- 04 January, 2022
- 0 Comment(s)
- 573 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
নতুন বছর এসেই গেলো, সকলে হেসে,গেয়ে সাদরে বর্ষবরণ করে নিলো। আশা করি এ বছর আমরা সামাজিক মাধ্যমে আদুরে বিড়াল, দুষ্টু কুকুর, সুন্দরী প্রভাবকদের নানান কর্মযজ্ঞ দেখে দিন পার করে দেবো। মগজকে শীতঘুম পাড়িয়ে সমস্ত দুর্নীতি, বিদ্বেষকে সমর্থন করে, পিতাদের সুরে গান গাইবো! হোয়াটসএপ গ্রুপে, ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম, ইউটিউব ভিডিওর মন্তব্য বিভাগ ভরিয়ে তুলবো বিদ্বেষে! আমরা জানি নারী বিদ্বেষ বা মিসোজিনি কাকে বলে। সমাজবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন নারী বিদ্বেষ একটি সামাজিক অসুখ। কেবলমাত্র নারীদের নারী হবার জন্য কম যোগ্য মনে করা হয়, ঘেন্না করা হয়,ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। আমাদের সমাজে নারী বিদ্বেষ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। নারীর বিকাশে নারী-বিদ্বেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক কালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী বিদ্বেষ অতিরিক্ত চোখে পড়ছে। বলিউড, টলিউডের হিরোইন, মিস ইউনিভার্স, সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবক থেকে মধ্যবিত্ত গৃহবধূ কেউ নিস্তার পাচ্ছেন না। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড ১৯ মাহামারির এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে, সেই সঙ্গে ভয়ানক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে নারীর প্রতি কটুক্তি, হেনস্তা, বিদ্বেষ, ঘৃণা। মনোবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মানসিক নির্যাতনমূলক আচরণগুলোকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-
ক) মৌখিক আক্রমণ ( এমন কোন মন্তব্য করা, যার ফলে ব্যক্তি বিরক্ত হন কিংবা কষ্ট পান)
খ) কর্তৃত্বমূলক আচরণ ( কোন কাজ করতে পারবেন, কোন কাজ করতে পারবেন না তার উপর বিধান আরোপ করা),
গ) ঈর্ষামূলক আচরণ (অপরের ইচ্ছা, ক্ষমতা,খারাপলাগা, ভাললাগা, যোগ্যতা, ইত্যাদি মেনে নিতে না পারা)।
অতি প্রাচীন কাল থেকে কূটনৈতিক পিতৃতন্ত্র সমাজ খুব সচেতন ভাবে নারী বিদ্বেষ সমস্যার গোড়াপত্তন করেছেন। কৌশলে কল কাঠি নেড়ে এখন পর্যন্ত নারীদের শোষণ করা হচ্ছে। নারীবিদ্বেষকে কে নিয়ন্ত্রণ করছেন? পিতৃতন্ত্রের বিজয়কে মজবুত করতে গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, শিক্ষিত নারী- পুরুষ দল বেঁধে মাঠে নেমেছেন।
আমরা সকলেই জানি আমাদের দেশে নারীবিদ্বেষ অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে আছে। গত বছরের বিতর্কিত কয়েকটি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নারী বিদ্বেষ কতটা গভীরতম অসুখে পরিণত হয়েছে। গত ১১/১২/ ২০২১ তারিখ সিবিএসই (CBSE) বোর্ডের ইংরাজি ভাষার পরীক্ষা ছিল। তাতে একটি বিতর্কিত অনুচ্ছেদ দেওয়া হয়েছিল পরীক্ষার্থীদের।সেখানে বলা হয়েছিল- সন্তানের অধিকারের বিষয়টি স্বামীর উপরে নির্ভর করে। এর মধ্য দিয়ে মহিলাদের শৃঙ্খলমুক্তি ঘটে। সন্তানের উপরে মায়ের কতটা অধিকার থাকবে সেটি নির্ধারণ করার একমাত্র অধিকার থাকবে বাবার। নারীদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেবার ফলেই সামাজিক সমস্যা বাড়ছে। স্ত্রীরা স্বামীর আনুগত্য মানছেন না। ফলে শৃঙ্খলাপরায়ণ হচ্ছে না সন্তানরাও। যার ফলে সামাজিক জীবনে অভিঘাত তৈরি করছে। এ ছাড়া প্রশ্ন ছিল, স্বাধীনতার কারণেই কি সামাজিক সমস্যাগুলি জটিল আকার ধারণ করছে? সিবিএসই-র এই প্রশ্ন ও অনুচ্ছেদ দেখার পর দেশ জুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী সংসদে এই বিষয় নিয়ে মুখ খোলেন।
২০২১ সালে দুই বাংলার মানুষের কৌতূহলের মাত্রা অতিক্রম করেছিল নুসরত জাহানের ব্যক্তিগত জীবনকে কেন্দ্র করে। ব্যবসায়ী নিখিল জৈনের সঙ্গে কখন বিচ্ছেদ ঘটলো ! যশ দাশগুপ্তের প্রেমে কখন পড়লেন! অন্তঃসত্ত্বা হলেন! তবে সন্তানের বাবা কে? এরকম ভুরিভুরি প্রশ্ন পাড়ার রক থেকে, পরনিন্দা করা কাকিমাদের ঠেক, সামাজিক মাধ্যমে উড়ে বেড়িয়েছে। গণমাধ্যমে রসালো মোড়কে গরম গরম রগরগে গল্প ফেঁদেছে। সমাজ পিতৃ পরিচয়হীন একটি শিশুকে মেনে নেয়নি। কেচ্ছা, কেলেংকারি করে, পল্লীসমাজের মোড়ল বামুনঠাকুরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সামাজিক বিধান বর্তে দিয়েছেন সমাজের অরগানিক ইন্টালেকচুয়ালরা!
প্রতিবেশী দেশের নারীবিদ্বেষী আচরণ আমরা দেখতে পেয়েছি পরীমনিকে ঘিরে। অভিনেত্রীর বাড়িতে মদ-মাদক দ্রব্য পাওয়া গিয়েছিল। তাই, নাটকীয় ভাবে পরীমনিকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনার মন্তব্য দেখে শিউরে উঠেতে হয়েছে। দেশের রাঘব বোয়াল থেকে চুনোপুটি একই সুরে গান গেয়েছেন।
বলিউডের দুই নায়িকা গতবছর খুব চর্চায় ছিলেন। তাঁরা তাদের থেকে বয়সে ছোট ছেলেকে বিয়ে করেছেন। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কেন জোনাস পদবি ত্যাগ করলেন, ক্যাটরিনা কেন তাঁর থেকে কম বিখ্যাত একজনকে বিয়ে করলেন। এসমস্ত পিতৃতান্ত্রিক প্রশ্ন আনাচেকানাচে ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছে। আধুনিক সমাজ কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত ভাবে এগিয়েছে অনেকখানি, কিন্তু মানসিকতা রয়ে গেছে সেই আদ্যি যুগে।
দুই রাজমিস্ত্রির সঙ্গে বালির দুই গৃহবধূ প্রেম করেছিলেন । এরপর তো দুই গৃহবধূ পালানোর ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে বহুল চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছিল। দুই গৃহবধূ মু্ম্বই পালিয়েছিলেন। একসময় সেখান থেকে তাঁরা ফিরে আসেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন, একাকীত্বের যন্ত্রণায় প্রেম করেছিলেন। কতজন নারীর মনস্তত্ত্ব বোঝেন? নারীদের কষ্টে কতজন সমব্যথী হন? শারীরিক এবং মানসিক ভাবে একটি নারীর পরিবর্তন সম্পর্কে কতজনের জ্ঞান আছে!
একটা শিশুর জন্মের পর থেকে লিঙ্গ বৈষম্যের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। আমাদের শিশুদের খেলনা, ঘুমপাড়ানি গান, ছড়া, কবিতা, সবকিছুর ভেতর থেকে উঁকি দেয় ভেদাভেদ । স্কুলের পাঠ্যবইতে বৈষম্যের ছড়াছড়ি।
স্কুলে থেকে শিশুদের শেখানো শুরু হয়ে যায়, নারীপুরুষের কাজ। শিশুরা শিখতে থাকে- নারীদের কাজ রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, সেলাই করা বাচ্চাদের দেখাশোনা করা। নারীরা হবে মমতাময়ী, ধৈর্যশীল। অপরদিকে, পুরুষ কাজ করবেন বাইরে। সমস্ত কঠিন কাজ করবেন পুরুষেরা। পাঠ্যবইয়েরব ছবি দিয়ে, গল্প দিয়ে, কবিতা দিয়ে, নৈতিক- সামাজিক শিক্ষার নামে নিমের পাচন গেলানো হতে থাকে। সামাজিক বিধানকর্তাদের আদেশ অমান্য করলে, নারীদের সমাজের রক্তচক্ষু দেখতে হয়, শুনতে হয় কটুবাক্য। সমাজচ্যুত করে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। নারীকে এই বিদ্বেষ মেনে, আপোস করে নিয়েই একটা জীবন কাটাতে হয়। অনেক সময়, কিছু পুরুষ মানুষ নারীদের প্রতি সদয় হন, বিদ্বেষ নিয়ে সরব হন। তবে এখানেও একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে ! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে পুরুষেরা নারীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন ; তাঁরা নিজেদের অজান্তেই পিতৃতান্ত্রিক বিধি আরোপ মাথায় রেখে সহানুভূতি দেখান। বিষয়টি এখানে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আমরা এখানে দুটি উদাহরণ তুলে ধরছি। নুসরত জাহান সন্তান জন্ম দেওয়ার পর, সামাজিক মাধ্যম উত্তাল হয়ে ওঠে বিরূপ মন্তব্যে। তাঁকে সমর্থন করে যে দু- একটি মন্তব্য নজরে পড়ে সেখানেও কিন্তু অসামঞ্জস্য দেখা গেছে। একটি মন্তব্যে বলা হয়েছে- "সন্তানের বাবাকে নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলছেন। সেই প্রসঙ্গে পরেও বলা যাবে। কিন্তু পৃথিবীতে আজকে একটি নতুন প্রাণ এসেছে। একজন মেয়ে মা হয়েছে, তাই সব কিছু ভুলে অভিনন্দন জানাচ্ছি নুসরতকে।" একজন নারীকে সম্মান পেতে মা হতে হবে! কোন নারী যদি মা হতে না চান, তবে তিনি মান মর্যাদা পাবেন না! আবার, পরীমনির ক্ষেত্রে আমরা একই মনোভাব দেখেছি। অনেক পুরুষ তাঁকে সমর্থন করলেও, ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছেন-যাঁরা তাঁকে বিপথে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করেছেন, তাঁদের শাস্তি কাম্য। একজন নারীকে অবলীলায় নষ্ট বলা যায়! অদ্ভুত মানসিকতা!
পিতৃতন্ত্র বিরাজমান থাকলে, নারীবিদ্বেষ চলতে থাকবে। এই নিয়ে আমরা কোন দ্বিমত পোষন করতে পারি না। হ্যাঁ, সাম্যের গান গাইতে গাইতে, স্বপ্নালু চোখ নিয়ে, সমতা একদিন আসবে ভাবতে ভাবতে চমৎকার কোন প্রভাবকের ইনস্ট্রা রিল দেখতে দেখতে ; সারাদিন আপনি সেজেগুজে ভিডিও করলে আপনার বাড়িতে রান্না করে কে, মন্তব্য করে আবার আমরা সমাজের পরিবর্তন ঘটাবোই প্রতিজ্ঞা করতেই পারি! কিন্তু তাতে কী পরিবর্তন ঘটবে, আমরা বুঝতেই পারছি! যাইহোক পরের বছর সালতামামি লিখতে লিখতে আবার না হয় আমরা হিসেব নিকেশ মিলিয়ে দেখবো খন! এখন আর আলোচনা না বাড়িয়ে, তুষারপাতের মতো ঠান্ডা পরিবেশে, মগজকে শীতঘুমে পাঠিয়ে দেওয়া শ্রেয়!
0 Comments
Post Comment