- 19 July, 2021
- 0 Comment(s)
- 785 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
ছোট বোন সুরমা এসেছে পাহাড়পুর গ্রাম থেকে। তার বড়বুবু রিজিয়া আগের দিন বিকেলে মারা গেছে। মৃত বুবুর পাশে বসে স্মৃতি খুলে বিনিয়ে বিনিয়ে সে কাঁদছে। সুরমার কান্নায় যোগ দিয়েছে মৃতদেহের পাশে বসে থাকা, সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরাও। আবার কাঁদছে ওরা। ভিড়ের মধ্যে অনেকেই আছে যারা আগের দিন বিকেল থেকে কেঁদেছে। আত্মীয় অনেক। দূর-দূরান্তে থাকে। মাঘ মাসের হিমকরা ঠাণ্ডার রাতে অনেকে পৌঁছতে পারেনি। সকাল থেকে একে একে ঢুকছে। দফায় দফায় তাই আওয়াজ উঠছে কান্নার। নতুন নতুন দল ঢুকেই একদফা কাঁদছে। তাঁদের সাথ দিচ্ছে মৃতদেহ ঘিরে থাকা মেয়েদের দলও। মৃতদেহকে রাখা হয়েছে টানা লম্বা এক বারান্দায়। তার চারপাশে মেয়েরা গোল হয়ে বসে আছে ছোট ছোট দলে। একেকটি দলে চার-পাঁচজন করে হবে। কান্না থামলেই দলগুলো নিজেদের মতো কথা শুরু করছে। মৃতের পরিবার, মৃতের অতীত, নিজেদের ঘরের কথা। স্বামীর খেদমতি। মেয়ের বিয়ে। ছেলের চাকরি। কাঁদার সময় কথার বিরতি দিয়ে ওরাও কান্নায় সুর মেলাচ্ছে। একেকটা কান্না পর্ব শেষ হলে আবার ফিরে যাচ্ছে কথা বিনিময়ে। মিনিট দশেক ধরে কেঁদে সুরমার চোখ পড়ল বোনঝি রুবিনার দিকে। রুবিনা বসে আছে মাবিয়া, ডলি, ফজিলাদের নিয়ে। কান্না থামিয়ে সুরমা সরে এল ওদের কাছে।
— রুবিনা তুই ক্যাল এলছিস?
— তোমার কিছুক্ষণ আগে এসেছি খালা।
— ক্যার সাথে এলি?
— ছোট মেয়েকে নিয়ে।
— কলকাতা থেকে তুরা একা এলছিস?
— হ্যাঁ খালা তোমার জামাই আসতে পারেনি।
— বড় বিটিকে আনলি না ক্যানে?
— ওর শাশড়ির শরীর খারাপ। আসতে দিলো না।
— হ্যারে রুবিনা ডাক্তার জামাই লিতে কত খরচা পড়ল?
— সে ভালই দিতে হয়েছে খালা। ধার-দেনা করে ধরে নিলাম। ডাক্তার পাত্র। তার ওপর পরহেজগার বাড়ি। বিহায়, বিহান তো হজ করেও এসেছে। চারদিক বুঝে তোমার জামাই এমন পাত্র হাতছাড়া করলো না।
— ভাল ছেলে ধরতে গেলে টাকা তো খসাতেই হবে মা।
— কই তোর ছোটবিটি? দেখা। ম্যালাইদিন দেখিনি। কতোবড়ো হল নাতনি আমার।
— হ্যাগো সুরমা ফুপু তুমার এসতে এত দেরি হলে ক্যানে? — ডলি জানতে চাইল।
মাবিয়া জিজ্ঞাসা করল, খালা ক্যাল কখন খবর পেলছো? রিজিয়া খালার দুনিয়াদারি শেষ হল এখনও যে বিশ্বাস হচে না।
— মাবিয়া, নেকদাররা অমন কর্যেই যায়। দেখ ক্যানে, বিছনায় পড়ে থ্যাকল না, কাউকে মুসিবতে ফেলল না। আল্লা তুল্যে লিল। তোর খালু বলে রিজিয়া বুবুর মতো স্বামীর সেবা করতে কম মেয়েই পারে।
— ঠিক বলছো খালা। তোমার ছেলে তো উঠতে বসতে আমাকে কথা শোনায়। রিজিয়া মামির মতো যে সেবা করতে পারিনা। নিজের অশুখ-বিশুখ নিয়েও স্বামীর যত্ন করেছে মামি। এখন মামার কী হবে তাই ভাবছি। — ফজিলা বলল। সে চাকরি করে এই মালতীপুর গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। মৃত রিজিয়ার বাড়ির পাশেই তার বাড়ি।
অনেকের সঙ্গে কতদিন পর দেখা। ওরা নিজের সংসারের খবর দেওয়া-নেওয়া শুরু করেছে।
অন্যদিকে একটু কম বয়সী বৌ-মেয়ের দল রাফা, জুলেখা, সাবিনা, সুমি, মুনতাহা বসে আছে। সুমি এক পিরের মুরিদান। পিরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা শোনাচ্ছে। কাছের-দূরের জা-ননদের চোখে বিস্ময়। সুমি কত সৌভাগ্যবতী। পিরের দোয়া আছে ওর ওপর। ওদের মধ্যে কয়েকজনের মনে হচ্ছে এই পিরের মুরিদ হতে পারলে ভাল হয়। রাফা বলল, সুমি ভাবি তুমি তো তাহলে বিনা খরচায় হজ করতে পারবে?
— হুজুর তো বলছেন, তোরা স্বামী-স্ত্রী চলে যা। বাসেট্রেনে চড়বি না, প্লেনে উঠবি না। কেউ তোদের দেখতে পাবে না। আমি পাঠিয়ে দিবো। শুধু হজের ময়দানে তোদের দেখা যাবে। হজ হলেই আবার ফিরিয়ে আনবো।
সাবিনা বলল, কপালজোরে পির পেয়েছিস সুমি। পির তো কম দেখিনি। কিন্তু এমন ক্ষমতাবান পিরের কথা তোর মুখেই শুনছি।
— কিসের আবার ক্ষমতা। ওসব ম্যাজিক, টাকা আদায়ের ফন্দি। পিরগুলোর কাজই হল মুরিদানদের বুজরুকি গল্প শুনিয়ে টাকা কামাই করা- সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোনো মালতীপুর গ্রামেরই মেয়ে মুনতাহা বলল।
সুমি বিড়বিড় করে তওবা তওবা বলে মুনতাহার দিকে ঘোরে। শুনো বহিন আর একটা ঘটনা বলি তাহলে। দীঘা ঘুরে এলাম জান তো? তুমাদের মতো করে শুধু পানির পাশে পাশে হাঁটিনি। এক হাঁটু পানিতে গা ভিজিয়ে দীঘা ঘুরিনি। হুজুরের এলেমে সমুদ্রের তল দেখে এসেছি। কিন্তু গা আমাদের ভিজেনি। পানির তলায় মজার মজার বাড়ি, ধন দৌলত। ওসব দেখার কপাল তো সবার হয় না।
প্রায় সম-বয়সী বলে মুনতাহা ওদের কাছে বসেছে। কিন্তু রূপকথার এই গল্পে সবাই যত ঝুঁকে পড়ছে ততই মনটা ক্ষেপে উঠছে মুনতাহার। ম্যাজিক শিখে পির-গুরু হয়ে ওঠা ব্যাবসিকগুলো মগজ ধোলাই করে মানুষদের। আর এরা বেহেস্ত যাওয়ার জন্য অর্থ লুটিয়ে দেয় পির-গুরুদের থলিতে। মুনতাহা কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। সবার সম্বিৎ ফিরল রিজিয়া্র মেয়ে লতিফাকে কান্নায় লুটিয়ে পড়তে দেখে। সারারাত জেগে মায়ের পাশেই বসে আছে লতিফা। কেঁদে কেঁদে গলা বসে গেছে। কলকাতা থেকে ওর খালাতো ভাই এলো। তাকে দেখে কাঁদছে। গল্প থেমে যায়। মেয়ের দল সুর মেলায় কান্নায়।
একদল পুরুষ ব্যস্ত আছে রান্নার তদারকিতে। বাড়ি লাগোয়া প্রসস্ত জায়গা ঘিরে ফেলা হয়েছে। বড় বড় উনুন তৈরি করে রান্না হচ্ছে তিন/চারশো মতো মানুষের। মৃত রাজিয়া ছিলো বড়লোকের বাড়ির গৃহকত্রী। লোকের ভিড়ে বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা নেই। রিজিয়াকে দাফনের পর শুরু হবে খাওয়ানো।
বারান্দা থেকে কিছুটা দূরত্ব বেছে নিয়ে গল্প করছে একদল তরুণ-তরুণী। ওরা সব তুতো ভাই- বোনের দল। দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা এই আত্মীয়-পরিজনরা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মিলিত হয়েছে। ওদের নিজস্ব ভঙিমায় চলছে ফিসফিস করে কথা। কখনও পড়ার বিষয়, কখনও চাকরি, কখনও গোপন কথার খুনশুটি। হাসতেও দেখা যাচ্ছে। শব্দ না করে। মৃত বাড়িতে দাঁড়িয়েও ওদের চৌহদ্দি আলাদা। তবে মাঝে মাঝে গল্পে ছেদ দিচ্ছে কান্নার আওয়াজ শুনে। তখন ওরাও সমব্যথী। মৃত্যু বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে ওদের অনুভূতিকে একাত্ম করে নিচ্ছে।
বারান্দার সামনেই রয়েছে বিরাট বড় উঠোন। রিজিয়ার স্বামী জাহিদ সেই উঠোনের মাঝে চেয়ারে বসে আছে। সবাই একবার করে তার কাছে আসছে সমবেদনা জানাতে। কিছু কিছু মহিলা-পুরুষ বসে আছে তাকে ঘিরে। তারা মনে করছে, স্ত্রী শোকে কাতর এই বৃদ্ধের পাশে উপস্থিত থেকে মানসিক শক্তি যোগানো দরকার। প্রতিবেশী আরিফ সান্ত্বনা দিতে দিতে বলছে, অমন নেকদার বৌ কজনের ভাগ্যে জোটে ভাই? আপনি নামাজি, পরহেজগার মানুষ। এক ওয়াক্ত নামাজ কোনদিন কামাই করতে দেখিনি। ভাবিও তেমনি আপনাকে ভক্তি করতো।
দুটোবাড়ির পরে থাকে হানুফা। সেও ভিড়ের মধ্য থেকে গলা বাড়িয়ে আরিফের কথায় যোগ দিল, — তা তো চোখের দেখা। এট্টুও গল্পকথা লয়। এই চুয়াত্তর বছর বয়সেও কিবা শীত, কিবা বর্ষা— ঠিক ভোরে উঠে স্বামীর চা-পানি হাজির করেছে ভাবি। টাইমে টাইমে টাটকা খাবার বানিয়ে দিয়েছে। লিজের শরীরের অসুখ-বিসুখ তুয়াক্কাই করেনি। কত্তো বড়লোক বাড়ির বিটি ছিলো তাও দেমাক দেখায়নি।
অন্য এক প্রতিবেশী মুনতাজ একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, — রিজিয়া বুবুকে কোনদিন দেখিনি আপনার মুখের ওপর কথা বলতে। আপনাকে কত যত্নই না করেছে। এরকম ভালোবাসা কটা স্ত্রীর মধ্যে দেখা যায়?
রিজিয়ার দুই বোন সাদিয়া আর মাজিয়া সবার কথা শুনে কিছুটা আত্মগ্লানির সুরে বলল, —হ্যাঁ ভাই, রিজিয়া বুবুর মতোন আমরা কেউ হতে পারিনি। স্বামীর খিদমতে কত্ত অবহেলা হয়। আল্লার কাছে কী যে জবাব দিবো।
স্ত্রীর গুণগান শুনতে শুনতে জাহিদ আবেগপ্লাবিত হয়ে ওঠে। সকলের দিকে তাকিয়ে বলে, —ওর মনে যা যা ইচ্ছে ছিলো সব আমি পূরণ করব।
ঘিরে থাকা লোকেদের চোখে জাগে সম্ভ্রম। স্ত্রীকে কতটা ভালবাসলে এই অথর্ব শরীরে স্ত্রীর ইচ্ছে পূরণের শপথ নিতে পারে।
একটু দূরে চুপ করে একা বসেছিল মৃত রিজিয়ার জা ওয়াহিদা। কারো সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল না তার। সঙ্গী ছিল এই জা। রিজিয়া বুবুর জীবনের কত দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী সে। সাদাসিধা মানুষ। স্বামীর কড়া শাসন মুখ বুজে সয়েছে। প্রতিবাদ করতে পারেনি। শখ করে কিছু কিনতে চাইলেও কিনতে পারেনি। স্বামী হাতে পয়সা দিত না। ফুরসত ছিলো না নিজের দিকে তাকানোর। স্বামী-হুজুরের হুকুম তামিল আর সংসারের জোয়াল টেনেই শেষ হয়ে গেল। বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ জোটেনি। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের সব কাজ আর স্বামীর মুখের সামনে গরম চা ও মুখরোচক খাবার যোগান দিতে দিতে নিজের প্রতি অবহেলা বেড়েছে ক্রমশ। সময়ের হেরফের হলেই সহ্য করতে হতো রক্তচোখ। ক্লান্ত শরীর, বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে ছেলেদের কাছে নালিশ জানিয়েছে কখনো। কোনও লাভ হয়নি। ছেলেরা বলেছে, ‘বয়স হয়েছে আব্বার। অশুখেও ভূগছে। সে জন্যই হয়তো খিটখিট করছে বেশি। এই বয়সে আব্বাকে তো আর কিছু বলা যাবে না।’ রিজিয়াবুবু তারপর আর কারো কাছে নালিশ জানায়নি। শুধু দুঃখ করে বলেছিল, ‘এ বাড়িতে ঢুকে থেকে এই মেজাজ সামলিয়ে চলছি। আর কতদিন? ওদের বাপের বয়স হয়েছে। আর আমার বয়স থেমে আছে। দশ হাতে সব সামলাতে হবে। না পারলে হম্বি-তম্বি।’ রাগ-দুঃখ-অভিমান চাপতে চাপতে মানসিক রোগে ভূগতে লাগলো। কত সময় নিজের মনেই বিড়বিড় করতো বুবু। ডাক্তাররাও পারল না এই রোগ থেকে বুবুকে সারিয়ে তুলতে। মনের কষ্ট চাপতে গিয়েই হয়তো হার্টফেল করলো। কথাগুলো মনে পড়ে চোখ ঝাপসা হলো ওয়াহিদার।
মুনতাহা রূপকথার আসর ছেড়ে রিজিয়া নানির স্বামী জাহিদ নানার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো শুনলো। তারপর চলে এলো ওয়াহিদা নানির পাশে। মুনতাহাকে দেখে ওয়াহিদা বলে,—তোর জাহিদ নানা কী বলছে বোন?
— নানির যা ইচ্ছে ছিল সব পূরণ করবে নানা। সবাই বলছে নানি খুব নেকদার। স্বামীর সেবায় ত্রুটি রাখেনি।
— ঠিক কথা মুনতাহা, অমন স্বামীর স্ত্রী হলে নেকদার না হয়ে উপায় আছে? তিনদিন আগেও বিছানায় পড়ে থাকা অসুস্থ স্ত্রীর ওপর পরহেজগার স্বামীর লাঠির সোহাগ পড়েছে। এবার বুঝি তাই তাজমহল বানাবে?
— তা হয়তো বানাতেও পারে নানি। স্ত্রীর স্মৃতিরক্ষায় পরহেজগার স্বামী বানিয়ে ফেলবে একটা রিজিয়ামহল।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গল্পলেখক, সমাজকর্মী
ছবি: সংগৃহীত
সৌজন্য উদার আকাশ
0 Comments
Post Comment