শাপিতপুরুষ (অষ্টাদশ কিস্তি)

  • 27 March, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 357 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা- আজ উঠি সুমনদা, পালাতে উদ্ধত হল চৈতি। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঝট করে দাঁড়িয়ে এক পা এগোতেই খপ্ করে চৈতির হাত টেনে ধরে সুমন। চোখের পলকে আছড়ে ফেলে দিল সোফায়। টানা প্রায় আধা ঘণ্টা ভয়ানক হিংস্র রমণে পিষ্ট চৈতি ছিটকে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়াল তখন টের পেল বুকের মাংসের স্তুপের উপরের অংশ প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছে হায়েনা।

[২৭]

ভয়ঙ্কর জেদি আর গোঁয়ার ছিল সুমন : অয়ন 

দেরি হয়ে গেল। আমার আরও আগেই আসা উচিৎ ছিল। একটা অপরাধবোধ বুকে নিয়ে অয়ন রওনা দিল রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। রিমার নিদারুণ অনুরোধে  আসাটা ত্বরান্বিত হয়। এভাবে দায় এড়িয়ে যেতে পারে না অয়ন। এ আসাটা সুমন স্বাভাবিক ভাবে নেবে না। এমনকি সিনক্রিয়েটও করতে পারে। তবে এ বিশ্বাসও জ্যান্ত আছে অয়নের মধ্যে, আমি সুমনের সামনে দাঁড়ালে সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা রেজাল্ট আসতেও পারে, যদি কোন প্রকারে ভুলিয়ে-ভালিয়ে অনুরোধ করে ডাক্তারের সামনে নেওয়া সম্ভব হয়। সকালে বাসে চড়ে সুমনকে ঘিরে রকমারি চিন্তার দাবা খেলা চলে অয়নের করোটিতে। পাশ করার পরে প্রথম প্রথম প্রতিবছরই একবার করে ঢু মারত উত্তরবঙ্গের এই বিভাগীয় শহরে। এ শহরটির প্রতি অয়নের বুকের জমিনের অনেকাংশই বরাদ্দ আছে। টার্মিনালে নেমেই বিষাদে ভরে ওঠে মন। হইহুল্লোড় আনন্দ ফুর্তির দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল! গ্রাম গ্রাম গন্ধ এখনো পাওয়া যায় এই নগরে। অয়নের আজ যে নামযশ তার শিক্ষা এ শহরে আলো বাতাস থেকেই পেয়েছে। পাশ করে বেরোলে বেমালুম ভুলে থাকে সবাই এই শহরটার কথা! জাতিটাই তো ভুলো জাতি। নইলে মুক্তিযুদ্ধের এত কীর্তি ভুলে যায় কী করে! রাজাকারের গাড়িতে পতাকা ওড়ে কিভাবে? কে বাঙালি কে বাংলাদেশি তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড। রাজা-বাদশাহর এই শহরটা যেন পণ করে বসে আছে কোন পরিবর্তন হতে দেবে না! এ শহরের মানুষগুলোও রাজা-বাদশাহর জাত কিনা—কারও কাছে কিছু চাইতে নারাজ! চোখের সামনে আশ-পাশের জেলাশহরগুলোতেও কেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, আকাশছোঁয়া বিল্ডিং, বাণিজ্যে রমরমা অবস্থা। এই শহর পাঁচ’শ বছর আগেও যেমন আজও তেমনটাই আছে। শুধু বাড়ছে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মিল-ইন্ডাস্ট্রি বানাবে না, বানানো যাবে না! এটাও আর একটা চাল। কোন দামি গাড়ি চোখে পড়ে না অয়নের। রাস্তায় গিজগিজ করছে রিকশা-ভ্যানে। অয়ন ভাবে, শুমারি চালালে  বোঝা যাবে এই শহরের মোট মানুষের অর্ধেকই ওরা।  ঢাকার রাজপথে যখন জ্বালাও-পোড়াও চলছে তখন অয়ন রিমার কাছে জানতে চেয়েছিল, রাজশাহীর কী অবস্থা? রিমা মজা করে বলেছিল, এখানে তেমন কিছু হবে কী করে অয়নদা? মাস্টার আর ডাক্তারের শহর যে। এই সব নিরীহ গোবেচারারা করবেটা আর কী? অয়ন বুঝতে পারে না দেশের এই প্রাচীন শহরটির প্রতি সব সরকারই এত উদাসীন থাকে কেন? একটা কথা মনে হলে ফিক করে হেসে ওঠে অয়ন। বিদেশি কোন এক ম্যাগাজিনের জরিপে নাকি বেরিয়েছে, বিশ্বের শান্তির শহর এটি। আর এই খবর নগরবাসিকে জানানো হয়েছে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সেঁটে। এত বড় সুখের খবর না জানালে এরা পাবে কোথায়? অয়ন ফের হেসে ওঠে। মাথা ঝাঁকায়, হ্যাঁ, এই মানুষগুলো সুখেই তো আছে। দিনভর রিকশা-ভ্যান ঠেলে, রাতে গলিঘুঁজিতে লাশের মতো ফিট হয়ে পড়ে থাকে। ডাক্তার-মাস্টারগুলো ঘাড়গুঁজে আদর্শের ঠ্যাং চেপে দিনগুজরান করে। ওদিকে ভেতরের তলানি ফেটে যাচ্ছে অভাবের চোটে। চেঁচাবে না, চিল্লাবে না, অধিকার চাইবে না, মন্ত্রিত্ব চাইবে না, রাস্তা-ঘাট-বিদ্যুৎ-গ্যাস চাইবে না, সচিবালয়ে দৌড়াবে না, পদ্মার পানি চাইবে না—এই শহরের মানুষগুলো শান্তিতে থাকবে না? এই শহর শান্তির শহর হবে না? এমন শহর কোন দেশে আছে যে টেক্কা দিয়ে পারে?

