ্ট্রের প্রতি চূড়ান্ত দায়বদ্ধতার নীতিবোধ ও কট্টর জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার শিক্ষা দান করা হয়। এই সামাজিক নীতিবোধ বা মূল্যবোধগুলি পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের শোষণকাঠামোটি সক্রিয় রাখে।
লেখক : সমাজকর্মী, গবেষক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment