- 09 August, 2022
- 0 Comment(s)
- 370 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
প্রথম বছরগুলিতে প্রায়শই স্ত্রী নিজেকে মোহাবদ্ধ করে রাখেন। নিঃশর্তভাবে স্বামীর প্রশংসা করার চেষ্টা করেন তিনি। কোনোরকম খুঁতখুঁতুনি ছাড়াই স্বামীকে তিনি ভালোবাসেন। চেষ্টা করেন স্বামী এবং সন্তানদের কাছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে। এরপর তাঁর প্রকৃত অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন--তাঁর স্বামী তাঁকে ছাড়াই চলতে পারেন, সন্তানরা তৈরিই হয়েছে তাঁর থেকে আলগা হয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁরা প্রত্যেকেই সবসময়ই কম-বেশি অকৃতজ্ঞ। বাড়িও তাঁকে আর তাঁর ফাঁপা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রক্ষা করে না। নিজেকে তিনি খুঁজে পান একাকী, পরিত্যক্ত একজন প্রজা হিসাবে। নিজের জন্য করার মতো কোনো কাজও তিনি খুঁজে পান না। স্নেহ বা অভ্যাস তখনও একটি বড়োরকমের সাহায্য হতে পারে, কিন্তু তা পরিত্রাণ বা মুক্তি নয়। সমস্ত আন্তরিক মহিলা লেখকই ‘ত্রিশ বছর বয়সি মহিলাদের’ হৃদয়-স্থিত এই বিষাদটি লক্ষ করেছেন। ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড[1], ডরোথি পার্কার[2], ভার্জিনিয়া উলফের[3] নায়িকাদের এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সেসিল সোভাজ[4], যিনি তাঁর বিবাহিত এবং মাতৃত্ব জীবনের শুরুতে এত আনন্দের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন, তিনিও পরবর্তীকালে একটি সূক্ষ্ম বেদনা প্রকাশ করেন। লক্ষ করার বিষয় হল, আমরা যদি অবিবাহিত এবং বিবাহিত মহিলাদের দ্বারা সংঘটিত আত্মহত্যার সংখ্যা তুলনা করি, তবে আমরা দেখতে পাব যে বিশ থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে শেষোক্তরা জীবনযাপনের বিতৃষ্ণার(বিশেষত পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে) বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে সুরক্ষিত, যদিও পরবর্তী বছরগুলিতে নন। হালবওয়াচস[5] লিখেছেন, “বিয়ের কথা ধরলে তা প্যারিসের মতো কোনো একটি প্রদেশের মহিলাদেরও রক্ষা করে তিরিশ বছর পর্যন্ত। পরবর্তী বছরগুলিতে তা কমতে থাকে”।
বিবাহের ট্র্যাজেডি এই নয় যে, বিবাহ একজন মহিলাকে সুখের যে-প্রতিশ্রুতি দেয় তা নিশ্চিত করে না। আসলে, বিবাহে সুখের কোনো নিশ্চয়তাই নেই। বিবাহই একজন নারীকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুনরাবৃত্তি এবং একই দিনলিপিতে তাঁকে বলিপ্রদত্ত করে দেয়। একজন নারীর জীবনের প্রথম কুড়ি বছর অসাধারণভাবে সমৃদ্ধ। এই সময়ের মধ্যেই তিনি ঋতুস্রাব, যৌনতা, বিবাহ, মাতৃত্বের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। তিনি আবিষ্কার করেন বিশ্ব এবং নিজস্ব ভাগ্য। কুড়ি বছর বয়সে চিরকালের মতো একজন পুরুষের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে, কোলে একটি সন্তান নিয়ে তাঁর জীবন চিরকালের জন্য শেষ হয়ে যায়। প্রকৃত ক্রিয়াকর্ম, প্রকৃত কাজ হল পুরুষের একান্ত ও বিশেষ অধিকারভুক্ত। স্ত্রীর আছে কেবল সেই পেশা যা মাঝেমধ্যে ক্লান্তিকর হলেও তাঁকে কখনোই পরিপূর্ণরূপে তৃপ্ত করে না। স্ত্রীর ত্যাগ এবং ভক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর কাছে প্রায়শই প্রবল নিরর্থক বলে মনে হয় “জীবনের শেষ অবধি যে-কোনো দুটি মানুষের রক্ষণাবেক্ষণে” নিজেকে উৎসর্গ করা। নিজেকে ভুলে যাওয়া খুব সুন্দর। কিন্তু জানতে হবে তা কার জন্য এবং কেন। সবচেয়ে খারাপ হল, তাঁর ভক্তিকেই বিরক্তিকর বলে মনে হয়। স্বামীর চোখে স্ত্রীর এই ভক্তি রূপান্তরিত হয় অত্যাচারে, যেখান থেকে স্বামী পালানোর চেষ্টা করেন। যদিও স্বামীই নিজেকে স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেন স্ত্রীর সর্বোচ্চ এবং অদ্বিতীয় ন্যায্যতা হিসাবে। বিয়ে করে স্বামী বাধ্য করেন স্ত্রী যাতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্বামীর কাছে বিলিয়ে দেন। এই উপহার গ্রহণ করার জন্য স্বামী কিন্তু উলটো দিকের বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করেন না। সোফি টলস্টয়ের কথা “আমি তাঁর মাধ্যমে বেঁচে আছি, তাঁর জন্য বেঁচে আছি। নিজের জন্য আমি এই একই জিনিস দাবি করি” নিশ্চিতভাবে বিদ্রোহাত্মক। কিন্তু টলস্টয় প্রকৃতপক্ষে দাবি করেছিলেন যে তিনি কেবল তাঁর জন্য এবং তাঁর মাধ্যমে বেঁচে ছিলেন--এটি এমন একটি মনোভাব যাকে শুধুমাত্র পারস্পরিকতাই ন্যায্যতা দিতে পারে। তবে স্বামীর ছলনা হল--স্ত্রীকে তিনি এমন এক দুর্ভাগ্যের দিকে ঠেলে দেন, যে-দুর্ভাগ্যের তিনিই শিকার বলে পরবর্তীকালে অভিযোগ করেন। বিছানায় তিনি স্ত্রীকে চান একইসঙ্গে উষ্ণ এবং নিরুত্তাপ হিসাবে। তিনি দাবি করেন স্ত্রী হবেন সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত এবং চাহিদাহীন। স্ত্রীকে তিনি অনুরোধ করেন তাঁকে মাটিতে ধরে রাখতে এবং মুক্তি দিতে, প্রতিদিনের একঘেয়েমি-পুনরাবৃত্তিকে নিশ্চিত করতে এবং তাঁকে বিরক্ত না-করতে, সবসময়ই উপস্থিত থাকতে এবং কখনোই ঘ্যানঘ্যান করে তাঁকে বিরক্ত না-করতে। স্ত্রীকে তিনি একান্তভাবে নিজের করে চান, আবার একইসঙ্গে চান যে স্ত্রী যেন তাঁর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস না-ফেলেন। তিনি চান দম্পতি হিসাবে বাস করতে এবং একইসঙ্গে একা থাকতে। এভাবেই বিয়ে করার মুহূর্ত থেকেই স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ঠকান। এই বিশ্বাসঘাকতার পরিমাপ করতে করতেই স্ত্রী তাঁর জীবন কাটিয়ে দেন। যৌন প্রেম সম্পর্কে ডিএইচ লরেন্স যা বলেছেন তা সাধারণভাবে অকাট্য। দুটি মানুষের মিলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় যদি একে অপরকে সম্পূর্ণ করার জন্য তাঁদের প্রত্যেকের প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। এই প্রচেষ্টার মধ্যেই ঠাহর করা যায় প্রাথমিক অঙ্গহানি। বিবাহকে হতে হবে দুটি স্বশাসিত অস্তিত্বের একত্রিতকরণ। বিবাহ পশ্চাদপসরণ নয়। তা একটি সংযুক্তি--পলায়ন বা প্রতিকারও নয়। এমনটাই বুঝেছিলেন নোরা[6] যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে স্ত্রী এবং মা হওয়ার আগে তাঁকে অবশ্যই প্রথমে একজন ব্যক্তি হতে হবে। দম্পতিদের উচিত নয় নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী বা একটি বদ্ধ একক হিসাবে বিবেচনা করা। বরং তাঁদেরকে একজন ব্যক্তি হিসাবেই এমন একটি সমাজের মধ্যে একীভূত হতে হবে যেখানে স্বামী বা স্ত্রী যে-কেউই কোনোরকম সাহায্য ছাড়াই বিকশিত হতে পারবেন। তারপরেই তিনি অনুমতি পাবেন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমানভাবে অভিযোজিত অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বিশুদ্ধ উদারতায় যোগাযোগ স্থাপনে। সেই যোগাযোগ স্থাপিত হবে দু-জন ব্যক্তিই স্বাধীন এই স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে।
এই ভারসাম্যপূর্ণ দম্পতি বা জোড় কিন্তু কোনো কল্পলোকের বাসিন্দা নন। কখনো-সখনো বৈবাহিক কাঠামোর মধ্যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈবাহিক কাঠামোর বাইরে এই জোড়ার অস্তিত্ব মেলে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাপক যৌন প্রেম দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হন, যা তাঁদেরকে তাঁদের বন্ধুত্ব এবং কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন রাখে। বাকিরা যুক্ত হন এমন বন্ধুত্বের দ্বারা যা তাঁদের যৌন স্বাধীনতায় বাধা দেয় না। খুব বিরল ক্ষেত্রেই এমন জোড় পাওয়া যায় যাঁরা একইসঙ্গে প্রেমিক-প্রেমিকা এবং বন্ধু, যদিও একে-অপরের মধ্যেই তাঁরা তাঁদের বেঁচে থাকার একচেটিয়া কারণ অনুসন্ধান করেন না। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকগুলি সূক্ষ্মতা সম্ভব : কমরেডশিপ, আনন্দ, বিশ্বাস, স্নেহ, সহযোগিতা, ভালবাসায় তাঁরা একে-অপরের জন্য হতে পারেন আনন্দ, সমৃদ্ধি এবং মানুষের জন্য উপলব্ধ শক্তির সবচেয়ে ফলপ্রসূ উৎস। বিবাহের ব্যর্থতার জন্য ব্যক্তিরা দায়ী নন : এটি হল বোনাল[7], কোঁত[8],টলস্টয়ের দাবির বিপরীত – বৈবাহিক প্রতিষ্ঠানটি নিজেই মূলত বিকৃত। ঘোষণা করা যে--একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা যাঁরা একে-অপরকে বেছে নেননি, তাঁদের অবশ্যই একে-অপরের সারা জীবনের প্রয়োজন মেটাতে হবে--এটা হল একপ্রকার দানবিকতা যা অবধারিতরূপে জন্ম দেয় কপটতা, মিথ্যা, শত্রুতা, সুখহীনতার।
[1]নিউজিল্যান্ডের প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ লেখিকা হিসাবে পরিচিত।
[2]প্রখ্যাত মার্কিন কবি, লেখক, সমালোচক।
[3]উনিশ শতকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য আধুনিকতাবাদী ব্রিটিশ লেখক।
[4]ফরাসি কবি।
[5]Les Causes du suicide. পৃষ্ঠা ১৯৫-২৩৯। উদ্ধৃত মন্তব্যটি ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিন্তু হাঙ্গেরি বা ওল্ডেনবার্গের ক্ষেত্রে নয়।
[6]হেনরিক ইবসেনের লেখা‘A Doll’s House’-এর নায়িকা চরিত্র।
[7]লুই দ্য বোনাল (Louis de Bonald) ছিলেন একজন ফরাসি প্রতিবিপ্লবী-দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ। ফরাসি সমাজবিজ্ঞান গঠনের তাত্ত্বিক কাঠামো প্রদানের জন্য তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।
[8]ওগুস্তকোঁত হলেন ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক। ‘সোসিওলজি’ শব্দটি তিনিই প্রথম ব্যবহার করেছেন। পজিটিভিজম দর্শনের উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা অসামান্য।
0 Comments
Post Comment