এই সেই ভাবতে ভাবতে রিক্সা কখন যে বাজারের জিরোপয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি অয়ন। বড় মসজিদ থেকে দক্ষিণের গলি ধরে পায়ে হেঁটে এগোয়। মন্দির থেকে কিছু দূরে চারতলা বাড়ি একটি-ই। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেলতে দুলতে অয়নের পেছনে পেছনে আসা ছেলেটা বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছে দেখে অয়ন ডাকে, বাবু, তুমি তো এ বাড়িতেই থাকো? ছেলেটি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায়। তুমি কি বলতে পারো প্রফেসর সুমন গাঙ্গুলি বাইরে বের হন কিনা? ছেলেটি বত্রিশ দাঁত বের করে হিহি করে হেসে দিল। সুমন স্যার তো পাগল হয়ে গেছে। সারারাত ঘরের মধ্যে দৌড়ায়। এটা সেটা ভাঙে। আমরা নিচতলায় থাকি কিনা। উপরেই থাকেন স্যার। টের পাই। মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে যায়।

ছেলেটির কথায় অয়নের মাথায় হাত। থ মেরে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। ঘটনা তাহলে এতদূর!

ধীর পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে অয়ন। মনে দ্বিধা-ভয়। দরজার সামনে দাঁড়াতেই ধূপ পোড়ার গন্ধ ঝামটা মারে নাকে। ভরদুপুরে রুম হতে ধূপপোড়ার গন্ধ! বিস্ময়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।

উপর হতে এক বৃদ্ধা মাথা নাড়াতে নাড়াতে অয়নের সামনে এসে দাঁড়াল। বয়সের ভারে ন্যূব্জ। কিন্তু যৌবনে চেহারায় চোখ ধাঁধানো জৌলুস ছিল। কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে ধবধবে ফর্সা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। অয়নকে পরখ করে নিল ছানি পড়া চোখে। কে তুমি বাবা? কোথা থেকে এলে? আমি কি তোমাকে দেখেছি? চমৎকার শুদ্ধ উচ্চারণে প্রশ্ন করে বৃদ্ধা।

আমি সুমনের বন্ধু । ঢাকা থেকে এসেছি।

বৃদ্ধা যেন অয়নের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে বহুদিন, এমন উচ্চকিত হয়ে ওঠে। বেশ রাগত কণ্ঠে বলে, এতদিনে কেন? খেলা তো শেষ!

অয়ন বলে, ব্যস্ততার চাপে পারিনি আসতে। আগে প্রায়ই আসতাম।

এত ব্যস্ত! কি করো? সরি, তুমি করে বলছি।

অয়ন বলে, না, আমি কিছু মনে করিনি। আমি ডাক্তার।

কোথাকার?

ঢাকা।

কলিংবেল নষ্ট। আমার সাথে একটু আসবে উপরে। কিছু একান্ত কথা আছে। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে সুমন টের পাবে। অনিষ্ট হবে।

বৃদ্ধার বাসায় ঢুকেই অয়ন তাজ্জব। চারপাশে আট দশটা স্টিলের বুক সেলফ ভর্তি বই। ফ্লোরেও থরে থরে সাজানো বই। রকমারি বই। দেশি-বিদেশি লেখকের এত বইয়ের কালেকশন একজন মানুষের থাকতে পারে!

বিস্মিত হচ্ছো, এত বই কী করে? বসো আগে। এই বইগুলোই আমার স্বামী-সন্তান। 

জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় অয়ন।

বুঝতে পারোনি ছেলে। তোমার এই মাসিমা চিরকুমারী। আমার নাম কমলিকা ব্যানার্জি। কলেজে পড়াতাম।

অকস্মাৎ উঠতি বয়সের একটা মেয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে হাত বাড়িয়ে দিল, দিদা তোমার চশমা। চশমা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। চশমা চোখে দিয়ে কমলিকা ব্যানার্জি স্মিত হেসে বলে, তোমাকে ঝাপসা দেখছিলাম এতক্ষণ। এখন পরিস্কার দেখছি। আর কত দেখব বলো? বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই। আমার ছাত্ররাই একে একে ঝরে পড়ছে। যমের সাথে আঁতাত করে দেখো আমি এখনো রয়ে গেছি দিব্যি।

বিব্রত অয়ন নিজেকে গুছিয়ে স্বাভাবিক হয়। সংকোচে সম্ভ্রমে অয়নের ফর্সা গালের মাংস লাফাচ্ছে তিরতির করে। মানুষের ব্যক্তিত্ব বুঝি এমন করেই মন্ত্রাহতের মতো টানে। মুহূর্তেই কমলিকা ব্যানার্জিকে আপন বলে মনে হয়। একটা হিসাব  মেলাতে পারে না। এত বড় বাসা, অন্দরে মানুষের গুঞ্জন, একটু আগে একটা নাতি বয়সী মেয়ে চশমা দিয়ে গেল—এরা কারা? অয়নের মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, ম্যাডাম, ওরা কারা?

কমলিকা ব্যানার্জি মিষ্টি করে হেসে বলে, তুমি কী জানতে চাইছো আমি বুঝতে পারছি। ওরা আমার কেউ না। সবাই আশ্রিতা। প্রসঙ্গ পাল্টে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, সুমনকে কতদিন ধরে চেনো?

ভয় পেয়ে গেল অয়ন। তবু উত্তর দিল ঠিকঠাক, ছেলেবেলা থেকে। আমরা একসাথেই বড় হয়েছি।

অ! তোমাদের বন্ধুত্বের পরিধি তবে দীর্ঘ। তোমার বন্ধুর ভয়ানক ভুল ধরিয়ে দাওনি কেন? কটমটিয়ে তাকাল কমলিকা ব্যানার্জি।

এমন ঝাঁঝাল কণ্ঠ আর বিদ্ধ চাহনিতে ভড়কে গেল অয়ন। কী উত্তর দেবে দিশা পাচ্ছে না।

কমলিকা ব্যানার্জি ধমকিয়ে ফের একই প্রশ্ন করে।

আমি চেষ্টা করেছি তখন। ছেলেবেলা থেকেই সুমন বড় একরোখা জেদি। ওর মাথায় যা ঢোকে তা না করে নিষ্কৃতি নেই। এতে প্রাণের মায়াও করে না। এছাড়া রিমাও সুমনের মোহ কাটাতে পারেনি।

মরেও যেখানে মানুষ এক হয় না। কেউ কবরে যায়, কেউ চিতায় পুড়ে। জীবিত মানুষ কি করে এক ছাদের তলে থাকে? আর সমাজই বা মানবে কেন? তোমার কেউ হলে তুমি মানতে?

অয়ন আতঙ্কের চোখে তাকায় ।

কমলিকা ব্যানার্জি বড় করে নিশ্বাস ফেলে। চোখ হতে আলগোছে চশমা খুলে আঁচলে মুছতে মুছতে বলে, জানো, গত ছয় মাস আমি রাতে ঘুমোই না। একটা ভয়। একটা ত্রাসের মধ্য দিয়ে রাতের প্রহর কাটে। সিঁড়িতে বসেই পার করি রাত। ওদের ঘরে সামান্য টু শব্দ হলেও আমি দৌড়ে যাই এই জীর্ণ দেহ নিয়ে।

কমলিকা ব্যানার্জির ঘোলাটে চোখের কোণা বেয়ে একটা অশ্রুর লাইন সাপের মতো পেঁচিয়ে নেমে গালের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে সিক্ত করে দিচ্ছে। এক ছায়াচ্ছন্ন আতঙ্ক ভর করেছে অয়নের মধ্যেও। ঘন নীল বেদনায় কমলিকা ব্যানার্জির শিরা উপশিরা ফুলে উঠছে। এক প্রগাঢ় নৈঃশব্দতা ধেয়ে আসতে লাগলে কমলিকা ব্যানার্জি গলা খেঁকিয়ে বলে, আগের চারবার রিমা ভেঙেচুরে ধুকে ধুকে একশেষ। বুক চাপড়ে চাপড়ে বিলাপ করেছে তবু আমি শক্ত থেকে এ পথ হতে সরিয়ে এনেছি। এবার আর পারলাম না। সুমনের জেদের  কাছে, হিংস্রতার কাছে রিমা এবার ভীষণ অসহায়!

কমলিকা ব্যানার্জির প্রতি এতক্ষণে গড়ে ওঠা অয়নের সম্ভ্রম ক্রোধে রূপ নিল।  বেশ কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল, ওহ! তাহলে সুমনের আগের বাচ্চা চারটি পৃথিবীর মুখ না দেখার নেপথ্যে আপনি ছিলেন!

কমলিকা ব্যানার্জি নিচু কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।

কিন্তু কেন? কেন আপনি এ কাজ করলেন? ক্ষ্যাপা কণ্ঠ অয়নের।

তার উত্তর কি আমাকেই দিতে হবে?

উত্তেজনায় অয়ন কাঁপছে। তীব্র আক্রোশে রুখে উঠছে সে, হ্যাঁ, আপনাকে-ই দিতে হবে। সুমনের আজকের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্যে আপনি-ই দায়ী।

কমলিকা ব্যানার্জি যেন কেঁপে উঠল। অপ্রতিভ হয়ে বলে, আমার আগের কথা সত্য নয়। আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছি। আমি চিরকুমারী না।

অয়ন রাগে হিস্ হিস্ করছে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টায় আরও বেড়ে গেল হিস্হিসানি। নির্ঘাত এর পেছনে বড় ধরনের কোন চাল আছে। প্রচণ্ড আক্রোশে নিচের দিকে মাথা নামিয়ে ভাবে।

তুমি তো আজ থাকবে নিশ্চয়। তোমার ভেতরে ঘৃণাটা আরও বাড়তে থাকুক। রাত জাগা প্রহর খুব কষ্টের। তখন কথা হবে। কমলিকা ব্যানার্জি আকস্মিক সটান দাঁড়িয়ে গেল। সে হাঁপাচ্ছে প্রচণ্ড রকম। সাঁই সাঁই শব্দ করে তার বুকের ধুকধুকানি বাঁশির সুর তুলছে। মাথা নাড়ছে অস্বাভাবিক মাত্রায়। জড়ানো পেঁচানো চামড়ার ফর্সা শরীর কাঁপছে রীতিমত ভয়ানকভাবে। উঠে যাবে বলে হাত সোফায় ফেলে শরীর চেতাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ভেতর থেকে সেই মেয়েটা খাবি খেতে খেতে দৌড়ে আসে। দিদা দিদা, প্লি¬জ দিদা বলে গদ্গদ্ কণ্ঠে সোনাবাবুকে যেভাবে বুকে ধরে কান্না থামায় তার মা, মেয়েটিও জবুথবু কমলিকা ব্যানার্জিকে ঠিক সেই ভাবে দুই হাতে পেঁচিয়ে বুকের সাথে লেপটে উঁচিয়ে নিয়ে গেল অন্দরে। সাথে সাথে দৌড়ে এসে অয়নকে জানিয়ে গেল, আপনাকে বসতে বলল দিদা।

অয়ন নীরবে বসে নিজের মধ্যে ক্রমেই আলোড়িত হতে লাগল। সুমনের প্রতি এত দায়বোধ তার! কেন? অন্যের বেদনা এমন রক্তে রক্তে অনুভব কী করে সম্ভব!

খাবার সাজানো চাকা লাগানো ছোট্ট একটি টেবিল ঠেলে পর্দা দুলিয়ে প্রবেশ করে মেয়েটি। কাঁসার থালায় ভাত সাজাতে সাজাতে বলে, আপনাকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে।

তা কিছুটা বটে। জোরে শ্বাস ফেলে অয়ন।

কিছু মনে নিবেন না। দিদা ইদানিং প্রায়ই এরকম সিনক্রিয়েট করে। বিশেষ করে, সুমন স্যারের...। মেয়েটার কণ্ঠ ভার হয়ে আসে।

কী নাম তোমার? কী পড়?

চয়নিকা। বোটানি থার্ড ইয়ার। খানিক চুপ থেকে চয়নিকা বলে, আপনি সুমন স্যারের কেমন বন্ধু?

ভাত মুখে দিতে দিতে অয়ন বলে, হাফপ্যান্ট পরার বয়স থেকে আমরা বন্ধু।

আপনাকে বলা যায়। দিদাকে বলবেন না এখনই। যদিও কালকে পত্রিকায় বেরোলে আর চাপা থাকবে না। ভাবছি, কাল পত্রিকাওয়ালাকে ফোন করে জানিয়ে দেব যেন আমাদের বাসায় পত্রিকা না দেন।

চয়নের মুষ্টিভর্তি ভাত, মুখে তুলতে পারেনি, ভয়ার্ত চোখে তাকাল মেয়েটির দিকে। 

ক্যাম্পাসে স্যারের স্ক্যান্ডাল মুখে মুখে।

স্ক্যান্ডাল! কী বলো?

ডিপার্টমেন্টের এক ম্যাডামের দিকে নাকি স্যার কেমন কেমন করে তাকিয়েছেন। একটু হাতও নাকি বাড়িয়েছেন তার দিকে। ম্যাডাম কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিক জড়ো করে বলেছেন এসব কথা। স্যার অবশ্য কী বলেছেন জানি না। কিন্তু তাতেই কি? তার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে! আগেও স্যার নাকি কোথাকার কোন মহিলার সাথে দরজা বন্ধ করে গল্প করেছেন। বিভাগের পিয়নই এই সব স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছে। দেখে ফেলার জন্য ও নাকি মারও খেয়েছে স্যারের হাতে। তার উপরে আরও সাংঘাতিক কাজ করেছে।

কেমন? অয়ন ঢেকুর গেলে।

এক সাংবাদিক গিয়েছিল এ বিষয়ে জানতে। স্যার মারতে তেড়ে ওঠেন।

বিভাগ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

চেয়ারম্যান নাকি ম্যাডামকে বুঝিয়েছেন, স্যারের মেন্টাল প্রবলেমের বিষয়টা। এমন রোগে আক্রান্তদের হাত পা নিজের ইচ্ছায় চলে না। হয়ত অনিচ্ছায় করে থাকবে। কিন্তু ম্যাডাম তো সেই রেগে আছে। কিছুতেই মানতে রাজি না। এসব নাকি স্যারের ভণ্ডামী। চরম অপমানবোধ করেছেন তিনি। প্রয়োজনে সচিব-মন্ত্রী পর্যন্ত কান করবেন।

খাবার আর কিছুতেই গলা দিয়ে নিচে নামছে না। খাবার রেখেই উঠে গেল অয়ন।

[চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment