- 09 May, 2024
- 0 Comment(s)
- 251 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
প্রতি বছর নিয়ম করে পালিত হয় নারীদিবস, আন্তর্জাতিক কন্যাদিবস, মাতৃদিবস ইত্যাদি কত কিছু। কিন্তু এখনও নারীকে দেখা হয় দেবী অথবা দুরাত্মা রূপেই। নারী জাগরণ, মহিলা স্বশক্তিকরণ সহ কন্যারত্নের মাহাত্ম্য নিয়ে সবরকমের রাজনৈতিক-সামাজিক ঢক্কানিনাদ যে কতখানি অন্তঃসারশূন্য তা বারবার প্রমাণিত হয় সমাজে ঘটে চলা অজুত ঘটনায়।
এতদিন আমরা সোশাল মিডিয়ায় স্ত্রী, মহিলা বস্ ও অফিস কলিগ নিয়ে লাঞ্ছনা ও যৌনইঙ্গিতপূর্ণ নানা অশ্লীল খিল্লী বা মিম্ দেখেছি। সোৎসাহে বন্ধুকে ফরোয়ার্ডও করেছি। মনে মনে নিজের লিঙ্গবাদী সুপিরিওরিটি নিয়ে খুব একচোট হেসেও উঠেছি। কিন্তু সেসব সুগারকোটেড চুটকিগুলো যেহেতু কৌতুকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাই ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার হয়নি। কিন্তু গত মাসে সংবাদে আসা একটি বিতর্কিত ঘটনা আবার প্রমাণ করল ভবিষ্যতে আরও কয়েক শতাব্দী ধরে সমানাধিকার ইস্যুতে নারীদিবস (অপভ্রংশে নারী-দ্য-বস্) পালনের যৌক্তিকতা বজায় থাকবে ষোলআনা।
যে কোনও পেশায় মহিলা নেতৃত্ব নিয়ে আজকের দুনিয়াতেও যে নোংরা বৈষম্য ও তাচ্ছিল্যের মনোভাব রয়েছে তা আবারও প্রমাণ করল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ঘটনা। ২৬শে এপ্রিল ২০২৪ অনুষ্ঠিত ম্যাচে মহিলা আম্পায়ার ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় দুই ক্রিকেট দল ‘প্রাইম ব্যাঙ্ক’ ও ‘মহামেডানে’র তরফে আপত্তি ওঠে। উক্ত ম্যাচের মহিলা আম্পায়ার জাকির হোসেন জেসি ICC-র প্যানেলভুক্ত অভিজ্ঞ আম্পায়ার। অথচ স্রেফ নারী হওয়ার জন্যই তাঁর অধীনে খেলতে অস্বীকার করে দুই ক্রিকেট টিম। ঘটনার পরে প্রত্যাশিতভাবেই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট। এরপর ক্রিকেট বিশ্বে তুমুল সমালোচিত হয়ে কার্যত তাদের আপত্তি থেকে অবশেষে সরে আসে দুই দল, তবু নিঃশর্ত ক্ষমা না চেয়ে তারা নিজেদের আপত্তির সমর্থনের আম্পায়ার জেসির অভিজ্ঞতা নিয়ে অপমানজনক অভিযোগ করে। অর্থাৎ একজন মহিলা যিনি নিজের যোগ্যতায় ICC-র প্যানেলে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি যত বড়ই হোন না কেন যেহেতু জন্মসূত্রে তিনি ‘দ্বিতীয় লিঙ্গের’ তাই তাঁকে পরিচালক হিসেবে মেনে নিতে খেলোয়াড়দের পৌরুষে আঘাত লেগেছে!
যেখানে বিশ্ব-ক্রিকেট বর্তমান যুগে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে – সেখানে আজও এমন একটা ন্যক্কারজনক ঘটনার সাক্ষী থাকতে হচ্ছে আমাদের এটা সত্যই লজ্জার।
দেশটার নাম বাংলাদেশ বলেই হয়ত অনেকেই নাক সিঁটকে বলবে ‘আমাদের এখানে এমন হয় না।‘ কিন্তু যদি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যায় তবে দেখব বিষয়টা কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপার নয়। ভারতের ছোট বড় নানা শহরে খেলার জগতে আজও এমন বহু বৈষম্য ঘটে চলেছে।
“মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারবে না’ বলে ফতোয়া এসেছিল আমাদের পড়শি জেলা মালদার চাঁচলে। অথচ ওই মহিলা ফুটবল দলটি অনেক পুরোনা, ক্লাবের হয়ে বহু মেডেল – কাপ তারা জিতেছে। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে হঠাতই ‘ফুটবলে হাফ প্যান্ট পরতে হয় যা অনৈসলামিক’ বলে এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল স্থানীয় ফতোয়াবাজেরা।
এছাড়াও সাম্প্রতিককালে দেশের মহিলা কুস্তি দলের জোরদার প্রতিবাদ আমরা দেখেছি যা রীতিমতো ঝড় তুলেছে রাজনৈতিক মঞ্চে। রেসলিং ফোরেশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি, ব্রিজভূষণ শরণ সিং গত বছরের শুরুতে খবরের শিরোনামে আসেন। সেই সময় বজরঙ্গ পুনিয়া, ভিনেশ ফোগাত এবং সাক্ষী মালিক সহ দেশের শীর্ষ কুস্তিগীররা তাঁর বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং রাস্তায় নেমে ব্যাপক প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ধর্ণা দেওয়া সহ, নিজেদের পদক ফিরিয়ে দিয়েও প্রতিবাদে অনড় থেকেছেন তাঁরা। যে কারণে দীর্ঘ অনশন আন্দোলন ও অপেক্ষার পরে অবশেষে যৌন হেনস্থার অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে। প্রবল রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান লোকটি এখনও বিচারাধীন।
এইসব ঘটনাগুলো আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ও নির্দিষ্ট কোনও দেশের অভ্যন্তরীন বিষয় বলে মনে হলেও এসবের নেপথ্যে আছে আদিকাল থেকে বংশ পরম্পরায় চলে আসা ধারণা – ‘পুরুষমাত্রেই সুপিরিওর বা শ্রেষ্ঠ এবং নারী মাত্রেই তাদের অধীনস্ত সেবাদাসী বা যৌনদাসী।’
সুতরাং নারীদের বেশি উঁচুতে উঠতে দেখলেই যেনতেন প্রকারেণ তাদের দমিয়ে রেখে, মিথ্যে বদনাম অথবা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বয়কট করা জায়েজ। এই জাস্টিফিকেশন দেখে বহু ব্যবহৃত লব্জের মতো বলা যায় একবিংশ শতকের নারী ক্ষমতায়নের যুগে “পুরুষ খতরে মে হ্যায়!”
