বিবাহিত নারী

  • 10 November, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 939 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
১৯০৮ সালের ৯ জানুয়ারি। ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করলেন এমন এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব যাঁর পাণ্ডিত্যে, বৈদগ্ধ্যে, বিতর্কে বদলে গেল পৃথিবীর নারী-আন্দোলনের ইতিহাস। তিনি সিমোন দ্য বোভোয়ার। দার্শনিক সার্ত্রের আজীবন বন্ধু। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ভুবনবিখ্যাত বই ‘ল্য দোজিয়েম সেক্স’। অনেক প্রবন্ধের সংকলনগ্রন্থ এটি। তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ‘বিবাহিত নারী’। এসকেসিউ-এর পাতায় এবার থেকে প্রতি দু-সপ্তাহ অন্তর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে সেই প্রবন্ধেরই বাংলা অনুবাদ। ফরাসি থেকে বাংলায়। আজ প্রথম পর্ব।

প্রথাগতভাবে মেয়েদের জন্য যে নিয়তি সমাজ প্রস্তাব করে, তা বিবাহ। এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ মহিলাই হয় বিবাহিত, নয়তো অনেকদিন ধরেই বিবাহিত জীবন যাপন করছেন, অথবা বিয়ের জন্য তৈরি হচ্ছেন কিংবা বিয়ে না-হওয়ায় কষ্টে ভুগছেন। বিয়েকে কেন্দ্র করেই স্থির হয় মেয়েদের কৌমার্য, তাঁদের মধ্যে কেউ হতাশ কিংবা প্রতিবাদী কি না, অথবা এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতি উদাসীন কি না। সুতরাং, এই বিবাহ নামক বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করতে করতেই আমাদের এই গবেষণায় এগিয়ে যেতে হবে।

নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবর্তন বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে ভাঙনের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বিবাহ এখন হয়ে উঠেছে এমন এক মিলন যা দুজন স্বশাসিত ব্যক্তির স্বাধীন সম্মতিতেই সম্পন্ন হয়। বিবাহের এই চুক্তি স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত এবং পারস্পরিক। দুজনের মধ্যে কোনো একজনের ব্যভিচারিতাই এই চুক্তিকে লঙ্ঘন করে। একই অবস্থায় এবং শর্তে যে-কোনো পক্ষই বিবাহ-বিচ্ছেদ লাভ করতে পারেন। নারীরা এখন আর সন্তান উৎপাদনের কাজে সীমাবদ্ধ নন। নিজেদের স্বভাবের সহজাত দাসত্বের বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যই তাঁরা কাটিয়ে উঠেছেন। প্রজননকে এখন দেখা হয় নারীর স্বাধীন একটি ইচ্ছা হিসাবে। বর্তমানে এটাকে উৎপাদনশীল কাজেরই অঙ্গীভূত করা হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন অবকাশের সময় রাষ্ট্র কিংবা নিয়োগকারী সংস্থা মহিলাদের অর্থসাহায্য দিতেও বাধ্য থাকে। 

কয়েক বছর ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিবাহ হয়ে উঠেছে এমন এক আন্তর্সম্পর্কীয় চুক্তি যা নির্ভর করে আছে কেবল স্বামী-স্ত্রীর স্বাধীনতার উপর। মনে হয়, বিবাহ হল বর্তমানে এমন এক সেবা যা রাষ্ট্র দুজনের উপরই চাপিয়ে দিয়েছে। বিবাহ এখন নির্ভর করে আছে এক সাধারণ সমাজ কাঠামোর উপর যেখানে কালকের পৃথিবীতে যে-কোনো একটি প্রবণতা জয় লাভ করবে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই পুরুষের অভিভাবকত্ব বিলুপ্তির পথে। যদিও যে-যুগে আমরা এখনও বাস করছি, নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তা এক সন্ধিক্ষণের সময়। মহিলাদের মধ্যে শুধুমাত্র একটি অংশই এখনও উৎপাদনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন এবং বাকিরা এমন এক সমাজের বাসিন্দা যেখানে পুরোনো দিনের কাঠামো, পুরোনো দিনের মূল্যবোধ বেঁচে আছে। আধুনিক বিবাহকে পুরোনো দিনের সেই চিরায়ত আলোতেই তাই একমাত্র বোঝা সম্ভব।

বিবাহ নামক বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে পুরুষ এবং নারীর কাছে উপস্থাপিত করা হয়। এই দুই লিঙ্গেরই একে-অপরকে প্রয়োজন, কিন্তু এই প্রয়োজন কখনোই উভয়ের মধ্যে পারস্পরিকতার জন্ম দিতে পারেনি। নারীরা কখনোই নিজেদেরকে পুরুষের মতো এমন একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি যেখানে তাঁরা পুরুষের সমান বিনিময় অর্জন ও চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হবেন। সামাজিকভাবে পুরুষ হলেন একজন স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব। একজন উৎপাদনক্ষম হিসাবেই সবার আগে তাঁকে দেখা হয়। সামূহিক প্রয়োজনে যে-কাজ তিনি নিষ্পন্ন করেন তার ভিত্তিতেই পুরুষের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দেখা গেছে, যে-সমস্ত কারণের জন্য আমরা একজন নারীকে তাঁর প্রজনন ও গৃহকর্মের ভূমিকায় বন্দি করেছি, তা তাঁর পুরুষের সমান মর্যাদা লাভের পথকে নিশ্চিত করেনি।

এটা নিশ্চিত যে পুরুষের একজন মহিলা বা নারীকে প্রয়োজন। কিছু প্রাচীন লোকের কাছে, যে-সমস্ত অবিবাহিত পুরুষ নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় অক্ষম তাঁরা এক ধরনের জাতিচ্যুত বা সমাজচ্যুত ব্যক্তি। কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন কৃষকের কাছে একজন কৃষাণীর প্রয়োজন অপরিহার্য। অধিকাংশ পুরুষের কাছে এটা সুবিধাজনক নিজের কিছু টুকিটাকি কাজ কোনো এক সঙ্গীর উপর ন্যস্ত করা। প্রত্যেক পুরুষ চান একটি সুস্থিত যৌন জীবন। তিনি চান উত্তরপুরুষ, বংশধর। সমাজও তাঁর কাছে দাবি করে যে মনুষ্য প্রজাতির ধারাকে চিরস্থায়ী করার কাজে তিনি অবদান রাখবেন। এই আহ্বান কিন্তু কোনো পুরুষ সরাসরি কোনো মহিলার কাছে পৌঁছে দেন না। পুরুষের এই সমাজই প্রত্যেক পুরুষকে অনুমতি দেয় স্বামী ও পিতার ভূমিকায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে আর দাস বা পুরুষ-মুখাপেক্ষীর ভূমিকায় মহিলাদের পরিবারভুক্ত করে নিতে। এই মহিলারা নিয়ন্ত্রিত হন বাবা বা ভাইয়ের দ্বারা। বাড়ির পুরুষেরাই মেয়েদের বিবাহ স্থির করে দেন অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে।

প্রাথমিকভাবে গোষ্ঠী বা পরিবারের পুরুষেরাই মেয়েদেরকে একটি পণ্য বা বস্তুর মতো বিবেচনা করতেন। বিয়ের সময় দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতেই মেয়েদেরকে মুনাফা প্রদানকারী পণ্য হিসাবে গণ্য করা হত। ততদিন পর্যন্ত মেয়েদের অবস্থার ব্যাপক কোনো পরিবর্তন হয়নি, যতদিন পর্যন্ত বিবাহ একটি চুক্তিভিত্তিক রূপ লাভ করেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভ করার পর মেয়েদেরকে সভ্য মানুষ হিসাবে গণ্য করা শুরু হয়। যদিও এই পণ বা সম্পত্তি তাঁকে পুনরায় পরিবারের কাছে ক্রীতদাসে পরিণত করে তোলে। বহুদিন ধরে বিবাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হত শ্বশুরমশাই ও জামাইয়ের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নয়। কেবল বিধবারাই কিছু অর্থনৈতিক স্বশাসন উপভোগ করতেন।

যুবতী মেয়েদের পছন্দের স্বাধীনতা সবসময়ই ভীষণ নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাঁদের কুমারীত্ব--কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র বাদে যেখানে তা ধর্মীয় পবিত্রতার পোশাকে ঢাকা--তাঁদের পরজীবী এবং সমাজ-বিচ্যুত বলে গ্রাস করে। বিবাহই তাঁদের কাছে রুটিরুজির উৎস এবং তাঁদের অস্বিত্বের একমাত্র সামাজিক সমর্থন বা ন্যায্যতা। নারীদের উপর বিবাহ দুটি বিষয় চাপিয়ে দেয় : সমাজ-সম্প্রদায়কে তিনি সন্তান উপহার দেবেন, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রে--স্পার্টা বা নাৎসি শাসনের কিছু অংশের মতো--রাষ্ট্রই সরাসরি অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নেবে এবং মহিলাদের কাছ থেকে কেবল মাতৃত্বই চাইবে। এমনকি যে-সমস্ত সভ্যতা পিতার উৎপাদকের ভূমিকাকে উপেক্ষা করে এসেছে, তারাও চায় যে একজন মহিলা তাঁর স্বামীর অধীনেই সুরক্ষিত থাকুন। সেই মহিলার কাজ হল স্বামীর যৌন আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করা এবং একইসঙ্গে গৃহস্থালীর যত্ন নেওয়া। সমাজ নারীর উপর যে-দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়, তা স্বামীর প্রতি এক ধরনের সেবা বলেই মনে করে। বিপরীতে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে উপহার দেবেন, অথবা যৌতুক দেবেন এবং দেখভালের ব্যাপারে নিয়োজিত থাকবেন। স্বামীর মাধ্যমেই সমাজ-সম্প্রদায় মহিলাদের উপর এইসব দায়িত্ব ন্যস্ত করে যার জন্য মহিলারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।    

(ক্রমশ ...)

 

লেখক : অধ্যাপক।

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট।

0 Comments

Post Comment