মহিলা শ্রমিকদের মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল?‌

  • 10 June, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1026 view(s)
  • লিখেছেন : শহীদুল ইসলাম
লকডাউনে মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যাটা এখনও স্পষ্ট নয়। এই মৃত্যু কিন্তু অনিবার্য ছিল না। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির নীতিহীনতার পাশাপাশি চাপানউতোরের শিকার ‘‌ভারত-‌নির্মাণ’‌-‌এর কারিগররা। 

২৫ মার্চ থেকে ৩০ মে লকডাউনের মধ্যে রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭৫০ জন, সেভ লাইফ ফাউন্ডেশন তাদের সমীক্ষায় প্রকাশ করেছে এই পরিসংখ্যান। মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ১,৪৬১। এই ৭৫০ জনের মধ্যে ঘরে ফিরতে মরিয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২৬.‌‌৪ শতাংশ অর্থাৎ ১৯৮ জন। এই সমীক্ষাগুলিতে মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা স্পষ্ট নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই আমরা সংবাদ মাধ্যমে পাই মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর খবর। এই মৃত্যু কিন্তু অনিবার্য ছিল না। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির নীতিহীনতার পাশাপাশি চাপানউতোরের শিকার ‘‌ভারত-‌নির্মাণ’‌-‌এর কারিগররা।  

বিহারের স্টেশনে ছোট্ট শিশুর মৃত মাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমেদাবাদ থেকে বিহারের মুজাফ্ফরপুরে ফিরছিলেন ওই মহিলা। জল ও খাবারের অভাবে ট্রেনেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ২৫ মে  স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগেই মৃত্যু হয়েছিল ওই মহিলার। ‘‌সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’‌-‌এ‌র ভারতের ছবি দেখে আমরা আতঙ্কিত—আর কত মা এভাবে মরবে।

লকডাউনে আরও কিছু মহিলাকে আমরা হারিয়েছি, যাঁদের আমরা চিনতাম না। অদৃশ্য থেকেই যাঁরা ভারত গড়ার কাজ করতেন। উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি-মির্জাপুর জাতীয় সড়কে ট্রাক উল্টে মৃত্যু হয় ৩ জন পরিযায়ী মহিলা শ্রমিকের। ১৭ জনের পরিযায়ী শ্রমিকের একটি দল পূর্ব উত্তরপ্রদেশে নিজেদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্যে দিল্লি থেকে হাঁটা শুরু করেন। মাঝপথে একটি ট্রাকে ওঠেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের সঙ্গে রফা হয় ট্রাকের চালক তাঁদের গ্রামে পৌঁছে দেবেন। ট্রাকটি প্রচণ্ড গতিতে চলছিল। হঠাৎই টায়ার ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় সেটি। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৮ মে।

কালিম্পঙের আলগারার কৃতি শেরপা। কাজ করতেন উত্তরপ্রদেশে। অনেক চেষ্টা করে শ্রমিক স্পেশ্যাল ট্রেনে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু আর বাড়ি ফেরা হল না তাঁর। ২৮ মে বিশেষ ট্রেনেই মৃত্যু হয় কৃতি শেরপার।

২৬ বছরের ভানলাল মাঙ্ঘাই জুয়ালি মিজোরামের বাসিন্দা। পুনেতে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করতেন। প্রায় দু মাস আটকে থাকার পর পুনে থেকেই ওঠেন মুম্বই-নাগাল্যান্ড স্পেশাল ট্রেনে। ১ জুন রাতে মালদার সামসির কাছে আচমকাই ঘুমের মধ্যে ট্রেন থেকে পড়ে যান তিনি। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন বলে খবর।

মহারাষ্ট্র থেকে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর— এই দীর্ঘ পথ অটোয় চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন একদল শ্রমিক। সেই দলটিতেই ছিলেন এক মহিলা ও তাঁর মেয়ে। তিন দিনের মাথায় ১১ মে তাঁরা ফতেপুর পৌঁছেছিলেন। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এসেই দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাকের ধাক্কায় কার্যত দুমড়েমুচড়ে যায় অটোটি। ওই দুর্ঘটনায় মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়।

বিহারের কাটিহারের বাসিন্দা এক মহিলা স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে আমেদাবাদ থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন। হঠাৎই ট্রেনের মধ্যে তিনি জ্ঞান হারান এবং পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ২৭ মে-‌‌র। গুজরাটের সুরাট থেকে ফেরা আরও এক মহিলার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

কর্নাটকের রায়চুর গ্রামের ২৯ বছরের তরুণী গঙ্গামা কাজ করতেন বেঙ্গালুরুতে। প্রথম লকডাউন শুরু হয় ২৫ মার্চ। টাকাপয়সা না মিটিয়েই মালিক তাঁকে ছাঁটাই করেছিল। ফলে বেঙ্গালুরু ছাড়তে বাধ্য হন। গঙ্গামা এবং তাঁর সঙ্গীরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন ১ এপ্রিল। দীর্ঘ পথ হেঁটে ৫ এপ্রিল তাঁরা পৌঁছান বেল্লারিতে। সেখানে পুলিস তাঁদের আটকায় এবং একটা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে অসুস্থ হয়ে পড়েন গঙ্গামা এবং মৃত্যু হয় তাঁর। দীর্ঘ সময় খেতে না পেয়ে মৃত্যু হয়েছে গঙ্গামার, অভিযোগ তাঁর স্বামীর।

১৭ মে সকালে মধ্যপ্রদেশের বারওয়ানি জেলায় চারজনের মৃত্যু হয় এক দুর্ঘটনায়। তাঁদের মধ্যে একজন পরিযায়ী শ্রমিক এবং তাঁর স্ত্রী ইন্দোরের দিকে ফিরছিলেন। সেই সময়েই ট্রাক এসে তাঁদের পিষে দেয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁদের।

এক কিশোরীর মর্মান্তিক মৃত্যুও আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছে। ছত্তিশগড়ের বীজাপুরের ১২ বছরের জামলো মকদম কাজ করত তেলেঙ্গানার লঙ্কা ক্ষেতে।  লকডাউন ঘোষণা হতেই মালিক তাকে ছাঁটাই করে। টাকা-‌পয়সা নেই। হেঁটেই  গ্রামে ফিরতে উদ্যত হল ১৩ জনের একটি দল। বনবাদাড় ডিঙিয়ে ১৫০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে বীজাপুরের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। বীজাপুর তখন আর ১৪ কিলোমিটার বাকি। পেটে খাবার নেই, জলও নেই শরীরে। ঝিমিয়ে পড়ল জামলো। ঝরে গেল শৈশব।

২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত করোনা রোধে লকডাউনে ঠিক কতজন মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, কী কারণে হয়েছে এ নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ আসবে। আসবে অনেক প্রশ্ন। তবে এখনই যে প্রশ্ন ভাবাচ্ছে আমাদের, তা হল ভারতের মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে। 

রুটির যোগানের জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দেন মহিলা শ্রমিকরা। এঁদের কাজের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে রয়েছে শস্য রোপণ এবং শস্য কাটা, ইট ভাটা, লঙ্কা এবং অন্যান্য মসলার ফ্যাক্টরি, ক্ষুদ্র শিল্প, নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি। সেই সঙ্গে গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন একটা বিরাট অংশ। ঠিক কত মহিলা পরিযায়ী শ্রমিক ভারতের বিভিন্ন অংশে কী কী কাজ করেন তার পরিসংখ্যান কী কেন্দ্র কী রাজ্য কারও কাছে নেই। উল্লেখ্য ২০১৫ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সমীক্ষায় বিশ্বজুড়ে ৬৭ কোটি গৃহকর্মীর (১৫ বছরের বেশি বয়সী) মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিল মহিলা। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের বলিষ্ঠ কোনও আইনও নেই মহিলা শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য। লকডাউন না হলে এঁদের মর্মান্তিক অবস্থার কথা আমরা জানতেই পারতাম না। সরকারি, বেসরকারি ক্ষেত্রে আলোচনাও শুরু হত না।

ভারতে পরিযায়ী শ্রম নিয়ন্ত্রণকারী অপ্রচলিত আইনগুলির সম্পূর্ণ পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। Interstate Migrant Workmen Act, 1979 ‌—  এই আইনটিকে আরও নারী-বান্ধব করার লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা কমিশন (এনসিডাব্লু) আলোচনা শুরু করেছে। তারা ভারত জুড়ে পরামর্শ নেওয়া শুরু করেছে। পর্যালোচনার ফলাফল কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের কাছে জমা দেওয়া হবে। পরামর্শে উঠে এসেছে আইনটির নাম সংশোধন করা উচিত এবং জেন্ডার বৈষম্য পুনরুদ্ধার করার জন্য মজুরির ব্যবধান পূরণ করতে হবে।

এনসিডব্লিউ (‌National Commission of Women) চেয়ারপারসন রেখা শর্মা বলেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীরা পুরুষদের সমান সুবিধা পান না। মহিলারা, যাঁরা কাজের জন্য মাইগ্রেশন করেন এবং পুরুষদের সঙ্গে আসেন না তাঁরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে মজুরি নিয়ন্ত্রণকারী মধ্যস্থতাকারী বা ঠিকাদারের ভূমিকা অবশ্যই পর্যালোচনা করতে হবে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই মহিলারা কম মজুরি পান।

আর একটি মূল্যবান পরামর্শ উঠে আসে— পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়োগকর্তাদের অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নির্যাতন (প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার) আইন, ২০১৩-‌কে কার্যকর করতে হবে।

সুপারিশ আসে, একটা সংহত পোর্টাল, যেখানে এই কর্মীদের বিশদ তথ্য সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সহজেই পাওয়া যায়, যা খুব তাড়াতাড়ি চালু করা দরকার। ওই পোর্টালটিতে গৃহপরিচারিকাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যসহ বিশদ বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

গুজরাটের সুরাট ও আমেদাবাদে শ্রমিকদের আজিভিকা ব্যুরো পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মহিলা পরিযায়ীরা তাদের মাসিক আয়ের ১০ শতাংশ শৌচাগারের উপর দিতে বাধ্য হন। বিশেষত  গর্ভাবস্থায় মহিলাদের অবস্থা আরও কঠিন। বেশিরভাগ মহিলা প্রসূতি, পুষ্টি এবং টিকাদান সুবিধাগুলির জন্য আবেদন করতে পারেন না কারণ তাঁদের আবাসিক নথি নেই।

দেশ জুড়ে এনসিডব্লিউ-‌এর পর্যালোচনায় বিভন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা জানান  মহিলা কর্মীদের জন্য অবশ্যই একটি ওরিয়েন্টেশন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, যা তাঁদের মজুরি, আবাসন ও অন্যান্য সুবিধাগুলির ওপর  অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে। পরামর্শগুলোর বাস্তবায়নের দিকে আমাদের নজর থাকল।  প্রস্তাব শুধু কি নথিভুক্ত থাকবে? না ব্যবস্থা করবে রূপায়নের? 

মূল ছবি— বিহারের মুজফ্ফরপুর স্টেশনে পড়ে আছেন মৃত মা। ছবি: সংগৃহীত

লেখক:‌ সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

‌‌‌‌

0 Comments

Post Comment