ক্রিকেট বিশ্বে লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দ ভাণ্ডার (ব্যাটার, বোলার, চেয়ারপার্সন, থার্ডম্যানের বদলে থার্ড, প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ ইত্যাদি ) দেখে যেমন চমকিত হই, তেমনি এই ধরনের লিঙ্গবৈষম্য ও নারীবিদ্বেষী মনোভাব আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা তুলে ধরে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের তরফে নেওয়া একটি চমৎকার উদ্যোগের কথা। তাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে - ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০% মানুষ গ্রামে বসবাস করে, যেখানে নারী ও পুরষের মধ্যে বিভাজন ও বৈষম্য ভীষণ প্রকট। আমাদের দেশের গ্রামীন বা মফস্বল সমাজে মেয়েদের যেমন স্বাধীন চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আছে, তেমনি আছে ছেলে ও মেয়েদের কাজের বিভাজন।
যদি একটি মেয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলা যেমন, সাঁতার, ক্রিকেট বা ফুটবলে অংশগ্রহণ করতে চায়, তখনই তাদের লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয়। একইভাবে, যদি কোনও ছেলে রান্নাবান্না করতে বা নাচতে আগ্রহী হয় তবে তাকেও সমাজের ভ্রূকুটি সহ্য করতে হয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ব্রিটিশ কাউন্সিল একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে। যার নাম রাখা হয় – ‘The changing moves, changing mind’ - অর্থাৎ কাজের পরিবর্তনের মাধ্যমে মানসিকতার পরিবর্তনের চেষ্টা। এই প্রকল্পের আওতায় স্কুলের শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট ও নাচ শেখানো হয়।
বৃটিশ কাউন্সিলের পরিচালক অ্যালান গেমেল মনে করেন, খেলার একটি সার্বজনীন ভাষা রয়েছে। তিনি বলেন, "খেলা একটি দলগত কাজ। যেখানে সবাইকে একীভূত করা যায়। এক্ষেত্রে সারা ভারতজুড়ে ক্রিকেট এমনই একটি শক্তিশালী সংযোগ স্থাপনকারী খেলা।"
এই স্কিমে অংশগ্রহণকারী শিশুদের নৃত্য এবং ক্রিকেটের দক্ষতার ওপর ধারাবাহিক অনুশীলন করানো হয়। যেমন নাচের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মুদ্রা ও কোরিওগ্রাফি এবং ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ব্যাটিং ও বোলিংয়ের কৌশল শেখানো হয়। এসব বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে গৎবাঁধা ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। যেখানে এটা বোঝানো হয় যে ছেলেদের কাজ বা মেয়েদের কাজ বলে কোন কথা নেই। কাজ সবার ক্ষেত্রে সমান।
প্রকল্পটির আওতায় শিক্ষকদের এমন কিছু বিষয়ে অনুশীলন করানো হয় যেন তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যেন তারা নারী পুরুষের ইতিবাচক ভূমিকার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের পাঠ দিতে পারেন। তবে বিষয়টা বাস্তবায়িত করা সোজা ছিল না, প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জের এবং বাধার মুখোমুখি হতেন। বহু দিন ধরে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা, মানসিক প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করে সমস্যার সমাধান এবং কাউন্সেলিং করানোর মাধ্যমে তাদের ধীরে ধীরে এই প্রকল্পের আওতায় আনা যায়।
বর্তমানে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় তিন লাখ বাচ্চা ব্রিটিশ কাউন্সিলের এই স্কিমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাদের শৈশবের কোমল মানবজমিন বিদ্বেষের অন্ধকার থেকে সাম্যের আলোয় আলোকিত হচ্ছে।
এই ধরনের সামাজিক প্রকল্প যদি আমাদের দেশে সরকারি স্তরে চালু করা যায়, তবে হয়ত খুব সহজেই বাল্যকাল থেকেই আমাদের শিশুদের বোধবুদ্ধি বিকশিত হবে, সমতার চেতনায় চিরভাস্বর হয়ে উঠতে পারবে তাদের কোমল মস্তিষ্ক।
এইসব আলোকিত শিশুরা যে উন্নত পৃথিবী গড়বে তাতে কাউকে লিঙ্গ বা জাতিভেদে বয়কট করা হবে না, কোনও ব্রিজভূষণ কাণ্ডের ন্যায়বিচার বিলম্বিত হবে না - আগামী কাছে আমাদের তো এটুকুই আশা।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment