লিঙ্গবৈষম্যমূলক মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের দাবি

  • 16 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 68 view(s)
  • লিখেছেন : সাফিউল্লা মোল্লা
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি হলে অনুষ্ঠিত হল সাউথ কলকাতা সোসাইটি ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন (SEW), রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি এবং Nariswattwo.com  এর উদ্যোগে একটি আলোচনাসভা।

 ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি হলে অনুষ্ঠিত হল সাউথ কলকাতা সোসাইটি ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন (SEW), রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি এবং Nariswattwo.com  এর উদ্যোগে একটি আলোচনাসভা। আলোচনার বিষয় ছিল- লিঙ্গবৈষম্যমূলক মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের দাবি। 

 

আলোচনার শুরুতে আমরা স্মরণ করেছি আমাদের SEW সংগঠনের প্রেসিডেন্ট প্রাক্তন বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত মহাশয়কে, যিনি গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন। তাঁকে ঘিরে পুরোনো স্মৃতির নানান কথা বিভিন্ন বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। বিচারপতি মলয় সেনগুপ্তকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে লিখিত শ্রদ্ধাপত্র পাঠান রোগশয্যায় শায়িত সোসাইটি ফর এম্পাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন ঘোষাল এবং রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতির সেক্রেটারি খাদিজা বানু। লিখিত শ্রদ্ধাপত্রদুটি পাঠ করেন অধ্যাপক মোনালিসা পাত্র ও অধ্যাপক সাফিউল্লা মোল্লা। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন সাউথ কলকাতা সোসাইটি ফর এম্পাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন এর সম্পাদক আফরোজা খাতুন এবং আইনজীবী সৌরভ মুখার্জি। 

 

এরপর শুরু হয় আর জি করের ন্যায় বিচার এবং লিঙ্গবৈষম্যমূলক মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারের দাবিতে আলোচনাসভা। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলি থেকে শতাধিক নারী অংশগ্রহণ করেন এই আলোচনাসভায়। যে দাবিগুলি মূলত উঠে এসেছে সেগুলি সংস্কারের দরকার বলে মনে হয়, শুধু সংস্কার নয়, তার সার্থক প্রয়োগের জন্য দরকার আইনের। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যখন আর জি কর-এ নিজ কর্মক্ষেত্রে একজন মেয়েকে জঘন্যভাবে মেরে ফেলা হয়, যেটা আমাদের আত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেই জায়গায় আমাদের মুসলিম পারিবারিক আইনে আমাদের মেয়েরা প্রতিনিয়ত ধিকৃত হচ্ছে- তাদের ইচ্ছের কাছে, স্বপ্নের কাছে, অধিকারের কাছে। তাদের ইচ্ছে, অধিকার আর স্বপ্নের কথা বলতেই মহাবোধি সোসাইটিতে এসেছিলেন মুসলিম পারিবারিক আইনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মহিলারা। তাদের সকলের অভিজ্ঞতা আলাদা, কিন্তু একটা জায়গায় এক- তারা সকলেই মুসলিম পারিবারিক আইনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত। কেউ স্বামী পরিত্যক্ত- স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, কারো স্বামী মারা যাওয়ায় স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত, কেউ তালাক নামক ঘৃণ্য মৌখিক ব্যাধির শিকার।

 পারিবারিক আইনের বৈষম্যের কারণে বঞ্চিত নারীরা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা অকপটে জানিয়ে এর প্রতিকার দাবি করলেন। তালাক, হালালা বিয়ে, বহু বিবাহ, সম্পত্তি আইনের বৈষম্যের কারণে তাঁরা কীভাবে নির্যাতন সইছেন সেকথা শুনিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করলেন মুর্শিদাবাদের হীরা খাতুন, লাজিনা খাতুন, মাহফুজা খাতুন, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রুমি সুলতানা, করিমা খাতুন প্রমুখ মহিলারা। এই মহিলারা সকলেই আর জি করের ন্যায় বিচারের দাবিতেও সোচ্চার হলেন। আর জি করের বিচারের দাবিতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার আরিফ মহম্মদ বক্তব্য রাখেন। এই অনুষ্ঠানের সভাপতি আইনজীবী সৌরভ মুখার্জি ইতিহাসের উদাহরণ দিয়ে বর্তমানের সমস্যা ও তার প্রতিকারের বিষয়টি নিয়ে এক মনোজ্ঞ আলোচনা করেন। বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আফরোজা খাতুন, অধ্যাপক সফি মল্লিক, অধ্যাপক ঈশিতা সুর, অধ্যাপক নাসিমা ইসলাম। অনুষ্ঠানের শেষে ওপেন ফোরামের আয়োজন করা হয়েছিল - যেখানে প্রতিটি মহিলা তাদের মতো করে দুঃখ কষ্টের কথা বলেছেন। ওপেন ফোরামে বললেন অধ্যাপক শবনম বৈদ্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নার্গিস পারভীন, সানজিদা গাজী, সমাজকর্মী আলপনা দত্ত, সুমিতা ঘোষ অধ্যাপক মোনালিসা পাত্র প্রমুখ মহিলারা। তাঁদের সকলের কন্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে বৈষম্যের অবসানের জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোট বাঁধা ও মেয়েদের অধিকার দখল নেওয়ার শপথ। মঞ্চে উপস্থিত বক্তাদের প্রতিবাদ ও কান্নার ধ্বনি প্রতিটি বিবেকী, উদার মনের মানুষের কাছে পৌঁছেছে নিশ্চয়, এখন দরকার আইন সংস্কারের।  

 

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মুসলিম মেয়েদের এই অবস্থান যা ভাবতেই পারা যায়না। কিন্তু তবুও আমাদের ভাবতে হচ্ছে। আমাদের ভাবতে হয়, শঙ্খ ঘোষের বাবরের প্রার্থনা কবিতায় - 'এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম আজ বসন্তের শূন্য হাত' - পঙক্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা পশ্চিমের দেশের ধর্ম পালন করি, তাই উপাসনাও করি পশ্চিমে বসে, এমনকি তুলনাতেও সেই পশ্চিমকে টেনে আনি, কিন্তু যখন মেয়েদের প্রশ্ন আসে তখন আমাদের মনের জীর্নতা বেরিয়ে আসে। আজ সৌদির মুসলিম মেয়ে আলকাহতানি, বয়স ২৭, পেশায় মডেল, মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, আর আমরা আমাদের মেয়েদের শেখাচ্ছি- ছবি তোলা, গান গাওয়া, নাচ এসবই পাপের মধ্যে পড়ে। 

 

ধর্ম তাই, যা আমাদের ধারণ করে, কিন্তু আজ ধর্মের উপদেশাবলী স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের মনগড়া কথায় পরিবর্তিত হয়েছে, নিজেদের মতো করে। সবকিছু বলে দেওয়া থাকেনা, সময়ের সাথে সাথে বলা কথাগুলো বা না বলা কথাগুলো মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়, যেমন কোভিডের সময় আপনার মন আপনাকে বলেছিল- বাঁচতে হলে টিকা নিতেই হবে, বাঁচার প্রশ্নে আপনি প্রাত্যহিকতায় পরিবর্তন এনে সময়ের দাবিকে মান্যতা দিয়েছিলেন, তেমনিই বাঁচার প্রশ্নেই বহুবছরের পুরনো কিছু ধার্মিক আইনে মানবতার খাতিরে সংস্কারকে মান্যতা দিতে বাধা কোথায়? 

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, গবেষক 

ছবি : অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment