- 11 February, 2022
- 0 Comment(s)
- 671 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
নিজের কাছে আন্তরিকতার সঙ্গে এই অনুভূতি প্রকাশ করা থেকে তরুণী স্ত্রী সবসময় অনেক দূরেই থাকেন। স্বামীকে ভালোবাসা এবং সুখী হওয়া হল তাঁর নিজের প্রতি এবং সমাজের প্রতি একটি কর্তব্য--এমনটাই তাঁর পরিবার তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা করে। অথবা পিতা-মাতা যদি বিবাহের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে থাকেন, তাহলে তাঁরা যে কতটা ভুল ছিলেন, তা তিনি প্রমাণ করতে চান। সাধারণত খারাপ বিশ্বাসে ভর করেই তরুণী স্ত্রী তাঁর দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। স্বেচ্ছায় নিজেকে বোঝাতে চান যে, স্বামীর প্রতি তিনি প্রভূত ভালোবাসা উপলব্ধি করেন। বিবাহিত মহিলা যত কম যৌনতৃপ্তি লাভ করেন, তত বেশি এই আবেগ একটি উন্মত্ত, দখলদারী, ঈর্ষান্বিত রূপ লাভ করে। যে-হতাশাকে তিনি প্রথমে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন, সেই হতাশার জন্য নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অপ্রশমনীয়ভাবে তাঁর স্বামীর উপস্থিতির প্রয়োজন অনুভব করেন। এইরকম অসুস্থ সংযুক্তির অনেক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন স্টেকেল।
infantile fixations-এর জন্য একজন মহিলা তাঁর বিবাহের প্রথম কয়েক বছর কামোত্তেজনাহীন ছিলেন। তারপর তাঁর মধ্যে একটি হাইপারট্রপিক প্রেম গড়ে ওঠে-- যেমনটা আমরা প্রায়শই দেখে থাকি সেইসব মহিলার মধ্যে যাঁরা দেখতে চান না যে, তাঁদের স্বামী তাঁদের প্রতি উদাসীন। তিনি কেবল স্বামীর জন্যই বাঁচতেন, স্বামীর কথাই ভাবতেন। তাঁর আর কোনো ইচ্ছা ছিল না। স্বামীকে সকালেই স্ত্রীর জন্য গোটা দিনের কর্মসূচি ঠিক করে দিতে হত, স্বামীকে বলতে হত কী কী জিনিস স্ত্রীকে কিনতেই হবে ইত্যাদি। বিবেকের সঙ্গে স্ত্রী সব কাজ করতেন। স্বামী যদি তাঁকে কোনো নির্দেশ না-দেন, তাহলে কোনো কাজ না-করে তিনি নিজের ঘরে থাকতেন আর স্বামীকে নিয়ে চিন্তা করতেন। তাঁর সঙ্গ ছাড়া স্বামীকে তিনি কোথাও যেতে দিতেন না। তিনি একা থাকতে পারতেন না, স্বামীর হাত ধরে রাখতে পছন্দ করতেন ... তিনি অসুখী ছিলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কাঁদতেন এবং স্বামীর জন্য কাঁপতেন। এই কাঁপার জন্য যদি কোনো উপলক্ষ্য নাও-থাকতো, তাহলেও নিজে তিনি সেই উপলক্ষ্যগুলি তৈরি করে নিতেন।
আমার দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল--একজন মহিলা জেলখানার মতো করে নিজেকে ঘরের মধ্যেবন্দি করে রাখতেন একাকী বেরোনোর ভয়ে। দেখেছিলাম--তিনি তাঁর স্বামীর হাত ধরে আছেন, স্বামীকে সবসময় তাঁর কাছে থাকার অনুরোধ জানাচ্ছেন ... সাত বছর বিয়ে হলেও স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী কখনও সম্পর্ক তৈরি করতে পারেননি।
সোফিয়া টলস্টয়ের ঘটনাটিও সাদৃশ্যপূর্ণ। আমার উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ এবং ডায়ারির বাকি অংশগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, স্বামীকে তিনি ভালোবাসেন না। স্বামীর সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক তাঁকে খুবই বিরক্ত করে দিয়েছিল। স্বামীর অতীতের জন্য স্বামীকে তিনি তিরস্কার করেছিলেন। তাঁর মনে হত, স্বামী বৃদ্ধ এবং বিরক্তিকর। স্বামীর সকল চিন্তাভাবনার প্রতিই ছিল তাঁর শত্রুতা। তা ছাড়া, বিছানায় স্বামীকে মনে হত লোভী ও নৃশংস। স্ত্রীকে তিনি অবহেলা করতেন। স্ত্রীর সঙ্গে কঠোর ব্যবহার করতেন। সোফিয়ার আবেগপূর্ণ ভালোবাসার প্রতিবাদের সঙ্গে মিশে যায় হতাশার কান্না, একঘেয়েমির স্বীকারোক্তি, দুঃখ, উদাসীনতা। নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রিয় স্বামীকে তিনি কাছে পেতে চান। স্বামী দূরে যাওয়া মাত্রই ঈর্ষায় অত্যাচারিত হন। সোফিয়া লিখেছেন :
১১-০১-১৮৬৩ ঈর্ষা আমার জন্মগত রোগ। এই রোগ সম্ভবত এই জায়গা থেকে আসে যে, স্বামীকে এবং একমাত্র স্বামীকেই আমি ভালোবাসি। কেবল স্বামীর সঙ্গেই এবং স্বামীর দ্বারাই আমি সুখী হতে পারি।
১৫-০১-১৮৬৩ আমি চাই তিনি আমার মধ্য দিয়েই স্বপ্ন দেখুন আর চিন্তা করুন, আর শুধু আমাকেই ভালোবাসুন ... এটা ভালোবাসি, ওটা ভালোবাসি বলামাত্রই আমি নিজেকে সংবৃত করি নিই আর অনুভব করি যে লিওভট্চ্কার বাইরে কিছুই ভালোবাসি না। যদিও, আমার সম্পূর্ণতই উচিত অন্য কিছুকে ভালোবাসা যেমনটা তিনি তাঁর কাজকে ভালোবাসেন ... তবুও তাঁকে ছাড়া আমি এরকম যন্ত্রণা অনুভব করি। আমি অনুভব করছি যে, তাঁকে ছেড়ে না-যাওয়ার প্রয়োজন দিন দিন আমার মধ্যে বেড়ে চলছে।
১৭-১০-১৮৬৩ আমি তাঁকে ভালো করে বুঝতে পারি না। সেই কারণে এত ঈর্ষার সঙ্গে আমি তাঁর ওপর গোয়েন্দাগিরি করি।
৩১-০৭-১৮৬৮ নিজেরডায়ারি পড়ে আমার হাসি পায়। কী পরিমাণ অসংগতি! যেন নারীদের মধ্যে আমি সবচেয়ে অসুখী! আমাদের চেয়ে বেশি একতাবদ্ধ এবং সুখী দম্পতি আর আছে কি? আমার ভালোবাসা কেবল বেড়েই চলছে। আমি এখনও তাঁকে একইরকম অস্থির, আবেগপূর্ণ, ঈর্ষান্বিত এবং কাব্যিক ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসি। তাঁর শান্তভাব এবং আত্মপ্রত্যয় মাঝে মাঝে আমাকে বিরক্ত করে।
১৬-০৯-১৮৭৬ অধীর আগ্রহে আমি তাঁর ডায়ারির পাতাগুলি খুঁজি যেখানে ভালোবাসার কথা আছে। সেই পাতাগুলি খুঁজে পাওয়ামাত্রই আমি ঈর্ষার দ্বারা গ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আমি লিওভট্চ্কাকেই দায়ী করি। আমি ঘুমোই না, প্রায় কিছুই খাই না। চোখের জল সংবরণ করি অথবা গোপনে কাঁদি। প্রতিদিন আমার একটু জ্বর হয়, সন্ধ্যায় কাঁপুনি লাগে ... তাঁকে এত ভালোবাসার জন্যই কি আমাকে শাস্তি পেতে হল?
প্রকৃত ভালোবাসার অনুপস্থিতির জন্য নৈতিক বা ‘কাব্যিক’ উচ্ছ্বাস দ্বারা তা ক্ষতিপূরণের একটি নিরর্থক প্রচেষ্টা এই সমস্ত পৃষ্ঠার মধ্য দিয়ে অনুভব করা যায়। চাহিদা, উদ্বেগ এবং ঈর্ষা হল তাঁর হৃদয়ের শূন্যতার প্রকাশ। অনেক অস্বাস্থ্যকর ঈর্ষাই এরকম পরিস্থিতিতে বিকাশ লাভ করে। পরোক্ষে,ঈর্ষাই এমন এক অতৃপ্তি প্রকাশ করে যা মহিলারা খাড়া করেন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী উদ্ভাবনের মাধ্যমে। কখনোই স্বামীর সঙ্গে পরিপূর্ণতা অনুভব করেন না তাঁরা। স্বামী তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করছেন--এই কল্পনা করে তিনি কোনোপ্রকারে নিজের হতাশাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলেন।
নৈতিকতা, ভণ্ডামি, অহংকার, লাজুকতা থেকে মহিলারা খুব ঘনঘন অনড়ভাবে মিথ্যা কথা বলেন। “প্রিয় স্বামীর প্রতি বিদ্বেষ প্রায়শই গোটা জীবন ধরেই বোঝা যায় না : একেই মেলানকলি বা অন্য কোনো নামে ডাকা হয়”, বলেছেন শারদন। নামহীন হয়ে থাকলেও এই বিদ্বেষকে যে কম অনুভব করা যায়--এমনটা নয়।স্বামীর আধিপত্য বা কর্তৃত্বকে যুবতী স্ত্রীর প্রত্যাখ্যানের প্রচেষ্টার দ্বারা কম-বেশি হিংসার সঙ্গে এই বিদ্বেষকে অনুভব করা যায়। মধুচন্দ্রিমার পর এবং প্রায়শই এর পরবর্তী বিশৃঙ্খলার সময়পর্বে বিবাহিত মহিলা চেষ্টা করেন তাঁর স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধারের। কাজটি সহজ নয়। কারণ, স্বামী যেহেতু প্রায়শই স্ত্রীর চেয়ে বয়সে বড়ো হন, সর্বক্ষেত্রেই স্বামীর যেহেতু রয়েছে পুরুষোচিত প্রতিপত্তি, আইন অনুসারে তিনিই ‘পরিবারের প্রধান’, ফলত নৈতিক এবং সামাজিক শ্রেষ্ঠত্ব তিনি অধিকার করে রেখেছেন। প্রায়শই তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হন, অথবা তেমনটাই অন্তত দেখা যায়। মহিলাদের থেকে সংস্কৃতি অথবা অন্ততপক্ষে পেশাদার প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর সুবিধা রয়েছে। বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই পার্থিব বিষয়ে পুরুষেরা আগ্রহী : এসব পুরুষের কাজ। আইন সম্পর্কে কিছুটা তাঁরা জানেন। সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। একটি দল, একটি সংগঠন, অনেক সমিতির তাঁরা সদস্য। কর্মী, নাগরিক হিসাবে তাঁদের চিন্তাভাবনা কর্মে নিয়োজিত। তাঁরা জানেন বাস্তবতার পরীক্ষা--যার সঙ্গে কেউ প্রতারণা করতে পারে না। অর্থাৎ, গড়পড়তা মানুষের আছে যুক্তির কৌশল, আছে তথ্য ও অভিজ্ঞতার প্রতি রুচি, একটি সমালোচনামূলক অনুভূতি। অনেক অল্পবয়সি মেয়ের মধ্যে এখনও এই অভাবই রয়ে গেছে। যতই তাঁরা পড়াশোনা করে থাকুন, বিভিন্ন কনফারেন্স শুনে থাকুন, সুন্দর কলাশিল্পের বুলি আওড়ান না কেন, কম-বেশি এদিক-ওদিক করে জড়ো হওয়া তাঁদের জ্ঞান কিন্তু কোনো সংস্কৃতি তৈরি করে না। কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ত্রুটির কারণে তাঁরা যে খারাপ যুক্তি দিতে জানেন, এমনটা কিন্তু নয় : আসলে অনুশীলন তাঁদেরকে তা করতে বাধ্য করেনি। চিন্তাভাবনা তাঁদের কাছে একটি হাতিয়ার নয়, বরং একটি খেলা। এমনকি বুদ্ধিমান, সংবেদনশীল, আন্তরিক হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের অভাবে তাঁরা জানেন না কীভাবে তাঁদের মতামত প্রদর্শন করতে হয় এবং পরিণতি টানতে হয়। এর মাধ্যমেই একজন স্বামী—অনেক বেশি মাঝারি মানের মানুষ হয়েও—সহজেই মহিলাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। স্বামী জানবেন, ভুল হলেও কীভাবে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করা যায়। প্রায়শই সহিংসতাই হল পুরুষের হাতের যুক্তি। l’Épithalame-এ শারদন চমৎকারভাবে নিপীড়নের এই গোপন কৌশলটি বর্ণনা করেছেন। বার্থের চেয়ে বেশি বয়সি, বেশি সংস্কৃতিবান এবং বেশি শিক্ষিত আলবার্ট নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রয়োগের জন্য স্ত্রীর মতামতের সমস্ত গুরুত্ব অস্বীকার করার জন্য স্ত্রীর মতামত ভাগ করে নেন না। অক্লান্তভাবে স্ত্রীর কাছে প্রমাণ করেন যে তিনিই সঠিক। স্ত্রীও তাঁর নিজের দিক থেকে অনড় হয়ে যান এবং স্বামীর যুক্তিতে যে কোনো পদার্থ আছে তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। নিজের ধারণা বা চিন্তাভাবনাতে স্বামী একগুঁয়ে। এখানেই শেষ। এভাবেই তাঁদের মধ্যে একটি গুরুতর ভুল বোঝাবুঝি বৃদ্ধি পায়। নিজের মধ্যে যেসব অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়ার শিকড় দৃঢ়প্রোথিত, অথচ স্ত্রী ন্যায্যতা দিতে পারেন না--স্বামী সেগুলি বোঝার চেষ্টা করেন না। স্ত্রী বুঝতে পারেন না, তাঁর স্বামীর পাণ্ডিত্যাভিমানী যুক্তির পিছনে এমন কীই-বা থাকতে পারে যা তাঁকে নড়বড়ে করে দেয়! স্বামীর কাছে না-লুকোনো স্ত্রীর অজ্ঞতায় বিরক্ত হয়ে স্বামী এতটাই দূরে চলে যান যে, চ্যালেঞ্জের সঙ্গে তিনি জ্যোতির্বিদ্যার প্রশ্ন তাঁর স্ত্রীকে করেন। তবে, স্ত্রীকে কী কী পড়তে হবে তা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে তিনি আহ্লাদিত হন। আহ্লাদিত হন স্ত্রীর মধ্যে এমন একজন শ্রোতাকে খুঁজে পেয়ে যাঁর ওপর সহজেই প্রভুত্ব করা যায়। এই লড়াইয়ে স্ত্রীর বুদ্ধিবৃত্তিক অপ্রতুলতা যখন তাঁকে প্রতিবার পরাজিত হওয়ার জন্য নিন্দা করে; তখন যুবতী স্ত্রীর কাছে নীরবতা, কান্না এবং হিংসা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না :
আলবার্টের এই ঝাঁকুনি দেওয়া কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনে বার্থ আর চিন্তা করতে পারেন না। হঠাৎ ঘা খেয়ে অবশ হয়ে যাওয়ার মতো তাঁর মস্তিষ্ক বধির হয়ে যায়। তাঁকে স্তব্ধ করার জন্য উদ্ধত ও কর্তৃত্বপূর্ণভাবে বিড়বিড় করে যেতে থাকেন আলবার্ট। বার্থের অপমানিত মনের অস্থিরতা-বিভ্রান্তির মাঝে তাঁকে আঘাত করেন। একটি অকল্পনীয় তর্কের কঠোরতার সামনে পরাজিত, বিক্ষিপ্ত হয়ে এই অন্যায় শক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বার্থ চিৎকার করে বলেন : আমাকে একা ছেড়ে দাও! এই কথাগুলো তাঁর কাছে খুবই দুর্বল মনে হয়েছিল; তিনি ড্রেসিং টেবিলে একটি ক্রিস্টাল বোতলের দিকে তাকালেন এবং হঠাৎ বাক্সটি আলবার্টের দিকে ছুঁড়ে মারলেন…
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment