লজ্জা কি কেবল নারীর?

  • 07 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 827 view(s)
  • লিখেছেন : মোনালিসা পাত্র
“লজ্জা নারীর ভূষণ” সমাজের এই বহুল প্রচলিত প্রবাদটির মাধ্যমেই সমাজিক এক দ্বিচারিতার প্রকাশ দেখা যায়। লজ্জা কি কেবল নারীদের? পুরুষের লজ্জা নেই? পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত দণ্ডমুণ্ডের কর্তা পুরুষ কিন্তু লজ্জা কেবল মেয়েদের। নারীর পোশাক কতটা লম্বা কতটা ছোট তার ওপর নির্ভর করে তার সামাজিক সম্মান, পারিবারিক শিক্ষা, সর্বোপরি তার সুরক্ষা, এমন এক সামাজিক নির্মাণের মধ্যে আমরা বাস করি। কিন্তু এই নির্মাণ যে কেবল পিতৃতন্ত্রের বুলি তা বোঝা যায় যখন বোরখা পরিহিতা নারী, পাঁচমাসের শিশু থেকে বৃদ্ধা সবাই ধর্ষিতা হন।

নারী ও পোশাক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে পোশাক নিয়ে খানিক চর্চা করতে হয়।
পোশাকের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে দেখা যায় পোশাক ব্যবহার শুরু হয় প্রথমত লজ্জা নিবারণের জন্য ও রোদ, ঝড়, বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে। তারপর নানা দেশ, নানা সংস্কৃতি, নানা প্রজাতির মানুষ নানা ধরনের পোশাক পরা শুরু করেন এবং পোশাক সংস্কৃতির একটি অবিছেদ্দ্য অঙ্গ হয়ে যায়। এবার আসা যাক লিঙ্গ ও পোশাকের যোগসূত্রে, পোশাকের ব্যবহার মূলত লজ্জা নিবারণের জন্য হলেও পরে লজ্জটা কেবল নারীদের প্রসস্থ স্কন্ধে চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং পুরুষদের লজ্জাহীন হবার কোনও বাধা থাকেনা। রাস্তাঘাটে, স্কুলকলেজে, সামাজিক, পারিবারিক অনুষ্ঠানে মহিলাদের পোশাক বহুল চর্চিত। সমাজ ও পরিবার নারী শরীর ও তার শালীনতাকে এক সামাজিক সম্মানের মানদণ্ড করে পেশ করে। একজন পুরুষ ধর্ষক হলে কেউ তার পোশাক বা সামাজিক শিক্ষা নিয়ে যতটা না প্রশ্ন তোলে নারীর পোশাক অনেক বেশি বিশ্লেষণের কারণ হয়। সমাজ মেয়েদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে তার পোশাক দেখে। সম্প্রতি কিছু ঘটনা খবরের কাগজ ও সোশ্যাল সাইটের দৌলতে চোখে পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল হিজাব বিতর্ক। যেখানে কর্ণাটকে একটি কলেজে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরাতে বাধা দেওয়া হয় এবং তারা তার উদ্দেশ্যে প্রতিবাদ করে এবং এই প্রতিবাদ একটি বৃহত্তর চেহারা নেয়। এপ্রসঙ্গে নারী ও পোশাকের যোগসূত্র এবং এর দীর্ঘ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব।

 

“লজ্জা নারীর ভূষণ” সমাজের এই বহুল প্রচলিত প্রবাদটির মাধ্যমেই সমাজিক এক দ্বিচারিতার প্রকাশ দেখা যায়। লজ্জা কি কেবল নারীদের? পুরুষের লজ্জা নেই? পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সমস্ত দণ্ডমুণ্ডের কর্তা পুরুষ কিন্তু লজ্জা কেবল মেয়েদের। নারীর পোশাক কতটা লম্বা কতটা ছোট তার ওপর নির্ভর করে তার সামাজিক সম্মান, পারিবারিক শিক্ষা, সর্বোপরি তার সুরক্ষা, এমন এক সামাজিক নির্মাণের মধ্যে আমরা বাস করি। কিন্তু এই নির্মাণ যে কেবল পিতৃতন্ত্রের বুলি তা বোঝা যায় যখন বোরখা পরিহিতা নারী, পাঁচমাসের শিশু থেকে বৃদ্ধা সবাই ধর্ষিতা হন। পুরুষের অসুস্থ মানসিকতা,ক্ষমতার আস্ফালন নারীর শরীরের ওপর তার অধিকার কায়েম করতে চায় তাই পুরুষ আত্মীয় হন বা আত্মজ শালীনতা বজায় রাখার দায় বর্তায় মেয়েটির
ওপর।  তাই শুনতে হয় “ভদ্রবাড়ীর মেয়েরা এই পোশাক পরেনা” কিন্তু ভদ্রবাড়ির পুরুষরা মহিলাদের সম্মান করতে শেখার দায় নিজের কাঁধে নেন না। আর এই পুরুষতন্ত্রের পরাকাষ্ঠার ধারক ও বাহক করা হয়েছে বাড়ির মহিলাদের । মা মেয়েকে, শাশুড়ি বৌমাকে শালীনতার পাঠ পড়ান। প্রখর গ্রীষ্মেও বোরখা পরা বা সামাজিক ভাবে নির্মিত শালীন পোশাক পরার দায় বর্তায় ভদ্র বাড়ির মেয়েদের।

 


এবার আসা যাক ধর্মীয় দাদাগিরির প্রসঙ্গে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের
নির্দিষ্ট পোশাক ঠিক করা আছে, ঋতুমতী মহিলাদের অপবিত্র বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। আসল
কথা হল সমাজ ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরা নারী শরীরকে তাদের সম্পত্তি মনে করেন তাই
সম্পত্তি যেমন আগলে রাখতে হয় তেমনি নারী শরীরকেও ঢেকে রাখতে হয়। উচ্চ,নীচ,ধনী,গরীব
নির্বিশেষে মহিলাদের পোশাক বিশেষ নজরের বিষয়। ধর্মীয় অনুশাসনের নিয়মনীতি মহিলাদের
মধ্যে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে তারা নিজেরাও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তাদের পোশাকের ওপর সমাজের ও পরিবারের সম্মান নির্ভর করে। তাই হিজাব বিতর্কের প্রসঙ্গে বলা যায় অবশ্যই নারীর পোশাক তার নিজস্ব পছন্দ, রুচি ও মানসিকতার ওপর নির্ভর করে তবে এর পিছনে যে আজন্ম লালিত সামাজিক নির্মাণ আছে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই।  তাই আফগানিস্তান হোক কি আফ্রিকা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্র সর্বদাই মহিলাদের পোশাকের ওপর নীতি পুলিশি করাটাই নিয়ম করে ফেলেছে।

 


এবার আলোচনা করা যেতে পারে মহিলাদের পোশাক কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে। ঠিক
তেমনটাই যেমনটা সে নিজে চায়। কেউ শিক্ষক বলে তাকে সর্বদা শাড়ি পরতে হবে আর কেউ টেনিস খেলেন বলে তিনি সর্বদা স্কার্ট পরবেন বা পরতে ইচ্ছা হবে এমনটা নাও হতে পারে। ঠিক তেমনি গায়ের রঙ, উচ্চতা, ধর্ম কোনটাই পোশাকের নির্বাচক হতে পারেনা। সমাজ কখনো একজন মানুষের পরিধেয় ঠিক করতে পারে না। আমরা প্রায়শই শুনি একজন মায়ের এমন পোশাক পরা সাজেনা, শিক্ষিকার এমন পোশাক মানায়? পেশা, ধর্ম, সমাজ এসব নিমিত্তমাত্র আসল হল পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মহিলাদের শরীর ও তার মননের ওপর নিয়ন্ত্রণ। এ নিয়ন্ত্রণ কেবল ফতোয়া জারি করে সরকার বা কর্তৃপক্ষ করেনা, এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিটি পদক্ষেপে, পারিবারিক স্তরে এবং মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। সব মহিলা একত্রে যদি এই পোশাক ফতোয়ার প্রতিবাদ করেন সেদিন এই অন্যায় দাবির মূলে কুঠারাঘাত করা যাবে। সমাজ ধর্ষিতা নারীর পোশাকের থেকে ধর্ষকের কুৎসিত মানাসিকতা নিয়ে কথা বলবে। নারী হিজাব পরুন কি না পরুন শাড়ী পরুন বা স্কার্ট তার সামাজিক সম্মান, চরিত্র বা পারিবারিক শিক্ষা এর সাথে একেবারেই সম্পর্কিত হবেনা। লজ্জা তাই কেবল নারীর নয়। লজ্জা সমাজের, যে সমাজ একজন মানুষের বিচার করে তার পোশাক দ্বারা।

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৭ জানুয়ারি ২০২৩ 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment