আফগানিস্তান এখন, ২০২২

  • 29 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 304 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মানুষকে বুঝতে হবে মানুষের সবচেয়ে বড় অবদান মানুষ ও মনুষ্যত্ব। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেননি, মানুষই ঈশ্বরভাবনার জন্ম দিয়েছে। অবাঞ্ছিত ধর্মবিশ্বাস অথবা অপ্রয়োজনীয় ধর্মভীরুতাকে হাতিয়ার করে যদি কোনও দল বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতা দখলে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবে সবচাইতে আগে তারই বিরোধিতা করা প্রয়োজন। আমরা কি খাব, কি পরব অথবা কি পড়ব, তা কোনও আকাশচারী ঈশ্বরের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। মানুষই কেবল নিজেদের অক্ষমতা দেখাতে, অথবা দুর্বলের ক্ষমতা জাহিরের প্রয়োজনে এমন একেকটি ধারণাকে সৃষ্টি করেছে।

বছর ঘুরে গিয়েছে। ৩০শে আগস্ট, ২০২১ – সেই থেকে আজ ২৮ বা ২৯শে জুলাই, ২০২২। আফগানভূমি থেকে মার্কিন সৈন্যদের পশ্চাদপসরণের সেই ঘটনার পর, তালিবান শাসনের অধীনে আজ বছর ঘুরতে চলেছে। কিন্তু সেই দেশের মহিলাদের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে অন্ধকার কেবলই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তরফে সেদেশের মেয়েদের বিষয়ে একটি দীর্ঘ সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেই রিপোর্টের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, “তিলে তিলে মৃত্যুঃ তালিবান শাসনে মেয়েদের অবস্থা”। শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট কি ভয়ানক পরিস্থিতিতে সেখানকার মেয়েদের জীবন কাটাতে হচ্ছে।

আয়েশা জাসুরের কথাই বলি। বছর ২২এর আয়েশা তালিবান-বিরোধিতার অন্যতম শক্ত ঘাঁটি পঞ্জশিরের বাসিন্দা। পেশায় মানবাধিকার কর্মী। তালিবান জমানাতেও এই পেশাটির যে এখনও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা গিয়েছে, সেই বিস্ময়ের। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, গত আগস্টের পর থেকেই তাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আয়েশার কথায়, “একে বাঁচা বলে না, কিন্তু এভাবেই আমাদেরকে বাঁচতে হয়।” তাঁর কথায়, “এর আগে কখনও সন্ধ্যে আটটার পর রাস্তায় বেরুতে গেলেও আমাদেরকে কিছু ভাবতে হতো না। আমরা সেই সময়ে সুপারমার্কেটে বেড়াতে যেতাম। এখন যা অসম্ভব। মহরম বা পুরুষ-সঙ্গী ভিন্ন পথেঘাটে চলাফেরা করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।” নয়া এই আফগানিস্তানে ভাইস এ্যাণ্ড ভারচু, অর্থাৎ কিনা সদগুণ ও অসদগুণ বিষয়ক একটি মন্ত্রক অবধি ইদানীং কালে স্থাপিত হয়েছে। সেখান থেকেই মেয়েদের পোশাক বিধির ব্যাপারে নিয়মিত ফরমান জারি করা হয়ে থাকে। ক্লাস সিক্সের পর থেকেই মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার উপরে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে রয়েছে। আফগানিস্তানের ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে, প্রায় সবকটিই নতুন করে চালু হলেও – অধিকাংশতেই মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে। যে কটিতে এখনও অবধি মেয়েদের প্রবেশাধিকার রয়েছে, সেগুলিতেও মেয়েদের উপর গুচ্ছ নিয়ম-কানুন-শর্তের বোঝা চাপিয়ে তাদের শিক্ষালাভের পথটিকে ক্রমেই সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করে আনা হচ্ছে। হিজাব, নিকাব, বোরখাতে টেলিভিশনের সংবাদপাঠিকা থেকে শুরু করে মুখ ঢাকতে বাধ্য হয়েছে আপামর আফগান নারীসমাজ। অন্ধকার নেমে এসেছে।

অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তথ্য বলছে, আফগান জনসংখ্যার ৮০% মানুষ কোনও না কোনও ভাবে আজ সরাসরি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় র‍য়েছেন। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন আগ্রাসনের সময়েও প্রায় সমস্ত আফগান অর্থনীতিরই ভিত্তি দাঁড়িয়েছিল বিদেশি সাহায্যের উপর। মার্কিন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে হাত তুলে নেওয়ার পর আফগান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সমস্ত সম্পদ তাদের তরফে আটকে দেওয়া হয়। এর ফলে সেদেশে ৮০% মানুষ রাতারাতি বেতনহীন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বেতনব্যবস্থা চালু হলেও, পুরুষ সরকারি কর্মচারীদের গড় বেতন যেখানে ছিল ৭০০মার্কিন ডলার, মেয়েদের ক্ষেত্রে সরাসরি সেই বেতনকে কমিয়ে ৩৫০ডলার করে দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সাল অবধি আফগান সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ২১% মহিলা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ১৬% উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। আফগান সংসদে ২৭% মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল অবধি প্রাইমারি শিক্ষায় শিক্ষিত আফগান মেয়েদের সংখ্যা ১০% থেকে বেড়ে ৩৩%এর কোঠায় পৌঁছিয়েছিল। সেসবই এখন দুস্তর ইতিহাস মাত্র।

অর্থনৈতিক সংকটের এই অবস্থায় মেয়েদের উপরেই সবচেয়ে আগে ভবিত্যবের খাঁড়া নেমে আসতে চলেছে। বাড়তে শুরু করেছে বাল্যবিবাহ, যৌনব্যবসা অথবা নারীপাচারের মতো একেকটি ঘটনা। তালিবান শাসনের আগেও, ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স অবধি আফগান মহিলাদের ২৮% বাল্যবিবাহের শিকার হতো। এখন সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে চলেছে, হদিস মিলছে না। খোস্ত প্রদেশের এক মহিলা সমাজকর্মী সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, সেই অঞ্চলের ৮ বছরের এক শিশুকন্যাকে ইতিমধ্যেই এক বৃদ্ধ তালিবানি মৌলবির বাগদত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রজঃস্বলা হওয়া মাত্র সেই মেয়েটিকে মৌলবির হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে তার পরিবারের তরফে সম্মতি প্রকাশ করা হয়েছে। এধরণের সত্যকে ছাপার অক্ষরে লিখতেও অস্বস্তি বোধ হয়। ঘৃণা বোধ হয় ভিতরে। কিন্তু সত্য যে সমস্ত সময়েই কঠিন ও রূঢ়তর এক মূর্তি ধরে আসে।

আফগানিস্তানের যে এমনতরো পরিস্থিতি হতে চলেছে, তা বোধহয় আমাদের কারোরই অজানা ছিল না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কেবল তালিবানেরই দোষ দেখলে চলবে না। বিগত একশো বছরে, ব্রিটিশ, সোভিয়েত ও সবশেষে মার্কিনি আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছে এই দেশ। প্রতিবারেই আগ্রাসকেরা কেবল উপর থেকে পাশ্চাত্য দয়া ও কিঞ্চিৎ পরিমাণে দায়িত্বশীল শাসকের ভূমিকা পালনেই ব্যস্ত হয়েছিল। জমিতে নেমে এসে আফগানদের হাত দিয়েই নয়া আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠার চেষ্টামাত্র করেনি। এর পরিবর্তে শেষ অবধি সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকা, বরং নিজেদের মধ্যকার ঠাণ্ডা লড়াইয়ের এক প্রাচ্যদেশীয় ফ্রন্ট হিসেবেই এই দেশকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। ফলস্বরূপ, শাসক অথবা নাগরিক সৃষ্টির পরিবর্তে, সেদেশে তৈরি হয়েছে একের পর এক বিরুদ্ধ মনোভাবাপন্ন চরমপন্থী সংগঠন, যারা কিনা যেনতেন প্রকারেণ অপর সংগঠনের ক্ষতিসাধনেই সিদ্ধহস্ত ও বদ্ধপরিকর। কাজেই স্বার্থসিদ্ধি ভিন্ন বিগত একশো বছরে আফগান শাসকেরা আর কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। অন্যদিকে উগ্রবাদী, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উত্থান সেদেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে ভিত্তি করে ক্রমশ নিজের জাল ছড়িয়েছে। ছড়াতে ছড়াতে যখন সেই জাল ক্যানসার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।

মানুষকে বুঝতে হবে, মানুষের সবচেয়ে বড় অবদান মানুষ ও মনুষ্যত্ব। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেননি, পরিবর্তে মানুষই ঈশ্বরভাবনার জন্ম দিয়েছে। অব্যাখ্যাত যদি কিছু থেকেই থাকে, তা হলো প্রকৃতি। ঈশ্বর নয়। ঠিক সেই কারণেই, অবাঞ্ছিত ধর্মবিশ্বাস অথবা আধুনিক সমাজের পক্ষে অপ্রয়োজনীয় ধর্মভীরুতাকে হাতিয়ার করে যদি কোনও দল বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতা দখলে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবে সবচাইতে আগে তারই বিরোধিতা করা প্রয়োজন। আমরা কি খাব, কি পরব, অথবা কি পড়ব – তা কোনও আকাশচারী ঈশ্বরের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। কোনও শূলদণ্ডধারী ম্যাজিস্ট্রেট উপরের ওই নীল আকাশের প্রাসাদখানিতে রাজত্ব বিস্তার করেন না। মানুষই কেবল নিজেদের অক্ষমতা দেখাতে, অথবা দুর্বলের ক্ষমতা জাহিরের প্রয়োজনে এমন একেকটি ধারণাকে সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু আফগানিস্তানের সমস্যা বোধ করি এর চেয়েও কিছু গভীর। স্বাধীনচেতা আফগানবাসীকে বিগত একশো বছর ধরে স্বাধীনতার টোপ দেখিয়ে আসা হয়েছে। জাতিগত বিভেদকে ইচ্ছাকৃত ভাবে আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এর দায় তালিবানের নয়। এর দায় সুসভ্য পাশ্চাত্য সভ্যতার। যারা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও নিকৃষ্টতার সঙ্গে সেদেশের মাটিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ মেটানোর, পারস্পরিক শাসানি ও পাল্টা শাসানির সময় নির্বাহের জন্য ব্যবহার করে এসেছে। এই দুইয়েরই মাঝে পড়ে একটি দেশ আজ বিধবস্ত ও চরম সংকটের অবস্থায়।

এতদসত্ত্বেও আয়েশা, অথবা অনামা এমন আরও অনেক মানুষ তাঁদের লড়াইকে জারি রেখে চলেছেন। তাঁরা সমাবেশ-মিছিলে সমবেত হচ্ছেন। লুকিয়েচুরিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা ও আধুনিক ভাবনা প্রসারে। এ্যামনেস্টির রিপোর্টে তাঁদের কথাও রয়েছে। কিন্তু যে অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে, সমাবেশ অথবা মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হলেই জীবনসংশয় নেমে আসছে, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই লড়াই কতদিন জারি রাখা সম্ভব হবে জানা নেই আমাদের। পাশ্চাত্য অথবা সংগঠিত আরও কোনও প্রতিষ্ঠানের উপরও ভরসা রাখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকেই কারোর না কারোর অঙ্গুলিহেলনে কাজ করে চলেছে। তবুও বিশ্বাস হারাব না, মানুষই পারে ইতিহাসের খাত বদলাতে, সাম্রাজ্যকে চূর্ণ করতে পারে। হিজাব, নিকাবে যে অন্ধকার নেমে এসেছে, সত্য এও যে – আফগান মানুষেরা, আফগান নারীসমাজ সেই অন্ধকারকে চিরস্থায়ী বলে মেনে নেয়নি। লড়াই জারি থেকেছে। জারি রয়েছে এখনও। আমরা বিশ্বাস করি, অনেক মানুষের মিলিত চেষ্টাতেই পৃথিবীতে সময়-পরিবর্তন সম্ভব। এ কারও একার ইচ্ছা, বা একার প্রচেষ্টার কর্ম নয়। আশা রাখব অদূর কোনও সময়েই এ্যামনেস্টির নতুন রিপোর্টের শিরোনাম লেখা থাকবে, “আফগানিস্তানের মাটিতে নতুন সূর্যোদয়ঃ নারীর হাতেই ক্ষমতা”, এই চিন্তাকে ইউটোপিয়া বলে মনে হতেই পারে আপনাদের – কিন্তু প্রতিবেদন কেবল যদি হতাশারই জন্ম দেয়, তাহলে নতুন সংগ্রামের প্রস্তুতিটুকুও শুরু হতে পারে না। পরিবর্তনের মুহূর্ত আসুক আমার আপনার নিজেদের পরিসর থেকেই!

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

সূত্রঃ

[১] https://www.amnesty.org/en/documents/asa11/5685/2022/en/

[২] https://nypost.com/2022/07/23/afghan-women-live-in-terror-one-year-after-us-withdrawal/

[৩] https://www.buzzfeednews.com/article/syedzabiullah/womens-rights-protest-taliban-arrest

[৪] https://www.npr.org/sections/goatsandsoda/2022/07/27/1114033369/what-its-like-being-a-woman-in-afghanistan-today-death-in-slow-motion

0 Comments

Post Comment